সরকার এখন নিরবাক দর্শকের ভুমিকায় , সাভারে লাশের মিছিল

লিখেছেন লিখেছেন রোহান ২৭ এপ্রিল, ২০১৩, ০৬:১৫:৪৬ সন্ধ্যা

সাভার ট্র্যাজেডিতে স্তব্ধ গোটা জাতি। লাশের সারি দেখে, স্বজনহারাদের আর্তনাদ শোনে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না মানুষ। বুধবার সকালে ঘটা ভয়াবহ ভবন ধসের পর চার দিন অতিবাহিত হতে চলছে। আজও ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে বের করা হচ্ছে জীবন্ত মানুষকে। বের হচ্ছে আরও লাশ। এখনও নিখোঁজ ছয় শতাধিক মানুষ। তাদের সন্ধানে স্বজনরা ভিড় করছেন ধসে পড়া ভবনের চারপাশে। জীবিত না হলেও অন্তত প্রিয়জনের লাশটি চাইছেন তারা। অভিযোগ তুলছেন উদ্ধার কাজে ধীরগতির। এ অভিযোগ আসছে গত চার দিন ধরেই। এ পর্যন্ত কয়েক দফায় অপেক্ষমাণ স্বজন ও সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন উদ্ধারকারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে। মানবিকতার তাগিদে অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে যাচ্ছেন সাভারে। কেউ খাবার নিয়ে যাচ্ছেন। কেউ নিয়ে যাচ্ছেন উদ্ধার সামগ্রী। কেউ বা যাচ্ছেন উদ্ধার কাজে অংশ নিতে। এমন শ’ শ’ মানুষ সেখানে টানা চার দিন ধরে অংশ নিচ্ছেন উদ্ধার কাছে। নিজের জীবন ঝুঁকি নিয়ে তারা প্রবেশ করছেন মৃত্যুকূপে। তুলে আনছেন জীবিত মানুষ। আনছেন হতভাগা শ্রমিকদের নিথর দেহ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘটনার দিনই ভবনে নানাচাড়া তত্ত্ব প্রকাশ করে শোকাহত মানুষের মনে ক্ষোভের অনল জ্বেলে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী সাভার ট্রাজেডির মূলহোতা সোহেল রানাকে তার দলের কর্মী নয় এমনটি প্রমাণের হাস্যকর চেষ্টা চালিয়েছেন। আজ যখন স্থানীয় এমপি’র সঙ্গে রানার অন্তরঙ্গ ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে তখন হয়তো প্রধানমন্ত্রী আর কোন ব্যাখ্যা দিতে যাবেন না।

কিন্ত মন্ত্রী-এমপি আর সরকারি দলের নেতাদের এসব কথা বার্তায় মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। কোথাও কোথাও ক্ষোভ বিক্ষোভে রূপ দিচ্ছে। তবে ক্ষোভ আর বিক্ষোভের মধ্যেও আশার কেন্দ্রে এই মানুষই। সাভার ট্র্যাজেডিতে যে যোদ্ধারা মৃত্যুকূপে জীবনের জয়গান গেয়ে যাচ্ছেন তারা সাধারণ মানুষ। তাদের স্বতঃস্ফূর্ততা, উদ্যম, সাহসের কোন তুলনা হয় না। নিজে বাঁচবে কি বাঁচবে না- তা না ভেবে তারা চলে যাচ্ছেন মৃত্যু সুড়ঙ্গ বেয়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে। অবিরাম চলছে তাদের সে চেষ্টা। কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে তারা পড়ছেন পদে পদে বাধার মুখে। নেই দেয়াল ভাঙার মতো হাতুড়ি। নেই রড কাটার করাত। অক্সিজেন, এয়ার ফ্রেশনারসহ অন্য উদ্ধার সামগ্রীও পাওয়া যাচ্ছে না পর্যাপ্ত। ভবনের ধংসস্তূপে দাঁড়িয়ে প্ল্যাকার্ডে তারা এসব সামগ্রী দেয়ার চেয়ে আবেদন জানাচ্ছেন সাধারণ মানুষের প্রতি। মানুষ অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছেন দেয়ার মতো সবটুকু সামর্থ্য। হাতুড়ি, শাবল নিয়ে, অক্সিজেন সিলিন্ডার, খাবার পানি নিয়ে সাধারণ মানুষ ছুটছে সাভারের দিকে। হাসপাতাল থেকে আহত রোগীদের রক্ত ও ওষুধের প্রয়োজন জানিয়ে আহবান আসছে প্রতিনিয়ত। গণমাধ্যমেও এসব আবেদন জানানো হচ্ছে। হাজারো মানুষ মত পথ ভুলে দাঁড়চ্ছেন রক্ত দেয়ার লাইনে। নিয়ে যাচ্ছেন ওষুধও। শ’ শ’ লাশ নিয়ে যাওয়ার মতো হাতের কাছে কফিন পাচ্ছেন না স্বজনরা। সহকর্মীরা সকালে খবর দিলেন সাভারের একটি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা এ পর্যন্ত ৩০টি কফিন দিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন প্রয়োজনে আরও কফিন তারা প্রস্তত রেখেছেন। এতো আবেদন এবং অভাবের মধ্যেও আমাদের প্রিয় রাষ্ট্রটি যেন অন্ধ হয়ে আছে। নির্লিপ্ত, নির্বিকার সরকারও। এতো বড় একটি মানবিক বিপর্যয়ের ঘটনায় সরকারে কোন উদ্বেগ নেই। অনুভূতিও নেই। মানুষের চোখে জল। কিন্তু রাষ্ট্রের সবকিছু আগের মতোই চলছে। বাড়তি কোন তাড়াহুড়ো নেই। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া মানুষের জন্য যেন কোন দরদ নেই। মমতা নেই।

অথচ এই সাধারণ মানুষরাই একদিন যুদ্ধ করে, জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে এই ভূখণ্ডকে স্বাধীন করেছিল। এই মানুষই এখনও দেশের মূল স্তম্ভ। মানুষের জীবন বাঁচানো, ও অধিকার রক্ষা যেখানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব সেখানে রাষ্ট্রের পরিবর্তে এই মানুষরাই আগে এগিয়ে আসছে মানুষের জীবন বাঁচাতে। মানুষের প্রয়োজনে রাষ্ট্রটি যখন ভিক্ষুকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, ব্যর্থতার পরিচয় দেয় তখন এই মানুষই রাষ্ট্রের রক্ষক হয়ে দাঁড়ায়। যেমনটি আমরা দেখছি সাভারে।

উদ্ধার তৎপরতা নিয়ে ক্ষোভের অনেক কারণ আছে। সেখানে শুরুর দিন থেকে সেনাবাহিনীর সাধারণ চারটি ইউনিট কাজ করছে। তারা শৃঙ্খলা রক্ষা এবং উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করছেন। অন্য উদ্ধারকারীরা অভিযোগ করেছেন, সেনা সদস্যরা ভেতরে যাচ্ছেন না। হয়তো এটি শুধু অভিযোগই হতে পারে। কিন্তু অনেকে বলছেন, সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত ইঞ্জিনিয়ারিং এবং মেডিকেল কোরের সদস্যদের সেখানে পাঠানো হলো না কেন? তারাতো সেখানে তাদের প্রশিক্ষণ ও মেধা কাজে লাগাতে পারতেন। প্রশ্ন উঠছে একটি মাত্র ভবনে আটকে থাকা লোকজনকে জীবিত উদ্ধার করতে এ হিমশিম অবস্থা হলে বড় কোন বিপর্যয় হলে তখন পরিস্থিতি কেমন হবে?

এখন পর্যন্ত সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের কেউ সাভারে যাননি। শপথ নেয়ার পর প্রেসিডেন্ট সাভার গিয়েছিলেন স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে। তিনি টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারেও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। সাভার যাওয়ার পথে ধসে পড়া ওই ভবনটির পাশে তিনি এক মুহূর্তের জন্য হলেও দাঁড়াতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রীও যাননি। তার প্রতিনিধিরা যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর সেখানে না যাওয়ার পেছনে যুক্তি হলো ভিআইপি মর্যাদার কেউ সেখানে গেলে উদ্ধার তৎপরতায় বিঘœ হবে। এই যুক্তি কেউ মানছেন আবার কেউ মানছেন না। বিরোধী নেত্রী গিয়েছিলেন সাভারে। তার সে যাওয়াকেও নেতিবাচক হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে সরকারের তরফে।

রানা প্লাজায় উদ্ধার তৎপরতা চলছে। আজকের দিনটি পার হলে হয়তো জীবিত কাউকে বের করে আনার সম্ভবনা থাকবে না। মৃতদেহগুলো বের করার চেষ্টা চলবে। এর সব আয়োজনও করে রাখা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে। যতোটা আয়োজন এ কয়দিন দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

বিষয়: বিবিধ

১১৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File