আজকের এ দিনে...

লিখেছেন লিখেছেন ভিনদেশী ২৯ মে, ২০১৪, ০৭:৩৮:৩১ সন্ধ্যা

১৫০ হিজরী। ৩০ শে রজব। জুমাবার। ফিলিস্তিনের গাজা শহর। মা-বাবার গৃহ আলোকিত করে ফুটফুটে এক সন্তান জন্ম গ্রহন করে। ছেলের নাম রাখা হয় মুহাম্মদ। বাবার নাম ইদ্‌রীস। চতুর্থতম পূর্বপুরুষের নাম শাফি'। নবম পূর্বপুরুষ ছিলেন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাদা আব্দুল মুত্তালীব। তাই শিশুটির পুরো নাম। মুহাম্মদ বিন ইদ্‌রীস আশ্‌ শাফিয়ী আল মুত্তালিবী। জন্মের কিছুদিন পর বাবা ইন্তেকাল করেন। শিশু মুহাম্মদের দায়িত্ব চলে আসে তার মমতাময়ী মায়ের উপর। পরিবারের একমাত্র রোজগারকারী স্বামী মারা গেছেন। আয় রোজগারের অন্য কোন ব্যবস্থাও নেই। তারপরও শাহসী মা সিদ্ধান্ত নিলেন তাঁর ছেলে পড়াশোনা করে একজন সত্যিকারের আলিমে দ্বীন হবে। দ্বীনের খিদমত করবে। রিজিক তো আল্লাহ তা'য়ালার হাতে। তাহলে কেন তিনি তার প্রিয় ছেলেকে পুঁজির মাধ্যম বানাবেন?

যথা সময়ে মা ছোট্ট মুহাম্মদকে মাকতাবে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। খুব অল্প সময়ে সাত বছর বয়সে মুহা্ম্মদ পবিত্র কোরআন হিফজ সমাপ্ত করে। তারপর সে মনোযোগ দেয় আরবী সাহিত্য, হাদীস ও ফিকহ বিষয়ে। দীক্ষ্ণ বুদ্ধি, প্রখর মেধা, উত্তম চরিত্র এবং সর্বোপরি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে খুব-ই অল্প সময়ে ছোট্ট শাফিয়ী বড়দের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়। পনের বছর বয়সে ইমাম মুসলিম বিন খালেদ যিনজী (রহ.) তাকে ফতোয়া প্রদানের অনুমতি দেন।

তখন চারিদিকে ইমাম মালিকের ব্যাপক প্রসিদ্ধি। মুসলিম জাহানের খলীফা থেকে নিয়ে আমীর-উমারা এবং জ্ঞান পিপাসুরা দূর দূরান্ত থেকে ইমাম মালিকের কাছে ইলম তলবে আসছে। তাঁর কাছে শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ পাওয়া এক ঈর্ষার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এমন পরিবেশে জ্ঞানপিপাসু ছোট্ট শাফিয়ীর মনেও ইমাম মালিকের কাছ থেকে 'মুয়াত্তা'র সনদ গ্রহনের আগ্রহ সৃষ্টি হয়। কিন্তু কিভাবে? মদীনা যে অনেক দূর? তার গরিব মা যে এ খরচ বহন করতে পারবেন না! তাহলে উপায়! প্রিয় ছেলেকে চিন্তিত দেখে মা কারণ জানতে চাইলেন। শাফিয়ী মায়ের কাছে সব খুলে বললেন। এ পৃথিবীতে তিনিই যে একমাত্র আপনজন। সব শুনে মা তাকে উৎসাহ দিলেন। দো'আ দিলেন এবং বললেন। আল্লাহ তা'য়ালার উপর নির্ভর করে বেরিয়ে পড়ো। তিনি-ই সবকিছু সহজ করে দিবেন। ১৬৪ হিজরীর কোন এক শুভক্ষণে চৌদ্দ বছরের শাফিয়ী মদীনার উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা এবং মমতাময়ী মাকে ত্যাগ করে।

ইমাম শাফিয়ীর মুখে শুনা যাক সে চমৎকার অভিযানের সামান্য বর্ণনা- "চৌদ্দ বছর বয়সে মদীনার উদ্দেশ্যে মক্কা ত্যাগ করি। পথে এক কাফেলার দেখা মিলে। তাদের মধ্যে এক বয়স্ক লোক আমাকে তাঁর বাহনে করে মদীনায় নিয়ে গেলেন। পথে আমি ষোলবার পবিত্র কোরআন খতম করি। আসরের সময় মদীনায় পৌঁছে জামাতান্তর নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামে করবের দিকে এগিয়ে যাই। কবরের পাশে পরনে লুঙ্গি এবং গায়ে চাদর পেচিঁয়ে মালিক বিন আনাস রাহিমাহুল্লাহ দারস দিচ্ছিলেন। কাছে যাওয়ার তাঁকে বলতে শুনলাম: " নাফে' আমাকে হাদিস বর্নণা করছেন ইবনে ওমরের (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কাছে থেকে, তিনি এই করববাসীর কাছ থেকে (হাতে কবরের দিকে ইশারা দিয়ে)।"

এ দৃশ্য দেখে শ্রদ্ধা ও অনুকম্পায় ইমাম মালিকের প্রতি আমার অন্তরে ভয় সৃষ্টি হলো।

(দুরু দুরু অন্তরে) আমি তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে সাক্ষাত করলাম। সাক্ষাতের পর তিনি বললেন: " হে মুহাম্মদ! সর্বদা আল্লাহ তা'য়ালাকে ভয় করে চলবে। তোমার ভবিষ্যত খুব-ই উজ্জ্বল। আল্লাহ তা'য়ালা তোমার অন্তরে যে 'নূর' ঢেলে দিয়েছেন। পাপাচারের মাধ্যমে তা নিবিয়ে ফেলো না'।

অত:পর ইমাম মালিকের কাছ থেকে পূর্ণ মুয়াত্তা দারস নিয়ে মক্কায় মায়ের কাছে ফিরে গেলেন। ধীরে ধীরে শাফিয়ীর প্রসিদ্ধি আশপাশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মানুষের মুখে ছোট্ট শাফিয়ীর নাম উচ্চারিত হতে থাকে। হিংসুকদের লুলুপ দৃষ্টি শাফিয়ীর উপর আবদ্ধ হয়। দুষ্টু লোকেরা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। খিলাফাতের বিরুদ্ধাচারণের অপবাধে তাকে হারুনুর রশীদের দরবারে ডাকা হলো। দরবারে শাফেয়ীর সঙ্গে ইমাম মুহাম্মদের পরিচয় ঘটে। রশীদের দরবারে ইমাম শাফিয়ীর যুক্তি ও জ্ঞানের প্রখরতা দেখে ইমাম মুহাম্মদ খলীফার কাছে তাঁর জন্য শুপারিশ করেন এবং নিজ বাড়িতে নিয়ে যান। দু'জনের মধ্যে ফিকহি বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়। ইমাম মুহাম্মদের নাম তিনি পূর্বে থেকে শুনেছেন। তাই এ সাক্ষাতকে তিনি গনিমত মনে করেন। ফিক্‌হে ইসলামীর এ দুই দিকপালের সাক্ষাত সম্পর্কে ইমাম শাফিয়ী নিজে-ই বলেন- "জ্ঞানের জগতে মুহাম্মদ ইবনুল হাসান ছিলেন উচূ মাক্বামের অধিকারী। তাই আমি তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা শুরু করি। আলোচনার মাধ্যমে আমি বুঝতে পারি, তাঁর এবং আমার পথ প্রায় কাছাকাছি। অত:পর আমি তাঁর দারসে নিয়মিত উপস্থিত হয়ে তাঁর কিতাবাদি লিখা শুরু করি। এভাবে আমি ইরাকবাসীর ফিকহ্‌ সর্ম্পকে গভীরভাবে অবগত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যাই। মুহাম্মদ (সে সময় ছাত্ররা শিক্ষকের নাম ধরে ডাকতো) যখন তাঁর দারস শেষে উঠে যেতেন আমি তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে ফিকহে হানাফীর বিভিন্ন বিষয়ে মুনাজারা করতাম'।

এভাবে ইমাম শাফিয়ী ইমাম মালিকের মাধ্যমে 'ফিকহুল আছর' তথা দালিলিক ফিকাহ্‌ এবং ইমাম মুহাম্মদের মাধ্যমে 'ফিকহুর রাই' তথা দার্শনীক ফিকহের সাথে গভীরভাবে পরিচিত হ্ওয়ার সুযোগ পান। এবং প্রসিদ্ধ এ দু'ধারার সমন্বয়ে আরেকটি তৃতীয় ধারার প্রবর্তন করেন। যা পরবর্তীতে শাফিয়ী মাজহাব নামে পরিচিতি লাভ করে।

(উল্লেখ্য: দার্শনীক ফিকহের অর্থ এ নয় যে, এ ধারাটি দালীলিক ফিকাহকে এড়িয়ে চলে। বরং এ ধারাটি ফিকহে ইসলামীকে দালীলিক ও দার্শনীক উভয় বিষয়ে সমন্বয়ের চেষ্টা করে থাকে।)

জ্ঞানাকাশে ইমাম শাফিয়ীর নাম দ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠে। দূর দূরান্ত থেকে জ্ঞান পিপাসুরা তাঁর কাছ থেকে শিক্ষা নিতে আসতে শুরু করে। তিনি নিজ পদ্ধতিতে ফিকহে ইসলামীর প্রচার শুরু করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রন্থাদিও রচনা করে যান। এর মধ্যে 'আল উম' নামক তাঁর অনবদ্য গ্রন্থটি সবচে' প্রসিদ্ধ। আল উম্‌ মানে মা। যে মা তাকে একজন আলিমে দ্বীন হিসেবে গড়ে তুলতে জীবনের সবকিছু বিলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরুপ এবং তাঁর অবদানকে ইতিহাস পরস্পরায় উজ্জ্বল করে রাখতে নিজের সবচে' গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের নাম করণ করেন উম বা মা নামে।

১৯৯ হিরজীতে ইমাম শাফিয়ী মিসরের উদ্দেশ্যে ইরাক ত্যাগ করেন। বাকী জীবন মিশরে ইলমের প্রচার-প্রসার এবং জাতি গঠনের মহান খেদমতের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেন।

২০৪ হিজরীর ৩০ শে রজব, জুমাবার রাতে দুনিয়া খ্যাত এ ইমাম মিশরে ইন্তেকাল করেন। (অবাক হওয়ার বিষয় হলো: তাঁর জন্ম ছিল ৩০ শে রজব, জুমাবার এবং মৃত্যুও ৩০শে রজব, জুমাবার)।

৫৪ বছর বসয়ে ইমাম শাফিয়ী আপন রাব্বের কাছে চলে যান। এবং উম্মাতের জন্য রেখে যান তাঁর নিজস্ব ফিকাহ্‌ পদ্ধতি। যা শাফিয়ী মাজহাব নামে আজো প্রসিদ্ধ এবং প্রচলিত। প্রজন্ম পরস্পরায় আজো পৃথিবীর কোটি মুসলিম এ মাজহাব অনুসরণ করে আসছে।

মৃত্যু পূর্বে প্রিয় ছাত্র (ইমাম) মুজানী ইমাম শাফিয়ীকে জিজ্ঞেস করেন: আপনার সকাল কেমন হলো?

ইমাম উত্তরে বলেন: "এমনাবস্থায় আমি সকাল করেছি যখন পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছি; দুনিয়াকে বিদায় দিতে। বন্ধুদের ত্যাগ করতে। মৃত্যুর স্বাদ অনুভব করতে। আল্লাহ তা'য়ালার কাছে উপস্তিত হতে। হায়! আমি যদি জানতাম। আমি চলছি জান্নাতের পথে তবে নিজেকে সুসংবাদ জানাতাম। আর যদি জানতাম আমি যাচ্ছি জাহান্নামের পথে তাহলে নিজেকে বৎসনা করতাম।"

এ কথা বলে তিনি স্বরচিত এ পঙতিগুলো পাঠ করেন-

ولمّا قسى قلبي وضاقتْ مذاهبي *** جعلتُ الرجا منّي إليك سُلّما

تعاظمَني ذَنْبي فلما قرنتُه *** بعفوك ربِّي كان عفوك أَعظَما

আল্লাহ তা'য়ালা ইমাম শাফিয়ীকে রহম করুন। এবং আমাদেরও তাঁর সঙ্গে জান্নাতের সূউচ্চ মাক্বামে মিলিত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।

বিষয়: বিবিধ

১২৭৫ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

228128
২৯ মে ২০১৪ রাত ০৯:৩৯
হারিয়ে যাবো তোমার মাঝে লিখেছেন : পড়ে কিছু ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে অবগত হলাম। ধন্যবাদ আপনাকে।
২৯ মে ২০১৪ রাত ১০:৩৭
174999
ভিনদেশী লিখেছেন : জেনে খুব ভাল লাগলো। আল্লাহ তা'য়ালা আমাদেরকে তাঁর এসব প্রিয় বান্দাদের সম্পর্কে জানার এবং তাঁদের মতো জীবনকে দ্বীনের জন্য উৎসর্গ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
228129
২৯ মে ২০১৪ রাত ০৯:৪৩
আহ জীবন লিখেছেন : আলহামদুলিল্লাহ ভাল লাগলো। জানতাম না উনার সন্মন্ধে। ধন্যবাদ।
২৯ মে ২০১৪ রাত ১০:৩৮
175000
ভিনদেশী লিখেছেন : আপনাদের ভাল লাগলো জেনে প্রীত হলাম। পড়ার ও মতামত জানানোর জন্য আপনাকেও ধন্যবাদ।
228131
২৯ মে ২০১৪ রাত ০৯:৫২
সিকদারর লিখেছেন : আস্-সালামু-আলাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহ। জাজাকাল্লাহ খায়ের।
২৯ মে ২০১৪ রাত ১০:৩৯
175001
ভিনদেশী লিখেছেন : ওয়ালাইকুমুস সালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহ্‌। ওইয়্যাকা আয়দান (আপনাকেও)। পড়ার ও সুন্দর দো'আর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
228177
৩০ মে ২০১৪ রাত ১২:২৮
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : অনেক ভালো লাগলো ধন্যবাদ।
আমাদের অনেকই চার মাজহাব চার ইমাম এর নাম জানেন কিন্তু তাদের জিবনি সম্পর্কে খুবই কম যানেন।
৩০ মে ২০১৪ রাত ০২:১৬
175037
ভিনদেশী লিখেছেন : আসলেই তাই। আমাদের অনেকে ফুটবল এবং ক্রিকেট তারকাদের বিস্তারিত জীবনবৃত্তান্ত জানলেও নিজেদের মহান লোকগুলো সম্পর্কে খুব একটা জানি না। আল্লাহ তা'য়ালা আমাদেরকে নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে যন্তবান হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন। পড়ার ও মতামত জানানোর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
228184
৩০ মে ২০১৪ রাত ১২:৩৫
সন্ধাতারা লিখেছেন : অনেক ভালো লাগলো ধন্যবাদ
৩০ মে ২০১৪ রাত ০২:১৮
175038
ভিনদেশী লিখেছেন : জেনে প্রীত হলাম। পড়ার ও মন্তব্যের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File