নবজীবনের পথে... পর্ব-৬
লিখেছেন লিখেছেন ভিনদেশী ০৮ মে, ২০১৪, ০৭:২৯:৩৯ সন্ধ্যা
ড. আ’লা অলিনিকবা। D. Ala Olinikova। রাশিয়ান এক হতদরিদ্র পরিবারের মেয়ে। তাঁর বাবা ছিলেন জেলে। মৎস শিকারের মাধ্যমে তাদের জীবন চলতো। ছোটবেলা থেকে পড়াশুনার প্রতি আ'লার ছিল অদম্য আগ্রহ। আর্থিক দৈন্যতা পরিবারের নিত্য সঙ্গী হলেও পড়াশুনার প্রতি অলিনিকের আগ্রহে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। জীবনে অনেক বড় হওয়ার আগ্রহ নিয়ে তিনি চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। এক সময় মস্কো ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। মেডিক্যাল সাইন্সে একে একে অনার্স, মাস্টার্স এবং ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেন। তারপর চাকুরী জীবন শুরু। চাকুরী জীবনে তিনি মস্কো, ক্যাফ এবং লিনিনগ্র্যাড ইউনিভার্সটির মেডিকেল কলেজে অধ্যাপনা করেন।
জীবন তার আপন গতিতে চললে থাকে। চাকুরী জীবনে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যাপক হয়েও পরিবারের আর্থিকাবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি! আ-জীবন অসহনীয় দুঃখ-দুর্দশা সহ্য করে আসা পরিবারের কল্যাণে তিনি কিছুই করতে পারেননি! তার জীবনে এ এক মর্মান্তিক অধ্যায়। এরূপ জীবনের উপর সন্তুষ্টি না থাকলেও তাঁর করার কিছু-ই ছিল না। কারণ, সমাজতন্ত্রের নামে সামাজিক-অর্থনৈতিক সমতার স্লোগান যারা দিয়েছিল, সেসব অতর্বগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন আঙ্গুল ফুঁলে কলা গাছ হলেও জনজীবনে এর কোন প্রভাব প্রতিফলিত হয়নি! সামাজিক অবকাঠামোও এর চেয়ে বেশি ভাল ছিল না। দেশের এ করুণ আর্থ-সামাজিক পরিস্তিতিতে ড. আ’লার অনুভূতি কেমন ছিল? চলুন তাঁর ভাষায় শুনা যাক।
‘সমাজতান্ত্রিক সরকারের অধীনে আমাদের জীবন ছিল খুব-ই দুরাশাপূর্ণ। ব্যক্তি স্বাধীনতা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং সাছন্দ জীবন-যাপনের কোন মানবিক চাহিদা পূরণের অধিকার ছিল না। আর্থ-সামাজিক এ করুণাবস্থার প্রতি আমার ভেতর খুব-ই আক্ষেপ ছিল। কিন্তু অন্যান্যদের মতো আমারও করার কিছু ছিল না। কারণ, এর অনিবার্য পরিণতি ছিল, হত্যা, সাইবেরিয়ায় নির্বাসন বা জেলের কঠিন শাস্তি!
জুলুম, নির্যাতন এবং রাষ্ট্রীয় স্বৈরাচার, সব ধরনের ইবাদত নিষিদ্ধ এবং জোরপূর্বক কুফর এবং ধর্মান্তরকরণের ধরুন আমাদের জীবন ছিল জ্বলন্ত জাহান্নাম।'
ইসলামের সঙ্গে পরিচয়ের ব্যাপারে অলিনিকবা বলেন-
ইসলামের ব্যাপারে আমাদের ধারণা ছিল অন্যসব পশ্চিমাদের চেয়ে বেশি। কারণ, সোবিয়েত ইউনিয়নে তখনো প্রায় ৬০ মিলিয়ন মুসলমানের বসবাস ছিল। আর তাদের অনেকে আমাদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করতো।
ব্যক্তিগতভাবে ইসলামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল কর্মজীবী মুসলিম বন্ধুদের মাধ্যমে। তাছাড়াও সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, ইরাক কুয়েতসহ মুসলিম রাষ্ট্রগুলো থেকে আগত ছাত্রদের চলা-ফেরাও আমি লক্ষ করতাম। তাদের চাল-চলনে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যেত। তবে ইসলাম সম্পর্কে আমার বিশেষভাবে জানার সুযোগ হয়েছিল ক্যাপ ইউনিভার্সিটির মেডিক্যাল সাইন্সের এক সিরিয়ান ছাত্রের মাধ্যমে। সে কখনো মদ পান করতো না। শুকরের গোস্ত খেতো না। ছাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতো না। এ কথায় সে খুব-ই চরিত্রবান ছাত্র ছিল। তার মধ্যে সততা ও বিশ্বস্ততা এ দু’টি গুণ বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল। সে একটি অতি সাধারণ ঘরে থাকতো। এ ঘর সম্পর্কে তার মন্তব্য ছিল- ‘এটি আমার ঘর এবং মসজিদ!’।
তিনি আরো বলেন-
‘ছাত্রটির চরিত্র, মাধুর্য্যপূর্ণ আচরণ আমাকে তার কাছে টেনে নেয়। পরিচয়ের এক ফাঁকে সে আমাকে ইসলাম সম্পর্কে কিছু বই উপহার দেয়। খুব আগ্রহভরে আমি বইগুলোর আদ্যোপান্ত পড়া শেষ করলাম। এতে ইসলামের ব্যাপারে আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে আরো পরিবর্তন আসে। এ বইগুলো আমার কাছে ইসলাম সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রবল করে। ১৯৯২ সালে কিছু সময়ের জন্য চাকুরী ছেড়ে সিরিয়া সফর করি। দাওয়া কলেজে ভর্তি হই। ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক পড়াশুনা করি। ১৯৯৫ সালে দাওয়া কোর্স শেষ করে-ই ইসলাম গ্রহণ করি!’
১৯৯৫ সালে ড. আ’লা ইসলাম গ্রহণ করেন। শুরু করেন এক নবজীবনের পথচলা। যে জীবন তাঁর আগের জীবন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। যাতে রয়েছে দুনিয়া-আখিরাতের মধ্যে গভীর সমন্বয়। যে ধর্ম দর্শনে দুনিয়াতে মনে করা হয় আখিরাত গঠনের একমাত্র মাধ্যম। এ নতুন জীবনদর্শন তাকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে। তিনি ইসলামের সুন্দর থেকে সুন্দরতম দিক-নির্দেশনায় অবগাহন করতে শুরু করেন। দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি জীবনের মর্মার্থ খুঁজে পেয়েছেন। তাই এ জীবনের পথে অন্যদের আহ্বানে তিনি পাগলপ্রায় হয়ে উঠলেন। ইসলাম পরবর্তী সময়ে তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত হলো- ‘ইসলাম একটি মহান ধর্ম। রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের বসয় মাত্র সত্তুর বছর। অথচ ইসলাম সেখানে হাজার বছরের বেশি সময় ধরে উপস্থিত। ব্যাপক প্রচার প্রসার সত্ত্বেও সমাজতন্ত্র ইতিহাসের আস্তা কুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। সমাজতন্ত্রীদের হাজারও ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও ইসলামের অস্তিত্ব বিলিন করা সম্ভব হয়নি। বরং রাশিয়াসহ সব দেশে দিনদিন এর চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে চিন্তাশীলদের জন্য রয়েছে ব্যাপক শিক্ষা-উপাদান। দুনিয়া-আখিরাতের মধ্যে সামঞ্জস্যতা-ই ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। যা মানব প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণ উপযোগী। হিজাব গ্রহণের পর থেকে যথাসম্ভব পরপুরুষের সঙ্গে মেলামেশা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। আমাদের সমাজ যদি ইসলামকে সঠিকভাবে জেনে বাস্তবায়ন করতো, তবে খুব সহজে সব ধরনের অপরাধ, ফাছাদ, অশ্লীলতা, মাদক এবং বেকারত্বের অবসান ঘটানো সম্ভব হতো। কারণ, নিজের ও অন্যের ক্ষতিকর সবকিছু-ই ইসলামে নিষিদ্ধ ও হারাম।’
ড. আ’লা ইসলামের মধ্যে ফিরে পায় তাঁর হারানো সব অধিকার। তাই ইসলাম তাঁর জীবনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যবিন্দুতে পরিণত হয়। অন্যদেরও এ সৌভাগ্যের পরশ পাথরের সন্ধান দিতে তিনি বাকি জীবন উৎসর্গ করেন।
আল্লাহ তা’য়ালা কাছে আমাদের কামনা। তিনি যেন আমাদের প্রিয় বোন আ’লা অলিনিকবার ইসলামকে কবুল করেন। এবং সব মুসলমানদের সঠিকভাবে ইসলামকে বুঝার এবং বাস্তবায়নের তাওফিক দান করেন। আমীন।
তথ্যসূত্র
বিষয়: বিবিধ
১১৫৫ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কেউ যদি সত্যের অনুসন্ধান করে সে অবশ্যই সন্ধান পায়। আর দুর্ভাগারা সত্যকে অবহেলা করে অন্ধকারকে গ্রহন করে নেয়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন