“স্মৃতিচিত্রে খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রহ.” --মাওলানা আতাউর রহমান খান (রহ.)
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর আ ফ ম খালিদ হোসেন ০২ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ১২:৪৭:০৭ রাত
পূর্ববর্তী ওলামা ও মাশায়েখদের স্মৃতিচারণের মধ্যে আমি মানসিক শান্তি পাই। বর্তমানের বিতৃষ্ণা আমাকে অতীতের সোনালি দিনগুলোর প্রতি আকৃষ্ট করে; কী ছিল আর কী হলো ? অতীত ও বর্তমানের আকাশ পাতাল ব্যবধান আমাকে সব সময় পীড়া দেয়। আসলে আমি এখন অতীত ও বর্তমানের মাঝামাঝি সন্ধিক্ষণে অবস্থান করছি। এ দু’য়ের মাঝে কোনভাবেই সামঞ্জস্য বিধান করতে পারছি না; ফলে পীড়াদায়ক টানাপোড়েনে পড়ে মনোকষ্টে ভুগছি।
পূর্ববর্তী মুরব্বীগণ ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা ও কাজে-কর্মে যে পরিমাণ সমৃদ্ধ ছিলেন আমরা এখন সে পরিমাণ অধঃপতিত। তারা দান করে শান্তি পেতেন, আমরা না দিয়ে শান্তি পাই; তারা উদার হয়ে ভালো থাকতেন, আমরা সংকীর্ণ ও সংকুচিত হয়ে আরাম পাই; তারা গুণীর প্রশংসা করে তৃপ্তি পেতেন, আমরা নিন্দা করে স্বস্তি পাই; তারা যোগ্যকে উপরে উঠিয়ে গর্ববোধ করতেন, আমরা দাবিয়ে দিয়ে আত্মতুষ্টি লাভ করি; তারা ইলমী আলোচনায় স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন, আমরা ইলমী আলোচনায় অস্বস্তিবোধ করি; তারা যে কোন দ্বীনি কাজকে ‘খিদমত’ মনে করতেন, আমরা একে জীবিকার অবলম্বন গণ্য করি; তারা একটা মাদ্রাসার দায়িত্বকে কঠিন আমানত মনে করতেন, আমরা একে অধিকার মনে করি; তাদের জ্ঞানে ছিল গভীরতা, আমাদের জ্ঞান ভাসা ভাসা এক ধরনের ফ্যাশন; ইবাদত বন্দেগীতে তারা ছিলেন কঠোর সাধক, আর আমরা দায়সার গোছের চাকুরে। মোটকথা, সর্বক্ষেত্রেই অতীত ও বর্তমানের ব্যবধান যে কোন অনুভূতিশীল সচেতন হৃদয়কে পীড়া না দিয়ে পারে না। আমি দু’কালের মধ্যবর্তী অবস্থানে পতিত হয়ে উভয় কালের পার্থক্যটা উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছি বলেই মানসিক যন্ত্রণায় ভুগি; আগে কী দেখলাম আর এখন কী দেখি! বিস্ময়ে হতবাক হওয়া ছাড়া করার কিছু নেই।
হযরত মাওলানার নির্দেশনা মোতাবেক সবার সাথে আমি সম্পর্ক স্থাপন করেছি এবং তাদের থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করেছি। বক্ষ্যমান নিবন্ধে খতিবে আযম আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.) সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে আলোচনা করার প্রয়াস পাব।
বহু বছর আগের কথা; কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়ার তখন আমি ছাত্র। মাদ্রাসার বার্ষিক সম্মেলনে ওয়াজ করার জন্য প্রধান মেহমান হিসেবে খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.)-কে দাওয়াত করা হলো। আগে তাকে কখনো দেখিনি। যথাসময়ে আমরা কয়েকজন রেল স্টেশনে গেলাম তাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। যাত্রীদের সাথে আমাদের কাক্সিক্ষত মেহমানও নামলেন কিন্তু পূর্ব পরিচিত না হওয়ায় তাকে প্রথমে চিনতে একটু অসুবিধা হলো। অনেকটা অনুমানের উপর নির্ভর করেই তাকে চিনতে হয়েছিল আমাদের। তার সাদাসিধে লেবাস পোষাক ও অনাড়ম্বরতা আমাদেরকে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছিল। সহজ সরল, নিরহংকার, ভাবলেশহীন, মাটির মানুষ খতীবে আযমকে আমরা পূর্ণ মর্যাদায় বরণ করে নিয়েছিলাম।
বিকেলে বিশাল মাহফিলে তার বয়ান যখন শুরু হলো, শত শত উলামা ও হাজার হাজার জনতা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তার অসাধারণ যাদুকরী বয়ান শুনে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন। সে দিনের দৃশ্য ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এমন ধারার বয়ান জীবনেও শুনিনি। তার বয়ানের ধরনই ছিল আলাদা। কিশোরঞ্জবাসীকে পাগল করে দিয়েছিল সেদিনের তার দার্শনিক বয়ান। আল কোরআন যে আল্লাহপাকের কালাম; এর অন্তর্নিহিত জ্ঞান ও তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য যে নজীরবিহীন, এর ভাষাশৈলী ও উপস্থাপনা কৌশল যে অনন্য, এর থেকে উপকৃত হতে হলে কী ধরনের মন-মনসিকতা ও অনুধাবন প্রতিভার প্রয়োজন, বিরুদ্ধবাদীদের সন্দেহ-সংশয় দূরীকরণে যুক্তিতর্কের বলিষ্ঠ অবতারণাসহ আনুষঙ্গিক সব বিষয় সংবলিত তার অশ্রুতপূর্ব বয়ান আজও প্রবীণরা স্মরণ করে থাকেন। তার সেদিনের বয়ান আমার জীবনে এত গভীরে রেখাপাত করেছিল যা আমার দর্শনসুলভ চিন্তা-ভাবনার বিনির্মাণে অপরিসীম অবদান রেখেছে। আমি এজন্য তার কাছে চির ঋণী। এরপর আমি তাকে বহুবার বহু জায়গায় দেখেছি। তার সাথে অনেক সফর করেছি। পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রোগ্রাম করেছি। রাজনীতি ও শিক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি কিশোরগঞ্জেও বহুবার এসেছেন। তার মূল্যবান গুরুত্বপূর্ণ বহু বয়ান শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। তার সম্পর্কে আমার বিশ্বাস জন্মেছিল যে, যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আল্লাহ তার অন্তরে ইলমে লাদুনীর স্রোতধারা প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন। রাজনীতির ধারাবাহিকতার এক পর্যায়ে তিনি নিখিল পাকিস্তান জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে সভা সম্মেলনে উর্দু ভাষায় বয়ান দিয়েছেন। তার বয়ান শুনে ঐ অঞ্চলের উলামায়ে কেরামগণ অবাক বিস্মিত হয়েছেন। পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলেও যে বড় মাপের আলেম আছেন, গভীর জ্ঞানের অধিকারী সুপ-িত ইলমী ব্যক্তিত্ব আছেন তা দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করেছেন, যা ইতোপূর্বে তারা মনে করতে পারতেন না।
‘খতিবে আযম’ উপাধিটা তার ন্যায্য পাওনা, যা তিনি যথাসময়ে পেয়েছেন। তিনি একজন বলিষ্ঠ চিন্তাবিদ ছিলেন। যুগের চাহিদা অনুধাবন করে এর চাহিদা পূরণে সক্ষম কালজয়ী প্রতিভা সম্পন্ন আলিম সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে পেরেই তিনি কওমী মাদ্রাসার নেসাবে যুক্তিসঙ্গত পরিবর্তন-পরিবর্ধন, সংযোজন-বিয়োজনের মাধ্যমে সংস্কার সাধনের রূপরেখা উপস্থাপন করে তা বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছিলেন। আল্লামা ইউসুফ বিন্নোরী (রহ.), আল্লামা নুর মুহাম্মদ আযমী (রহ.) ও খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর পেশকৃত সংস্কার ফর্মুলার অনুসরণে অতি সহজেই কওমী মাদ্রাসার নেসাব সংশোধন করা যেতে পরে। আমরা সবাই বিষয়টির প্রতি মনযোগী হলে পূর্বসূরীদের চিন্তা-ভাবনার যথার্থ মূল্যায়ন করতে সক্ষম হবো। জাতির জন্য খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.) অনেক দিকনির্দেশনা রেখে গেছেন। আমরা আমাদের ত্রুটি ও অযোগ্যতার কারণে উপকরণ দ্বারা কোন কাজ নিতে পারছি না। এক্ষেত্রে আমি নেতৃস্থানীয় উলামায়ে কেরামের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই, উপমহাদেশের আকাবেরীন বুযুর্গানের রেখে যাওয়া বিভিন্ন অবদানের উপর গবেষণা ও এর থেকে আমাদের বাস্তব জীবনের সমস্যাবলীর সমাধান বের করার লক্ষ্যে একটি উচ্চ পর্যায়ের ‘গবেষণা একাডেমী’ গঠন করার উদ্যোগ নিলে অতীতের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া বহু মূল্যবান সম্পদের সদ্ব্যবহার করতে পারতাম। পূর্ববর্তীদেরকে ভুলে যাওয়া পরবর্তীদের ধ্বংসের কারণ হয়ে যায়, একথা স্মরণ রাখা দরকার।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য, সাবেক প্রিন্সিপাল, ফরিদাবাদ মাদ্রাসা, ঢাকা।
http://www.dailyinqilab.com/archive_details.php?id=130121&&%20page_id=%2069&issue_date=%202013-09-01#.UiOKCH-UkRQ
বিষয়: বিবিধ
২১৩১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন