কাওরাইদ ; এক ঐতিহ্যবাহী জনপদ ।

লিখেছেন লিখেছেন তরিকুল হাসান ০৫ নভেম্বর, ২০১৪, ০৫:৫৮:৪৯ বিকাল

গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানায় সুতিয়া নদীর তীরে ছোট্ট গ্রাম কাওরাইদ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত এই গ্রামেই শৈশব কাটিয়েছেন 'মোদের গরব , মোদের আশা ; আমরি বাংলা ভাষা' সহ অসংখ্য বিখ্যাত বাংলা কবিতা ও গানের রচয়িতা কবি অতুল প্রসাদ সেন, ভারত বর্ষের প্রথম আইসিএস ও ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম 'নাইট ' উপাধিপ্রাপ্ত স্যার কে জি গুপ্ত সহ অসংখ্য প্রথিতজশা ব্যক্তি।

কাওরাইদের কিছু দর্শনীয় স্থান-

*রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত ডাক-বাংলোঃ

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ময়মনসিংহে যাওয়ার পথে এ ডাক-বাংলোতে ( যা বর্তমানে ভুমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে) অবস্থান করেন। কবি অতুল প্রসাদ সেন তার বিখ্যাত গান 'মোদের গরব , মোদের আশা , আমরি বাংলা ভাষা' এই ডাক-বাংলোতে বসেই রচনা করেন বলে কথিত আছে। ডাক-বাংলোটি সুদৃশ্য কাঠ নির্মিত ও সুতিয়া নদীর তীর ঘেষেই অবস্থিত।

*কাওরাদি ব্রম্ম মন্দির ও স্মৃতি ফলকঃ

গুপ্ত পরিবারের বিখ্যাত ব্যক্তিদের স্মরণে মন্দির চত্বরে রয়েছে সতেরটি স্মৃতি ফলক। স্মৃতিফলকগুলো কলকাতার সরাইসেন্ট

থেকে আনা মূল্যবান শ্বেত পাথরে নির্মিত।

স্মৃতিফলকে যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন স্যার কে জি গুপ্ত, প্রসন্ন তারা গুপ্তা, কালীনারায়ণ গুপ্ত, অন্নদা সুন্দরী গুপ্তা, প্যারী মোহন গুপ্ত, গঙ্গাগোবিন্দ গুপ্তা, বিনয় চন্দ্র গুপ্ত, হেমন্ত শশীগুপ্ত,

সরলা সুন্দরী দেবী, বিমলা দাস,

প্রাণকৃষ্ণ আচার্য, শশীভূষণ দত্ত,

সরযুবালা সেন, মিহির কুমার সেন,

হিমাংশু মোহন গুপ্ত, অতুল প্রসাদ সেন ও

বিনোদ মণি গুপ্তা।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়

স্মৃতিফলক চত্বরে অতুল প্রসাদ সেনের

স্মৃতিফলকে ‘মোদের গরব মোদের

আশা আ মরি বাংলা ভাষা’ লেখা থাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর

গুলিতে স্মৃতিস্তম্ভের কিছু অংশ

ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। পরে ক্ষতিগ্রস্ত অংশটুকু

পুনর্নির্মাণ করা হয়।

*শাল বনঃ

এটি মুলত ক্রান্তীয় পতনশীল পত্রযুক্ত বৃক্ষের বনভূমির একটি অংশ। শাল ( Shorea robusta ) এ বনের প্রধান বৃক্ষ।এ বনে খেঁকশিয়াল, বাগদাস , বেজী,

কাঠবিড়ালী , গুঁইসাপ আর কয়েক

প্রজাতির সাপ দেখা যায়।

*সুতিয়া নদীর মনোরম দৃশ্য ও কাওরাইদ রাবার ড্যাম প্রকল্পঃ

শ্রীপুরের বরমী বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদী কিছু দূর গিয়ে ত্রিমোহনী থেকে একটি শাখা উত্তর-পশ্চিম দিকে সুতিয়া নাম ধারণ করে। লাল-এঁটেল মাটির বুক চিরে বয়ে যাওয়া এই সুতিয়া নদী শ্রীপুর, গফরগাঁও ও ভালুকা হয়ে ফুলবাড়িয়া উপজেলায় গিয়ে শেষ হয়েছে।

*কাওরাইদ কেএন উচ্চ বিদ্যালয়ঃ

স্যার কে জি গুপ্ত ১৯২৯ সালের গোড়ার দিকে তার বাবা প্রখ্যাত ব্রাহ্মধর্মীয় নেতা ও

সঙ্গীতজ্ঞ কালি নারায়ণ গুপ্তের

নামে প্রতিষ্ঠা করেন কাওরাইদ কেএন উচ্চ

বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার কয়েক বছরের মাথায় এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়। এটি শ্রীপুরের সবচেয়ে প্রাচীনতম বিদ্যাপীঠ । এই এলাকার লোকজনকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে স্যার কে জি গুপ্ত তিন একর তেত্রিশ শতাংশ জমির ওপর স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় বাঁশ-কাঠ আর টিনের সমন্বয়ে গড়ে তোলেন বিদ্যালয়টি। এক্ষেত্রে স্যার কে জি গুপ্তকে সহযোগিতা দিয়েছিলেন তার মামা কোরান শরীফের প্রথম বাংলা অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ও ভাগিনা কবি অতুল প্রসাদ সেন। প্রসংগত, এই বিদ্যালয়ে আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে এবং আল্লাহপাকের অসীম কৃপায় এই বিদ্যালয় থেকে প্রথম এস এস সি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পাওয়ার তওফিক হয়েছে।

কাওরাইদের গুপ্ত জমিদারদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসঃ

কাওরাইদে গুপ্ত জমিদারি এস্টেট

প্রতিষ্ঠিত হয় ১৭৯৩ সালে। নরসিংদীর

ভাটপাড়ার প্রতাপশালী জমিদার

মহিন্দ্র নারায়ণ গুপ্ত কাওরাইদ এলাকার

তালুকগুলো কিনেছিলেন ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার শিলাশী গ্রামের জমিদার মীর আহম্মদের কাছ থেকে। ভাটপাড়ার বিশাল এলাকাসহ শ্রীপুরের কাওরাইদ এলাকা ও ময়মনসিংহের

ভাটি অঞ্চলে গুপ্ত পরিবারের জমিদারি বিস্তৃত ছিল।

এ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার শ্রী মহিন্দ্র নারায়ণ গুপ্ত সন্তানহীন হওয়ায় তাঁর বিশাল আধিপত্য রক্ষার জন্য দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার (পুরাতন রায়পুরা) চুলা ইউনিয়নের আকানগর গ্রামের সুধারাম সেন ও যশোধা দেবীর পুত্র কালীনারায়ণ

সেনকে। জমিদারবাবু কালীনারায়ণকে পুত্রস্নেহে পালন করতে থাকেন। ফলে তিনি সেন থেকে গুপ্ত উপাধিপ্রাপ্ত হন।

কালীনারায়ণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি, তবে নিজ প্রচেষ্টা ও প্রজ্ঞাবলে বাংলা, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপত্তি লাভ করেন।

তাছাড়া হিন্দুধর্মীয় ভক্তিগীতি গেয়ে সে সময়ে তিনি খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন।

পরবর্তীকালে ১৮৬৯ সালে তিনি হিন্দু

ধর্মসংস্কারক রাজা রামমোহন রায়,

পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী প্রমুখ প্রবর্তিত

ব্রাহ্মধর্মে দিক্ষিত হন। সে সময়ে এ ধর্ম

সংস্কার আন্দোলনকে পূর্ববাংলায়

বেগবান করার জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক

পৃষ্ঠপোষকতা দেন কালীনারায়ণ।

কালীনারায়ণের বড় ছেলে কৃষ্ণ গোবিন্দ গুপ্ত ওরফে কে জি গুপ্ত বিপুল খ্যাতিলাভ

করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসনামলে তাকে কিংবদন্তি বাঙালি মনে করা হতো। কে জি গুপ্ত ১৮৫১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর ভাটপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রখর মেধাবী কে জি গুপ্ত শিক্ষাজীবন শুরু করেন ঢাকার পগোজ, পরে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। কলেজ জীবনে অত্যন্ত ভালো ফলাফল করে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তখন অক্সফোর্ডে কে জি গুপ্তকে সবচে মেধাবী ভারতীয় বলে গণ্য করা হতো। সে সময় কেবল ইংরেজ বংশোদ্ভূতরাই উচ্চপদস্থ সরকারি চাকরি পেত। কিন্তু কে জি গুপ্ত নিজ প্রতিভাবলে চিরাচরিত নিয়ম ভেঙ্গে আইসিএস অফিসার হিসেবে চাকরি অর্জন করেছিলেন।

তাছাড়া তিনি ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয়ের ভারতীয় কাউন্সেলরের প্রথম ভারতীয় সদস্য, ইংল্যান্ডের হাউস অব কমনসের সম্মানিত সদস্য ছিলেন। এছাড়া ইংল্যান্ডের রানি কর্তৃক দুর্লভ সম্মানসূচক ‘নাইট কমন্ডারস অব দি স্টার’ এবং ব্রিটিশ প্রশাসন প্রথম ভারতীয় হিসেবে তাকে ‘স্যার’ উপাধিতে ভূষিত করে। স্যার কে জি গুপ্ত ১৮৫৭সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় ইংরেজ দুঃশাসনেরবিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। বিলেতের লিংকনস ইন থেকে ব্যারিস্টারি পড়ে ইংরেজদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে আন্দোলনরত বাঙালি সৈনিকদের আইনি সহায়তা দেন তিনি।

প্রসন্নতারা গুপ্তা ওরফে তুফানী গুপ্তা হচ্ছেন স্যার কে জি গুপ্তের সহধর্মিণী।

তুফানী গুপ্তা ১৮৮৬ সালে কলকাতায় সখী সমিতি নামে নারী উন্নয়ন কেন্দ্রিক একটি সামাজিক সংগঠনের গোড়াপত্তন করেন। এ সংগঠনটি ওই সময়ে স্ত্রীশিক্ষা, বিধবা বিয়ের প্রচলন, সহমরণ প্রথা রোধসহ বিভিন্ন সামাজিক সংস্কারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। লাকসামের জমিদার নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী এ সংগঠনের অন্যতম সদস্য ছিলেন।

স্যার কে জি গুপ্ত ও তুফানী গুপ্তা দম্পতির মেয়ে হেমকুসুম গুপ্তার বিয়ে হয় কে জি গুপ্তের ভাগনে উপমহাদেশের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ, সুরকার, গীতিকার ব্যারিস্টার অতুল প্রসাদ সেনের সাথে।

পবিত্র কুরআনের প্রথম সার্থক বাংলা অনুবাদক ভাই গিরীশ চন্দ্র সেন স্যার কে জি গুপ্তের মামা।

কে জি গুপ্তের ভাইবোনের মধ্যে অন্যরাও নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়েছিলেন। এরমধ্যে প্যারী মোহন গুপ্ত ভারতের তৎকালীন খ্যাতিমান সিভিল মেডিকেল অফিসার ছিলেন।

তৃতীয় ভাই গঙ্গাগোবিন্দ গুপ্ত বিখ্যাত

চিত্রকর ছিলেন। তিনি ছিলেন তৎকালীন ঢাকার হোলিখেলা উৎসবের উদ্যোক্তা।

তার বোন সৌদামিনী গুপ্তার ছেলে চারুচন্দ্র আর চারুচন্দ্রের মেয়ে বিজয়া হচ্ছেন বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের স্ত্রী ।

অপর বোন সরলা গুপ্তার মেয়ে সুপ্রভা হলেন সুকমার রায়ের স্ত্রী ও সত্যাজিৎ রায়ের মা। এ পরিবারের সদস্যরা আজও দেশে-বিদেশে সুনামের সাথে কর্মক্ষেত্রে স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠিত।

তথ্যসুত্র- সংগৃহিত।

(কোন তথ্যে অসংগতি পরিলক্ষিত হলে সংশোধন সাদরে গৃহিত হবে।)

বিষয়: বিবিধ

২০০৭ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

281531
০৫ নভেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪১
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
শ্রিপুর গেলেও তার সম্পর্কে এতকিছু জানা ছিলনা।
০৫ নভেম্বর ২০১৪ রাত ১১:২৭
225167
তরিকুল হাসান লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ।
312570
০৩ এপ্রিল ২০১৫ রাত ০১:০১
অয়ন খান লিখেছেন : নিজেদের ঐতিহ্যের অনেককিছুই আমরা জানি না। ধন্যবাদ
০৬ এপ্রিল ২০১৫ সন্ধ্যা ০৬:০১
254281
তরিকুল হাসান লিখেছেন : ঠিক বলেছেন। ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File