সালাম : প্রীতি, বন্ধুত্ব ও দয়ার প্রকাশ
লিখেছেন লিখেছেন আশরাফ রহমান ১৩ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:০৭:৫৭ রাত
বিভিন্ন সমাজে যোগাযোগ, অভ্যর্থনা, সম্ভাষণ ও শুভেচ্ছা প্রকাশের রীতি বা পদ্ধতি কিংবা এ সংক্রান্ত সংকেতগুলো বিভিন্ন ধরনের। যেমন, দেশ বা জাতিভেদে দেখা যায় কোনো ব্যক্তি বা বন্ধুর সাথে দেখা হলে অনেকে হাত বাড়িয়ে দেন বা হাতে হাত মেলান, আবার কেউবা বিশেষ শব্দ উচ্চারণ করেন, কেউ কেউ মাথার টুপি খুলে ফেলেন, আবার অনেকে মুচকি হেসে শুভেচ্ছামূলক বার্তা জ্ঞাপন করেন। আধুনিক যুগে মানুষের মধ্যে স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রীকতা বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের সম্পর্কে নেমে এসেছে গভীর শীতলতা। আধুনিক মানুষ এতই কর্মব্যস্ত বা চিন্তামগ্ন থাকেন যে আশপাশ দিয়ে কে বা কারা যাচ্ছে তা তাকিয়ে দেখার সময়ও তার নেই! নিজের অজ্ঞাতসারে বা ভুল করে সহানুভূতিপূর্ণ একটি দৃষ্টি নিক্ষেপ করাও যেন অতি দূর্লভ কিংবা অমাবশ্যার চাঁদের চেয়েও দুষ্প্রাপ্য।
মনোস্তত্ত্ববিদরা বলেন, আত্মকেন্দ্রীক জীবন বা নিজেকে গুটিয়ে রাখার জীবন মানুষকে মমতাহীন এবং অন্যের ব্যাপারে উদাসীন বা স্বার্থপর করে তুলছে। আর এ অবস্থা মোটেও কাংখিত নয়। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, আধুনিক যুগে মানুষের মধ্যে দয়া ও ভালোবাসার সম্পর্ক রাখা তথা সুস্থ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে জরুরী। কারণ, বর্তমান যুগে মনোস্তাত্তিক গবেষণাগুলোয় ভালোবাসা বা স্নেহপূর্ণ আচরণ ও দিকগুলোর ওপর বেশী গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
ইসলামী সংস্কৃতির এ ধারণা অত্যন্ত শক্তিশালী যে সুন্দর সুন্দর শব্দ ব্যবহার করে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার অনুভূতি জোরদার করা যায় এবং দূর করা যায় মানুষের অন্তরগুলোর দূরত্ব। মুসলমানরা একে-অপরকে দেখলে আসসালামুআলাইকুম বা সালাম শব্দটি উচ্চারণ করে একে-অপরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে থাকেন। সালাম বা আসসালামুআলাইকুম তথা আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক্- এ বাক্যের সাথে সাথে মিশে আছে অকৃত্রিম ভালবাসা ও পবিত্রতাপূর্ণ শ্রদ্ধার অপূর্ব বা সবচেয়ে মধুর অভিব্যক্তি। সালাম শব্দটি প্রীতির প্রসন্ন মুখে দুজন মুমিনের মিলনের আনন্দের প্রথম বহিঃপ্রকাশ। অজ্ঞতার যুগে একবার এক আরব ব্যক্তি পবিত্র কুরআনের আয়াত শোনার জন্যে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র কাছে উপস্থিত হন। সাক্ষাতের সূচনায় ঐ আরব তৎকালীন রীতি অনুযায়ী রাসূল (সা.)কে অভিবাদন জানান। রাসূলে খোদা (সা.) বললেন, আমার আল্লাহ আরো ভালো অভিবাদন পাঠিয়েছেন। আর তা হলো ‘আসসালামু আলাইকুম’ অর্থাৎ তোমার ওপর শান্তি বা প্রশংসা বর্ষিত হোক।
আগেই বলেছি- সালাম কোনো মামুলি বা সাধারণ শব্দ নয়। সালাম বলতে সুস্থতা, যে কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি ও ক্ষয় থেকে মুক্ত থাকার প্রার্থণাকেও বোঝায়। কারণ, মহান আল্লাহ অবিনশ্বর, অক্ষয় এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত বা পবিত্র। মহান আল্লাহর অন্যতম নাম হলো সালাম। তাই মানুষের সাথে যোগাযোগ ও সাক্ষাতের শুরুতেই মহান আল্লাহর নাম উচ্চারণ অত্যন্ত বরকতময় ও সুন্দর বিষয়। মানুষ তার প্রাত্যহিক কথাবার্তা ও ভ্রাতৃত্বপূর্ণ বা সহানুভূতিমূলক আচরণে নিত্য-নতুন প্রেরণা, অর্থ ও নতুন প্রাণের সঞ্চার করবে এবং এভাবে সামাজিক সম্পর্ককে জোরদার করবে—এটাই ইসলামের প্রত্যাশা।
যে জাতি বা সমাজের মানুষের মধ্যে আন্তরিক সম্পর্ক বা হৃদ্যতা যত বেশী সে জাতির অস্তিত্ব তত বেশী স্থায়ী হয়। ইসলাম মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্ক জোরদার এবং মানুষের জীবন-যাপনের পরিবেশকে সুস্থ রাখার জন্যে গভীর ও শক্তিশালী বন্ধুত্বের ওপর জোর দেয়। আর এক্ষেত্রে সালাম এবং ভ্রাতৃসুলভ বাক্যগুলো হচ্ছে দ্বিপাক্ষিকসহ বহুপাক্ষিক সম্পর্ক বা যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার শক্তিশালী ও আনন্দদায়ক মাধ্যম। আর এ দিক থেকে বলা যায় সালামের অর্থ হলো একে অপরকে এ বার্তা দেয়া যে তুমি বা আপনি আমার দিক থেকে নিরাপদ। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (রা.) বলেছেন, সালাম ভয়ের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বিধান করে।
সালামের মাধ্যমে আমরা একে-অপরকে এ ব্যাপারে নিশ্চয়তা দেই বা আশ্বস্ত করি যে আমরা একে-অপরের ক্ষতি করার চেষ্টা করছি না। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, সে ব্যক্তিই মুসলমান যার হাত ও মুখ বা কথা থেকে অন্য মানুষেরা নিরাপদ। তাই এটা বলা যায়, সালাম হলো মুসলমানিত্বের লক্ষণ। প্রকৃত মুসলমানকে তার আচার-আচরণ, ভদ্রতা, নম্রতা ও অন্যদের সাথে সুস্থ সম্পর্কের আলোকে চেনা যায়। মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নিজে ধনী ও গরীব এবং এমনকি শিশুদেরও সালাম দিতেন। অন্য সবার আগে তিনি মানুষকে সালাম দিতেন। রাসূলে পাক (সা.) মানুষের সাথে সাক্ষাতের সময় তাদের সাথে হাত মিলাতেন বা মোসাফাহ করতেন এবং অন্যপক্ষ হাত ছাড়িয়ে না নেয়া পর্যন্ত তিনি হাত ছেড়ে দিতেন না। কারো ঘরে প্রবেশের নিয়ম শেখাতে গিয়ে মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, কারো ঘরে প্রবেশ করতে চাইলে প্রথমে সালাম করো এবং প্রবেশের অনুমতি চাও। রাসূলে পাক (সা.) কারো ঘরে প্রবেশ করতে চাইলে ঘরের অধিবাসীদের উদ্দেশ্য করে তিন বার সালাম দিতেন। জবাব পেলে ঘরে ঢুকতেন নতুবা চলে যেতেন। বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, তোমরা যদি বন্ধুত্ব সৃষ্টি করতে চাও, তবে একে-অপরকে সালাম কর।
বিশ্বনবী (সা.) আরো বলেছেন, তিনটি বিষয় বন্ধুত্বকে খাঁটি ও গভীর করে, বন্ধুকে দেখলে সালাম দিবে, মজলিসে তার জন্যে স্থান উন্মুক্ত করে দেবে এবং সবচেয়ে সুন্দর নামগুলোর মাধ্যমে তাকে ডাকবে।
ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী সালাম দেয়া সুন্নাত বা মোস্তাহাব, কিন্তু সালামের জবাব দেয়া ওয়াজিব। অর্থাৎ যে বা যিনি আমাদের জন্যে শান্তির প্রত্যাশায় শান্তির বার্তা পৌঁছে দেয় তার জন্যেও শান্তি প্রত্যাশা করা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক হয়ে যায়। সালামের সুফল সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সুরা নিসার ৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, যে কেউ তোমাদের অভিবাদন বা প্রশংসা করে তোমরা তার চেয়েও উত্তমভাবে ঐ অভিবাদনের উত্তর দাও অথবা অন্ততঃ তার মতো করে জবাব দাও। আল্লাহ সব কিছুর হিসেব রাখেন।
এ ছাড়াও ইসলামী বর্ণনায় এসেছে সেই ব্যক্তি সবচেয়ে কৃপণ যে সালাম দিতে কার্পণ্য করে।
এখানে স্মরণ করা যেতে পারে- ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী মহান আল্লাহর ফেরেশতা ও সৎ বান্দাদের যোগাযোগের মাধ্যমও হলো সালাম। বেহেশতে কয়েক ধরনের সালামের প্রচলন থাকবে। মহান আল্লাহ সৎ মানুষদের উদ্দেশ্য করে সালাম দিবেন, ফেরেশতাগণ বেহেশতবাসীকে এবং মুমিনরা একে-অপরের সাথে সাক্ষাতে সালাম দিবেন।
দয়াময় আল্লাহ নিজে মুমিন ও বেহেশতী বান্দাগণকে নিরাপত্তা ও সালামের বা শান্তির বাণী জ্ঞাপন করবেন। বেহেশতবাসীরা আল্লাহ পাকের সালাম ও সন্তুষ্টির হৃদয়-জুড়ানো শব্দ শুনে আনন্দে আত্মহারা হবেন এবং হৃদয়ে অনাবিল প্রশান্তি লাভ করবেন।
পবিত্র কুরআনের বর্ণনায় দেখা যায় মহান আল্লাহর ফেরেশতারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধকামী ও ত্যাগ-তিতিক্ষার ব্যাপারে ধৈর্যশীল মানুষকে সালাম দিয়ে থাকেন। সূরা রাদের ২৪ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, তোমাদের প্রতি শান্তি যেহেতু তোমরা প্রতিরোধ করেছিলে ও ধৈর্য ধারণ করেছিলে, কত ভালো এই পরিণাম তথা বেহেশতের (স্থায়ী) আবাস।
নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যায়, বড়দের সম্মান করা একটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ। ইসলামের এই শিক্ষা সমাজে ভালো মূল্যবোধগুলোকে জোরদার করার বা প্রাতিষ্ঠানিক করার এবং ঐশী পথপ্রদর্শকদের আদর্শ অনুসরণের উপযুক্ত পরিবেশ বা পটভূমি সৃষ্টি করে। মহান আল্লাহ নিজে ঐশী পথপ্রদর্শকদের বা মনোনীত বান্দাদের সালাম ও প্রশংসা করে তাঁদের সম্মানিত করেছেন। পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ সুবাহানাহু তায়ালা হযরত নূহ (আ.), ইব্রাহীম (আ.), মূসা (আ.), হারুন (আ.) ও বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)'র প্রতি সালাম জানিয়ে ও প্রশংসা করে তাঁদের প্রতি সম্মান জানিয়েছেন। তাই মহান আল্লাহর নির্বাচিত ব্যক্তিদের সালাম জানানোর ও তাঁদের সম্মান করার বিষয়টি বিভিন্ন দোয়া ও জিয়ারতনামায় ও দেখা যায়।
বর্তমানে ধর্ম বিদ্বেষী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ইসলামকে হিংস্র ধর্ম হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। খোদায়ী ধর্মগুলো শান্তিকামী এবং ইসলামও প্রেম, শান্তি,ভালোবাসা ও দয়ার ধর্ম। ইসলামের ধর্মীয় নেতারা দয়ালু ও শান্তিকামী হওয়া সত্ত্বেও এই স্বার্থবাদী মহল তাদেরকে হিংস্র বলে তুলে ধরছে এবং তাদের পবিত্র ইমেজ ধ্বংসের চেষ্টা করছে। ইসলাম যে মানবাধিকারের প্রতি কত গুরুত্ব আরোপ করেছে তার প্রমাণ হিসেবে ইসলামী রাষ্ট্রের গভর্ণর বা প্রশাসক ও কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে হযরত আলী (রা)'র পরামর্শের কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছেন, যখনই কোনো শহর বা জনপদে প্রবেশ করবে, পানি বা জলাধারের পাশে অবস্থান নেবে। কারো ঘরে প্রবেশ করবে না। এত নম্র ও শান্তভাবে জনগণের কাছে যাবে যে তারা যেন তোমাদেরকে আপনজন বলে গ্রহণ করে। জনগণকে সালাম দিবে এবং সালাম দেয়া, সৌজন্যতা প্রকাশ ও দয়া দেখানোর ব্যাপারে কোনো অবহেলা করবে না। আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী আরো বলেছেন, দূর্গম বা অপরিচিত কোনো স্থানে প্রবেশ করলে মানুষ হতচকিত হয়ে পড়ে। তাই সেখানে মনকে প্রশান্ত করার জন্য সালাম দেয়ার মাধ্যমে নিজের বক্তব্য শুরু করবে।
বিষয়: বিবিধ
১৩৮৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন