১/১১’র এপিঠ ওপিঠ ও আজকের বাস্তবতা - নোমান মাহমুদ -
লিখেছেন লিখেছেন নোমান সিলেট ২২ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:২৪:১২ দুপুর
“কয়লা ধুইলেও ময়লা যায় না”- প্রবাদ বাক্যটির সাথে সিলেটের একটি ছিলখের হুবহু মিল রয়েছে- “হাজার বাড়ির হাজার টান, আর নাড়িয়ে মারে এক টান”। আবার “কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই” এমন সব অধিক প্রচলিত লোক মুখের কথার মাঝে রাজনৈতিক বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার,বেশ মিল রয়েছে। বাংলাদেশের রাজনীতি, রাজনীতিবিদ সর্বোপরি সাধারণ মানুষের সাথে উপরোক্ত কথাগুলোর মিল পাওয়া যায় অক্ষরে অক্ষরে । এদেশের মানুষ অতীতকে ভূলে যায় খুব অল্প সময়ে। অতিতের অনুশোচনা থেকে শিক্ষা নিতে এদেশের মানুষ জানে না কিংবা জানতে চায় না। যেমনি হয় নি ১/১১ পরবর্তী সময়েও।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ১/১১ একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়। বাংলাদেশ যখন একটি ইমার্জিন টাইগারের দেশে পরিনত হতে চলেছিলো ঠিক তখনি আমাদের অতি ক্ষমতালিপ্সু রাজনৈতিক নেতাদের অদূরদর্র্শী চিন্তা এবং জাতীয় স্বার্থে দল ও ব্যক্তি স্বার্থের জলাঞ্জলি না দেয়াই এক-এগারোর শানে-নূযুল। আজ এক-এগারোর প্রেক্ষাপট নতুন করে বলার কিছুই নেই। সবই আমাদের মত নতুন প্রজন্মের কাছে পরিষ্কার। যদিও আজ থেকে হয়তো ২০-৫০ বছর পরে ১/১১ নিয়ে অনেক বিকৃত ও কল্পনাপ্রসূত ইতিহাস রচিত হতে পারে যেমনি আজকের বাস্তবতায় ৭১’র কে নিয়ে হচ্ছে। কে স্বাধীনতার ঘোষক আর কে নয়, কে বাংলার স্থপতি আর কে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদান কারী, কে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে শক্তি আর কে বিপক্ষের শক্তি (?) তা আজো জাতিকে বিভ্রান্ত, বিভক্তি ও সংঘাতের মধ্যে রেখেছে।
যাই হোক ১/১১ পূর্ববর্তী সময়গুলোতে আমাদের দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে কাঁদা ছোড়া-ছুড়ি হয়েছিল, তা জাতির সামনে ছবির মত দৃশ্যমান। একপক্ষের ক্ষমতা পূণঃদখলের পায়তারা আর অপরপক্ষের যে কোন মতে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র, কেউ কাউকে ছাড় না দেয়ার মানসিকতাই ১/১১’র দুঃসহ বেদনার দুটি বছরের জন্ম দেয়। সুযোগ বুঝে আধিপত্যবাদীরা আমাদের দেশের কিছু সুযোগ সন্ধানী সুশীল সমাজের (!) ব্যক্তিদের আড়ালে অন্তরালে সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেয়। পশ্চিমা গোষ্ঠী ও পাশ্ববর্তী দেশের কুটনৈতিক তৎপরতা ১/১১ কে অপরিহার্য করে তুলেছিল তা সময়ের ব্যবধানে হলেও সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। তখনকার সময়ে প্রধান দুই দলের মহাসচিব যথাক্রমে আব্দুল মান্নান ও আব্দুল জলিলের মধ্যকার সংলাপ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলে ২৮ অক্টোবরের মত কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত হয়। সেদিন রাজপথে লাশের মিছিল হয়েছিল। ১/১১ আসার পর যখন রাজনীতিবিদদের মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছিল তখন আব্দুল মান্নান (যিনি এখন মৃত্যু পথযাত্রী) দল ও দেশের সাথে বেঈমানী করে তৎকালীন জরুরী সরকারের (?) আশির্বাদপুষ্ট হয়েছেন আর জলিল সাহেব জেলে পুরে রাজনীতি করবেন না বলে হলফনামা দিয়েছিলেন। সেনা সমর্থিত সরকারের অপশাসনের মুখে যখন আমাদের রাজনীতিবিদদের মুখোশ উন্মোচিত হচ্ছিল, দূর্নীতি আর লুটপাটের শ্বেতপত্র বের হচ্ছিল, রাজনীতিবিদদের হীন চরিত্র লোক সম্মুখে প্রকাশ পাচ্ছিল তখন এদেশের সাধারণ মানুষ তৎকালীন জরুরী সরকারকে বাহবা দিয়েছিল। কিন্তু জরুরী সরকারের নামে ক্ষমতায় এসে যারা দূর্নীতি বিরোধী হয়ে উচ্চস্বরে গলাবাজী করেছিল তারাই শেষ পর্যন্ত দূর্নীতির কাছে মাথা নত করেছে।ঐ সময় যারা প্রেস নোট জারি করে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের জন্য বিপদজনক ব্যক্তি বলেছিল, যারা মাইনাস টু ফর্মূলা বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিল তাদেরকে জাতি শেষ পর্যন্ত বেঈমান, মীরজাফর বলেছিলো এবং আজও অবদি গোটা জাতি তাদের প্রতি ধিক্কার জানাচ্ছে। উপরন্তু ক্ষমতাসীনরা তাদেরকে জামাই আদরে রেখেছে। জরুরী সরকারের নামে যারা দেশের রাজনীতিবিদদেরকে হেনস্তা করেছিলে, ধরে ধরে জেলে পুরিয়েছিল, দূর্নীতির দায়ে সাজা দিয়েছিলো, রাজনীতিবিদদের দেশের উন্নয়নের জন্য হুমকিসরূপ ও বাঁধার প্রাচীর বলে প্রচার করেছিল, তারাই সেই রাজনীতিবিদদের কাছে হার মেনেছিলো। গোটা জাতি তখন মনে করেছিল ১/১১ হলো আমাদের সকল রাজনৈতিক দল ও নেতাদের জন্য উত্তম শিক্ষা। দেশবাসী মনে করেছিল পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকার হবে একটি উত্তম সরকার। যেখানে থাকবেনা ১/১১ পূর্ববর্তী হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলবে না রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলো বেরিয়ে আসবে তাদের হীন গন্ডি থেকে, তাদের মাঝে জন্ম নেবে সম্প্রীতি, গড়ে উঠবে শ্রদ্বাবোধ। প্রতিটি দল নিজ নিজ আদর্শ ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ করবে। একটি সুন্দর ও আধুনিক বাংলাদেশ হিসেবে গণতন্ত্র বিকশিত হবে। সুসংহত হবে আমাদের গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। মানুষ মনে করেছিলো সেনা সমর্থিত সরকার দুবছরে আমাদের দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে যেভাবে পঙ্গু করেছিলো, ২০০৮সালের ২৮ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও রাজনীতির ভঙ্গুর দশা হতে মুক্তি পাবে।
নির্বাচনে প্রধান দুই দলসহ সবকটি দলের নির্বাচনী ইশতিহারও তৈরী করা হয়েছিলো রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার অঙ্গীকার নিয়ে। গণতন্ত্রকে বিকশিত করা, রাজনীতিতে সহনশীল ও সহাবস্থানের সুনিশ্চিত করারও অঙ্গীকার ছিল প্রতিটি রাজনৈতিক দলের মেনিফেস্টুতে। গোটা জাতি আশা করেছিল যে দলই ক্ষমতায় যাক না কেন দেশ আর ১/১১’র পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরে যাবে না। কিন্তু কই সেই নির্বাচিত দলের মেনিফেস্টু? কই গেলো রাজনীতিবিদদের কাছে গোটা জাতির প্রত্যাশা? গণতন্ত্রকামী এ জাতির প্রত্যাশা আজ গুড়ে বালিতে পরিণত হয়েছে। মানুষ মনে করেছিলো একটি অবৈধ জরুরী সরকারের চেয়ে ভোটের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত গণতন্ত্রমনা সরকারের কর্মকান্ড অনেক ভাল হবে। যদিও ২০০৮সালের নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন, অনেক কৌতুহল, অনেক ষড়যন্ত্র আর অসংখ্য রহস্যাবৃত ছিল তবুও পরাজিত রাজনৈতিক জোট ও গণতন্ত্রকামী জাতি আওয়ামী সরকারকে মেনে নিয়েছিল। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা যে বিগত অবৈধ সরকারের যোগসাজশে ক্ষমতায় এসেছে তার প্রমাণ কিন্তু এরশাদ সাহেব ও জলিল সাহেবদের বিভিন্ন সময়ের কথাবার্তায় (সংসদেও) থলের বিড়ালের মত বেরিয়ে এসেছে। তথাপিও এদেশের মানুষ আওয়ামী সরকারের উপর অনেক আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছিল। সবার ধারণা ছিল, জরুরী সরকারের নামে মঈন-ফখরুদ্দিন সরকারের চরম ব্যর্থতার ফলে পঙ্গু হয়ে যাওয়া দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও গণতন্ত্র বর্তমানে কিছুটা হলেও হালে পানি পাবে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ১৯ মাসের কর্মকান্ড গোটা জাতিকে চরমভাবে হতাশ করেছে। সাধারণ মানুষের আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। বিগত ১৯মাসের ক্ষমতাসীনদের হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি, দখলদারী, রাজনৈতিক নিপীড়ন, প্রতিশোধ গ্রহন সবকিছুতেই যেন তারা ১০০-তে ১০০ নম্বর পাবেন। ক্ষমতা গ্রহন পরবর্তী সময়ের অপরাজনীতি ও অস্থিরতা বিগত সময়ে বি.এন.পি’র সব রেকর্ডকেও ছাড়িয়ে যাবে। যার প্রমান তাদের বাম ঘরনার পত্রপত্রিকার লাল হেডিংগুলো। আওয়ামী ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের দৌরাত্মে খোদ তাদের নেত্রীও নিজ সাংগঠনিক পদ ছেড়েছেন। ইত্যকার সময়ে তাদের অপকর্মের ফলে ৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ২৮৭ দিন বন্ধ হয়েছে এবং ৪৫ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ১২৭ টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৯ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়। যার তুলনায় ৪ দলীয় জোট সরকারের সময় ১জন নিহত হয়েছিল এবং বন্ধ ছিল ৮৪ দিন। ছাত্রলীগের এমন তান্ডব আজো বন্ধ হয় নি। এমতাবস্থায় সরকার নিজ দলীয় সন্ত্রাস ও অবৈধ কর্মকান্ড না থামিয়ে বিরোধী দলের উপর নির্যাতন অতিমাত্রায় বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক নিপীড়ন ও নির্যাতন বেড়েই চলেছে। দেশের বিনিয়োগ যেখানে ৩৬% কমে গেছে সেখানে সরকার দেশের অর্থনীতির প্রতি খেয়াল না রেখে বিরোধী দল দমনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিরোধীদলকে হেনস্তা দল ও দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে সরকার দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির সুযোগ করে দিচ্ছে। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার স্বাধীনতাকে ছেপে ধরা, রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজপথে তাদের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে নেয়া সবই যেন বাকশালী অপতৎপরতার হাতছানি। বর্তমানে সরকার আরো কঠোর পথে পা বাড়াচ্ছে। সংবিধান সংশোধনের নামে৭২’র সংবিধান কার্যকর করা, ৫ম সংশোধনী বাতিল (অর্থাৎ বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তুলে নেয়া) করা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার মত স্পর্শকাতর বিষয়ে কাজ করছে। যা এদেশের ধর্মপ্রান মুসলমানরা কোনভাবেই মেনে নেবে না। এদেশের ৯০ভাগ মুসলমানেরা দেশে ৭২’র সংবিধানের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। আবার যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে জরুরী সরকারের মঈন-ফখরুদ্দিনের বিচার না করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আওয়ামী বুদ্ধিজীবিদের প্রশ্ন তোলা যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক ঘটায়। সর্বোপরি অতীতে যাদের সাথে অতীতে এক টেবিলে বসে এরশাদ ও বি.এন.পি বিরোধী আন্দোলন করেছিলো আওয়ামী লীগ সেই সব দল ও নেতাদেরকে আজ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্ঠা চলছে।
সবমিলিয়ে বাংলাদেশের আকাশে এক কালো মেঘ অশনি সংকেত দিচ্ছে। জানি না কোন শকুন শ্যোন দৃষ্টি নিয়ে বাংলাদেশের আকাশে উড়ো-উড়ি করছে। আমরা চাই না এদেশে আরো একটি ১/১১ আসুক, আরো একটি পঁচাত্তর, ছিয়াশি আসুক। আমরা চাই একটি সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধ হানা-হানী ম্ক্তু সম্প্রীতির বাংলাদেশ। যারা অতি মাত্রায় স্বাধীনতার দাবীদার তাদের উচিত দেশকে স্থিতিশীল রেখে সকল দল ও ব্যক্তির সাথে সম্প্রীতি ও সূহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরীর মাধ্যমে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তবেই সার্থক হবে স্বাধীনতা শহীদদের রক্ত, মুক্তিযুদ্ধাদের অসীম ত্যাগ ও স্বাধীনতার প্রকৃত চেতনা-বিশ্বাস।
বিষয়: রাজনীতি
১৬৬৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন