জেনারেল ওসমানীর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে থাকা না থাকা নিয়ে দুটি পরস্পর বিরোধী বিতর্ক

লিখেছেন লিখেছেন ইব্রাহীম খলিল ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০১:২০:৫১ দুপুর

জেনারেল ওসমানীর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে থাকা না থাকা নিয়ে দুটি পরস্পর বিরোধী বিতর্ক নিচে তুলে ধরা হল। কোনটা বিশ্বাস করবেন ওইটা আপনার ব্যাপারঃ

** অকুতোভয়, একরোখার, প্রচন্ড আত্মসন্মানজ্ঞ্যানী, ছোটখাট শরীরের এক বড় যোদ্ধা, যাকে চরম শত্রু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ‘টপ ব্রাস’ রা ‘পাপা টাইগার’ নামে ডাকতো। আমরা তাকে কি সন্মান দিয়েছি? তার নামে একটা মিলনায়তন, ব্যাস! দেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, যুদ্ধে অসম সাহসিকতা আর নেতৃত্বের জন্য জীবিত সদস্যদেরকে প্রদেয় সেনাবাহিনীর পদক একটা ‘বীরউত্তম’ পদকও তার কপালে জুটে নাই।

এমন কি নয় মাসের যুদ্ধের পরে পাকিস্তানী হানাদার লজ্জাকর আত্মসমর্পণের কালেও তাকে ষড়যন্ত্র করে তাকে অনুপস্থিত রাখা হয়েছিল। এ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্যও শুনি নি। যে যুদ্ধের তিনি নেতৃত্ব দিলেন, সেই যুদ্ধ জয়ের আনন্দ থেকে তাঁকেই বঞ্চিত করা হল।

‘আবিদ বাহরা’ ওয়েকাপবিডিতে লিখেছেনঃ

“ঘটনার বিশ্লেষন করলে দেখা যায় জেনারেল ওসমানীকে ‘কায়দা’ করে পাকিস্থানীদের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান থেকে অনুপস্থিত রাখা হয়েছিল। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের জড়িত বিভিন্ন পার্টির বিভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল। বাংগালী জনতার কাছে ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ। কিন্তু আরেক পার্টি ‘ভারত’ এর কাছে ছিল উপমহাদেশে তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা যা কিনা তাদের নেতা জওহের লাল নেহেরূর ‘অখন্ড ভারত’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন।এই লক্ষ্যে তারা সিকিম, গোয়া হায়দ্রাবাদ কাশ্মির কে তাদের ‘পতাকাতলে’ নিয়ে নিয়েছে”।- এমবিআই মুনশীঃ ইন্ডিয়া ডক্ট্রিন।

অন্যদিকে বিজয়ে উদ্বেলিত বাঙ্গালী যখন দেখতে চাইছিল হানাদার জেনারেল নিয়াজী বাংগালী জেনারেল ওসমানীর কাছে কি ভাবে আত্মসমর্পণ করে। সিলেট অঞ্চল থেকে জেনারেল ওসমানী হেলিকপ্টারে করে ঢাকা আসছিলেন সেটাকে গুলি করে মাটিরে নামতে বাধ্য করে ও দেরী করিয়ে দেয়া হয়।

“ফেঞ্চুগঞ্জে হেলিকপ্টারটিকে নামিয়ে আনা হয়, যদিও এই এলাকাটি পাকিস্থানী হানাদার মুক্ত ছিল, হেলিকপ্টারে জেনারেল ওসমানীর সাথে অবস্থানরত লেঃকর্নেল এম,এ, রব তার থাই ও ডান হাতে গুলিবিদ্ধ হ’ন। হেলিকপ্টারটি তেলের ট্যাঙ্কি ফুটো হয়ে যায়। জেনারেল সাহেব হাতের কাছে কিছু না পেয়ে নিজ হাত দিয়েই সে ফুটো বন্ধ করে রাখতে যান। গরম তেলে তার হাত পুড়ে যায় তখন তার গায়ের জ্যাকেট দিয়ে তেলের ট্যঙ্কের ফুটো বন্ধ করেন।“

“পেছনের র‍্যম্প খোলা ছিল, যাত্রীরা হেলিকপ্টারের দুইপাশের দুইটি বেঞ্চে বসা ছিল। কারো সিটবেল্ট ছিল না, পাইলট ইমার্জেন্সী ল্যান্ডিং করার চেষ্টা করছিলেন, অজ্ঞ্যান কর্নেল রব প্রায় ছিটকে পড়েই যাচ্ছিলেন কপ্টার থেকে বাইরে। মুস্তফা আল্লামা তাকে ধরে ফেলেন”।

“হেলিকপ্টারটি একটি মাঠে ক্র্যাশ ল্যান্ড করে। প্রায় সাথে সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল দুইটি এ্যাম্বুলেন্স সহ হাজির হ’ন অস্বাভাবিক দ্রুততার সাথে!”

“এই ব্যাপারে মনে হয় না বাংলাদেশ সরকার না ভারতীয় সেনাবাহিনী কেউ কোন অনুসন্ধান করে নি, যেন এই দুইপক্ষই এই ‘অনভিপ্রেত’ ‘বিব্রতকর’ পরিস্থিতি এড়াতে চায়”।

“এমনকি চতুর ভারতীয় বাহিনী তাদের মিগ২১ বিমান দিয়ে কিছুটা ‘ফ্রেন্ডলি’ গোলাবর্ষন করায় বিএনএস পদ্মা ও বিএনএস পলাশে। যদিও সবাই জানতো এই এলাকায় ১০ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পরে কোন হানাদার ছিল না”।

বোঝাই যায়, তাকে অনুষ্ঠানের অনুপস্থিত রাখার জন্য একটি নিখুঁত পরিকল্পনা কাজ করেছে। তাই কোন কোন জায়গায় পাকিস্থানীর দাবী করে তারা আসলে বাংলাদেশের কাছে পরাজিত হয় নি তারা পরাজিত হয়েছে ভারতীয় বাহিনীর কাছে আর এজন্যই তারা আত্মসমর্পণের দলিলে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল জগজিত সিং অরোরার কাছে স্বাক্ষর করে। আমাদের বিজয়ের আনন্দ ও স্বীকৃতি আমাদের কাছ থেকে প্রতারণা করে ছিনিয়ে নিয়েছে ওরা।

**বিপক্ষের যুক্তিঃ

যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরে জনসংযোগ কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম। একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা নামে এক স্মৃতিচারণে তিনি তুলে ধরেছেন এর বিষদ বিবরণ।

ঘটনা হচ্ছে ১২ ডিসেম্বর ওসমানী কলকাতা থেকে আগরতলা হয়ে মুক্তাঞ্চল সিলেটে যান। এটা নিশ্চিত করেন মুক্তিবাহিনী হেডকোয়ার্টারের অফিসার ইন চার্জ জেনারেল ওসমানীর বিশ্বস্ত বন্ধু মেজর এমআর চৌধুরী।

১৮ ডিসেম্বর সদর দপ্তরে ফিরে তাকে নিয়ে এসব গুজব শুনে ভীষণ ক্ষুব্ধ হন ওসমানী। নজরুল ইসলামের মুখে পুরোটা শুনে যে জবাব দিয়েছেন কোট করছি:

দেখুন আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে যাচ্ছি। কিন্তু দুঃখ হলো স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পর্কে কোনো চেতনা এখনও জন্ম হয়নি। আমাকে নিয়ে রিউমার ছড়ানোর সুযোগটা কোথায়? কোনো সুযোগ নেই। তার অনেক কারণ রয়েছে। নাম্বার ওয়ান- পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কবে আত্মসমর্পণ করবে আমি জানতাম না। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর তাদের আত্মসমর্পণের প্রস্তাব এসেছে।

নাম্বার টু- ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এই সশস্ত্র যুদ্ধ ভারত-বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধীনে হলেও যুদ্ধের অপারেটিং পার্টের পুরো কমান্ডে ছিলেন ভারতীয় সেনাপ্রধান লেফট্যানেন্ট জেনারেল স্যাম মানেকশ। সত্যি কথা হচ্ছে আমি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো নিয়মিত সেনাবাহিনীর সেনাপ্রধানও নই। আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুযায়ী পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমার কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না। কারণ বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ নয়।

আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে জেনারেল মানেকশকে রিপ্রেজেন্ট করবেন লে.জে অরোরা। জেনারেল মানেকশ গেলে তার সঙ্গে যাওয়ার প্রশ্ন উঠতো। সার্বভৌম সমতার ভিত্তিতে আমার অবস্থান জেনারেল মানেকশর সমান। সেখানে তার অধীনস্থ আঞ্চলিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল অরোরার সফরসঙ্গী আমি হতে পারি না। এটা দেমাগের কথা নয়। এটা প্রটোকলের ব্যাপার। আমি দুঃখিত, আমাকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। আমাদের মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধের বড় অভাব।

ঢাকায় ভারতীয় বাহিনী আমার কমান্ডে নয়। জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল অরোরার কমান্ডের অধীন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে যৌথ কমান্ডের ভারতীয় বাহিনীর কাছে। আমি সেখানে (ঢাকায়) যাবো কি জেনারেল অরোরার পাশে দাড়িয়ে তামাশা দেখার জন্য? হাও ক্যান আই!

আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করবেন জেনারেল মানেকশর পক্ষে জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর পাকিস্তানী বাহিনীর পক্ষে জেনারেল নিয়াজী। এখানে আমার ভূমিকা কি? খামোখা আমাকে নিয়ে টানা হ্যাচড়া করা হচ্ছে।

পাশাপাশি কেনো মুক্তিবাহিনীর কাছে পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণ করেনি এটার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ওসমানী সংক্ষেপে ব্যাপারটা এমন যে যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নীতিমালা আছে যার অন্যনাম জেনেভা কনভেনশন। বাংলাদেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয় বলেই সেই নীতিমালা মানতে মুক্তিবাহিনী বাধ্য ছিলো না। তাই তাদের হত্যা করলে বা তাদের উপর অত্যাচার করলে বলার থাকতো না কিছু। পাকিস্তানীরা জেনেশুনে সে ঝুকি নেয়নি। তাছাড়া ৯০ হাজার যুদ্ধবন্দীকে খাওয়ানো পড়ানো তদারক করার ক্ষমতাও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ছিলো না। তখনও নিজের খাওয়াটাই যে জোটে না!

একই বইয়েই জানা গেছে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য ওসমানী একটি ভাষণ লিখেছিলেন ইংরেজীতে যার অনুবাদে কমান্ডার ইন চীফের বাংলা মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি করা হয়েছে দেখে খেপে যান তিনি। নির্দেশ দেন সর্বাধিনায়ক লিখতে। বিব্রত নজরুল তথ্য মন্ত্রনালয়ে গেলে ভারপ্রাপ্ত সদস্য আব্দুল মান্নান প্রধান সেনাপতি লিখতে বলেন। ক্ষুব্ধ ওসমানী এরপর স্বাধীন বাংলা বেতারে কোনো ভাষণ দেননি গোটা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। প্রসঙ্গত মুজিব নগরে বাংলাদেশ সরকারের স্বাধীনতা ঘোষণায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের পদ দেওয়া হয়। ওসমানী ছিলেন মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক।

তথ্যসূত্র : একাত্তরের রণাঙ্গন অকথিত কিছু কথা

বিষয়: Contest_mother

২৯৮৮ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

300722
১৯ জানুয়ারি ২০১৫ রাত ১২:২৫
মোহাম্মদ খোরশেদ আলম লিখেছেন : ওসমানি ছিলেন সর্বাধিনায়ক। তাই তাকে দেখলে পাকিদের লজ্জা আরও বেশি লাগতো 42 বছর পার হবার পর আমাই তাই মনে হচ্ছে।
372110
১৬ জুন ২০১৬ রাত ০৪:১৭
কুয়েত থেকে লিখেছেন : যে যুদ্ধের তিনি নেতৃত্ব দিলেন, সেই যুদ্ধ জয়ের আনন্দ থেকে তাঁকেই বঞ্চিত করা হল অনেক ধন্যবাদ ভালো লাগলো

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File