ধস রাজ্যে প্রত্যাবর্তন-১

লিখেছেন লিখেছেন নয়া অভিযাত্রী ০৩ মে, ২০১৩, ০৮:৪২:৪৯ রাত

রানা প্লাজা ধসে স্মরণকালের ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে ব্যাপক প্রাণহানি, আহত ও ক্ষয়-ক্ষতিতে পুরো জাতি শোকে মুহ্যমান। স্বজনদের আহাজারী, আর্তনাদ, হাহাকার, শুন্যতা, কান্না আর লাশের মিছিলে সাভার জর্জরিত। ভাগ্যাহত এসব শ্রমিকদের করুন কান্নায় বাংলাদেশ কাঁদছে। খবরে প্রকাশ, ভবনটি ধসে পড়ার একদিন আগেই ফাটলে তিনটি পিলার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিষয়টি ভবনের মালিক ও স্থানীয় প্রশাসন সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন ভবনটি খালি করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ১৮ দলের ডাকা হরতালের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে ঐদিন রাতে ফোন করে শ্রমিকদের কাজে যোগদানের নির্দেশ দেয়া হয়। উপরন্তু কাজে যোগ দেয়ার জন্য বাধ্য করতে পিটানোর হুকুমসহ চাকুরীচ্যুত করার হুমকি দেয়া হয়। ফলশ্রুতিতে সকালে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেয়। এরপরে সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ ভবনটি কেঁপে ওঠে ও বিকট আওয়াজ করে ধসে পড়ে।



সমালোচিত এ ভবনটির মালিক সাভার পৌর যুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক সোহেল রানা। বাবা আব্দুল খালেক যিনি তেল ব্যাপারী। অর্থাভাবে পাঠ চোকানো অধরচন্দ্র বিদ্যালয় হতে নবম শ্রেণী পাস রানা হয়ে ওঠে এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী, দখলবাজ, চাঁদাবাজ। আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে ক্ষমতার দাপটে বনে যান কোটিপতি। ক্ষমতার দাপটে ১৯৯৮ সালে আওয়ামী আমলে সংখ্যালঘু রবীন্দ্রনাথ সাহা থেকে উক্ত ভবনটির জমি জোরপূর্বক দখল করে। এরপর ভবন নির্মানে নিয়ম অনুসরণ না করে সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ সরকারী কর্মকর্তাদের যোগসাজশের মাধ্যমে ডোবায় মাটি ভরাট করে ভবনটি নির্মান করা হয়।

একই মালিকের আরেকটি ভবন রানা টাওয়ারে ফাটল দেখা দিয়েছে। এছাড়া দেশব্যাপী বিভিন্ন ভবনকেন্দ্রিক যে খবর গনমাধ্যমে এসেছে তা রীতিমতো আশঙ্কাজনক। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী-'রানা প্লাজার মতো অসংখ্য মৃত্যকুপ ঢাকার আশে-পাশে' (দেখুন, নয়াদিগন্ত, ২৬ এপ্রিল, ২০১৩)। অভিন্ন তারিখ ও পত্রিকার আরেকটি খবর-'চট্টগ্রামে ঝুকিপূর্ন ৬০ ভবন ভাঙ্গার নাম নেই'। এবং 'চট্টগ্রামে স্কুল ধস আতঙ্ক: প্রাণ ভয়ে দৌড় দিল ছাত্ররা'। ২৭ এপ্রিলের ঐ পত্রিকার খবর-'মানিকগঞ্জে ভবনে ফাটল, কার্যক্রম বন্ধ'। এছাড়া নয়াদিগন্তের ২৮ এপ্রিলের প্রতিবেদন-'গবেষকরা ঢাকা মহানগরীতে ঝুকিপূর্ণ ৭২ হাজার ভবন চিহ্নিত করেছেন'। এবং 'চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে ঝুকিপূর্ণ চারতলা জেকস ভবন সিলগালা করে দিয়েছে জেলা প্রশাসন'। এখানে শুধু কয়েকটি মাত্র সংগৃহিত খবর উল্লেখ করা হলো। শুধু রানা প্লাজার ধসের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে না-আরো ধ্বংসযজ্ঞ সামনে অপেক্ষা করছে। অবস্থাদৃষ্টে বলাই বাহুল্য যে আমরা একটি ধস রাজ্যে প্রত্যাবর্তন করেছি। এসব অনৈতিক কর্মকান্ড হচ্ছে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক যোগসাজশে। পুরো দেশের সমাজব্যবস্থায় যে নৈতিকতার চরম ধস নেমেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।



সাভার ট্রাজেডীর খলনায়কদের ফাঁসির জন্য শ্রমিক সমাজ ও বিভিন্ন মহল দাবী তুলছে। প্রশ্ন হচ্ছে- শুধু খলদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলেই বুঝি সমাজ দেহে যে পঁচন ধরেছে তা ঠিক হয়ে যাবে? অথবা শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে যে প্রতিবন্ধকতা তার অবসান হবে? নৈতিকতার যে ধস নেমেছে তা রোধ হবে? তার মানে এই নয় যে সকলের দাবীর সাথে আমার ভিন্নমত রয়েছে। তবে আমার প্রশ্ন ও অবস্থান আরো গভীরে। আমরা যদি দু-চারজনকে বিচারের আওতায় এনে বিষয়টি সীমিত করে বুঝবার চেষ্টা করি তাহলে আমাদের সামনে আরো শোকাবহ দিন অপেক্ষা করছে। এসব প্রশ্নকে এড়িয়ে পুরো প্রক্রিয়ার রাজনৈতিক তাৎপর্য বুঝা অসম্ভব। একজন নাগরিক কিভাবে তার নাগরিকতা নিয়ে গড়ে উঠবে-এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্তব্য কি? আবার নাগরিক রাষ্ট্রকে কিভাবে ধারন করবে তার রাজনৈতিক ভূমিকা কি? স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রকে নৈতিক ও আদর্শের ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে কল্যাণকামী হিশাবে পরিগঠন করতে যা দরকার ছিল তা করা হয়নি। একজন নাগরিককে রাষ্ট্রের উপযোগী করে গড়ে তোলার ব্যর্থতা আরো প্রকট। বরং রাষ্ট্র ও রাজনীতির ভূমিকাই ছিল বিপরীতমূখী। আমরা যদি দেশকে নৈতিকতার ধস হতে রক্ষা করবার তাগিদ অনুভব করি তাহলে সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানো ছাড়া বিকল্প পথ নেই। এজন্য শ্রমিক সমাজসহ প্রত্যেক লোককে নতুন করে ভাবতে হবে এবং প্রবেশ করতে হবে সমস্যার গভীরে। বর্তমানে শিল্প শ্রমিক সমাজ যেসব জটিলতা ও সমস্যায় উপনীত-তা অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকৃতির কারনেই হয়েছে। মূলত এই অর্থনৈতিক বিকৃতির জন্য দায়ী হলো রাজনৈতিক ব্যবস্থা। গোটা জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তন না করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা কল্যাণমূখী করা অসম্ভব। একই সাথে শ্রমজীবি মানুষের সমস্যা এবং জটিলতাও সম্পূর্নরুপে দুরভিত হতে পারে না।

বর্তমানে দেশে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু রয়েছে-তা বস্তুবাদী সভ্যতার পতাকাবাহী সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ হাসিলের অন্যতম হাতিয়ার পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা। এ অর্থব্যবস্থায়-ব্যক্তি তার উপার্জিত ধন-সম্পদের মালিক। ব্যক্তির উপার্জিত ধন-সম্পদে অন্যের অংশ ও অধিকার অস্বীকার এবং ব্যয়ের অপরিসীম স্বাধীনতা ও তা কুক্ষিগত রাখার পাশাপাশি ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যয়ের অধিকার স্বীকৃত। ব্যক্তি স্বার্থপরতার উপর দাঁড়িয়ে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা সমাজে ধন-সম্পদের তারতম্য ঘটিয়ে দু'শ্রেণীতে বিভক্ত করে। প্রথম শ্রেণীতে ব্যক্তি সুখ-সম্ভোগ, আরাম-আয়েশের জন্য ব্যয় এবং অর্থের প্রবৃদ্ধি ঘটাতে সমাজ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে দ্বিধা করে না। অপরশ্রেণীতে অবস্থিত দরিদ্র শ্রেণী ধন-সম্পদের অংশ ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চনার পাশাপাশি ধনকুবেদের অর্থের পাহার গড়তে সহায়তা করে, জীবন-জীবিকার সামগ্রী সংগ্রহের মধ্য দিয়ে তাদের জীবনাবসান ঘটে।



সমাজে কার্যকরী এই পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় মায়া-মমতা, সহৃদয়তা-সহানুভূতি ও পারস্পারিক সাহায্য ইত্যাকার মানবীয় ভাবধারা অনুপস্থিত থাকে। ফলশ্রুতিতে সমাজের সাধারণ ব্যক্তিবর্গের ব্যক্তি মালিকানা হতে বঞ্চিত করে সমস্ত মানুষকে কেবলমাত্র সমাজ ও সমষ্টির গোলাম বানিয়ে দেয়াই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সমগ্র দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত এই অভিশপ্ত ব্যবস্থার যুলম-নির্যাতন-নিপীড়ন দুনিয়াকে সমস্যা ও জটিলতায় নিক্ষেপ করেছে। বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনরোষ সীমায় ঠেকে এর পতন অনিবার্যতা লাভ করেছে। জোড়া-তালি দিয়ে মেরামতকৃত এই অর্থব্যবস্থা থেকে মানুষ যেন বেরিয়ে গিয়ে ভিন্ন পন্থা না খোঁজে এজন্য অতি সুকৌশলী সাম্রাজ্যবাদী শক্তি 'বৈশ্বিক মন্দা' নামে আখ্যায়িত করছে। পাশাপাশি স্নায়ুতে এই ইনজেকশন দেয়া হচ্ছে-মানব জীবনের জন্য কোন অর্থব্যবস্থা থাকলে তা একমাত্র পুঁজিবাদীই ব্যবস্থা।



অভিশপ্ত এ ব্যবস্থার নিষ্পেষনের হাত থেকে রক্ষা পেতে উপায় হিশাবে সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা নামে আরেক ধোকাবাজি ফ্যাসিস্ট অর্থব্যবস্থা দাঁড় করানো হলো। মানব ইতিহাসে বিভিন্ন দেশকে নির্যাতন-নিষ্পেষনের এ ব্যবস্থা নজিরবিহীন। পুঁজিবাদের সম্পূর্ন বিপরীত সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার মূল কথা হচ্ছে-পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সৃষ্ট দুই প্রান্তিক শ্রেণীকে (ধনিক ও দরিদ্র) সমান্তরালকরণ। এলক্ষ্যে ধনী-গরিব উভয় শ্রেণীর ধন-সম্পদের যাবতীয় উপায়-উপাদান ব্যক্তিবর্গের হাত থেকে রাষ্ট্রীয় তদারকীতে আনয়ন করা। এ অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তির উৎপাদন ও মুনাফার অধিকার অনস্বীকার্য। তবে রাষ্ট্রের নির্দেশানুসারে সকল শ্রেনী-পেশার মানুষকে তাদের কার্যাদির জন্য জীবিকা নির্বাহে বিনিময় মূল্য প্রদান করা হবে। পুঁজিবৃদ্ধির জন্য ব্যক্তি স্বার্থপরতা পরিবেশের সৃষ্ট তাই ব্যক্তিস্বার্থ প্রবণতা শুন্য মনোভাব তৈরীতে শিক্ষা-সংগঠনের মাধ্যমে সম্ভব বলে সমাজতন্ত্রীরা মনে করে। ব্যক্তির মালিকানা ও কতৃত্ব হতে জমি-ক্ষেত-খামার, কারখানা, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য উৎপাদন উপায়কে কেড়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসা কোন সহজসাধ্য কাজ নয়। এ ব্যবস্থা কার্যকরী করতে রাষ্ট্রকে ফ্যাসিস্ট ভূমিকায় অবতীর্ন হয়ে জনগনের বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধে লিপ্ত হতে হবে। রাশিয়া এই অত্যন্ত কঠিন ও দুরূহ কাজ করতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময়-ক্রমাগত ও নিরবচ্ছিন্নভাবে মারাত্মক অত্যাচার, নিষ্পেষন, সর্বাত্মক রক্তপাত ও গণহত্যার তান্ডবলীলা সৃষ্টি করেছিলো।



এ কার্য সম্পাদন করতে ১৯ লক্ষ মানুষকে হত্যা, ২০ লক্ষ মানুষকে বিবিধ দন্ড দান এবং ৪০-৫০ লক্ষ মানুষকে জন্মভূমি হতে বহিস্কৃত, নির্বাসিত ও বিক্ষিপ্ত হয়ে দুনিয়ার নানাস্থানে আঘাত খেয়ে মরতে হয়েছে। একারনে কমিউনিস্ট ডিকটেটরী সরকার প্রতিটি মুহুর্তে প্রতি বিপ্লবের আশঙ্কায় এবং এ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে দল, সংগঠন, প্লাটফর্ম, মিডিয়া, ভিন্নমত, সমালোচনা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, অভিযোগ, মামলা দায়ের, বিচারালয় নিষিদ্ধ করা হয়। কমিউনিজম সমস্ত পুঁজিবাদী খতম করে একজন সর্বগ্রাসী ও সর্বশ্রেষ্ঠ পুঁজিদার সৃষ্টি করে, তা হচ্ছে-কমিউনিস্ট সরকার। সমাজতন্ত্র জনগনের চিন্তা, মত ও কর্মের সমস্ত স্বাধীনতা হরণ করে মানুষকে যান্ত্রিক দানবে পরিণত করে। সঙ্গতকারনে বলতে হচ্ছে-বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবি মানুষের সমস্যাকে পুঁজি করে সমাজতন্ত্রীরা যে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শ্রমিকদের স্বর্গরূপে প্রচার করছে - তা শ্রমিকসহ সকলের জন্যই জাহান্নামের নামান্তর। সেই স্বর্গরাজ্য! প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রমজীবি মানুষের সমস্যা ও জটিলতাকে ভিত্তি করে শ্রমজীবি মানুষকে উত্তেজিত করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। এ বিপ্লব প্রতিষ্ঠাকল্পে-জমি ও কারখানা ছিনিয়ে এনে শ্রমিকদের মালিকানায় অর্পনের যে দিবাস্বপ্ন দেখানো হচ্ছে-মূলত তা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র তথা সমাজতন্ত্রী শাসকদের আয়ত্তাধীন করা হবে। এবং সকল কৃষক ও শ্রমিকদের অনুগত গোলাম হয়ে জীবিকা নির্বাহ ব্যতিত ভিন্ন পন্থার সুযোগ থাকবে না। পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দাবী আদায়ে হরতাল, ধর্মঘট ও আন্দোলন করা যায়-কিন্তু সমাজতন্ত্রে এসব তো দুরের কথা দাবী উত্থাপনই সম্পূর্ন নিষিদ্ধ।চলবে.......

(লেখার দ্বিতীয় কিস্তি পড়ুন)

বিষয়: রাজনীতি

১৭১৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File