দৌড় !
লিখেছেন লিখেছেন তরিকুল হাসান ০৬ মে, ২০১৬, ১০:৪৪:৪১ সকাল
[১৮৫ বছর আগে ১৮৩১ সালে আজকের এই দিনে (৬ মে) ইংরেজদের নাগপাশ থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মুক্ত করে পরিপুর্ন জীবন ব্যবস্থা ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী ও শাহ ইসমাইলসহ ১৩৫ জন মুজাহিদ বালাকোট প্রান্তরে জীবন বিলিয়ে দেন। বালাকোটের চেতনা থেকেই এই গল্পটি লেখা।]
নদীর নাম ডাকাতিয়া। লোকে বলে মগ জলদস্যুরা এই নদী ব্যবহার করে নোয়াখালী ও কুমিল্লায় আসে। ত্রিপুরা থেকে কুমিল্লা, লক্ষীপুর ও চাঁদপুর হয়ে মেঘনায় মিশেছে প্রচন্ড খরস্রোতা এ নদী। নদীর পাশে ঘন শালবনে সরু ঘোড়া চলাচলের একটা রাস্তা। রাস্তার পাশে একটা পুরনো মসজিদ। আশেপাশে জনবসতি খুব ঘন নয়। মসজিদের দেয়ালে টানা আরবিতে লেখা কিছু নকশা। স্থানে স্থানে ইট-সুড়কি খসে পড়লেও বেশ সুন্দর লাগে এখনও। ভেতরে ঢুকলে একটা অপার্থিব ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধাবোধ চলে আসে। মাগরিবের নামাজের সময় হয়েছে। মাথার পাগড়ীটা ভালভাবে বেধে বাড়ী থেকে বের হয় মজু ব্যাপারী। মসজিদের ডান পাশে দাড়িয়ে গলা ছেড়ে আজান দেয় সে। আল্লাহু আকবার . . আশহাদু . .
আযান শুনে আরো ছয়-সাতজন বৃদ্ধলোক নামাজ পড়তে আসে। এরাই এই মসজিদের নিয়মিত মুসল্লী। জুম্মা বারে অবশ্য বাচ্চাদের নিয়ে পাড়ার সকল পুরুষ হাজির হয়। মা-ঝিরা বাড়ী থেকে খেজুর রস দিয়ে ক্ষীর রান্না করে পাঠিয়ে দেয়। কলার পাতায় কাঠের ডাবর দিয়ে সেই ক্ষীর সবার পাতে তুলে দেয় মজু ব্যাপারী। সবাইকে বেড়ে দিয়ে নিজেও একটা পাতায় সামান্য ঢেলে নেয় সে। মনের গভীর থেকে সে বলে ওঠে . . শোকর আলহামদুলিল্লাহ।
ঘোড়ার খুরের শব্দে চিন্তায় তাল কেটে যায় ব্যাপারীর। একটা কালো ঘোড়া এসে ঠিক মসজিদের পাশে থেমে যায়। ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নামে এক তরুন। সাদা পাগড়ী আর জুব্বা পড়া এ তরুন স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি লম্বা। এত লম্বা মানুষ এ অঞ্চলে সাধারনত দেখা যায় না। ফর্সা মুখে ঘন কালো দাড়িতে মুখটা অসম্ভব সুন্দর লাগছে। মুখে বাচ্চা বাচ্চা একটা ভাব আছে। ব্যাপারির দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হেসে বলে, আসসালামু আলাইকুম। নম্রভাবে দোয়া পড়তে পড়তে মসজিদে ঢুকে সে। বৃদ্ধরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। তাকে ইমামতি করতে অনুরোধ করে ব্যাপারী। নামাজ শুরু হয়। মৃদু স্বরে তেলাওয়াত শুরু করে সে। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে সে সুর। পুরনো ইটের দেয়ালে প্রতিফলিত হয় অপুর্ব ধ্বনির ঝংকার। বুকের বামপাশটা চিন চিন করে ওঠে ব্যাপারির। দুচোখ বেয়ে নেমে আসে অশ্রুধারা। এত সুন্দর তেলাওয়াত কোনদিন শোনেনি সে। মনে হয় এ সুর যদি না থামত।
أَلَمْ تَرَ كَيْفَ ضَرَبَ اللّهُ مَثَلاً كَلِمَةً طَيِّبَةً كَشَجَرةٍ طَيِّبَةٍ أَصْلُهَا ثَابِتٌ وَفَرْعُهَا فِي السَّمَاء
তুমি কি লক্ষ্য কর না, আল্লাহ তা'আলা কেমন উপমা বর্ণনা করেছেনঃ পবিত্র বাক্য হলো পবিত্র বৃক্ষের মত। তার শিকড় মজবুত এবং শাখা আকাশে উত্থিত। [সুরা ইবরাহীম: ২৪]
تُؤْتِي أُكُلَهَا كُلَّ حِينٍ بِإِذْنِ رَبِّهَا وَيَضْرِبُ اللّهُ الأَمْثَالَ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَذَكَّرُونَ
সে পালনকর্তার নির্দেশে অহরহ ফল দান করে। আল্লাহ মানুষের জন্যে দৃষ্টান্ত বর্ননা করেন-যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। [সুরা ইবরাহীম: ২৫]
وَمَثلُ كَلِمَةٍ خَبِيثَةٍ كَشَجَرَةٍ خَبِيثَةٍ اجْتُثَّتْ مِن فَوْقِ الأَرْضِ مَا لَهَا مِن قَرَارٍ
এবং নোংরা বাক্যের উদাহরন হলো নোংরা বৃক্ষ। একে মাটির উপর থেকে উপড়ে নেয়া হয়েছে। এর কোন স্থিতি নেই। [সুরা ইবরাহীম: ২৬]
يُثَبِّتُ اللّهُ الَّذِينَ آمَنُواْ بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الآخِرَةِ وَيُضِلُّ اللّهُ الظَّالِمِينَ وَيَفْعَلُ اللّهُ مَا يَشَاء
আল্লাহ তা'আলা মুমিনদেরকে মজবুত বাক্য দ্বারা মজবুত করেন। পার্থিবজীবনে এবং পরকালে; এবং আল্লাহ জালেমদেরকে পথভ্রষ্ট করেন। আল্লাহ যা ইচ্ছা, তা করেন। [সুরা ইবরাহীম: ২৭]
এক সময় নামাজ শেষ হয়। ক্ষীনকন্ঠে ব্যাপারী আগন্তুকের পরিচয় জিজ্ঞেস করে। তরুন শুরু করে তার গল্প . .
আমার নাম শামসির খান । আমি বেনারসের বিখ্যাত তৈমুর বংশের একজন শাহজাদা। আমি যখন বেড়ে উঠেছি তখন বেনারসে মুসলমানদের মধ্যে নানা কুসংস্কার দানা বেধেছে। স্থানীয় পীর সাহেব আমাদেরকে চাঁদার বিনিময়ে ছয়মাস বা তারও অধিককাল সময় নামাজ-রোজা না করার অনুমতি দিয়ে সার্টিফিকেট দিত। পীর সাহেবের দরবারে নাচ গানসহ নানারকম বেদাতি কর্মকান্ড হতো। সব মিলিয়ে আমার মন বিষিয়ে উঠেছিল। এ সময় সৈয়দ আহমেদ বেনারসে এলেন। তিনি এসেই বেদাতি সব কাজ বন্ধ করে দিয়ে প্রকৃত দ্বীনের আলো ছড়িয়ে দিলেন। আমি তার হাতে বাইয়াত হলাম।
শুরু হলো নতুন করে পথ চলা। ইংরেজশক্তির বিরুদ্ধে ইসলামী চেতনায় জাগ্রত হয়ে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার মিশনে আমিও শামিল হলাম। জানলাম ইসলামের মানে।
এক আল্লাহতে অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসই ইসলাম। ইসলাম একটি পরিপুর্ন জীবন বিধান। মানবরচিত যাবতীয় ভ্রান্ত ও জাহেলী মতবাদের উপর ইসলামকে বিজয়ী করার মহান মিশনে প্রেরন করা হয়েছিল রাসুল (সাঃ) কে। আল্লাহ পাক স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন-
هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ
তিনিই প্রেরণ করেছেন আপন রসূলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বীন সহকারে, যেন এ দ্বীনকে অপরাপর দ্বীনের উপর জয়যুক্ত করেন, যদিও মুশরিকরা তা অপ্রীতিকর মনে করে। (সুরা তওবাঃ৩৩)
তাই এ দ্বীনের ঝান্ডা উড়িয়ে দেয়ার জন্য ইংরেজদের উৎখাত করে পুরো ভারতবর্ষে আজাদী নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য সৈয়দ আহমদের নেতৃত্বে আমরা একতাবদ্ধ হয়েছি।
আগন্তুকের কথা শেষ হয়।
উপস্থিত বৃদ্ধদের একজন তার হাত চেপে ধরে। 'আমি কি তোমাদের সাথে শামিল হতে পারি ?' চারপাশ থেকে আওয়াজ আসে 'আমরাও যেতে চাই'।
কাফেলা এগিয়ে চলে। দৌড়ে চলে সেই পথের দিকে যে পথ যাচ্ছে তাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে যার প্রশস্ততা সমস্ত আসমান ও জমিনের ন্যায় আর যা তৈরী করা হয়েছে মুত্তাকীদের জন্য।
বিষয়: বিবিধ
১৩৫৬ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন