বিভাজন নয়, জাতীয় সংহতিই এ মুহূর্তে আশু প্রয়োজন
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর আ ফ ম খালিদ হোসেন ১৬ মে, ২০১৪, ০৯:৫৭:৫২ রাত
বিশ্বের বুকে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। লাল-সবুজের নতুন পতাকা ও একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ড আমাদের জাতীয় গৌরবের স্মারক। যুদ্ধের মাধ্যমে এ দেশ অর্জিত হয়েছে, কোন চুক্তির মাধ্যমে নয়। বাংলার যে সব দামাল ছেলেরা স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনেন, গোটা জাতি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। যারা মুক্তিযুদ্ধে স্বজন হারিয়েছেন তাদের প্রতি রইল আমাদের গভীর সহানুভূতি ও আন্তরিক সমবেদনা। এ দেশের মানুষের মায়ের ভাষা বাংলা আন্তর্জাতিক মর্যাদা পেয়েছে, এটা আমাদের অহংকার। ভাষার জন্য আত্মদান অন্য কোন জাতির ইতিহাসে নেই।
বিগত ৪৪ বছরে বহুবার ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে এবং আগামীতেও হবে। অনেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হয়েছেন। ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলের পারস্পরিক অনাস্থা ও মুখোমুখী অবস্থান আমাদের হতাশ করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার জেনারেল জিয়াউর রহমান এ দেশের জাতীয় নেতা। যার যা প্রাপ্য তা তাঁকে প্রদান করতে কার্পণ্য করলে আমরা জাতি হিসেবে ছোট হয়ে যাব। সংসদে তাঁদের নিয়ে যেসব কটুক্তি করা হয় তা কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়, লজ্জাজনকও বটে। বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানের নামকরণ ও নাম অপসারণ আমাদের একটি বেদনাদায়ক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। ভিন্ন মতের প্রতি শ্রদ্ধা, পরমত সহিষ্ণুতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ‘জিরো পয়েন্টে এসে ঠেকেছে। উপরন্তু এক শ্রেণীর নেতা-নেত্রী ও তাদের পোষ্যদের দেশের সম্পদ লুটে-পুটে খাওয়ার জঘন্য মানসিকতা আমাদের কাক্সিক্ষত অগ্রগতিকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়। দুর্নীতিগ্রস্থ দেশ হিসেবে বৈশ্বিক তালিকার শীর্ষে বাংলাদেশের অভিষেকের ফলে জাতি হিসেবে আমাদের গৌরব কালিমা লিপ্ত ও আমাদের সততা প্রশ্নবিদ্ধ। দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির উর্ধে উঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। সব সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সরকারী আমলাগণ যে হারে দলীয় কর্মী হিসেবে কাজ করেছেন এবং ভিন্ন মতালম্বীদের কোনঠাসা করা হয়েছে তা জাতীয় ঐক্যের পথে বড় অন্তরায়।
সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দেশ প্রেমের ঘাটতির কারণে জাতীয় বাজেট প্রণয়ণ ও অবকাঠামো উন্নয়নে দাতাগোষ্ঠীর উপর আমাদের অনেকাংশে নির্ভরশীল থাকতে হয়। ২০০৮-৯ অর্থ বছরে বৈদেশিক অনুদান, সাহায্য ও ঋণের পরিমান ১৯৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বর্তমানে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমান দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৩১২ টাকা ৪০ পয়সা (১৪৭ ডলার ৩২ সেন্ট) যার ফলশ্র“তিতে সরকার পরিচালনা, জাতীয় নীতি নির্ধারণ, সামগ্রিক উন্নয়ন বিশেষতঃ সার, বিদ্যুৎ, গ্যাস, তেল, কয়লা, পরিবহনসহ প্রায় প্রত্যেকটি সেক্টরে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (International Monitory Fund) , এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন নির্দেশনা (Dictation) দিয়ে থাকে; যা অনেক সময় অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৭১/৭২ থেকে ২০০৬/০৭ সাল পর্যন্ত আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) থেকে সাহায্য নিয়েছি ১৪২৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে মন্তব্য করেছে তা রীতিমত আপত্তিকর। সরকারকে পাশ কাটিয়ে বিদেশী রাষ্ট্রসমূহ এন.জি.ও দের যে হারে আর্থিক যোগান দিয়ে চলেছে তাতে সমান্তরাল সরকার (Parallel Govt.) কায়েম হতে পারে ভবিষ্যতে। এ আশংকা অমূলক নয়। এ ব্যাপারে সরকারের সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।
স্বাধীনতার চারদশকেও আমরা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে স্বনির্ভর হতে পারিনি অথচ আমাদের একই সময় অথবা আগে পরে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার বহুদেশ আজ শনৈঃ শনৈঃ আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। মালদ্বীপ (১৯৬৫), ভিয়েতনাম (১৯৭৬), সিঙ্গাপুর (১৯৬৫) এবং ব্র“নাই (১৯৮৪) স্বাধীনতা অর্জন করে ইতোমধ্যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। দেশেপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে মেরুদন্ড সোজা করে আমাদেরকেও ঘুরে দাঁড়াতে হবে আবার। ন্যালসন ম্যান্ডেলা, ফিদেল ক্যাষ্ট্রো ও মাহাথির মোহাম্মদ এর মত নেতার প্রয়োজন আজ বড্ড বেশী। “মুক্তিযুদ্ধের চেতনা” মানে জনগণের মধ্যে সংঘাত ও বিভেদ সৃষ্টি নয়; বরং নানা মত ও পথে মানুষের মধ্যে সংহতি সৃষ্টির অব্যাহত প্রয়াস। স্বাধীনতার ৪৪বছর পর কে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, কে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি; এভাবে বিভাজন আমাদের জাতীয় ঐক্য ও সংহতিকে দুর্বল করে দেবে। এ কথা আমাদের মনে রাখতে হবে নিছক রাজনৈতিক স্বার্থে কোন ব্যক্তি বিশেষ বা দল বিশেষকে হয়রানি, ক্ষতিগ্রস্থ বা হেয় প্রতিপন্ন করা হলে তা সংঘাত ও জিঘাংসা মনোবৃত্তি সৃষ্টি করবে। হিংসা প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য সামাজিক সংহতি ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা অপরিহার্য পূর্বশর্ত।
নানা কারণে বাংলাদেশে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে শিল্প ও বানিজ্য নির্ভর কল-কারখানা বেশী গড়ে উঠেনি। পুরনো অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সীমাহীন দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ফলে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া রাস্ট্রায়ত্ব প্রায় সব শিল্প-কারখানায় জ্বলছে লাল বাতি। সরকারকে জরুরী ভিত্তিতে নতুন গ্যাস ফিল্ড আবিস্কার, বিদ্যুত প্লান্ট স্থাপন, অবকাঠামো নির্মাণ, সড়ক উন্নয়ন ও দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে। ইতোমধ্যে বিদেশে জনশক্তি রপ্তানী হৃাস পেয়েছে। সরকারের কার্যকর উদ্যোগের অভাবে ২০০৭ হতে ২০০৯ অর্থ বছরে ৪ লাখ প্রবাসী কর্মজীবি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে রেমিট্যান্সে ভাটার টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আসুন দল-মত-পথ নির্বিশেষে আমরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে মেধা, শ্রম, সেবা ও ত্যাগ দিয়ে গড়ে তুলি; এগিয়ে নিয়ে যাই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে। শত্রু-মিত্রকে ক্ষমা ও উদারতার বাহু ডোরে বেঁধে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করি।
বিষয়: বিবিধ
১৪২১ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সহমত
দেশপ্রেমের যতই নসীহত এদেরকে করাহোক এরা দেশের সম্পদ চুরি করা ত্যাগ করবে না।
ভাল মানুষের শাসন ছাড়া দুর্নীতি বন্ধ হবে না। ভাল মানুষ তৈরি করতে হলে ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া সম্ভব নয়। এরা একারণেই ধর্মীয় শিক্ষা সংকুচনের কথা বলে যেন কেও আর তাদেরকে চুরি করা থেকে বিরত থাকার নসিহত না করে। ধর্মীয় শিক্ষায় বাঁধা দেয়ার পেছনের উদ্দেশ্যও সেই একই। দেশ ধ্বংস করা। ধর্ম মানুষকে দুর্নীতি থেকে বিরত রাখে, তাই দুর্নীতিবাজরা ধর্মীয় শিক্ষার বিরোধিতা করে।
দেশপ্রেমিক ও ধর্মপ্রেমিক মানুষের হাতে যত দিন ক্ষমতা না আসবে তত দিন দেশে শান্তি আসবে না।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর লেখার জন্য। যাজাকাল্লাহু খায়রান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন