সেই পথে ... (ছোট গল্প)
লিখেছেন লিখেছেন তরিকুল হাসান ২২ নভেম্বর, ২০১৪, ০৬:৫০:১৬ সন্ধ্যা
জাবেদ পাটোয়ারীর মাথাটা কিছুটা টলে উঠল। সিগারেটে শেষ একটা টান দিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিলেন। পথের আউলা বাতাসে ধোয়াটা ছেড়ে দিলেন। তারপর আরিফের চোখের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন।
'তুই ঠিক করি কতিছিস তো ?'
আরিফ মিন মিন করে বলল 'হ , চাচা আমার বন্ধু আমারে পাক্কা খবরইত দিল।'
মাথাটা কেমন যেন ফাকা ফাকা লাগছে তার। এটা কিভাবে সম্ভব ! তরুন বয়সে মানুষের রক্ত টগবগ করতে থাকে। এই বয়সে ছেলেপুলে সিগারেট-গাজা ধরতে পারে, ক্লাস ফাকি দিয়ে মেয়ে মানুষের সংগে রং ঢং করতে পারে। কিন্তু তার মত প্রগতিশীল মানুষের ছেলে যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে মিছিল করে পুলিশের হাতে ধরা খাবে, এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যাচ্ছে না! তিনি মাটিতে একরাশ থুতু ফেলেন ! স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের কমান্ডার হিসেবে বহুদিন যাদের কথায় কথায় তুলোধুনা করেছেন, তারা এখন কি তবে নিজের ঘরেই বাসা বেধেছে ? সর্বনাশ! তিনি কড়া সুরে বলেন 'এই খবর কাক-পক্ষীও যেন জানতি না পারে, জানলি কলাম তোরে জানে শেষ করি দিবানে !'
আরিফ ছেলেটাকে ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। বিড়ি সিগারেটতো খায়ই নেশা-টেশাও করে বোধহয়। তবে না জেনে কেউ তার কানে উল্টা পাল্টা কথা লাগানোর দুঃসাহস করবেনা। ঠিক খবরটা নেয়া দরকার। ছোটবেলার বন্ধু এস আই কবিরকে ফোন দিলে হয়। এক ঝলকে শৈশবের বহু স্মৃতি মনে পড়ে যায়। একবার ঝগড়া করে কানে কামড় দিয়েছিল বদমাশটা। এখনও মাঝে মাঝে কানটা ব্যাথা করে। বাদরটার সাথে বহুদিন কথা হয় না।
তিনবার ডায়াল করার পর কবির কল রিসিভ করল। ওপাশে পরিচিত একটা কন্ঠ বিরক্তি নিয়ে বলল 'কিডা কতেছেন?'
'তোর বাপ কতিছে , আছিস কিমুন?'
'ও জাবিদ ! শালা, এতদিন পোর কি মনি করি ফুন দিলি?'
'তোগোরে থানায় নাকি ভার্সিটির কয়েকটা বদমাশকি ধরিছিস ?'
'ধরিছিতো ? তোর পরিচিত কিউ আছে নিকি ?'
'দেখতো আমার পুলা কাশিম আছে নিকি?'
'ও কাশিম! কাশিম তোর পুলা ? অই পুলাইত নেতা! অরে তো বিস্ফোরক মামলায় চালান করি দিসি ?'
'কস কি ? এখন কি হবি ? সবাই জানলি পরি আমার মান-ইজ্জত কটি জাবি খিয়াল করিছিস ?'
'ঠিক আছে , তুই চিন্তা করিসলে , আমি ইকটা বেবুস্থা নিতিছি।'
কল কাটার পর কেমন কেমন যেন লাগে জাবেদ সাহেবের। কাশেমের মুখটা বারবার চোখে ভেসে ওঠে। আচ্ছা কোনদিনতো এই ছেলেকে কোন খারাপ কাজে দেখেননি তিনি। আশেপাশের সবার কাছে কত গর্ব করতেন - 'তোমরা দিখি লিও আমার পুলা এমন পাশ দিবি তিন গেরামের মানুষ তার কথা কবি।' বুকের বামপাশটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠে।
বাড়ীতে ঢুকে কাশেমের ঘরে ঢুকেন তিনি। আহা, দুইমাস আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে এই চেয়ারে বসেছিল ও, এখন পুলিশের নির্যাতনে শীতের মধ্যে কোথায় আছে কে জানে ? ভাবতে ভাবতে চোখ ভিজে যায়। আনমনে সেই চেয়ারে বসে পড়েন। টেবিলে একটা অপরিচিত বই পড়ে আছে। একপাতায় চিহ্ন দেয়া। আশ্চর্য! বইটা পাঠ্য বইয়ের মত দাগিয়ে দাগিয়ে পড়া। বেখেয়ালে পড়তে শুরু করেন জাবেদ সাহেব।
. . . . পিতা-মাতার পরম আদরে ঐশ্বর্যের মধ্যে লালিত মক্কার অন্যতম সুদর্শন যুবক ছিলেন তিনি। মা সম্পদশালী হওয়ার কারণে অত্যন্ত ভোগ-বিলাসের মধ্যে তাঁকে প্রতিপালন করেন। তখনকার যুগে মক্কার যত রকমের চমৎকার পোষাক ও উৎকৃষ্ট খুশবু পাওয়া যেত সবই তিনি ব্যবহার করতেন। রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সামনে কোনভাবে তার প্রসঙ্গ
উঠলে বলতেনঃ “মক্কায় মুসআবের চেয়ে সুদর্শন এবং উৎকৃষ্ট পোষাকধারী আর কেউ ছিল না।” (তাবাকাত) । ঐতিহাসিকেরা বলেছেনঃ “তিনি ছিলেন মক্কার সর্বোৎকৃষ্ট সুগন্ধি ব্যবহারকারি।”
উহুদের যুদ্ধ শেষে হযরত মুসয়াবের লাশটি খুঁজে পাওয়া গেলো। রক্ত ও ধুলোবালিতে একাকার তার চেহারা। লাশের কাছে দাঁড়িয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অঝোরে কেঁদে ফেললেন। হযরত খাব্বাব ইবনুল আরাত বলেনঃ “আমরা আল্লাহর রাস্তায় আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাথে হিজরাত করেছিলাম। আমাদের এ কাজের প্রতিদান দেওয়া আল্লাহর দায়িত্ব। আমাদের মধ্যে যারা তাদের এ কাজের প্রতিদান মোটেও না নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে তাদের একজন মুসয়াব ইবন উমাইর।
… … ইসলাম গ্রহণের পর
প্রাণপ্রিয় ছেলেকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে বের
করে দিতে দিতে মা বলছেঃ ‘তোমার যেখানে খুশি যাও। আমাকে আর মা বলে ডেকো না’। ছেলে একটু মায়ের দিকে এগিয়ে বললেনঃ ‘মা আমি আপনাকে ভালো কথা বলছি, আপনার প্রতি আমার দারুণ মমতা রয়েছে। আপনি একবার একটু বলুন, আশহাদু আল-লাইলাহা ইল্লাল্লাহু
ওয়া আন্না মুহাম্মাদান আবদুহু ওয়া রাসূলুহু’।
মা উত্তেজিত হয়ে নক্ষত্ররাজির নামে কসম খেয়ে বললেনঃ ‘আমি তোমার দ্বীন গ্রহণ করব না। তোমার দ্বীন গ্রহণ করলে আমার মতামত ও বুদ্ধি-বিবেক দুর্বল বলে মনে করা হবে।’
এভাবে কুরাইশদের সেই চরম আদুরে ও
বিলাসী যুবক মুসয়াব বাড়ী থেকে বিতাড়িত
হয়ে পথে বেরিয়ে পড়লেন। এখন তিনি মোটা শতচ্ছিন্ন পোশাক পরেন। একদিন
খাবার জুটলে অন্যদিন অভুক্ত কাটান।
কিন্তু বিশ্বাসেরআলোয় আলোকিত তার
অন্তরটি।
উহুদে তিনি শাহাদাত বরণ করলেন।
তাকে কাফন দেওয়ার জন্য একপ্রস্থ চাদর
ছাড়া আর কোন কাপড় পাওয়া গেলো না।
তা দিয়ে তার
মাথা ঢাকলে পা এবং পা ঢাকলে মাথা বেরিয়ে যাচ্ছিলো।
শেষমেষ রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের বললেনঃ চাদর
দিয়ে মাথার দিক
থেকে যতটুকু ঢাকা যায় ঢেকে দাও বাকী পায়ের
দিকে ‘ইখযীর’ ঘাস দাও।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
মুসয়াবের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে পাঠ
করেনঃ ‘মিনাল মু’মিনীনা রিজালুন সাদাকু
আহদুল্লাহ আলাইহি… মুমিনদের মধ্যে এমন
কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর সাথে অঙ্গীকার
সত্যে পরিণত করেছে ... ...
. . .বেলা গড়িয়ে যায়। জাবেদ সাহেবের
অন্তরে জেগে ওঠে অন্য এক মানুষ। বিবেকের সেই
চিরন্তন পথে পবিত্র আলোয় উদ্ভাসিত হয় সহস্র
সুশীতল ঝর্নাধারা। নিরন্তর তাওহিদী ঝলক
ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে।
বিষয়: বিবিধ
১১২৩ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
“আসহাবে রাসূলের জীবনকথা [প্রথম
খন্ড]” গ্রন্থটি থেকে হুবহু
তুলে দেয়া হয়েছে।
অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন