ঝড় বৃষ্টির সন্ধ্যায় !
লিখেছেন লিখেছেন তরিকুল হাসান ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ০৫:৫৯:৪০ বিকাল
আজ ঝড়-বৃষ্টির সন্ধ্যা, মৃত্যু নিতান্ত অনাকাংখিত। ছিপছিপে কাঁদায় জানাজার মিছিল বিরক্ত। মাইক হাতে হিমেল হাওয়া
অথবা আসন্ন মৃত্যুভয়ে কেঁপে ওঠে পাড়ার মেম্বারের কন্ঠ । গোর-খোরেরা জল নিংড়াতে নিংড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে।আপনজনের কান্না আড়াল করে বর্ষার গুড়ি গুড়ি জল।
শত-বর্ষী রহমত মুন্সী কেবল ক্লান্ত ছিল না। সন্ধ্যা থেকেই তার শীর্ণ হাতে মধ্য যৌবনের শক্তি এসে ভর করে। জুনাইলের হাট থেকে বহু বছর আগে কেনা লাঠিটা তাকের উপর থেকে নামায় সে। ঈদ বা কোন বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া এই লাঠিটা সে বের করে না। সরিষার তেলের বোতলে তেল প্রায় শেষ। উপুড় করে একটু পাওয়া যায়। ওটুকুতেই হবে, আপন মনে ভাবে সে। লাঠিতে তেল দিয়ে ঘসে চকচকে করে তোলে সে। নতুনের মত লাগে। আলমারীতে ধুয়ে ভাজ করে রাখা পাঞ্জাবীটা গায়ে দিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। এই আধো-অন্ধকারেও বেশ ভালোই দেখতে পায় সে। নানাজান বলতেন,ভোরে কুরআন পড়লে চোখ ভাল থাকে। তাই ছোট থেকেই ফজরের পর কুরআন পড়ার অভ্যাস তার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ দেখেছে সে। এই গ্রামের কত মানুষকে সে জন্ম নিয়ে আবার বুড়ো হয়ে মরতেও দেখেছে সে। কেবল তার মৃত্যুটাই কেন যেন হচ্ছেনা। সে অপেক্ষায় আছে,তার নিজের মৃত্যুও হবে যেকোন দিন। জানাজা পড়তে সে কখনো অলসতা করে না। সে অলসতা করলে মানুষজনও অলসতা করবে তার জানাজায়। কে জানে হয়ত জানাজার লোকজনের দোয়ায় তাকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। দমকা হাওয়া আর বৃষ্টির ছিটায় পুরো ভিজে যায় রহমত মুন্সী।
জানাজার নামাজ শুরু করতে দেরি করা হয়। কারন এ গাঁয়ে কেউ মারা যাবে আর তার জানাজায় দাড়িয়ে রহমত মুন্সী তার দাড়ি চোখের পানিতে ভিজিয়ে 'হে বড় ভালা মানুষ আছিল' বলবে না, এ অসম্ভব। হাটতে থাকে মুন্সী। ঐতো জব্বারদের বাড়ী, এ বাড়ী ছেড়ে তিনশ গজ হাটলেই মসজিদ। তার পাশের লম্বা মাঠটাতেই সব জানাজা পড়া হয়। কতবার জানাজা পড়তে গিয়েছে সে হিসাব রাখা হয়নি। সব পথ ঘাট মুখস্ত মুনশীর। তবু একটু কেমন কেমন যেন লাগছে। পথ ঘাট পুরো ফাকা। এই ঝড়ে কেউ বের না হওয়াটাই স্বাভাবিক, মনে মনে ভাবে মুন্সী। হাওয়াটা ক্রমশ বাড়ছে। ছোটবেলায় এমন ঝড়ে আম কুড়াতে বের হওয়ার বহু জীর্ন স্মৃতিটা হঠাৎ মনে উঁকি দিয়ে যায়। প্রচন্ড আলোড়নে আশেপাশের গাছগুলো সব বিদ্রোহ করে বসেছে যেন। প্রচন্ড শব্দে বাজ পড়ছে দূরে কোথাও। মট করে হঠাৎ ভেংগে পড়ে কাঠাল গাছের ডালটা। পেছনে শীরদাড়ায় এসে আঘাত করে ওটা। মাটিতে পড়ে যায় মুন্সী। অন্ধকার লাগে চারপাশটা। ক্ষনেক বাদেই সামান্য সম্ভিত ফিরে পায় সে। সজোরে 'লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা' বলে উঠে সে।এই কি মৃত্যু ? মনপ্রানে সে কালেমা স্মরন করার চেষ্টা করে। আশ্চর্য,এতবার পড়া কালেমাটা আজ একটুও মনে নেই। প্রচন্ড ভয় নাড়া দিয়ে যায় তাকে। তবে কি কালেমা বিহীন মৃত্যু হবে তার? চোখের কোনা দিয়ে নোনতা পানির ধারা নেমে আসে। ছোট বাচ্চাদের মত কেঁদে ওঠে সে। অস্ফুট স্মরে বলে, 'আল্লাহ আমারে মাফ কইরা দেও।'
আজ ঝড়-বৃষ্টির সন্ধ্যা, মৃত্যু নিতান্ত অনাকাংখিত। ছিপছিপে কাঁদায়ও জানাজার মিছিলে আজ ঢল নেমেছে। পাশের ক্ষেতেও লক্ষ জনতার ভীড়। সাত গ্রামের লোকেরা ভীড় করেছে। এমন লোকসমাগম কোন জানাজায় কেউ দেখেনি আগে। মাইক হাতে প্রচন্ড আবেগে মৃত্যুভয়ে কেঁপে ওঠে পাড়ার মেম্বারের কন্ঠ । গোর-খোরেরা জল নিংড়াতে নিংড়াতে আজ আর ক্লান্ত হয় না। সবাই এক বাক্যে বলে, 'রহমত মুন্সী বড় ভালা মানুষ আছিল'। আপন-পর সবার চোখ দিয়ে আপনা-আপনি গড়িয়ে পড়ে অশ্রু, হাজারো বৃষ্টিতে যা আড়াল হয় না।
-------------
কুমিল্লা/ ২২.০২.১৬
বিষয়: বিবিধ
১৩৯৯ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন