নিশিগল্প
লিখেছেন লিখেছেন তরিকুল হাসান ০৭ এপ্রিল, ২০১৫, ১০:১২:০০ সকাল
রাত দশটায় সার্জন এসে পৌছলেন। আমি এখানকার ডিউটি ডক্টর। ওটিতে ঢুকতেই স্যার ওয়াশ নিতে বললেন, এসিস্ট করতে হবে। এমনিতেই বেশ ঘুম পেয়েছে। তার উপর নিউরোসার্জারীর অপারেশন, কম করে হলেও দুই ঘন্টা লাগবেই, খাইছেরে !
সার্জন বললেন -কোত্থেকে পাস করছ ? আমি বললাম-রংপুর।
-সার্জারী কার আন্ডারে করছ ?
-বিমল স্যার।
-বিমল দা তো অনেক চমৎকার সার্জন। নিউরোসার্জারী ওটি এসিস্ট করছ কখনো?
-জি স্যার।
-বাড়ী কই তোমার ?
-গাজীপুরের শ্রীপুর।
-মাওনা চেন ?
-চিনি স্যার।
-আমার আপন চাচার এক ক্লোজ বন্ধু প্রফেসর মুজিব স্যার চেম্বার করে ওখানে । বরমী চিন ?
-জি।
-ওখানে এক ক্লিনিকে অনেকদিন অপারেশন করেছি।
আমার সার্জারীর ক্যারিয়ার শুরুর দিকের কথা। ঢাকায় তখন তেমন রোগী নেই। খুব কম অপারেশন হচ্ছে। বসে বসে সময় কাটছে না। এমন সময় একজন ঢাকার বাইরের একটা ক্লিনিক থেকে এসে বলল, স্যার ঢাকা থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে আমাদের ক্লিনিক, আমাদের নিজস্ব গাড়ী আছে , জ্যাম না থাকলে একটানে যামু আর আসমু । মাত্র এক ঘন্টার মামলা, ৪টা অপারেশন কইরা সন্ধ্যার মধ্যেই ঢাকায় আইসা নান্নার গরম বিরানী খাইয়া বাসায় চইলা যাবেন। আমি বললাম ,তোমাদের ডায়াথার্মি আছে তো ? ওরা বলল, ব্যাবস্থা হবে স্যার।
আমার ভাবাভাবির কিছু ছিলনা। সংগে সংগে রাজী হয়ে গেলাম। কথা হল দুপুর ১২টায় আমি ও একজন এনেস্থেটিস্ট একসাথে অপেক্ষা করব। ওদের গাড়ী আমাদের তুলে নিয়ে যাবে।
বেলা ১টা বেজে গেল। ওদের কে ফোন দিলাম। দেরির জন্য সরি বলল। এখনি আসবে বলল। দেখতে দেখতে বিকেল গড়াতে লাগল। ওদের দেখা নেই। অবশেষে সন্ধ্যা ৬টায় ওরা আসল একটা ভাড়া করা হলুদ ট্যাক্সি ক্যাব নিয়ে। আমি বললাম, কি ব্যাপার? ভাড়া করা ট্যাক্সি কেন ? ওরা আমতা আমতা করে বলল ,ওদের গাড়িতে একটু প্রবলেম হয়েছে। আমার মন একটু খুতখুত করতে লাগল। সব ঝেড়ে ফেলে গাড়ীতে চড়লাম। পথে উত্তরায় এক ক্লিনিক থেকে ডায়াথার্মি নিল। গাজীপুর চৌরাস্তা যেতেই রাত ৯টা বাজল। আর কতদুর যেতে হবে? মাওনা চৌরাস্তায় গিয়ে মেইন রোড ছেড়ে আচমকা গাড়ী চলতে লাগল ডান দিকের ছোট এক রাস্তা দিয়ে। গ্রামের পথে নেমেছে গভীর নিশুতি। চারদিকে ঝিঝির ডাক আর দূরে জনশুন্য প্রান্তরের পর প্রান্তর। কোন অজানায় চলছে আমাদের গাড়ী ? রাস্তায় অন্য কোন গাড়ী নেই বললেই চলে।
আমি নিঃসন্দেহ হয়ে গেলাম আমাদের অপহরন করা হয়েছে। অতি লোভে তাতী নষ্ট, ওটির জন্য সার্জন ভ্রষ্ট। ফিসফিস করে এনেস্থেটিস্ট বন্ধুকে আমার আশঙ্কার কথা জানালাম। সে চোখ বড় বড় করে বলল, এখন কি হবে ?
মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। আমরা যে ওদের পরিকল্পনা বুঝে ফেলেছি এটা ওদের কোনভাবেই জানতে দেয়া যাবে না। পথে কোন অজুহাতে নেমেই দুজন দুদিকে দৌড় দিতে হবে। তারপর অন্ধকারে হাওয়া। এরপর? এই অন্ধকারে যাবটা কোথায় ? চোর ভেবে গ্রামের মানুষ যদি উত্তম মধ্যম দিয়ে বসে ? ওরে বাবা ! না, পথে কোন বাজারে নেমে পড়তে হবে। তারপর বাজারের লোকদের বিষয়টা খুলে বললে একটা ব্যাবস্থা হবে বোধহয়।
আমি কাশি দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সামনে কি কোন বাজার আছে?
-কেন স্যার।
-একটু মাইনাস করে হালকা হওয়া লাগত। আর তাছাড়া রাত তো প্রায় এগারটা বাজে কিছু খাওয়া প্রয়োজন ।
-স্যার সামনেই শ্রীপুর বাজার। তবে স্যার আপনাদের জন্য মোরগ-পোলাও রান্না করতে বলেছি। রান্না শেষ হল কিনা এখনই খোজ নিচ্ছি স্যার।
আমি মনে মনে বললাম, মোরগ-পোলাও লাগবোনা ,জান বাচলেই খুশি। শ্রীপুর বাজারের কথা শুনে মনটা একটু আশার আলো দেখতে পেয়েছিল, কিন্তু গিয়ে হতাশই হলাম, একটা উপজেলা অথচ এই রাতেই প্রায় সব দোকান ঝাপি দিয়ে বন্ধ। ওদেরকে একটু পাশ কাটিয়ে পাশের উপজেলা সাস্থ্য কেন্দ্রে ঢুকে পড়লাম। সেখানে একজন মেডিক্যাল টেকনোলজিস্টের দেখা পেয়ে সবকিছু খুলে বললাম। সে বলল , স্যার আপনারা বাসার ঠিকানা দিয়ে যান যদি আপনারা ফেরত না আসেন আমি খবর পাঠাব, তবে ওদেরকে আমি চিনি মনে হচ্ছে। মনে মনে বললাম, আমরাই যদি ফেরত না আসি তাহলে খবর দিয়ে কি হবে? যাক, আল্লাহর উপর ভরসা করে গাড়িতে উঠে বসলাম। রাত আরো গভীর হচ্ছে। রাস্তার চারপাশে একদমই অজপাড়াগাঁ। অবশেষে বরমী এসে গেল। এসেই স্তম্ভিত হয়ে পড়লাম। হাজার হাজার লোক জমে গেছে। প্যান্ডেলের মত করা হয়েছে। মাইকে ঘোষনা হচ্ছে , আমরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে এইমাত্র ঢাকা থেকে বিশিষ্ট সার্জন ডা. . .
ওই ক্লিনিকেই অনেকদিন অপারেশন করেছিলাম।
-----
গল্পের ফাকে ফাকে মাঝরাতে কখন অপারেশন শেষ হয়ে গেল টেরই পেলাম না।
বিষয়: বিবিধ
১১৫৮ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন