“খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রাহ.) : একজন অসাধারণ মুফাসসির ও বহুমাত্রিকতায় যুগশ্রেষ্ঠ আলিম” --আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী (দা.বা.)
লিখেছেন লিখেছেন ডক্টর আ ফ ম খালিদ হোসেন ৩০ আগস্ট, ২০১৩, ০৯:০৪:৪০ রাত
মহান আল্লাহ তায়ালা খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর মাঝে এতো বিপুল গুণ, বৈশিষ্ট্য, মেধা-প্রতিভা, ধীশক্তি, জ্ঞানগভীরতা এককথায় বহুমাত্রিক যোগ্যতার সমাহার ঘটেছিলেন যা প্রকৃতই অপার বিস্ময়ের। বর্ণনা দিয়ে তাঁর পরিচয়ের পূর্ণাঙ্গ চিত্রায়ণ সহজসাধ্য নয়। বিশেষভাবে যে কথাটি আমি প্রথমে উল্লেখ করতে চাই তা হলো তিনি এতো বড় ব্যক্তিত্বরূপে গড়ে উঠার নেপথ্য বড় একটি কার্যকারণ হলো আপন উস্তাদ, শীর্ষস্থানীয় অলি-আউলিয়া ও বুযুর্গদের বিশেষ সুদৃষ্টি বা তাওয়াজ্জুহ। বিশেষত, এ ক্ষেত্রে দারুল উলূম হাটহাজারীর প্রতিষ্ঠাতা, দেশের অন্যতম শীর্ষ আলিম ও বুযুর্গ ব্যক্তিত্ব হযরত আল্লামা হাবিবুল্লাহ সাহেবের কথা প্রণিধানযোগ্য। যৌবনে যখন খতিব আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.) দারুল উলূম হাটহাজারীর বার্ষিক মাহফিলে বয়ান শুরু করতেন তার উস্তাদ হযরত মাওলানা হাবিবুল্লাহ (রহ.) আড়ালে-আবডালে দাঁড়িয়ে থাকতেন; যখন বয়ানের গতিপ্রবাহ তুঙ্গে উঠে যেতো তিনি অকস্মাৎ নীরবে সরে যেতেন। একইভাবে তিনি বাংলাদেশের আরেকজন শীর্ষ বুযুর্গ, সমাজসংস্কারক ও উঁচুমাপের আলিম মুফতিয়ে আযম হযরত আল্লামা মুফতি ফয়েজুল্লাহ (রহ.)-এর সান্নিধ্য ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছিলেন। তাঁদের পরস্পরের মধ্যে চমৎকার হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল। তিনি দরসে নেজামীভূক্ত ‘মাইবুজী-এর মতো জটিল কিতাব মুফতি ফয়েজুল্লাহ (রহ.) (বড় মুফতি সাহেব) এর কাছে শ্রেণীকক্ষে নয় পথে পথে পূর্ণ পাঠ গ্রহণ করেছিলেন।
তিনি যখন ভারতের সাহারানপুরে দেশটির বিখ্যাত ও অন্যতম বৃহৎ দীনি প্রতিষ্ঠান মোযাহের উলূমে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছিলেন পরীক্ষক তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমাকে ‘কাযী মোবারক’ গ্রন্থটি কে পড়িয়েছেন ? উত্তরে তিনি বললেন, মুফতি ফয়েজুল্লাহ (রহ.)। জবাব শুনে পরীক্ষক বললেন, তোমার উস্তাদ তো কিতাবটির গ্রন্থকারের চেয়েও অধিক পাণ্ডিত্যের অধিকারী!’ তাঁর প্রবাদপ্রতীম মেধার সাক্ষর হিসেবে দারুল উলূম দেওবন্দে ‘মুখতাসারুল মাআনী’ বিষয়ের পরীক্ষার খাতাটি এখনো সংরক্ষিত রয়েছে।
জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ তো ছিলই; বিশেষত, তাফসীর ও হাদিসশাস্ত্রের তার উচ্চতর দক্ষতা ও বিরলপ্রতিভা বস্তুত, ‘ইলমে লাদুন্নী’ (আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ জ্ঞান) এর সুস্পষ্ট অভিপ্রকাশ। অর্জিত জ্ঞানের সঙ্গে যার বিরাট তফাৎ থাকে। তিনি পবিত্র কুরআনের যে তাফসীর করতেন তা পৃথিবীর কোনো তাফসীরে পাওয়া যেত না কিন্তু জ্ঞানবান ও বিশেষজ্ঞ আলিমদের কাছে বরাবরই এর হৃদয়গ্রাহী আবেদন ছিল ব্যাপক। শ্রোতৃমণ্ডলী খুব সহজেই তা অনুধাবন এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করতো। একই সঙ্গে অন্যান্য তাফসীরের সঙ্গে তার তাফসীরের কোনো বৈপরিত্যও ছিল না। মান বিচারে তাঁর তাফসীর বিশ্ববিখ্যাত তাফসীরসমূহের সমপর্যায়ের ছিল। এটা কোনো সাধারণ স্তরের আলিমের পক্ষে আদৌ সম্ভবপর নয়। তার চির প্রতিদ্বন্ধী ও দীর্ঘদিনের সহপাঠী ‘শেরে বাংলা’ খ্যাত মাওলানা আজিজুল হক পর্যন্ত জ্ঞানের রাজ্যে তাঁর আকাশচারিতা আর বিরল প্রতিভার উচ্ছ্বসিত ও সপ্রশংস স্বীকৃতি দিয়েছেন। একবার দেশে কোনো এক অঞ্চলে কাদিয়ানী মতবাদ সম্পর্কে অনুষ্ঠিতব্য এক বিতর্কে বিতার্কিক হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব করলে তিনি বলেছিলেন, ‘এটা আমার কাজ নয়; চকরিয়া বরইতলীর মাওলানা ছিদ্দিক আহমদের কাজ। তাকে দাওয়াত কর।’ প্রতিপক্ষকে জব্দ করার ক্ষেত্রে তিনি যথোপযুক্ত ব্যক্তি।
এদেশের মানুষ তাঁর মুল্যায়ন করেনি :
যদি খতিবে আযম হযরত মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর ওয়ায়, বয়ান, বক্তৃতা, বিতর্ক, আলোচনাগুলো যত্নের সঙ্গে লিপিবদ্ধ করে গ্রন্থিত করা গেলে তা হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) ও শায়খুল ইসলাম আল্লামা কারী তৈয়্যব (রহ.)-এর গ্রন্থ ও রচনাবলির সমপর্যায়ে পরিগণিত হতো। কিন্তু অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও পরিতাপের বিষয় হলো, এদেশের মানুষ তাঁর মূল্যায়ন করেনি। বয়ান-বক্তৃতা লিপিবদ্ধ করা হলে তা জ্ঞানভান্ডারের অমূল্য সম্পদ বিবেচিত হতো। এই অবহেলা আমাদের জাতীয় জীবনে ক্রমাগত শূন্যতার সৃষ্টি করেছে।
দারুল উলূম হাটহাজারীতে তাফসীর ও হাদিসগবেষণার দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব
একবার তিনি কোনো রাজনৈতিক জনসভা শেষে তাঁর দারুল হাটহাজারীতে পৌঁছলে জামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হযরত আল্লামা হাবিবুল্লাহ সাহেব বললেন, আপনি অনেক রাজনীতি, সভা-সমাবেশ, বয়ান-বক্তৃতা করেছেন এবার তাফসীর ও হাদিস গবেষণায় মনোনিবেশ করুন। আমি দারুল উলুম হাটহাজারীতে একটি গবেষণাগারের যাবতীয় সুবন্দোবস্ত করে দেবো। সব ধরনের সুযোগ সুবিধের ব্যবস্থা থাকবে। আপনি তাফসীর ও হাদিস বিষয়ে গবেষণা এবং গ্রন্থ রচনা হাত দিন। আপনার তাফসীর হবে পৃথিবীর অন্যতম বিরল ও গবেষণাধর্মী তাফসীর। এটি হবে জাতির জন্য বড় ধরনের আরেকটি খেদমত। এ কাজের জন্য আপনাকে আমি অত্যন্ত উপযুক্ত বিবেচনা করছি। সেদিন খতিবে আযম সম্মতি দিলেও শেষ পর্যন্ত তার পক্ষে জীবদ্দশায় সে মহান কাজটি সম্পাদনের সুযোগ হয়ে উঠেনি। ফলে এদেশের মানুষ বিশ্বমানের তাফসীর ও হাদিসগবেষণা কর্মের সুফল থেকে বঞ্চিত হয়। তবে তিনি সারাজীবন তাঁর বয়ান-ওয়ায-বক্তৃতায় কুরআন সুন্নাহর আলোকে জীবন গড়ার জন্য মানুষ উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি নিজেকে দারুল উলুম হাটহাজারীর একজন শক্তিমান মুখপাত্র রূপেই উপস্থাপন করে গেছেন। শিরক ও বিদআতের কুফল ধরার ক্ষেত্রে তার পারদর্শিতা, নৈপূণ্য ও অনন্য কুশলতা ছিল অত্যন্ত কার্যকর ও আকর্ষণীয়। সমাজকে বিদআত ও কুসংস্কার মুক্ত করার জন্য তিনি জীবনভর দাওয়াতী মেজাযে নিরলস মেহনত করে গেছেন।
তাঁর সঙ্গে আমার বহু সুখময় ও মূল্যবান স্মৃতি রয়েছে। আমি তাঁর ‘ছাত্রের ছাত্র’ পর্যায়ের হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমাকে অত্যধিক স্নেহ করতেন। আল-জামিয়া আল ইসলামিয়া পটিয়ার বার্ষিক সম্মেলনে মঞ্চে পাশে বসে তিনি ঘন্টার পর ঘন্টা আমার বয়ান গভীর অভিনিবেশে শুনতেন। বার্ষিক মাহফিলে আমি উপস্থিত হয়েছি কিনা খোঁজ-খবর নিতেন। বলতেন, ‘আহমদ শফি এসেছে কিনা ?’ রাজশাহীর পোরশাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ওয়ায, বয়ান উপলক্ষে তাঁর সঙ্গে আমার সফরের সৌভাগ্য হয়েছে।
তিনি জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় নিয়মিত বুখারী শরীফের দারসের বাইরে আল্লামা জালালুদ্দীন রুমীর বিশ্ববিখ্যাত মাসনবীর দারস দিতেন। সেই ক্লাসে পাঠগ্রহণের উদ্দেশ্যে অন্যান্য শিক্ষকের পাশপাশি জামিয়ার তৎকালীন পরিচালক শায়খ মাওলানা ইউনুস (রহ.) (হাজী সাহেব) স্বয়ং অংশগ্রহণ করতেন।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তিনি সর্বপ্রকার সুন্দর ও মার্জিত গুণাবলির অধিকারী ছিলেন। আত্মশুদ্ধি ও সুলুকের তরিকায় তিনি মুফতি ফয়েজুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতেন। বিশেষত, তিনি এত বড় মাপের আলিম, সুবক্তা, বিতার্কিক ও বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তাঁর শিশুসুলভ সারল্য তাকে বিনয়ের অনন্য উচ্চতায় সমাসীন করেছে। তাঁর জীবন ছিল নিরহঙ্কার, অনাড়ম্বর ও একেবারে সাদামাটা; এককথায় আমাদের সালফে সালেহীন তথা আদর্শ পূর্বসূরীদের উজ্জ্বলতর নমুনা ছিলেন তিনি। ইতিহাসে তার মতো ব্যক্তিত্বের জন্ম খুবই কম ও দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানেই হয়ে থাকে। আজও এদেশ ও জাতি তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেনি। তাঁর তুলনা কেবলই তিনি। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউসের মেহমান হিসেবে বরণ করে নিন।
----------------------------------------------------------------
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড (বেফাক);
মুহতামিম, জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম;
আমীর, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ
বিষয়: বিবিধ
৩৯৩৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন