হেফাজত তরিকায় পরাশক্তি,সেক্যুলার ও ইসলাম (শেষ কিস্তি)

লিখেছেন লিখেছেন নয়া অভিযাত্রী ২১ মে, ২০১৩, ১২:১৯:০৭ রাত

সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো সাম্প্রতিক সময়ে ইসলামপন্থিদের গনহত্যায় শুধুমাত্র কাগুজে উদ্বেগ ব্যতিত নিশ্চুপ থেকে প্রকারান্তরে সমর্থনই করে গেছে। এছাড়া সম্প্রসারনবাদী ভারত তাদের স্বার্থ আদায়ের পাশাপাশি বাংলাদেশকে হেফাজত করার অন্যতম শক্তি ইসলামপন্থিদের দমন প্রক্রিয়ায় নেপথ্য নেতৃত্ব দিয়ে সেক্যুলার বাংলাদেশ গঠনে আওয়ামীলীগ ও তাদের এদেশীয় উচ্ছিষ্টভোজী গোলামদের সমর্থন ও সহযোগীতা অব্যাহত রেখেছে। ভারতীয় পত্রিকা 'The Indian Express' গত ৮ মে, ২০১৩ তারিখের 'Keeping the faith' প্রতিবেদনটি দেখলে ভারতীয় দাসত্ববাদী সেক্যুলার আওয়ামীলীগের প্রতি বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভারতীয় অবস্থান সহজেই অনুমেয় হবে। 'বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের সংবিধানের চারটি প্রতিষ্ঠিত মুলনীতির অন্যতম হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। তবে সামরিক সরকারগুলো ক্রমান্বয়ে সংবিধানের ইসলামিকরনের মাধ্যমে এসব নীতি থেকে সরে যায় এবং এর দ্বারা স্বীকৃতি পায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। ২০১১ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসলে সংবিধানে ওই চারটি প্রতিষ্ঠিত মুলনীতি পুন:স্থাপন করে। সব প্রতিকুলতা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা অব্যাহত রাখার সংকল্প ব্যক্ত করেছে। ভারতের উচিত বাংলাদেশে সেক্যুলার ধারা রক্ষার লড়াইকে উৎসাহিত করা। দেশটির প্রগতিশীল শক্তির প্রতি ভারতকে অবশ্যই সমর্থন দিতে হবে।' মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পূর্বে ১/১১ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে কিভাবে ইসলামপন্থিদের দমন করে ও ইসলামী রাজনীতি নির্মুলের মাধ্যমে সেক্যুলার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হবে তার একটি সেক্যুলার প্লান প্রধানমন্ত্রী পুত্র ও ভারতের সাবেক জামাই সজীব ওয়াজেদ জয়ের লিখিত প্রবন্ধের কথাটি উল্লেখ না করলে আওয়ামীলীগের বর্তমান ফ্যাসিস্ট চরিত্র ও অবস্থান বোঝা যাবে না। ইসলাম বিদ্বেষী মার্কিন সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা Carl J. Ciovacco এর সাথে 'Harvard International Review' এ যৌথভাবে লিখিত ‘Stemming the rise of Islamic Extremism in Bangladesh’ অর্থাৎ 'বাংলাদেশে ইসলামী চরমপন্থার উত্থান ঠেকানোর উপায়' শীর্ষক প্রবন্ধে বিএনপি-জামায়াতের সাথে জঙ্গি সম্পর্ক, ইসলামী চরমপন্থা বৃদ্ধি, সামরিক বাহিনীতে ইসলামপন্থিদের অনুপ্রবেশ, ব্যাপকভাবে নারীদের হিজাব ব্যবহার বৃদ্ধি তত্ত্ব আবিস্কার করা হয়েছে। অতএব Carl J. Ciovacco এবং জয় এসব দমনের উপায় হিসেবে সেক্যুলার আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে - ইসলামপন্থিদের বিবিধ উপায়ে মোকাবেলা, মাদ্রাসার শিক্ষার আধুনিকায়ন, সেক্যুলার বিদ্যালয় ও হাসপাতাল তৈরী, সামরিক বাহিনীতে সেক্যুলার মনোভাবাপন্নদের নিয়োগ প্রভৃতি পরিকল্পনার বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইসলামী আন্দোলনের পথ রূদ্ধ করে সেক্যুলার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে লেখা এ প্রবন্ধ হতে বোঝা যায় হাসিনাতনয় এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যত কর্নধার(?) জয় আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পরাশক্তির কাঙ্খিত চাহিদা বেশ ভালোভাবে রপ্ত করেছেন। বলাবাহুল্য বর্তমানে সংঘটিত ঘটনা এবং সামনে যা ঘটবে সেগুলো মোটেও বিচ্ছিন্ন নয় বরং একটার সাথে আরেকটার যোগসূত্রতা রয়েছে। আওয়ামীলীগ ক্ষমতাসীন হয়ে সেই পরিকল্পনামাফিক প্রত্যেকটি উপাদান বাস্তবায়নে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে সেক্যুলার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশের শাসক-শোষক-সংবাদমাধ্যমসহ তাদের পক্ষের ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের মনোবৃত্তি অনুযায়ী জামায়াতে ইসলাম সেক্যুলার বাংলাদেশ ভারতের স্বার্থ এবং অখন্ডতা রক্ষার প্রতিবন্ধক মনে করা হয়। অতএব এদের দমন করা তাদের রাজনীতির স্বার্থেই প্রয়োজন। তাই মানবতাবিরোধী অপরাধে জামায়াতের সামনের সারির নেতাদের যেন-তেন ভাবেই ফাঁসিতে ঝুলানোই তাদের কর্তব্য। তারা অপরাধ করুক আর নাই করুক অথবা মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রেক্ষাপটে ক্ষতিগ্রস্থ জনগনের চাওয়া পাওয়া একই সাথে আইন-আদালত এখানে গৌণ বিষয়। সেক্যুলারিজম ও ভারতের স্বার্থের প্রতি আওয়ামীলীগের দায়বদ্ধতার খাতিরে জামায়াতের নেতাদের ফাঁসানো হচ্ছে বলে মনে করছে দেশে-বিদেশের অনেকেই। এছাড়া উন্নাসিক মানসিকতার শহুরে ও মধ্যবিত্তদের উদরে জন্ম নেয়া সেক্যুলার ও নাস্তিক প্রজন্ম হতে সৃষ্ট শাহবাগী আন্দোলনের মাধ্যমে উত্থিত জামায়াতে ইসলামকে নিষিদ্ধ, ইসলামী নেতৃত্ব ও রাজনীতির প্রতি বিষোদগার, ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলো নিষিদ্ধের দাবীর যে মঞ্চায়ন হচ্ছে তা এই কাঠামোরই একটি অংশ। এই সুপরিকল্পিত কাঠামোয় হেফাজতে ইসলামের কুঠারাঘাত বরদাসত হবে তা কল্পনা করাই অবান্তর। অথচ হেফাজতে ইসলাম সেই কাজটিই করেছে। তাই হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা এই ইসলামী চরমপন্থি! হেফাজতে ইসলামকে প্রতিহত করাও তাদের সেক্যুলার রাজনীতির ধারাবাহিক কাজের অংশ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। অতএব আওয়ামীলীগের কর্তব্য কি হওয়া উচিত সে সম্পর্কে ভারতের 'The Telegraph' পত্রিকায় ON THE BRINK প্রতিবেদনের ভাষ্য হচ্ছে-'বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের নজির থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতি নজিরবিহীন। এটাকে আর পাঁচটা রাজনৈতিক সংকটের মতোই আরেকটা হিসেবে দেখলে ভুল হবে। হেফাজত আধুনিক রাষ্ট্রের মৌলিক ধারনার প্রতি হুমকি সৃষ্টিকারী। সত্যিকার অর্থে হেফাজতের দাবী দেশকে তালিবানকরন। তাদের মোকাবেলার একটিমাত্র উপায়ই আছে: সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে, কেবল সরকারই নয়, অবশ্যই দ্ব্যর্থহীনভাবে তাদের দাবী প্রত্যাখান করতে হবে। হেফাজতকে যদি তার পথে চলতে দেয়া হয়, তবে তারা কেবল বাংলাদেশের গণতন্ত্র নয়, সভ্যভাবে জীবন-যাপনকেও শেষ করে দেবে।' ভারতের এই নীতি ও সমর্থনের ওপর দাঁড়িয়ে আওয়ামীলীগ হেফাজতের দাবীকে সম্পূর্নভাবে নাকচ করে তাদেরকে মোকাবেলায় এই গনহত্যা সংঘটিত করলো। হেফাজতকে যেভাবে ভারত ও তাদের এদেশীয় বংশবদ চিত্রিত করছে আসলেই কি তারা সেরকম? তারা কি সত্যিই আধুনিক রাষ্ট্রের প্রতিবন্ধক? বলাবাহুল্য যেখানে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক, সেক্যুলারগোষ্ঠী ও তার পক্ষের শক্তিগুলো সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সুপরিকল্পিতভাবে সেক্যুলারিজমের পথে দোর্দন্ডপ্রতাপে এগিয়ে চলছে, সেখানে এসব পরিকল্পনাকে মোকাবেলা করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কোন সুপরিকল্পনা হেফাজতের আছে? যে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে সেক্যুলারগোষ্ঠী ইসলাম ও ইসলামপন্থিদেরকে নিশ্চহ্ন করবার বিপুল কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে, সেই রাষ্ট্রযন্ত্র ইসলামের আয়ত্ত্বে এনে সেক্যুলারিজমের তাসের ঘর চুর্ণ-বিচুর্ণ করার কি দরকার নাই? হেফাজতের এসব কর্মকান্ড তো নেই বরং তারা নিজেদের অরাজনৈতিক দাবী করে হাস্যষ্পদের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরো হাস্যকর ব্যাপার এই যে শুনছি সেক্যুলার প্রতিবন্ধক শক্তি জামায়াতে ইসলামের সাথে নাকি তাদের সাপে নেউলে সম্পর্ক। আমরা জামায়াতকে অপছন্দ করতে পারি, কিন্তু মাদ্রাসা, বিরোধী আলেম-ওলামাদের ও বিভিন্ন ইসলাম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে শত্রুজ্ঞান না করে বরং এগুলোকে বুক দিয়ে আগলিয়ে হেফাজতই করতে দেখা যায় জামায়াতকে। সম্প্রতি হেফাজতে ইসলামের অবরোধকে কেন্দ্র করে সরাসরি সম্প্রচারের জন্য জামায়াতপন্থি দুই টিভি চ্যানেল বন্ধ হওয়ার যে আত্মাহুতি তারই উৎকৃষ্ট নজির। এই উদারতার জন্যই জামায়াত আজ প্রথম ও বৃহৎ ইসলামী দলে পরিনত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গণহত্যায় হেফাজতের হৃদয়ে যে রক্ত ক্ষরণ হলো পুনরায় সেই জায়গায় আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আজকে হেফাজত যে প্রক্রিয়ায় ইসলামকে হেফাজত করতে চাইছে সেটি ভুল বা সঠিক সে বিশ্লেষনের ভার তাদের উপর ছেড়ে দিয়ে একথা বলতে হয়-মসজিদ-মাদ্রাসার চার দেয়ালের মধ্যে ইসলামকে আবদ্ধ রাখার যে প্রক্রিয়া এই কাজটিই করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তি একইসাথে এদেশীয় শক্তিগুলো নিরন্তর লড়াই-সংগ্রাম চালাচ্ছে। এটিও চরম সত্যি ইসলামকে এই গন্ডি থেকে বের করে রাষ্ট্র, রাজনীতি, সংস্কৃতি, আইন-কানুন ও সমাজে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা হলে তাদেরকে অবশ্য অবশ্যই বলির পাঠার স্বীকার হয়ে উলু ধ্বনি দেয়ার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় সেক্যুলার দেবতার ভক্তদের। আমরা মানি আর নাই মানি ইসলামপন্থি দল জামায়াত-শিবিরকে সন্ত্রাসী-জঙ্গি হিসেবে প্রমান করবার যে প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন ধরে চলছে-হেফাজতের সামান্য তের দফা দাবী আদায় করতে গিয়ে যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হলো তাতে উল্টো নিজেরাই সেক্যুলার ফ্যাসিস্টদের কাছে সন্ত্রাসী-জঙ্গি হিসেবে খেতাবপ্রাপ্ত হবার যে অপপ্রয়াস দেশের জনগন দেখল তাতে জামায়াতের প্রতি জনগের সহমর্মিতার প্রবৃদ্ধি ঘটবে একইসাথে ইসলামবিদ্বেষী শক্তিগুলোকে চেনা হলো এমনকি ইসলামী চেতনা লালন করে অরাজনৈতিক থেকে দাবীর পরিনামও বুঝা গেলো। পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে সেক্যুলার মনোবৃত্তির লোক তৈরীর যে সেক্যুলার পরিকল্পনা তার পথ-পন্থা তারা খুঁজে পাইনি। হেফাজত সেই অস্ত্রটি তুলে দিল কিনা সেটাই এখন দেখবার বিষয়। বলা হচ্ছে- টাকা খেয়ে, মন্ত্রীর প্রলোভনে পরে হেফাজতের নেতারা কোমলমতি মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বিভ্রান্ত করেছে। এদের আধুনিক জ্ঞান-গরিমা নাই বলে হেফাজতের নেতারা তাদের ব্যবহার করেছে। অতএব এদেরকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষ করা দরকার। এজন্য মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার প্রয়োজন। যদি তাই হতো তাহলে মাদ্রাসা পড়ুয়াদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে কেন? আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, কওমী মাদ্রাসার যে শিক্ষাব্যবস্থার ধরন দেখছি তাতে এর সংস্কার হওয়া দরকার। তবে সেটি সেক্যুলারদের পরিকল্পনা দ্বারা নয়। এ সংস্কার হওয়া উচিত ইসলামকে আন্তর্জাতিকভাবে পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবার প্রয়োজনীয় সংস্কার। এজন্য ইসলামী আন্দোলনের আলেমসহ কওমীমাদ্রাসার সম্মানিত আলেমগনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দ্বারা এ কাজ হওয়া উচিত। তবে সেই কাজ করবার সময় এখন নয়। হেফাজতে ইসলামের এখনকার প্রধান কর্তব্যই হচ্ছে জেলায় জেলায় ব্যাপক ভিত্তিতে গণসংযোগ ও বিক্ষোভ কর্মসুচীর মাধ্যমে বিতর্কের জায়গাগুলোতে জনগনকে বুঝিয়ে ইসলামের আওতায় নিয়ে আসা।

হাসিনাতনয় জয় উৎসারিত সামরিক বাহিনীতে ইসলামপন্থিদের বিরূদ্ধে শুদ্ধি অভিযানের জন্য এবং সেক্যুলার করন প্রক্রিয়ায় বিডিআর ট্রাজেডী ঘটানো আওয়ামী রাজনীতির জন্য অপরিহার্য ছিল। বর্তমানে বিভিন্ন বাহিনীর একাংশের মিডিয়ায় প্রদত্ত বক্তব্য দেখলেই মনে হয় এরা বাহিনীর লোক নয় বরং এরা আওয়ামী নেতা গোছের কেউ এবং এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে সামরিক বাহিনীর সেক্যুলারকরন। (সমাপ্ত)

বিষয়: রাজনীতি

১৭৮৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File