শা'বান মাস এবং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল...

লিখেছেন লিখেছেন ভিনদেশী ৩০ মে, ২০১৪, ০৬:১৩:৩১ সন্ধ্যা

আজ শা'বানের প্রথম তারিখ। এ মাস শেষে মুমিনদের জন্য সুসংবাদ নিয়ে উপস্থিত হবে পবিত্র রমযান মাস। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে কোন আমল বেশি করতেন? কেন করতেন? কিভাবে করতেন?

সংক্ষিপ্ত পরিসরে এসব প্রশ্নের উত্তর দেখে নেওয়া যাক।

এক নম্বর হাদীস:

عن أُسَامَةُ بْنُ زَيْدٍ، قَالَ: قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، لَمْ أَرَكَ تَصُومُ شَهْرًا مِنَ الشُّهُورِ مَا تَصُومُ مِنْ شَعْبَانَ، قَالَ: «ذَلِكَ شَهْرٌ يَغْفُلُ النَّاسُ عَنْهُ بَيْنَ رَجَبٍ وَرَمَضَانَ، وَهُوَ شَهْرٌ تُرْفَعُ فِيهِ الْأَعْمَالُ إِلَى رَبِّ الْعَالَمِينَ، فَأُحِبُّ أَنْ يُرْفَعَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ»، أخرجه الإمام النسائي في السنن الصغرى، كتاب الصوم، باب صوم النبي صلى الله عليه وسلم، وحسسه الشيخ الألباني رحمه الله تعالى.

হযরত যাইদ বিন ছাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- আমি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করি: হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে শা'বানের মতো অন্য কোন মাসে (রমযান ছাড়া) এতো বেশি রোজা রাখতে দেখি না?

উত্তরে নবীজী বলেন- "রজব এবং রমযানের মধ্যবর্তী ঐ মাসে (শা'বান) লোকেরা ইবাদতের ব্যাপারে গাফিল (অমনোযোগী) থাকে। অথচ এ মাসে (শা'বান) বান্দার (বাৎসরিক) আমল বিশ্ব জাহানের রবের (আল্লাহ তা'য়ালা) কাছে পেশ করা হয়। আমার ইচ্ছা, রোজাদারাবস্থায় যেন আমার আমল (আল্লাহ তা'য়ালার) পেশ করা হয়। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস নম্বর: ২৩৫৭, হাসান)।

দুই নম্বর হাদীস:

عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: «لَمْ يَكُنْ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِشَهْرٍ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ لِشَعْبَانَ، كَانَ يَصُومُهُ أَوْ عَامَّتَهُ»، أخرجه الإمام النسائي رحمه الله تعالى في السنن الصغرى، كتاب الصوم، باب صوم النبي صلى الله عليه وسلم، والحديث صححه الشيخ الألباني.

হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা বলেন- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা'বান মাসে (রমযান ছাড়া) সবচে' বেশি রোজা রাখতেন। তিনি কখনো পুরো শা'বান আবার কখনো অধিকাংশ শা'বান রোজা রাখতেন। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস নম্বর: ২৩৫৪, সহীহ)।

তিন নম্বর হাদীস:

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَبِي قَيْسٍ، سَمِعَ عَائِشَةَ تَقُولُ: " كَانَ أَحَبَّ الشُّهُورِ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَصُومَهُ: شَعْبَانُ، ثُمَّ يَصِلُهُ بِرَمَضَانَ " أخرجه الإمام أبو داود رحمه الله تعالى في السنن، كتاب الصوم، باب صوم شعبان، وسكت عنه الإمام أبو داود، وهذا يعني أن الحديث صحيح عنده.

হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা বলেন- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা'বান মাসে রোজা রাখতে অধিক ভালবাসতেন। (শা'বানে এমনভাবে রোজা রাখতেন যে, শা'বানের রোজাকে) রমযানের (রোজার) সঙ্গে মিলিয়ে দিতেন। (সুনানে আবী দাউদ, হাদীস নম্বর: ২৪৩১, সহীহ)।

চার নম্বর হাদীস:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: تُعْرَضُ الأَعْمَالُ يَوْمَ الاِثْنَيْنِ وَالخَمِيسِ، فَأُحِبُّ أَنْ يُعْرَضَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ. قال الإمام الترمذي: حَدِيثُ أَبِي هُرَيْرَةَ فِي هَذَا البَابِ حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ

أخرجه الإمام الترمذي في السنن، كتاب الصوم، باب ما جاء في صوم الاثنين والخميس

হযরত আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: "(বান্দার) আমলগুলো (আল্লাহ তা'য়ালার কাছে) সোমবার এবং বৃহস্পতিবারে পেশ করা হয়। তাই আমার ইচ্ছা, রোজাদারাবস্থায় যেন আমার আমল পেশ করা হয়"।

সুনানে তিরমিজী, হাদীস নম্বর: ৭৪৭, হাসান)।

পাঁচ নম্বর হাদীস:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَالَ: " يَتَعَاقَبُونَ فِيكُمْ مَلَائِكَةٌ بِاللَّيْلِ، وَمَلَائِكَةٌ بِالنَّهَارِ، وَيَجْتَمِعُونَ فِي صَلَاةِ الْفَجْرِ، وَصَلَاةِ الْعَصْرِ، ثُمَّ يَعْرُجُ الَّذِينَ بَاتُوا فِيكُمْ، فَيَسْأَلُهُمْ رَبُّهُمْ وَهُوَ أَعْلَمُ بِهِمْ: كَيْفَ تَرَكْتُمْ عِبَادِي؟ فَيَقُولُونَ: تَرَكْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ، وَأَتَيْنَاهُمْ وَهُمْ يُصَلُّونَ "

رواه الشيخان؛ البخاري ومسلم رحمهما الله تعالى


হযরত আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- "রাতে এবং দিনে ফেরেসতাদের দু'টি দল তোমাদের মধ্যে আসা যাওয়া করে থাকে। তারা ফজর এবং আসরের নামাজের সময় তোমাদের কাছে এসে মিলিত হয়। (এক দল অবতরণ করলে অন্য দল আল্লাহ তা'য়ালা কাছে ফেরৎ যায়। তখন) আল্লাহ তা'য়ালা বান্দাদের সব হালাত (অবস্থা) সম্পর্কে খুব-ই অবগত থাকা সত্ত্বেও (হয়তো ফেরেসতাদের দায়িত্বের পরীক্ষা হিসেবে বা বান্দাদের কথা তাদের মুখে শুনতে) ফেরেসতাদের জিজ্ঞেস করেন- "তোমরা আসার সময় আমার বান্দারা কেমন ছিল?

উত্তরে তাঁরা বলে- আমরা আসার সময় তারা নামাজরত ছিল এবং আমরা যখন তাদের কাছে গিয়েছি তখনও তারা নামাজাবস্থায় ছিল। (বুখারী ও মুসলিম)

কেন নবজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা'বান মাসে অধিক রোজা রাখতেন?

শা'বানে অধিক রোজা রাখার হিকমত হিসেবে ইমাম ইবনুল কায়্যূম রহ. তাঁর (তাহযীবুস সুনান) গ্রন্থে বলেন- তিনটি উদ্দেশ্যে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা'বানে অধিক রোজা রেখে থাকতে পারেন:

এক- নবীজীর সাধারণ নিয়ম ছিল প্রতি (হিজরী) মাসে তিনটি রোজা রাখা (১৩, ১৪ এবং ১৫ তারিখ)। হয়তো কোন মাসে তিনি রোজা রাখতে পারতেন না। আর তা রমযানের ফরজ রোজা শুরু হওয়ার আগে এ মাসে রেখে দিতেন।

দুই- নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানের সম্মানার্থে শা'বানে অধিক রোজা রাখতেন। এ রোজা অনেকটা ফরজ নামাযের পূর্বে সুন্নাতের মতো। যা ফরজের সম্মানার্থে পড়া হয়ে থাকে (!)।

তিন- শা'বান মাসে বান্দার (বাৎসরিক) আমল আল্লাহ তা'য়ালার কাছে পেশ করা হয়ে থাকে। তাই রোজাদারাবস্থায় যেন তাঁর আমল পেশ করা হয়। তাই তিনি এ মাসে রোজা রাখতেন।

ইমাম ইবনে রজব রহ. তাঁর (লাতাইফুল মা'আরিফ) গ্রন্থে আরো একটি হিকমত উল্লেখ করেন। আর তা হলো- রমযানের রোজার প্রস্ততি (প্রাকটিস) হিসেবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শা'বান মাসে অধিক রোজা রাখতেন।

উল্লেখ্য- বিগত কয়েক বছর যাবত বহু দেশে রমযান গ্রীষ্মকালে হওয়ায় দৈনিক রোজার সময়টা অনেক দীর্ঘ হচ্ছে। যেনম ব্রিটেনে গত বৎসর রোজা প্রায় ১৮ ঘন্টার কাছাকাছি ছিল। এ বৎসর আরো দীর্ঘ হতে পারে। এমতাবস্থায় ইমাম ইবনে রজব (রহ.) -এর উল্লেখিত হিকমতানুযায়ী রমযানের পূর্বে শা'বান মাস থেকে রমযানে প্রস্তুতি হিসেবে রোজা রাখা হলে। পবিত্র রমযান মাসে কষ্ট কিছুটা হলেও কম অনুভূত হবে।

পবিত্র কোরআন ও শা'বান মাস:

প্রখ্যাত তাবিয়ী সালামা বিন কুহাইল (রহ.) বলেন- শা'বান মাসকে কোরআনের মাস বলা হতো। কারণ, এ মাসে সাহাবায়ে কিরামসহ মুসলমানরা অধিক পরিমানে কোরআন তিয়াওয়াত করতেন।

কূফার প্রখ্যাত আবিদ ও জাহিদ (যার জানাজায় শরীক হতে কূফার দোকান-পাট বন্ধ হয়ে গিয়েছিল) আমর বিন কাইস মুলায়ী (রহ.) শা'বান মাসে দোকান বন্ধ করে কোরআন তিলাওয়াতে ব্যস্ত সময় কাটাতেন।

এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষনীয়। আর তা হলো-

নবীজী প্রথম হাদীসে ইরশাদ করেছেন- শা'বান মাসে বান্দার আমল আল্লাহ তা'য়ালার কাছে পেশ করা হয়ে থাকে। দ্বিতীয় হাদীসে ইরশাদ করেছেন- প্রতি সোমবার এবং বৃহস্পতিবার বান্দার আমল পেশ করা হয়। এবং পঞ্চম হাদীসে এসেছে, বান্দার আমল প্রতিদিন সকাল বিকাল পেশ করা হয়।

এ হাদীসগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্যতা বর্ণনায় ওলামারা বলেন- হাদীস শরীফগুলোর মধ্যে বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিরোধপূর্ণ মনে হলেও মূলত এতে কোন বিরোধ নেই। কারণ, পঞ্চম হাদীসে দৈনিক হিসাবের কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় হাদীসে সাপ্তাহিক এবং প্রথম হাদীসে বাৎসরিক হিসাবের কথা বলা হয়েছে। তাই হাদীসগুলোর পরস্পরে কোন বিরোধ নেই। আলহামদুলিল্লাহ।

আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের প্রত্যেককে শা'বান মাসে যথাযথ ইবাদতের মাধ্যমে রমযানের প্রস্তুতি নেওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।

اللَّهُمَّ بَارِكْ لَنَا فِي رَجَب وَشَعْبَانَ وَبلغنا رَمَضَانَ

বিষয়: বিবিধ

১২১২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

228417
৩০ মে ২০১৪ রাত ০৮:১৬
জাইদী রেজা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
৩১ মে ২০১৪ দুপুর ০২:০৮
175349
ভিনদেশী লিখেছেন : আল্লাহ তা'য়ালা আমাদের সবাইকে পবিত্র রমযানের যথাযত প্রস্তুতির তাওফীক দান করুন। আমীন। পড়ার এবং মতামত জানানোর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
228436
৩০ মে ২০১৪ রাত ০৯:২১
ফেরারী মন লিখেছেন : জাজাকাল্লা... অনেক ভালো লাগলো পড়ে
৩১ মে ২০১৪ দুপুর ০২:০৯
175350
ভিনদেশী লিখেছেন : ওইয়্যাকি আয়দান (আপনাকেও)। আপনার ভাল লাগলো জেনে প্রীত হলাম। ধন্যবাদ।
228478
৩০ মে ২০১৪ রাত ১১:০৮
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক অনেক ধন্যবাদ ভালো লাগলো
৩১ মে ২০১৪ দুপুর ০২:০৯
175352
ভিনদেশী লিখেছেন : আপনাকেও আন্তরিক শুকরিয়া।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File