প্রসঙ্গ: “ফতোয়া ও গ্রাম্য সালিশ”, প্রয়োজন উলামা-মাশায়েখদের সমন্বিত পদক্ষেপ
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর আ ফ ম খালিদ হোসেন ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৯:৫৫:৩৭ রাত
আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অসামাজিক ও নৈতিকতাবিরোধী কর্মকাণ্ডকে কেন্দ্র করে গ্রাম্য মাতব্বর এবং সালিশকারীদের সিদ্ধান্তকে ‘ফতোয়া’ ও শাস্তিকে ‘দোররা’ হিসেবে অভিহিত করে প্রতিনিয়ত এসব কর্মকাণ্ডকে ‘ফতোয়াবাজি’ বলে প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। গ্রামের যেসব লোক সালিশ করে বেত্রাঘাতের মাধ্যমে শাস্তি কার্যকর করছে, তারা কেউ ইসলামী আইনে পারদর্শী ‘মুফতি’ নন। তাদের প্রদত্ত রায় কোনোক্রমে ‘ফতোয়া’ নয়। ফিকহে ইসলামীর মৌলিক নীতিমালা সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। তারা যা করছে তা প্রচলিত সামাজিক রীতি-প্রথার (Convention of the society) আওতায় পড়তে পারে, ধর্মের আওতায় নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রাম্য সালিশে মানসিক ও দৈহিক শাস্তি মেয়েদের প্রদান করা হয়, তাকে একঘরে করা হয় আর ছেলেকে করা হয় আর্থিক জরিমানা। এটাও ইসলামী ইনসাফের পরিপন্থী। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে প্রদত্ত সালিশি বিচারের নামে এসব রায়, সিদ্ধান্ত ও দন্ড প্রয়োগ শরিয়াহ আইনের পরিপন্থী এবং বিচারবহির্ভূত এসব কার্যক্রম কোনোভাবেই বরদাশত করা উচিত নয়। কোনো সভ্য সমাজে এটা চলতে পারে না।
ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত থাকলে ‘মুফতি’ কুরআন, হাদিস, ইজমা, কিয়াস, ইশতেহসানের ভিত্তিতে যে কোনো সমস্যার শরয়ী ব্যাখ্যা দেবেন। প্রদত্ত ব্যাখ্যাকে ভিত্তি ধরে রাষ্ট্র কর্তৃক নির্ধারিত উপযুক্ত আদালতের (Competent Court) বিচারক (কাজী) বাদী-বিবাদী-সাক্ষীর বক্তব্য, আসামির স্বীকারোক্তি, জেরা-জবানবন্দি, তদন্ত প্রতিবেদন ও Circumstantial evidence গ্রহণ করে নিরপেক্ষ রায় প্রদান করবেন এবং প্রশাসন আদালতের রায় কার্যকর করবে। সাজা ও ভীতি প্রদর্শনমূলক শাস্তি (হুদুদ ও তাজিরাত) কার্যকর দায়িত্ব সরকারের নির্দিষ্ট বিভাগের। ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কোনো ব্যক্তির পক্ষে শরয়ী শাস্তির বিধান কার্যকর করার সুযোগও নেই, আইনও নেই।এটা তার এখতিয়ার বহির্ভূত। ফতোয়া প্রদান করা মুফতিদের ধর্মীয় অধিকার। জোর করে এ অধিকার হরণ করা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। বাংলাদেশের প্রায় কওমী ও আলিয়া মাদরাসায় স্বতন্ত্র ফতোয়া বিভাগ আছে। পারদর্শী মুফতিরা হাতে-কলমে শিক্ষার্থীদের ‘শরিয়াহ আইন’ সম্পর্কে বিস্তারিত পাঠদান করে থাকেন। যুগ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের ব্যক্তি, পারিবারিক ও সামষ্টিক জীবনে নানা সমস্যা দেখা দেয়—এগুলোর শরয়ী ব্যাখ্যা ও সমাধান মানুষ জানতে আগ্রহী। যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞ মুফতিরা এ দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পরিচ্ছন্নতা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, চাঁদ দেখা, বিয়ে, তালাক, খোরপোশ, ইদ্দত, সম্পত্তির উত্তরাধিকার, দেনমোহর প্রভৃতি বিষয়ে উদ্ভূত সমস্যা বা মাসয়ালার শরয়ী ব্যাখ্যা ও সমাধান দেয়ার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ (Competent Authority) হচ্ছেন মুফতিরা। এসব আদালতের কাজ নয়। আদালতের পক্ষে ইসলামী শরিয়তের জটিল মাসায়েলগুলোর ব্যাখ্যা দেয়া সঙ্গত কারণে সম্ভব নয়। আদালতের মূল কাজ হচ্ছে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। এসব মাসয়ালা-মাসায়েলের জবাব দিতে গেলে বিচার কার্যক্রম ব্যাহত হবে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অনেক সময় হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, মুসলিম পারিবারিক বিষয়াবলীতে শরিয়াহের বিধিবদ্ধ বিধান (Islamic Legal Codes) অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক। বিধিবদ্ধ বিধানে স্পষ্ট নয় অথবা দ্বৈততা আছে অথবা ভিন্ন ভিন্ন মত আছে এমন সব ব্যাপারে বিজ্ঞ বিচারক বিজ্ঞ মুফতিদের আদালতে তলব করে শরয়ী ব্যাখ্যা জানতে চান। প্রদত্ত ব্যাখার আলোকে বিজ্ঞ বিচারক রায় ঘোষণা করেন। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এরকম বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। তখন বিচারকের কাছাকাছি ইসলামী আইনে পারদর্শী জুরি বোর্ডের সদস্যরাও আদালতে বসতেন। বাংলাদেশেও এরকম ঘটনার নজির আছে। তালাকপ্রাপ্ত নারী সাবেক স্বামীর কাছ থেকে কত দিন খোরপোশ পাওয়ার দাবিদার এ সম্পর্কিত একটি মামলায় জেলা জজ আদালত ও হাইকোর্টের বিজ্ঞ বিচারকরা পরস্পরবিরোধী রায় দিলে সুপ্রিমকোর্ট বায়তুল মোকাররমের সাবেক খতিব মাওলানা উবায়দুল হক (রহ.) ও মাসিক মদীনার সম্পাদক মাওলানা মুহীউদ্দীন খানকে আদালতে তলব করে এ ব্যাপারে শরিয়তের ব্যাখ্যা জানতে চান। তাদের প্রদত্ত ব্যাখ্যার আলোকে বিজ্ঞ বিচারক রায় ঘোষণা করেন যে, তালাকপ্রাপ্ত মহিলা ইদ্দত চলাকালীন সাবেক স্বামীর পক্ষ থেকে কাবিননামায় বর্ণিত হারে যথাযথ খোরপোশ পাবেন।
ভারতের প্রায় প্রতিটি অঙ্গরাজ্যে সরকারের অনুমোদনক্রমে শরিয়াহ আইনে বিশেষজ্ঞ মুফতিদের সমন্বয়ে ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড’ রয়েছে। বোর্ডের রায় আদালতের কাছে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য। কেন্দ্রীয় ‘মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড’-এর এক সময় চেয়ারম্যান ছিলেন বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)।
এরই মধ্যে বাংলাদেশ হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ফতোয়ার নামে সংঘটিত সব ধরনের বিচারবহির্ভূত কর্মকাণ্ডকে অবৈধ ও ফৌজদারি অপরাধ বলে ঘোষণা করেছেন। আদালত একই সঙ্গে রায়ে বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি ফতোয়া জারি করে এবং তার মাধ্যমে কোনো ব্যক্তিকে শাস্তি দেয় তাহলে তা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। এছাড়া যারা ফতোয়া জারি করে ও শাস্তি দেয়ার মতো বিচারবহির্ভূত কাজে সহযোগিতা করবেন তারাও একই দোষে দোষী হিসেবে সমপরিমাণ শাস্তি পাবেন। হাইকোর্টের রায়ে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে, ফতোয়া একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিচারবহির্ভূত শাস্তি প্রদান অবৈধ ও ফৌজদারি অপরাধ বলে আদালতের রুলিংয়ের ক্ষেত্রে কারও দ্বিমত নেই। হাইকোর্টের রায়ে আলিম ওলামাগণ প্রচন্ডভাবে বিরোধিতা করেন। এর পেছনে যৌক্তিক কারণ রয়েছে। ফতোয়া যদি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হয়ে থাকে তা হলে শরিয়াহ আইন (ফিকহে ইসলামী) শিক্ষা, অনুশীলন ও চর্চার কাঠামো ভেঙে পড়বে। বাংলাদেশে যেসব মাদরাসা ও গবেষণা কেন্দ্রে হাতে-কলমে ইফতা পড়ানো হয় তা বেআইনি হয়ে যাবে এবং যুগে যুগে প্রাজ্ঞ ইমামদের লিখিত ফতোয়ার বিপুল আয়তনের গ্রন্থাবলি নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
অবশ্য পরবর্তী সময়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিজ্ঞ বেঞ্চ ফতোয়া দেয়ার অধিকার মুফতিদের রয়েছে বলে রায় প্রদান করেন।
অনেক সময় মাসয়ালা ও জটিল সমস্যার বর্ণনা, পারিপার্শিক অবস্থা, সাক্ষীর বক্তব্যের অসঙ্গতির কারণে মুফতিরা একই মাসয়ালার ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। অনেক সময় প্রাজ্ঞ ইমামদের ইখতিলাফের কারণেও ব্যাখ্যা ভিন্ন হতে পারে। এ অসঙ্গতি দূর করার জন্য আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনায় ইসলামী আইনে বিশেষজ্ঞ আলিমদের নিয়ে একটি শক্তিশালী ‘কেন্দ্রীয় ফতোয়া বোর্ড’ গঠন করা হোক। এ বোর্ডের প্রধান দেশের ‘গ্র্যান্ড মুফতি’ অভিধায় ভূষিত হবেন। বোর্ডের আওতায় জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় বিজ্ঞ আলিমদের নিয়ে ‘ফতোয়া বোর্ড’ থাকবে। বোর্ড প্রদত্ত ফতোয়া রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য হবে। বড় বড় মাদরাসায় বা ইসলামী গবেষণাকেন্দ্রিক ইফতা বিভাগ আছে এবং শিক্ষার্থীরা নিয়মিত শরিয়াহ আইনের ওপর গবেষণা করেন তাদের প্রদত্ত ফতোয়াও সহিহ বলে বিবেচিত হবে। ফতোয়ার ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা দিলে ‘কেন্দ্রীয় ফতোয়া বোর্ড’-এর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। এর বাইরে ইসলামী আইনের ব্যাখ্যা দেয়ার মতো কোনো অথরিটি না থাকা বাঞ্ছনীয়। তা হলে গ্রামগঞ্জে যেসব মোড়ল-মাতব্বর সালিশি রায় দিয়ে তা কার্যকর করছে, সে প্র্যাকটিস বন্ধ হয়ে যাবে। সৌদি আরব সরকার সম্প্রতি এমন একটি নির্দেশনা জারি করে।
যেসব ফতোয়ার সঙ্গে সাজা, দণ্ড, প্রশাসনিক ও বিচারিক কর্মকাণ্ড বিজড়িত সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞ মুফতিরা অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করবেন। আমাদের মনে রাখতে হবে, মুফতিরা বিচার করার ও দণ্ড কার্যকর করার বৈধ কর্তৃপক্ষ নন। এ দায়িত্ব আদালতের ও প্রশাসনের।
একশ্রেণীর সংবাদপত্র ও এনজিও চক্র যে হারে গ্রাম্য সালিশ এবং শাস্তিকে ‘ফতোয়া’ ‘ফতোয়াবাজি’ ও ‘দোররা’ বলে অভিহিত করে সাধারণ মানুষের অন্তরে ইসলামী অনুশাসন এবং বিধিবিধানের প্রতি ভীতি ও অশ্রদ্ধার জন্ম দিচ্ছে, তাতে আমরা শঙ্কিত না হয়ে পারি না। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অনৈতিক যৌন সম্পর্কে যারা জড়িয়ে পড়ছে বা পরকীয়া প্রেমে যারা আসক্ত তাদের ব্যাপারে বিদ্যমান আইনের ধারাকে আরও কঠোর করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। অন্যথায় সামাজিক স্থিতি ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, অনৈতিক যৌন সম্পর্ক গড়া বা পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়া কোন দোষের নয়। মুরব্বি বা সালিশকারগণ পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলার স্বার্থে কোন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে গেলেই হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়।
স্মর্তব্য যে, পারিবারিক ও সামাজিক শৃঙ্খলার স্বার্থে শরিয়াহ আইন অপরাধীর প্রতি কঠোর। অপরাধের মাত্রানুযায়ী দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা শরিয়াহ আইনের বৈশিষ্ট্য, যাতে অপরাধের উত্সমূল বন্ধ হয়ে যায়। কারণ অপরাধ অপরাধের জন্ম দেয়।
আমরা আবারও বলছি, শরিয়াহ আইন কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের। শরিয়াহ আইন ব্যাখ্যা করবেন বিজ্ঞ মুফতিরা। শরিয়াহ আইনের অনুপস্থিতিতে প্রচলিত দেশীয় আইন মেনে চলতে জনগণ বাধ্য। সুতরাং আলিম, উলামা, মাশায়েখ ও মুফতিদের সমন্বিত কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, সংলাপ, আলোচনা সভার মাধ্যমে ‘ফতোয়া’ ও ‘দোররা’র সঠিক তথ্য এবং অবস্থান জনগণের কাছে তুলে ধরা দরকার। প্রয়োজনে উচ্চ আদালতের বিচারক, সিনিয়র আইনজীবী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিজ্ঞ আলিম ও মুফতিদের মতবিনিময় হতে পারে।
বিষয়: বিবিধ
২৩২৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন