লাশের স্তূপে স্তব্ধ মৃত্যুপুরী : এ পর্যন্ত ৩৯৭ লাশ উদ্ধার, হস্তান্তর ৩৯১, জীবিত উদ্ধার ২৪৩৭ জন
লিখেছেন লিখেছেন রোহান ২৮ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:৩৪:৫৯ রাত
লাশের স্তূপে স্তব্ধ হয়ে পড়েছে মৃত্যুপুরী সাভারের রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ। লাশের দুর্গন্ধে ভারি হয়ে উঠেছে সাভারের আকাশ-বাতাশ। ছড়িয়ে পড়ছে রোগ-জীবাণু। দেশের শিল্প-কারখানার ইতিহাসে স্মরণকালের ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় গতকাল রাত ১১টা পর্যন্ত ৩৯৭ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯১টি লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিগুলো অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ২ হাজার ৪৩৭ জনকে। ধসেপড়া ভবনের ভেতরে এখনও চাপা পড়ে আছে সাড়ে ৮ শতাধিক শ্রমিক। জীবিত ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে তাদের পরিবারগুলো।
এদিকে গতপরশু পর্যন্ত রানা প্লাজার মালিক পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সোহেল রানার স্ত্রীসহ তার ৬ আত্মীয়, দুই কারখানার মালিক এবং চার প্রকৌশলীসহ ১২ জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এদের মধ্যে নিউ ওয়েভ বটমস ও নিউ ওয়েভ স্টাইল গার্মেন্ট কারখানার মালিক মাহবুবুর রহমান তাপস এবং বজলুস সামাদ আদনানকে ৬ দিন করে ১২ দিনের এবং সাভার পৌরসভার দুই প্রকৌশলী এমতেনাম ও আলম মিয়াকে দুই মামলায় চার দিন করে মোট ৮ দিনের রিমান্ডে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
রানা প্লাজার বিধ্বস্ত ভবনের যেখানেই চোখ যায়, সেখানেই শুধু লাশ আর লাশ! ধ্বংসস্তূপের এ মৃত্যুপুরীতে লাশের গন্ধে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে বাঁচার জন্য এখনও শেষ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন কয়েকশ’ হতভাগ্য শ্রমিক, যাদের অধিকাংশই নারী। আবার অনেকেই উদ্ধারকারীরা পৌঁছানোর আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন। ফলে যথারীতি বিধ্বস্ত ভবনের মধ্যে আটকেপড়া নিহতের সংখ্যা ব্যাপক হারে বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
উদ্ধারকারী সেনাবাহিনীর জনসংযোগ পরিদফতরের পরিচালক মোহাম্মদ শাহিনুল ইসলাম গতকাল সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের জানান, ধ্বংসস্তূপ থেকে এ পর্যন্ত ৩৯৭ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া ২ হাজার ৪৩৭ জীবিত শ্রমিককে উদ্ধার করা হয়েছে। মৃতদেহগুলো রাখা হচ্ছে স্থানীয় অধর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে। এই মাঠে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণকক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইফতেখার হোসেন। তিনি জানিয়েছেন, গতকাল বিকাল পর্যন্ত ৩৯৭টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে উদ্ধার কার্যক্রম নিয়ে গতকাল সকালে সেনাবাহিনীর সাভার ক্যান্টনমেন্টের নবম ডিভিশনের জেনারেল অফিসার ইনচার্য (জিওসি) মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দী গতকালও বলেন, একজন জীবিত প্রাণের স্পন্দন থাকলে তাকেও জীবন্ত উদ্ধার করা হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত উদ্ধার কাজ শেষ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত উদ্ধার কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে। এখনও যেহেতু আটকেপড়া বেঁচে থাকা শ্রমিকের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, তাই সতর্কতার সঙ্গে উদ্ধার অভিযান চালানো হচ্ছে।
সরেজমিন বিধ্বস্ত ভবনের উদ্ধার কার্যক্রম ঘুরে দেখা গেছে, উদ্ধারকারীরা ১০৮ ঘণ্টা অতিক্রম করার পরও ভারি যন্ত্রপাতি দিয়ে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেননি। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে হাতুড়ি, ড্রিল মেশিন ব্যবহার করে গর্ত খুঁড়ে একটি একটি তলা অতিক্রম করে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছেন। উদ্ধারকারী দল জীবিত উদ্ধারে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন। উদ্ধার কাজে সক্রিয়ভাবে জীবিতদের বের করে আনার কাজটি করছেন দমকল বাহিনীর সদস্য এবং সাধারণ মানুষ। বাইরে সেনাবাহিনী এদের সহযোগিতা করছে।
পাচ দিন পরও জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা : সরেজমিন উদ্ধার কার্যক্রমে দেখা গেছে, ভবন ধসের প্রায় ১০৮ ঘণ্টা অতিক্রম করার পরও উদ্ধারকারীরা কিছুক্ষণ পরপরই জানাচ্ছেন—এখানে একজন জীবিত মানুষ আছে। এভাবে ভবনের একেকটি অংশ থেকে উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা চিত্কার করে বলছেন, ‘অক্সিজেন সিলিন্ডার দিন, পানি দিন, স্প্রে নিয়ে আসুন।’ অপরদিকে একাধিক দল বড় সিলিন্ডার নিয়ে দ্রুত সেদিকে ছুটছে। কেউ পানির বোতল নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছেন। গর্ত খুঁড়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন এবং জীবিতদের বের করে আনছেন। এভাবে গতকাল রাত সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করার কথা জানিয়েছেন উদ্ধারকর্মীরা।
ভবনের পেছনের অংশে এবং পূর্বদিকে আরেকটি ভবন আরএস টাওয়ারের সামনে দিয়ে গতকাল সকাল থেকে উদ্ধার কাজ শুরু করা হয়। ছোট ছোট ২৫টি গর্ত করে হলুদ লম্বা পাইপ ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে যেখানেই জীবিতদের সন্ধান মিলছে, সেখানেই বাতাস ও অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। অপরদিকে ভবনের অষ্টম তলা দিয়ে গতকাল আরও সাতটি গর্ত খোঁড়া হয়েছে। এই অংশে উদ্ধারকারী দমকল ও সাধারণ মানুষের চারটি দল কাজ করছে।
এই উদ্ধারকারীরা ড্রিল মেশিন দিয়ে গর্ত খুঁড়ে অষ্টম থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত ঢোকার চেষ্টা চালাচ্ছেন। উদ্ধারকারীরা সকাল থেকে এ চেষ্টা করছেন এবং দুপুর পর্যন্ত তারা চতুর্থ তলা পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন। উদ্ধারকারী দলের সদস্য জসিম উদ্দিন, নাদিম, মোবারক জানান, বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপের একটি অংশে গিয়ে তারা আটকে যাচ্ছেন। সেখানে পিলারের রড পেঁচিয়ে আছে। ওই রড কাটতে পারলে তৃতীয় তলা পর্যন্ত এক পাশ দিয়ে তারা ভেতরে যেতে সক্ষম হবেন।
তবে দুপুরে বৃষ্টির কারণে কিছুক্ষণ উদ্ধার কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। আকাশে বালু আর কাদার মধ্যে উদ্ধারকারীরা বিড়ম্বনার শিকার হন। এসময় ভবনে উদ্ধারকারীদের খোঁড়া গর্তগুলো পলিথিন দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়, যাতে ভেতরে ঝুলে থাকা বা কোনোরকম আটকে থাকা বিধ্বস্ত অংশ ধসে না পড়ে। তবে গতকালও উদ্ধারকারীরা উদ্ধারকার্যক্রমে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবের অভিযোগ করেছেন।
লাশের দুর্গন্ধে অসুস্থ উদ্ধারকর্মীরাও : এ পর্যন্ত উদ্ধারকারীরা যেখানেই জীবিত মানুষের সন্ধান পেয়েছেন সেখানেই গর্ত খুঁড়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। এই উদ্ধার কাজ করতে গিয়ে যে লাশটি তোলা সম্ভব, সেটিই বের করে আনা হচ্ছে। এর ফলে ভবনের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে চাপা পড়া অনেক লাশ এখনও উদ্ধার করা হয়নি। এর ফলে উদ্ধারকারীরা জীবিতদের খুঁজতে গিয়ে লাশ আর লাশের দুর্গন্ধে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। শুক্রবার রাত থেকে এখনও ভবনে প্রতিমুহূর্তে গোলাপ জল আর এয়ারফ্রেশনার দিয়ে লাশের গন্ধ একটু উপশম করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এতেও লাশের গন্ধ থেকে রেহাই মিলছে না। প্রচণ্ড গরমে লাশে পচন ধরেছে আর তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এতে ভেতরে গিয়ে একদিকে দুর্গন্ধ, গরম আর পানিশূন্যতায় উদ্ধারকারীরা অচেতন হয়ে পড়ছেন। গত শুক্রবার ছয়জন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং গতকাল দুপুরে আরও ছয়জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের চিকিত্সা দেয়া হয়েছে।
নিখোঁজদের ছবি নিয়ে স্বজনদের আহাজারি : সাভারের বিধ্বস্ত রানা প্লাজার সামনে এবং স্থানীয় অধোরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে এখনও শত শত মানুষ তাদের প্রিয়জনকে ছবি নিয়ে খুঁজছেন। আইএসপিআরের পক্ষ থেকে গতকাল নিখোঁজদের সংখ্যা জানিয়েছে সাড়ে আট শতাধিক। গত শুক্রবার থেকে সাভার এবং অন্যান্য হাসপাতালে আহতাবস্থায় ভর্তি হওয়াদের তালিকা ও ঠিকানা টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে।
গত বুধবার এই ভবনধসের পর থেকে অধোরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় এবং রানা প্লাজার সামনে শত শত স্বজনের ছবি নিয়ে প্রিয়জনকে খুঁজতে কাউকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেছে। এখনও স্বজনরা প্রিয়জনের খোঁজে আহাজারি করছেন। উদ্ধারকারীরা বলছেন, এখনও যারা নিখোঁজ রয়েছেন, তাদের একটি বড় অংশ বিধ্বস্ত ভবনের নিচে চাপা পড়ে আছে। এই হতভাগ্যদের অনেকেই হয়তো আর বেঁচে নেই। এই আশঙ্কা সঠিক হলে হতাহতের সংখ্যা আরও অনেক বেড়ে যাবে। এখানে বিধ্বস্ত ভবন থেকে জীবিত ও মৃতদের বের করে আনতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে দমকল বাহিনী।
এ ব্যাপারে দমকলের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ বলেন, এখনও অনেকে কলাম ও বিমের সংযোগস্থলে আটকে আছেন। এই বিম কিংবা কলামে আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করা গেলে অনেক নিখোঁজের সংখ্যা কমে যাবে। তবে এই বিম কাটলে জীবিতদের উদ্ধার করা সম্ভব নাও হতে পারে। এ কারণে এখনও সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে।
রানার স্ত্রী-আত্মীয় ও ৪ প্রকৌশলীসহ আটক ১৩ : সাভারে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে গতকাল ৪ প্রকৌশলীকে আটক করেছে ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশ। এছাড়া ভবন মালিকের স্ত্রী মিতু আকতার ও তার চাচাতো ভাই, ফুফা, ভগ্নিপতিসহ আরও ৬ জন এ ঘটনায় আটক রয়েছেন। এ নিয়ে এ ঘটনায় আটকের সংখ্যা দাঁড়াল ১৩ জন। গতকাল সকালে পৃথক অভিযান চালিয়ে দুই প্রকৌশলীকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। তারা হলেন সাভার পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. এমতেমাম হোসেন বাবু, সহকারী প্রকৌশলী (সিভিল) মো. আলম মিয়া পরে তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী অপর দুই প্রকৌশলীকে আটক করা হয়। আটক ব্যক্তিরা হলেন ভবনের নকশা প্রস্তুতকারক প্রকৌশলী তোরাব আলী ও সোহরাব হোসেন। এ বিষয়ে সাভার থানার ওসি আসাদুজ্জামান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, দায়িত্বে অবহেলার ঘটনায় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের আটক করা হয়েছে। এর আগে গত শুক্রবার রাতে রানার স্ত্রী মিতু আকতারকে আটক করে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
সাভার ও মানিকগঞ্জ থেকে শুক্রবার আটক করা হয়েছে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানার পোদ্দারবাড়ী এলাকার বাসিন্দা রানার চাচাতো ভাই জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী মুন্নী বেগম ও রানার ফুফা আনোয়ার হোসেন, ভগ্নিপতি মমিনুল হক মমিন ও ভাড়াটিয়া মাহবুবুর রহমান তুষার।
বিষয়: বিবিধ
১০৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন