জীবনের শুদ্ধতায় রমজান
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর আ ফ ম খালিদ হোসেন ২৯ জুন, ২০১৪, ০১:২৯:৫০ দুপুর
পবিত্র মাহে রমজানের এক মাস সিয়াম সাধনা মানব জীবনে শুদ্ধতা লাভের সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। মহত্তর চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন ও সত্যবোধকে জাগ্রত করার জন্য সংযম ও কৃচ্ছেন্সর ভূমিকা ব্যাপক। সাওম মানে বিরত থাকা। কুকর্ম, কুচিন্তা ও ইন্দ্রিয় পরিচর্যা পরিহার করে সংযমী হওয়াই রোজার শিক্ষা। রমজানের শাব্দিক অর্থ দগ্ধ করা। সিয়াম সাধনার উত্তাপে; ধৈর্যের অগ্নিদহনে মুসলমানমাত্রই এ মাসে কুপ্রবৃত্তিকে দগ্ধ করে শুদ্ধ পরিশোধিত মানুষে পরিণত হয়। তাই রমজানুল মুবারক দৈহিক, আত্মিক, নৈতিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধির প্রশিক্ষণের মাস। দিনে রোজা ও রাতে ইবাদতের মাধ্যমে মানুষ দেহ-মনকে পরিশুদ্ধ করতে পারে এ রমজান মাসে। পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতার জন্য সিয়াম পালিত হয়ে থাকে। সিয়াম পালিত হয় চিত্তশুদ্ধি, পরিচ্ছন্নতা, সত্যবোধ জাগ্রত রাখা, পার্থিব আকাঙ্ক্ষাকে নিবৃত্ত রাখা, বিনয় ও নম্রতা প্রতিষ্ঠা, সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যরে চেতনা উজ্জীবন সর্বোপরি মহান প্রভু আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য।
আত্মিক পরিশুদ্ধি
সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক পবিত্রতা অর্জন করে থাকে। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম আল-জাওজি বলেন, ‘মানুষের আত্মিক ও দৈহিক শক্তি সংরক্ষণে রোজা অত্যন্ত কার্যকর। এক দিকে তা মানুষের পাশবিক চাহিদার প্রাবল্য থেকে মুক্ত করে তার দৈহিক স্বাস্খ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করে, অপর দিকে তা নৈতিক উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে আত্মিক সুস্খতা সাধন করে।’ মাসব্যাপী রোজার মাধ্যমে মানুষের জৈবিক চাহিদা ও পাশব প্রবৃত্তি দুর্বল হয়ে যায়, মনুষ্যত্ব ও রূহানিয়াত সজীব ও জাগ্রত হয়। রিপুর তাড়নামুক্ত হয়ে মানুষ আল্লাহপ্রদত্ত বিবেক ও প্রজ্ঞার সদ্ব্যবহার করে সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী হতে পারে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ সৎকর্মের প্রতি ধাবিত হওয়ার প্রণোদনা লাভ করে এবং অসদুপায়ে সম্পদ পুঞ্জীভূত করার মানসিকতা লোপ পায়। আমরা সিয়াম পালনের ক্ষেত্রে চিত্তশুদ্ধির কথা বলেছি। চিত্তশুদ্ধি কাকে বলে? মানুষের চিত্ত সততই চঞ্চল। আমাদের চিত্তে নানা ধরনের ইচ্ছা জাগে এবং সেসব ইচ্ছার ভালো-মন্দ দুই-ই আছে। কিন্তু চিত্তকে শাসনে রেখে অপরাধের আগ্রহ থেকে মুক্ত রাখা অত্যন্ত কঠিন। এখন এই কঠিন কাজটি কিভাবে সাধন করতে হবে? তার একটি প্রথাগত দিকনির্দেশনা আমরা সিয়াম সাধনার মধ্যে পেয়ে থাকি। রমজানের ব্যবহারিক নিয়ম-কানুন আমরা যদি পূর্ণভাবে পালন করি তাহলে তার মধ্য দিয়ে চিত্তশাসন সহজেই কার্যকর হয়। একজন মানুষ যদি সারা দিন খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ না করে এবং সে সময়টুকুতে যদি সে মহান প্রভু আল্লাহ তায়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সর্ববিধ কার্যক্রম গ্রহণ করে তাহলে তার চিত্তে পার্থিব আকাáক্ষা জাগবে না এবং অশুদ্ধ ও বিকল চিন্তায় চিত্ত ভারাক্রান্ত হবে না।
দৈহিক পরিশুদ্ধি
অতি ভোজন স্নায়ুকোষে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে। রোজা দেহের জন্য প্রতিষেধকের কাজ করে থাকে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের গবেষণায় দেখা গেছে, উপবাসব্রতের কারণে দেহাভ্যন্তরে অ্যান্টিবায়োটিক শক্তি সৃষ্টি হয় যার মাধ্যমে বহু ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও জীবাণু মারা পড়ে। এক মাসের সিয়াম সাধনার উদ্দেশ্যে দিনের বেলা যখন পানাহার বìধ থাকে, তখন পাকস্খলী ও অন্ত্রের ঝিল্লি দেহযন্ত্র থেকে জীর্ণ পদার্থগুলোকে বের করে দেয়। সারা বছর জৈব রসজাত যে বিষ দেহে জমা হয়, সিয়ামের আগুনে তা পুড়ে বিশুদ্ধ হয়, বিষমুক্ত হয়। একজন রোজাদার রমজান মাসে তার প্রতিটি অঙ্গ বিশেষত হাত, পা, চোখ, মুখ, উদরকে অবৈধ ও গর্হিত কাজ হতে বিরত রেখে সংযমী হয়। দেহের ওপর রোজার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। ইচ্ছাশক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রেখে দৈহিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিচালিত করার শিক্ষা দেয় মাহে রমজান ।
নৈতিক পরিশুদ্ধি
যখন রমজান মাস শুরু হয়, মহান আল্লাহ জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত করে দেন, জাহান্নামের দরজা বìধ করে দেন এবং শয়তানকে শৃঙ্খলিত করে রাখেন। যার কারণে ইবাদত, জিকির, তেলাওয়াত, কৃচ্ছ্র সাধন ও আল্লাহর একনিষ্ঠ আনুগত্যের স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পানাহার ও পাপাচার ত্যাগ করলেই রোজা পালন হয় না, সেই সাথে সর্বপ্রকার অন্যায় ও পাপকাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং অন্তরকে করতে হবে পরিচ্ছন্ন, তবেই রোজা মুমিনের জীবনে নিয়ে আসবে অফুরন্ত রহমত ও বরকত। এ প্রসঙ্গে মহানবী সা: বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোজা রাখে সে যেন কোনো রকম অশ্লীলতা ও হৈ-হুল্লোড় না করে। কেউ যদি তাকে গালাগাল বা তার সাথে ঝগড়া করে সে যেন বলে আমি রোজাদার’ (বুখারি ও মুসলিম)। রোজা ধৈর্য, সংযম ও নৈতিক উৎকর্ষের জন্ম দেয়। শিষ্টাচারের মাধ্যমে নৈতিক চরিত্র গঠন রমজানের সিয়াম সাধনার একটি মৌলিক শিক্ষা।
সামাজিক পরিশুদ্ধি
শুদ্ধতার এ অমোঘ মাসটিতে সাধনায় সিদ্ধি লাভ করার সুযোগ অবারিত হয়। সিয়ামের অর্থ হচ্ছে তাকওয়ার অনুশীলন আর তাকওয়ার অনুশীলনই অপরাধমুক্ত সমাজ তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। রমজান মানুষের মধ্যে মানবিকতাবোধের উন্মেষ ঘটায়। মহানবীর ভাষায়, ‘সহমর্মিতা ও সৌহার্দ্যরে মাস মাহে রমজান ’ (বায়হাকি)। কেননা ধনী ও বিত্তশালীরা সারা দিন রোজা রেখে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জঠর জ্বালার দহন-বেদনা বুঝতে সক্ষম হন, ফলে তাদের মধ্যে সমাজের বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের প্রতি সহমর্মিতার অনুভূতি জাগ্রত হয়। রমজান মাসে দরিদ্র ও অভাবগ্রস্ত মানুষের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। মহানবী সা: বলেন, ‘হে আয়েশা, অভাবগ্রস্ত মানুষকে ফেরত দিয়ো না। একটি খেজুরকে টুকরো টুকরো করে হলেও দান করো। দরিদ্র মানুষকে ভালোবেসে কাছে টানো। কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ তোমাকে কাছে টানবেন।’ সমাজের প্রতিটি সদস্য সিয়াম সাধনার ফলে অর্জিত সহমর্মিতার শিক্ষা বছরের বাকি এগারো মাস যদি অনুশীলন করতে পারে তাহলে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়া সম্ভব। রমজান মাস এলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যসামগ্রী মজুদ করে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে অত্যধিক মুনাফা লাভের আশায়। এটা অত্যন্ত গর্হিত ও অন্যায় কাজ। মহানবী বলেছেন, ‘মজুদদার অভিশপ্ত।’
রমজানে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা প্রভৃতি অন্যায় আচরণ পরিহার করে অতি মানবীয় জীবনের দীক্ষা গ্রহণের সুযোগ লাভ করে থাকে। অতএব মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা আল্লাহ পাকের এক অপূর্ব নিয়ামত, যা অফুরন্ত কল্যাণের পথ উন্মোচিত করে।
বিষয়: বিবিধ
১৮৬৫ বার পঠিত, ৪৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাযাকাল্লাহ খাইরান...
সুন্দর, গুরুত্বপূর্ণ, প্রয়োজনীয় ও সৃজণশীল লেখাটিতে মন্তব্য গুলো পড়েছে সাদামাটা ভাবে। প্রায় মন্তব্যের ভাষা একই ও অভিন্ন! রোজার মত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে, জানিনা ব্লগারেরা নিজেদের মন্তব্য সংযোজন করতে এত কার্পন্য কেন করছেন!
যাক, তারপরও তো মন্তব্য করা হয়েছে, ভাল কাজে মন্তব্য করা উত্তম কাজের অংশীদার হওয়া সমান কথা। বিষয়টি সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করার জন্য লেখক কে আন্তরিক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন