বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ, একটা নাম একটা লিজেন্ড, তার পরিবার খাওার জন্য ভাতও পায় না
লিখেছেন লিখেছেন শাহজাদা ইয়ামেন ০৭ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৫:২২:৩৪ বিকাল
বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ, একটা নাম একটা লিজেন্ড, তার নামে বিজিবি পিলখানায় স্কুল আছে, দেশের সেরা স্কুল কলেজগুলোর মধ্যে একটা । কিন্তু তার পরিবারের খবর কেউ রাখেন কি ?
[ঘটনাটা আমার সাথে হয়েছিলো ১৫ই ডিসেম্বর সন্ধ্যায়। কাওকে বলার আগে টাইম নিয়েছিলাম আরেকটু শিওর হওয়ার জন্য - এমন না এটা অসম্ভব কোন ঘটনা, কিন্তু আমি টাশকি খেয়ে ছিলাম অনেকক্ষন। কেন জানি এসব শুধু আমার সাথেই হয়]
ফাহিমকে পড়াতে গিয়েছি। লিটারেচার পড়াচ্ছি (সে ক্লাস ৫ এ পড়ে অ্যাকাডেমিয়াতে), দেখি তার মন নাই পড়ায়।
আমি তার সাথে খুনসুটি করি। আবার পড়ানো শুরু করি। আবার একটু খুনসুটি করি। এভাবেই যাচ্ছে; এমন সময় সে বলে - "স্যার, মুন্সী আব্দুর রউফ কে, চিনো?"
সে ইংলিশ মিডিয়ামের ষ্টুডেন্ট। এবং ছোট, স্বাভাবিকভাবেই সব বীরশ্রেষ্ঠদের নামধাম তার জানার কথা না। আমি একটু খুশী হয়েই গেলাম। ডিটেইলসে গল্প বলবো এমন প্রস্তুতি নিয়ে বললাম, "হ্যা ফাহিম, চিনি তো, কেন?"
- "খুব কি পপুলার কেউ?"
আমি হেসে বললাম - "হ্যা ফাহিম, উনি অনেক পপুলার। কেন?"
- "উনি তো আব্দুল্লাহ'র দাদা হোন"
ওদের বাসায় নতুন কাজের ছেলে এসেছে, ৭ দিনও হয়নি। নাম আব্দুল্লাহ।
মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো। আমি বললাম - "মুন্সী আব্দুর রউফ ওর দাদা?"
- "হ্যা স্যার"
- "কে বলসে তোমাকে?"
- "আব্বু বললো"
আমি বললাম - "ডাকো তো একটু"
ডেকে আনলো। বাচ্চা একটা ছেলে কত হবে বয়স ১৫-১৬ ... আমি জিজ্ঞেশ করলাম, নাম কি।
"আব্দুল্লাহ"
"বাড়ি কই?"
"বিক্রমপুর" - এইবেলা একটু কনফিউজড হয়ে গেলাম। মুন্সী আব্দুর রউফের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর।
"দাদা বাড়ি তোমাদের?"
"না এটা দাদির বাড়ি, দাদা মারা গেসে"
"কবে মারা গেসেন আব্দুল্লাহ?"
"অনেক আগে, আমার জন্মের অনেক আগে, যুদ্ধের সময়"
"নাম কি তোমার দাদার, জানো?"
"মুন্সী আব্দুর রউফ ব্যাপারী"
আমি তাকায় আছি। কিছুক্ষন পর বললাম, "তুমি জানো তোমার দাদা কে ছিলেন?"
"ঐ দাদী বলে যুদ্ধ টুদ্ধ করসে আর যুদ্ধের পয়লা দিকেই মারা গেসে" - হ্যা মিলতেসে। সব মিলতেসে। মুন্সী আব্দুর রউফ মারা যান এপ্রিল মাসের ১৮ তারিখ।
"তোমার দাদাবাড়ি কই জানো?"
"ফরিদপুর"
"গেসো কখনো ওখানে আব্দুল্লাহ?"
নাহ, যায় নাই সে। আমি আবার জিজ্ঞেশ করি, "বাবা কি করে?"
"অটোরিকশা চালায় বিক্রমপুরে"
"আব্দুল্লাহ তুমি কি জানো তোমার দাদা কে ছিলেন?"
"দাদি বলে মাঝেমাঝে, যুদ্ধ করসে নাকি, আর শুরুর দিকেই মরে গেসে।"
"কেউ যায় না তোমার দাদিকে সাহায্য টাহায্য দিতে?"
"হ্যা যায় তো আর্মি যায় অনেকে অনেক কিছু দেয়। দাদির বাড়িটা আর্মিরা টিন দিয়ে বানায় দিয়ে গেসে।"
আর কিছু বলার ভাষা পাই না। একটু পর আবার বলি - "তুমি জানো তোমার দাদা কি ছিলেন?"
এইবার সে একটু চিন্তিত। বুঝতেসে না কিছু। এবং সে কিছু জানেও না। স্বাভাবিক, যার পেটের ভাত জোগাড় করতে আরেকজনের বাসায় কাজ করতে হয়, যার বাবাকে পিতৃপরিচয় বুকে চাপা দিয়ে অটোরিকশা চালাতে হয় তার কিছু জানার কথাও না।
আমি তাকে জড়ায় ধরে বসে থাকি কিছুক্ষন। নিজেকে খুব ছোট লাগে, খুব ভন্ড মনে হয় তাই সাথেসাথেই আবার ছেড়ে দেই। পতঙ্গের মত লাগে বাচ্চাটার সামনে বসে থাকতে।
অপি'কে রাতে এক কাহিনী বলার পর ও বলসিলো তুমি ওকে একদিন রাইফেলস কলেজে নিয়ে যেও। কলেজের নামটা পড়ুক নিজেই। পরদিন পড়াতে গিয়ে তাকে এটা বললামও, সে যাবে না। আমাকে বলে - শুনলামই তো আপনার মুখ থেকে, গিয়ে আর কি হবে।
এতটা ছোট লাগে !!! এতটা নিচ মনে হয় নিজেকে !!!
পুনশ্চ ১ : মুন্সী আব্দুর রউফ মারা যাবার পর উনার ওয়াইফ মানে আব্দুল্লাহ'র দাদি, উনার বাবাবাড়িতে চলে আসেন। ওটা বিক্রমপুর। উনার ছেলেমেয়ে সব এখানেই বড় হয়।
পুনশ্চ ২ : ফাহিম বাচ্চা ছেলে, সে বুঝেও না আসলে কিন্তু তার বাসার কাজের ছেলেকে এতটা প্রায়োরিটি দিচ্ছি দেখে তার খুব গায়ে লাগসে। আমাকে বলে - "ওর দাদা হচ্ছে বীরশ্রেষ্ঠ, ও তো আর না।"
ছেলেটা যদি বুঝতো কেন আমি এত অস্থিরের মত বারবার আব্দুল্লাহকে ডাকি!
ঘটনা ফেসবুক থেকে পাওয়া
বিষয়: রাজনীতি
১৪০১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
১৫ বছর আগে একদিন বাসে দেখা হয়েছিল বিরশ্রেষ্ঠ সিপাহি মুস্তফা কামাল এর পিতার সাথে। তিনি দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার থেকে চট্টগ্রামের চাঁদপুর বাস টার্মিনালে আসছিলেন তার নিজস্ব পেনশন এর বার্ষিক হাজিরা দিয়ে। আয় থাকায় তিনি মোটামুটি ভালই ছিলেন। জানিয়েছিলেন ভোলায় নাজিউর রহমান মুস্তফা কামাল এর নামে একটি স্কুল করে দিয়েছেন। বিরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন এর নামে চট্টগ্রামের ক্রিকেট ষ্টেডিয়াম এর নাম করন করা হয়েছিল যার আগের নাম ছিল একজন আওয়ামিলিগ নেতার নামে। এখন আবার সেই নাম দেওয়া হয়েছে। রুহুল আমিন এর এক নিকটআত্মিয় তার মেয়ে বা বোনের মেয়ে পাশেই থাকতেন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন