বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে অ্যামনেষ্টির গভীর উদ্বেগ প্রকাশ
লিখেছেন লিখেছেন ভালোবাসার পচা গন্ধ ২৩ মে, ২০১৩, ০৪:০৩:০৫ বিকাল
লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তার বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রধানমন্ত্রীর ২০১২-এর জানুয়ারির একটি মন্তব্য ‘দেশে কোনো মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়নি’ উদ্ধৃত করার পাশাপাশি বছরজুড়ে ঘটা বিভিন্ন ধরনের গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কয়েক ডজন ঘটনার বিবরণ তুলে ধরেছে। বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটায় লন্ডনে অ্যামনেস্টির বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৩ প্রকাশ করা হয়। এতে বিশ্বের ১৫৯টি দেশের গত বছরের (২০১২) সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। অ্যামনেস্টি প্রতিবছরই বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিস্তারিত পর্যালোচনা প্রকাশ করে থাকে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ পরিস্থিতির বিবরণে বিনা বিচারে ৩০ জনকে হত্যা, ১০ জনের গুম এবং অনেকগুলো নির্যাতনের ঘটনায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু, নারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন, বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের হামলা থেকে আদিবাসীদের রক্ষায় ব্যর্থতা, কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু, সংখ্যালঘুদের প্রার্থনালয়, ঘরবাড়ি ও ব্যবসাকেন্দ্রে হামলার বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। তবে বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনায় সংস্থাটি এবারের প্রতিবেদনে মূলত অভিবাসী ও শরণার্থীদের ভোগান্তি এবং তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতার কথা বলা হয়। সংস্থাটি বলছে, বিশ্বব্যাপী সংঘাত থেকে বাঁচতে অথবা কর্মসংস্থানের আশায় দেশান্তরি হওয়া লাখ লাখ উদ্বাস্তু ও অভিবাসী মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন। বিশ্বব্যাপী সরকারগুলো তাদের নাগরিক অথবা উদ্বাস্তু ও শরণার্থীদের অধিকার রক্ষার চেয়ে বেশি আগ্রহী সীমান্ত রক্ষায়। অ্যামনেস্টির মহাসচিব সলিল শেঠি বলেছেন, অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের নামে অনেক বেশিসংখ্যক সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনে লিপ্ত হচ্ছে, যা সীমান্ত নিয়ন্ত্রণের বৈধ সীমাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। অ্যামনেস্টির প্রতিবেদনে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার দেশগুলোতে রাজপথ এবং অনলাইন—উভয় ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর ‘রাষ্ট্রের নির্মম আক্রমণ’কে একটি অভিন্ন প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে রাজনৈতিক সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। আগামী নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আয়োজনের জন্য বিরোধী দল বিএনপির দাবি এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারাধীন জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মুক্তির দাবিতে হরতাল কার্যকর করা এবং বিরোধীদের সমাবেশে সরকার-সমর্থকদের হামলার দৃষ্টান্ত এতে তুলে ধরা হয়।
বিনা বিচারে হত্যার ঘটনায় কমপক্ষে ৩০ জনের নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, তাঁরা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন বলে পুলিশ দাবি করেছে। আর নিহতদের পরিবারগুলো বলেছে, বেসামরিক পোশাক পরিহিত লোকজন র্যাব বা পুলিশের পরিচয় দিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়ার পর মেরে ফেলা হয়েছে। এসব ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। উদাহরণ হিসেবে গত বছরের ১২ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া জেলার একজন কৃষক আতিয়ার রহমান ওরফে তোফা মোল্লার নিহত হওয়ার ঘটনাটি উল্লেখ করা হয়। র্যাবের দাবি, তিনি ক্রসফায়ারে মারা গেছেন। আর তাঁর পরিবার ও অন্যান্য প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, র্যাব তাঁকে আগের দিন সন্ধ্যায় বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তাঁর মৃতদেহে তিনটি গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে, যেগুলোর মধ্যে দুটো ছিল পেছন দিকে। নির্যাতন এবং দুর্ব্যবহার ব্যাপকভাবে প্রচলিত উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কোনো জবাবদিহি নেই। নির্যাতনের ক্ষেত্রে যেসব পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়, সেগুলোর মধ্যে মারধর করা, লাথি মারা, ছাদ থেকে ঝুলিয়ে রাখা, খাবার ও ঘুম থেকে বঞ্চিত করা এবং বৈদ্যুতিক শক দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।গত বছরে মোট ১০ জন গুম হয়েছেন উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি বলেছে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হতভাগ্য ব্যক্তিদের কোনো সন্ধান মেলেনি। আর যাঁদের মৃতদেহ পাওয়া গেছে, তাঁদের দেহে মারধর ও আঘাতের চিহ্ন ছিল। দৃষ্টান্ত হিসেবে এ ক্ষেত্রে গত বছরের ১৭ এপ্রিল নিখোঁজ হওয়া বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলীর কথা তুলে ধরা হয়েছে।
নারী এবং মেয়েশিশুদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে অ্যাসিড নিক্ষেপ, যৌতুক দিতে না পারায় হত্যা, ধর্মীয় বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে সালিসের মাধ্যমে দোররা মারা, পারিবারিক সহিংসতা এবং যৌন সহিংসতার কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এতে দৃষ্টান্ত হিসেবে কুষ্টিয়া জেলার খোকসা থানায় গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর আলেয়া বেগম এবং তাঁর মেয়েকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করার অভিযোগের কথা বলা হয়। তাঁদের দুই দিন খোকসা থানায় আটক রাখার পর কুষ্টিয়া সদর থানায় নিয়ে একটি অন্ধকার ঘরে আটকে রাখা হয়। এরপর কলেজপড়ুয়া মেয়েটিকে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে পুলিশ যৌন নিপীড়ন চালায়। ১৮ সেপ্টেম্বর আদালতে হাজির করার পর তাঁরা ছাড়া পেয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে এসব অভিযোগ জানালে পুলিশ ২৬ সেপ্টেম্বর আবার তাঁদের গ্রেপ্তার করে।
আগের বছরগুলোর মতোই গত বছরও সরকার আদিবাসীদের ভূমি অধিকারের দাবি নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে অ্যামনেস্টি বলেছে, এই জনগোষ্ঠীর ওপর বসতি স্থাপনকারী বাঙালিদের হামলা অব্যাহত রয়েছে এবং নিরাপত্তা বাহিনী তাদের সুরক্ষা দিতে পারেনি। পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এবং কাজের পরিবেশ উন্নয়নের দাবি সমর্থন করেছেন যেসব শ্রমিকনেতা, তাঁদের হয়রানি করা এবং ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে জানিয়ে অ্যামনেস্টি গত বছরের ৪ এপ্রিল শ্রমিকনেতা আমিনুল ইসলামের নিখোঁজ হওয়া এবং পরে ঘাটাইলে তাঁর লাশ পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে। পরিবার তাঁর দেহে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছে। পরিবার বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনী তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া গত নভেম্বরে সাভারের তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ডে ১১১ জনের প্রাণহানির ঘটনা তুলে ধরে বলা হয়, কারখানার কর্মকর্তারা দুর্ঘটনার সময় শ্রমিকদের সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য গেট খুলে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা গত সেপ্টেম্বরে এক নতুন মাত্রা লাভ করে বলে মন্তব্য করে অ্যামনেস্টি বলেছে, ফেসবুকে কোরআন শরিফের বিকৃত ছবি প্রকাশের প্রতিবাদে চট্টগ্রামের পটিয়া ও কক্সবাজারের রামুতে হাজার হাজার লোক ২০টি বৌদ্ধমন্দির ও আশ্রম, একটি হিন্দু মন্দির এবং বহু বাড়িঘর ও দোকানে আগুন লাগিয়ে দেয়। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, গত বছর বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে ৪৫ জনের। আর ফাঁসি কার্যকর হয়েছে একজনের।
বিষয়: বিবিধ
১৩৮০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন