'ফকির মজনু শাহ' নামের আড়ালে নবাব নুরুদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জং; এক অবহেলিত চমকপ্রদ ইতিহাস !
লিখেছেন লিখেছেন তরিকুল হাসান ২৪ আগস্ট, ২০১৪, ০৮:০৬:৪৮ সকাল
'এখানে শায়িত আছেন বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রানপুরুষ শহীদ নবাব নুরুউদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জং। তিনি ছিলেন দিল্লীর সম্রাট শাহ আলম (২য়) এর আপন চাচাত ভাই ও ভগ্নিপতি। ইংরেজ শাসন উৎখাতে তিনি ১৭৬০-১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অসংখ্যবার সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ন হয়েছিলেন। অবশেষে জমিদারীর লোভে 'দিবা ও নিশি' নামক দুইজন বিশ্বাসঘাতকের ষড়যন্ত্রে বর্তমান লালমনিরহাটের আদিতমারীস্থানের মোঘলহাট নামক স্থানে বৃটিশ সৈন্যদের অতর্কিত আক্রমনে আহত হন। আহত অবস্থায় তাকে তার রাজধানী (নির্মানাধীন) ফুলচৌকিতে আনা হয়। ১৭৮৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি আহত হন এবং ১৫ই ফেব্রুয়ারী ১৭৮৩ সালে তিনি ফুলচৌকিস্থ নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। প্রতিশোধ পরায়ন বৃটিশ শাসক গোষ্ঠি তাকে ফুলচৌকি জামে মসজিদের মুল গেইট বরাবর কবরস্থ করতে বাধ্য করে।-সৌজন্যে মাসিক ইতিহাস-অন্বেষা।'
এই সাইনবোর্ডটি অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে রংপুরের মিঠাপুকুরের ফুলচৌকির সুপ্রাচীন মসজিদের মুল গেইটে। আসরের নামাজের জামাতে একজন বৃদ্ধ ব্যক্তিকে পেয়ে জানতে চাইলাম এ সম্বন্ধে তিনি বললেন
'এখানে একজন বুজুর্গের কবর আছে বলে শুনেছি, তাকে অপমান করার জন্য মুলগেইটে কবর দেয়া হয়েছে, যাতে তাকে পা দিয়ে মাড়িয়ে মসজিদে ঢুকতে হয়। এজন্য মুলগেইট বন্ধ করে রাখা আছে আর আমরা সবাই পাশের ছোট গেইট দিয়ে ঢুকি।'
এর বেশি কিছু মসজিদের ইমাম সাহেবও বলতে পারলেন না।
এই হল ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিস্মরনীয় ব্যক্তি ফকির মজনু শাহ খ্যাত নবাব শহীদ নুর উদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জং এর সমাধি। ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রধান নায়ক ও সংগঠক ছিলেন নুর উদ্দিন মোহাম্মদ বাকের জং; যাকে ইতিহাসে মজনু শাহ নামে অভিহিত করা হয়েছে। প্রচন্ড জনবিদ্রোহকে শুধুমাত্র ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ হিসেবে আখ্যায়িত করার অপমন-মানসিকতায় বৃটিশ বেনিয়ারা এই মোঘল শাহজাদাকে ফকির মজনু শাহ হিসেবে প্রচার করেছে।জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানো এবং ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহকে অবমূল্যায়ন করার লক্ষ্যেই পরিকল্পিতভাবে বিদ্রোহী নবাবকে একজন ডাকাত সর্দার হিসেবে উপস্থাপন করেছে ইংরেজরা। নবাব নূর উদ্দিনই ঐতিহাসিক চরিত্র "নুরলদিন"। অথচ, ইংরেজরা তাঁকে স্বঘোষিত নবাব, বিদ্রোহীদের ঘোষিত নবাব, কখনও বা বিদ্রোহী ফকির সন্ন্যাসীদের দলনেতা হিসেবে উপস্থাপন করেছে। "নুরলদিন" যে নবাব নূর উদ্দিন বাকের মোহাম্মদ তার স্বপক্ষে কিছু অকাঠ্য প্রমাণ পাওয়া যায় বিশিষ্ট ইতিহাস গবেষক ও রংপুর জেলা বোর্ডের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান হায়দার চৌধুরীর লেখা ছয় শতাধিক পৃষ্ঠার "পলাশী যুদ্ধোত্তর আজাদী সংগ্রামের পাদপীঠ" নামক অমুল্য গবেষণাধর্মী গ্রন্থে। হায়দার আলী চৌধুরী দীর্ঘ ৪০ বছর গবেষণা করে অনেক তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে ১৯৬৭ সালে বইটি প্রকাশ করেন।
বর্তমানে নবাব নুর উদ্দিন বাকের জং এর নির্মানাধীন রাজধানী ফুলচৌকির মসজিদ বাদে সমস্ত স্থাপনা প্রায় ধ্বংস স্তুপে পরিনত হয়েছে। টাকশালের পুরো দেয়াল জুড়ে বুনো গাছ আর সাপ-কীট-পতংগের বসতি। অন্যান্য স্থাপনার পুরনো ইট-সুড়কির বেশিরভাগ অংশ লুটপাট হয়ে গেছে।
আজাদী সংগ্রামে শাহজাদা নুর উদ্দিন বাকের জং এর ভুমিকা-
বিহারের পশ্চিম প্রান্ত থেকে বাংলার পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে নবাব নুর উদ্দিন বিচ্ছিন্ন কৃষক ও কারিগর বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ করে একটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরিচালনাধীনে আনবার চেষ্টা করেছিলেন। এই বিদ্রোহে তিনি কখনও সৈন্য সংগ্রহকারী, কখনও প্রধান সেনাপতি আবার কখনও সমগ্র বঙ্গদেশ ও বিহারের বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহীদের সংঘবদ্ধ করতে ব্যস্ত ছিলেন।
ফকির মজনু শাহ সম্বন্ধে মুয়ায্যম হুসায়ন খান লিখেছেন,
He (ফকির মজনু শাহ) organised the sufi saints and the yogi sannyasis under a common platform, reported to have moved frequently between the western part of Bihar and the eastern extremity of Bengal mobilising the scattered fakirs and sannyasis and floating the spontaneous support of the
professional classes and the common people of Bengal in his fight against the east india company. (বাংলাপিডিয়া)
১৭৬৯ সালে তারা রংপুর আক্রমণ করেন। সেনাপতি ল্যাফটেনেন্ট কিং সৈন্যসহ তাদের দমন করার জন্য রংপুর গমন করে। যুদ্ধে কোম্পানী সৈন্য পরাজিত হয় এবং সেনাপতি লেফটেনেন্ট কিং নিহত হয়। ১৭৭১ সালে ফকির মজনু শাহের নেতৃত্বে আড়াই হাজার সৈন্য বিরাট ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে বিপর্যস্ত হলে তিনি মহাস্থানগড়ের সুরক্ষিত দুর্গে আশ্রয় নেন। পরে বিদ্রোহের প্রয়োজনে বিহার যান। ১৭৭১ সালে ১৫০ জন ফকিরকে হত্যা করা হয় বিনা কারণে। যা প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং এ ক্ষোভ পরবর্তীকালে ভয়াবহ রূপ নেয়। ১৭৭৪ সালের শেষ ভাগ থেকে কয়েকটি অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো আক্রমণ শুরু হলেও প্রকৃত সংগ্রাম আরম্ভ হয় ১৭৭৬ সালের শেষ দিক থেকে। এই সময় মজনু শাহ উত্তরবঙ্গে ফিরে এসে ছত্রভঙ্গ বিদ্রোহীদের আবার সঙ্ঘবদ্ধ করার ও নতুন লোক সংগ্রহের চেষ্টা করেন।
দিনাজপুর জেলায় তার উপস্থিতির খবরে ইংরেজ শাসক এতই ভীত হয়েছিল যে, অবিলম্বে জেলার সব জায়গা থেকে রাজস্বের সংগৃহীত অর্থ দিনাজপুর শহরের সুরক্ষিত ঘাঁটিতে স্থানান্তরিত করে রাজকোষের রক্ষী বাহিনীর শক্তি বাড়ানো হয়। ১৭৭৬ সালের ১৪ নভেম্বর একটি ইংরেজ সৈন্যদলের সঙ্গে মজনু শাহ’র বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এভাবে অসংখ্য সম্মুখ সমরে অংশগ্রহন করেন তিনি। অবশেষে ১৭৮৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে লালমনিরহাটের আদিতমারীর মোঘলহাটে প্রচন্ড যুদ্ধে আহত হয়ে বন্দী হন এবং ১৫ই ফেব্রুয়ারী রংপুরের মিঠাপুকুরের ফুলচৌকিতে শাহাদত বরন করেন। তার নির্মিত জামে মসজিদের মুল গেইটে তাকে কবরস্থ করে বৃটিশ বেনিয়ারা।
তথ্যসুত্র-
১)বাংলাপিডিয়া
২)১৮৫৭'র সিপাহী বিদ্রোহে রংপুর : ফকির ও সন্যাসী বিদ্রোহের কিছু অবিশ্বাস্য অপ্রকাশিত ইতিহাস
৩)আত্মবিস্মৃত এক রাজধানী : মিঠাপুকুরের ফুলচৌকি
৪) পলাশী যুদ্ধোত্তর আজাদী সংগ্রামের
পাদপীঠ : হায়দার আলী চৌধুরী।
৫) কিংবদন্তীর রংপুর : মতিউর রহমান বসুনীয়া
৬) কোচ বিহারের ইতিহাস খাঁ চৌধুরী আমানুল্লাহ আহমেদ।
৭)প্রথম ইংরেজ বিদ্রোহী বীরাঙ্গনা জয়দূর্গা দেবী চৌধুরানীর স্মৃতি গাঁথা
৮) প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী মজনু শাহ
-এ.জেড.এম. শামসুল আলম।
৯) বাংলার মুক্তি সন্ধানী
-সব্যসাচী চট্টপাধ্যায়, রাখী চট্টপাধ্যায়।
১০) বিদ্রোহী ভারত
-নীহাররঞ্জন গুপ্ত।
বিষয়: বিবিধ
২৮৭৪ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নবাব নুরুদ্দিন ও ফকির মজনু শাহ এক ব্যাক্তি ছিলেন কিনা সন্দেহ আছে। তবে সমসাময়িক ছিলেন এটা বুঝা যায়। বিশেষ করে নুরুদ্দিন বাকের জং এর অবস্থান ছিল উত্তর বঙ্গে ফকির মজনু শাহ এর অবস্থান ছিল বগুড়া ও বর্তমান ময়মনসিং অঞ্চলে।
নবাব নুরুদ্দিন এর উপর বিশদ গবেষনা এখনও হয়নি। তা স্মৃতিময় স্থানগুলির যে ঐতিহাসিক মুল্য আছে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর সেগুলি সংরক্ষন এর দায়িত্ব নেয়া উচিত।
তাই মৌলিক মানুষের অধিকারের দাবীকে সন্ত্রাস আখ্যা দিয়ে দমন করা হয়!
ইতিহাসের পাতায় গেলে নিজেদের শিকড় খুঁজে পাই
জাযাকাল্লাহ..
মন্তব্য করতে লগইন করুন