নবজীনের পথে... পর্ব-৫
লিখেছেন লিখেছেন ভিনদেশী ১২ মার্চ, ২০১৪, ০৪:৩৬:৪০ বিকাল
ড. মুরাদ উইলফ্রীড হোফম্যান (Murad Wilfried Hofmann)। একজন জার্মান ক্যাথলিক খৃস্টান। আইনবিদ। আলজেরিয়া ও মরক্কোর সাবেক জার্মান রাস্ট্রদূত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর সমর্থন করেলেও গোপনে নাৎসি বিরুধী একটি নিষিদ্ধ সংঘটনের সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি ‘ব্যালেনৃত্য বা Ballet dance’ এক পাগল ভক্ত ছিলেন। ব্যালে সমর্থকগুষ্ঠী নামে একটি সংস্থাও প্রতিষ্ঠা করেন। তখন এ বিষয়ে বেশ কিছুদিন লেখা-লেখিও করেন।
খুব ছোট বয়সে ড. মুরাদ এক গাড়ি এক্সিডেন্টে গুরুতর আহত হন। এমন এক্সিডেন্টে সাধারণত বাচা সম্ভব নয়। কিন্তু আল্লাহ তা’য়ালার রহমতে তিনি বেচে গেলেন। সবাই আশ্চর্য হলেন! অপারেশন সার্জেনও অবাক হলেন! সুস্থ হয়ে ওঠার পর ডাক্তার বলেই পেললেন- ‘বাবা! তুমি যে এক্সিডেন্ট করেছ। এরূপ এক্সিডেন্টে সাধারণ কেউ জীবনে রক্ষা পায় না! আমার মন বলছে, বড় কোন কাজের জন্য স্রষ্টা তোমাকে বাচিয়ে রেখেছেন!’
সময় এগিয়ে চলে। চোট্ট মুরাদ সময়ের সাথে বেড়ে উঠছেন। এক সময় হার্বার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের উপর ‘ডক্টোর্যাট ডিগ্রী’ অর্জন করেন। এখন চাকুরির পালা। জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ‘পরমানু বিভাগে’র গবেষক হিসেবে কর্মজীবনের শুরু। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দিন দিন তাঁর পদোন্নতিও হচ্ছে। আর তিনি এক দেশ থেকে আরেক দেশে সফর করে চলছেন। জীবন তাঁর সুখেই কাটছে! ষাটের দশকে তিনি আলজেরিয়ার জার্মান দূতাবাসে কাজ করেন। এখানেই তিনি প্রথম পরিচিত হন ‘ইসলাম ও মুসলামান’দের সঙ্গে। এক সময় তিনি ইসলামের প্রতি দুর্বলতা অনুভব করেন। এবং ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনা শুরু করেন। দীর্ঘ বিশ বছরের গবেষণা তাকে ইসলামের প্রতি চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণ করে! তিনি ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন! কিন্তু কেন তিনি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন? সে এক সমৎকার কাহিনী! আর তাই আমরা শুনব ড. মুরাদের ভাষায়। শোনা যাক সে হৃদয়চোঁয়া গল্প!
ড. মুরাদ বলেন (মূল বক্তব্য): ‘১৯৬১-১৯৬২ সালে আমি আলজেরিয়ার জার্মান দূতাবাসে কাজ করি। তখন আলজেরিয়ান স্বাধীনতাকামী জাতীয় ফ্রন্ট ও ফরাসি বাহিনীর মধ্যে চলছে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ! দীর্ঘ আট বছর পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলতে থাকে! এক সময় ফ্রান্সের পক্ষে তৃতীয় একটি শক্তির উদয় হয়। এর নাম; ফরাসি গোপন সৈন্যদল! এ গ্রুফের কাজ ছিল, গোপনে আলজেরিয়ার রাস্তায় লাশের মিছিল ফেলা! তাদের দৃষ্টিতে আলজেরিয়ানরা ছিল সন্ত্রাসী। কারণ, তারা মুসলিম এবং স্বাধীনতাকামী! দুঃখময় এসব অভিজ্ঞতা আমাকে মুসলমানদের কাছে টেনে নেয়। আমি তাদের কাছে থেকে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করি। সফল ও হই। এবার আমি কাছ থেকে দেখলাম, তাদের দুঃখ-কষ্ট। বিজয়ের ব্যাপারে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। রমজান মাসে তাদের কঠোর সাধনা। মৃত্যুপুরীতেও তাদের মানবতা বোধ! এসব দেখে আমার মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো যে, নিশ্চয় বড় কোন উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে এ লোকগুলো কাজ করে যাচ্ছে। অন্যতায় কেউ এরূপ দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে না বা করতে পারে না।আমার মধ্যে যখন আলজেরিয়ানদের ব্যাপারে এসব অনুভূতি কাজ করছিল, ঠিক তখনি আমার জীবনে একটি বড় ঘটনা ঘটে। এ ঘটনা আমার মনে কঠিন রেখাপাত তৈরি করে। যুদ্ধের বিভিষিকাময় পরিবেশে আমার স্ত্রী গর্বপাতের শিকার হন। গভীর রাতে তার রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এদিকে বাহিরে চলছে কারফিউ। রাতে এম্বুলেন্স আসার কোনো সুযোগ নেই! কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না! এম্বুলেন্স আসতে দেরী হওয়ায় খুব ভোরে আমরা একটি গাড়ি নিয়ে হাসপাতালের পথ ধরলাম। পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর ডাক্তার বললেন। ব্যাপক রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাই আমার স্ত্রীর রক্তের প্রয়োজন। তার রক্তের গ্রুফ ‘ও পজেটিব’। যুদ্ধকালীন সময় হওয়ায় তাদের ব্যাংকে পর্যাপ্ত রক্ত জমা নেই! তাই আমাকেই রক্ত সংগ্রহ করতে হবে! এমন কঠিন সময়ে একজন বহিরাগতকে কে রক্ত দিবে? আমার মাথা কাজ করছে না! কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। আমাদের ড্রাইবার ছিল একজন মুসলিম। তিনি রক্তের কথা শুনে বললেন। আমার রক্তের গ্রুফ ‘ও নেগেটিভ’। আমি আপনার স্ত্রীকে রক্ত দিব!
আমি অবাক হলাম! এরূপ কঠিন পরিস্থিতিতে একটি ভিনদেশী নারীর জীবন রক্ষায় একজন মুসলিম রক্ত দিবে! শুনে আমি বিহ্বল হয়ে পড়লাম! বিষয়টা আমার অন্তরকে ব্যাপক নাড়া দেয়! মানবতার এই ‘চমৎকার রূপ’ দেখে আমি আবিভূত হলাম! সে আমার স্ত্রীকে রক্ত দিল। অতঃপর ধীরে ধীরে আমার স্ত্রী সুস্থ হয়ে উঠল।
আমার মধ্যে প্রবল ইচ্ছা জাগলো এ লোকগুলোর ‘ধর্মীয় ও মানবিক চেতনা’র উৎস খুঁজে বের করতে। আমি তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ নিয়ে গবেষণা শুরু করলাম। কোরআনের ফরাসি অনুবাদ পড়া আরম্ভ করলাম। এক সময় একে একে আমার অন্তরের পর্দাগুলো খুলে যেতে শুরু করল! আমি সত্য-মিথ্যার স্পষ্ট পার্থক্য দেখতে পাচ্ছি! ধীরে ধীরে আল্লাহ তা’য়ালার একত্ববাদের বিশ্বাস আমার অন্তরে স্থান করে নেয়। আমি ‘চিন্তাগত’ দিক থেকে মুসলিম হতে শুরু করি! কিন্তু ইসলামকে একমাত্র জীবনবিধান হিসেবে মেনে নিতে আরো কিছুদিন সময়ের প্রয়োজন হয়। আমার গবেষণা চলতেই থাকে। অবশেষে নিজের মধ্যে পূর্ণ বিশ্বাস তৈরি হলো, ইসলামই একমাত্র ধর্ম যা ‘চিন্তাগত ও কার্যত’ উভয় দিক থেকে মানবতাকে সঠিক পথ দেখাতে পারে।’
দীর্ঘ বিশ বছর গবেষণার পর ১৯৮০ সালের কোনো এক শুভক্ষণে ড. মুরাদ হোফম্যান শাহাদাতের সাক্ষ দিয়ে ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করেন! এবং উম্মাতে মুহাম্মদির সৌভাগ্যবান কর্মীর তালিকায় নিজের নাম অন্তরভূক্ত করে নেন! শুরু হলো তাঁর নতুন জীবনের পথ চলা! তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন- ‘ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। প্রতিপক্ষের সব রকম হামলা-মামলার মোকাবেলা করার পূর্ণ শক্তি ইসলামে রয়েছে। জ্ঞানার্জনকে আবশ্যক করে ধর্মীয় ইতিহাসে ইসলাম নিজের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্থান করে নিয়েছে। হাজারো ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও ইতিহাসের মূল ঘটনা প্রবাহে ইসলামের দৃঢ় অব্স্থান, পাশ্চাত্যের গুণীজনদের দৃষ্টিতে ‘সময় ও ইতিহাসের’ গতি ভিন্ন একটি উপখ্যান! বরং অনেকে তা পাশ্চাত্য জগতের জন্য অবমাননা ও চ্যালেঞ্জ মনে করেন’।
উচ্চ পর্যায়ের সরকারী কর্মকর্তা ড. মুরাদের ইসলাম গ্রহণকে জার্মান খৃস্টানরা সহজে মেনে নিতে পারেনি। শুরু হলো তাঁর বিরুদ্ধে ‘মিডিয়া যুদ্ধ’। প্রতিদিন তাঁর বিরুদ্ধে নিত্য-নতুন অপবাদ আসতে শুরু হয়! প্রতি উত্তরে তিনি কোনো বাড়াবাড়িতে গেলেন না। বরং কিছু সময়ের জন্য চুপচাপ শুনে গেলেন! তারপর শুরু হয় তাঁর ‘কলমযুদ্ধ’। সমস্ত শক্তি নিয়ে তিনি এ যুদ্ধে নেমে পড়লেন। ইসলামের স্বকীয়তা বর্ণনায় একের পর এক গ্রন্থ লিখে চললেন। তাঁর গ্রন্থগুলো ‘ধর্মনিরপেক্ষবাদ ও খৃস্টবাদের’ প্রসাদে কঠিন আঘাত হানতে শুরু করে। কিভাবে এই ‘জ্ঞান ও যুক্তিশ্রোতে’র গতি রোধ করা যায়, ধর্মনিরপেক্ষগুষ্ঠী ও খৃস্টানরা ভেবে পেল না! অসহায় বোধ তাদের মধ্য চেপে বসতে শুরু করে!
এক সময় ড. মুরাদের Islam: The Alternative প্রকাশিত হয়। এ গ্রন্থ দুনিয়ার শিক্ষিত সমাজে গুণঞ্জন শুরু করে। নতুনভাবে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় । অনেকে এই বইকে খৃস্টবাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে মনে করেন! প্রতিপক্ষের বাড়াবাড়ির প্রতি মনোযোগ না দিয়ে তিনি নিজ দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এবং লিখে চললেন (Journey to Makkah), (The Future of Islam in Occident and Orient), (Islam in 2000), এবং (Religion On The Rise Islam In The Third Millennium) সহ বহু অনবদ্য গ্রন্থ।
সমগ্র ইউরোপে ইসলাম সম্পর্কে জানার এক নতুন পথ উন্মোচিত হয়। বহু জ্ঞানী-গুণীরা ইসলাম সম্পর্কে পড়তে শুরু করেন। অনেকে শেষ পর্যন্ত ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন!
আল্লাহ তা’য়ালা ড. মুরাদ হোফম্যানকে কবুল করুন। আমাদেরকেও তাঁর সঙ্গে জান্নাতে মিলিত হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।
তথ্যসূত্র:
Welcome Back To Islam
Murad Wilfried Hofmann
من هو مراد هوفمان؟
هكذا أسلم الدكتور مراد هوفمان
বিষয়: বিবিধ
১১৯৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ তা'য়ালাই সহায়।
মন্তব্য করতে লগইন করুন