অভিমানী এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার গল্প
লিখেছেন লিখেছেন শাহজাদা ইয়ামেন ০৪ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৩:১৬:৫০ দুপুর
আজকে এক কিশোর যোদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার কথা বলবো যার নাম এখন হয়তো কোণ নথিতে পাওয়া যাবে না, সহযোদ্ধারা ছাড়া কেউ তাকে আজ চিনবে না, আজ প্রায় বাষট্টি ছুঁই ছুঁই সেই প্রৌড় ব্যাক্তিটির অসীম সাহসিকতা কেউ জানে না ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের অগ্নিঝড়া বছরের কোন এক দিন জন্ম নেয় সেই ছেলেটি সিলেট জেলার কোন এক মহকুমার কোন এক থানায় । সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া মা বাবার প্রথম সন্তান । যার পঞ্চদশ উর্ধতন পুরুষ ছিলেন হযরত শাহজালালের সাথে আগত দিল্লীর সুলতানের অধীন কোন এক সিপাহ সালার (সেনা অফিসার) । সিলেট বিজয়ের পর আর দিল্লী ফিরে যান নি পাঠান বংশের সেই বীর পুরুষ । এই সিলেটেই বিয়ে করে থিতু হন । সেই বীরের রক্ত বইছিলো ছেলেটির শরীরে । তখনকার সময়ে লেখাপড়ার জন্য নির্দিষ্ট করে কোন বয়স ছিলো না । বেশ বড়সড় হয়ে ছেলেরা প্রা ১০ ১২ বছর হওয়ার পর থার্ড গ্রেডে (ক্লাস ওয়ান) ভর্তি হত । সেও এর ব্যাতিক্রম ছিলো না ।
তার লেখাপড়া না করলেও চলতো পারিবারিক সম্পত্তি কম ছিলো না, তাছাড়া তার অঞ্চলের সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবারটিও ছিলো তার পরিবার । কিন্তু লেখাপড়া করার উচ্চাশা থেকেই ছেলেটি লেখাপড়া চালিয়ে যায় । ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের সময় তার বয়স মাত্র ১৪ । তখনই বামপন্থী ধারার ছাত্র আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয় । EPSU (East Pakistan Students Union) করতো সে, আর সঙ্গত কারণেই ছয়দফার বিরোধী ছিলো । তখনকার বামধারার রাজনৈতিকরা বিশ্বাস করতেন ছয়দফা কখনৈ স্বাধীনতার সনদ হতে পারে না বরং এটা স্বাধীনতা বিরোধী স্বায়ত্বশাসনের নামান্তর । তাই ছেলেটি এর বিরোধিতা করেছিলো । তবে ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য ক্যানভ্যানিঙ্গও করেছিলো সে । ১৯৭১ সালে তার মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিলো । কিন্তু তার আগেই শুরু হয়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধ । দেশের টানে আর চুপ থাকতে পারে নি ছেলেটি । তার ভয় ছিলো তার ধর্মভীরু গদিনশিন পীর বাবা হয়তো তাঁকে যুদ্ধে যেতে বাঁধা দেবে, তাই চুপচাপ পালিয়ে যাবার পরিকল্পনা করে সে । একা একা পালিয়ে যাবে, বাল্লা সীমান্ত দিয়ে চলে যাবে আগরতলা । পরিকল্পনা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিলো সে । কিন্তু হঠাত বাবার কাছে ধরা পরে গেলো । বাবার জেরার সামনে মিথ্যা বলতে পারেনি সে । আসলে কোনদিনই মিথ্যা বলতে পারে না সহজে । সব কিছু স্বীকার করার পর দেখা গেলো উলটো চিত্র । তার বাবা বরং তার হাতে টাকা পয়সা ধরিয়ে দিলেন সাথে তার ভাইকেও নিয়ে যেতে বললেন, য্রো বললেন হয় যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে আসবে নইলে শহীদ হয়ে যাবে পরাজিত হলে যেন ভুলে যায় এইটা তার বাড়ি ছিলো আর তিনিই তার বাবা ।
মনের আনন্দে ১৭ বছর বয়স্ক ছোটভাইকে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পা রাখলো ছেলেটি । তখন খুব সম্ভব এপ্রিলের শেষভাগ বা মে এর প্রথম দিক । প্রচন্ড গরমে মাইলের পর মেইল হেঁটে রিফিউজি ক্যাম্পে গেলো তারা । সেখান থেকে আরো কয়েকজন যুবকের সাথে চলে গেলো ত্রিপুরার মেলাঘর । সেক্টর কমান্ডার মেজর (তৎকালীন) খালেদ মোশাররফ । প্রায় দুই সপ্তাহের কঠিন ট্রেইনিং শেষে নাম লেখালো গেরিলা যুদ্ধের লিজেন্ড প্লাটুন ক্র্যাক প্লাটুনে । ছোটোখাট অপারেশনে অংশও নিলো । দুই নং সেক্টরে ট্রেইনিং নিলেও যুদ্ধ করেছে সে তিন নং সেক্টরে । সে সবসময় চেষ্টা করতো তার সর্বোচ্চটা দেওয়ার জন্য, এরজন্যই বোধহয় তার কমান্ডার একদিন তাকে ডেকে নিয়ে একটি অপারেশনের সম্পুর্ণ দায়ীত্ব বুঝিয়ে দিলেন । তখন তারা ময়মনসিংহের একটা এলাকায় অবস্থান করছেন । পাশেই টাঙ্গাইল, কাদের সিদ্দিকীর এলাকা । তাদের জন্য টাঙ্গাইলে অপারেশন চালানো নিষেধ ছিলো কারণ তাতে সেমসাইড হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো । যাই হোক তার উপর দায়ীত্ব ছিলো ব্রহ্মপুত্রের গতিপথে নজর রাখা এবং পাক বাহীনির রণতরী দেখতে পেলে অতিসত্ত্বর তা জানানো । তার সাথে ছিলো তার ছোটভাই সহ আরো তিনজন । পাঁচজনের একটা টীম নিয়ে নিয়মিতই টহল দিয়ে যেতো ছেলেটি । হঠাত একদিন ভোরের দিকে দেখতে পায় একটি গানবোট ভৈরব থেকে ময়মনসিংহের দিকে ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে । তিনি তার ভাইকে পাঠিয়ে দিলেন কমান্ডারকে খবর দেওয়ার জন্য যাতে তারা হামলা করতে পারেন । এদিকে তিনি ও তার সহযোদ্ধারা লুকিয়ে লুকিয়ে নদীর তীর ঘেষে বোটের পেছন পেছন যাচ্ছেন । এদিকে অনেক সময় চলে গেলেও তার ভাই ফিরে না আসায় তিনি ঠিক করলেন তিনি নিজেই বোটে আক্রমণ করবেন । এবং তিনি তাই করে বসলেন । অথচ তার দলের কাছে একটা এলএমজি ছাড়া তেমন কোণ অস্ত্রও ছিলো না । কিন্তু বিপুল সাহসিকার সাথে তারা একদিক থেকে আক্রমণ করে বসেন । এদিকে গানবোটটা হয়তো আগে থেকেই বিপদগ্রস্ত ছিলো তাই দেখা গেলো তারা যেরকম প্রতিরোধ আশা করেছিলেন সেরকম কোন প্রতিরোধ আসে নি । কিন্তু তারপরেও গানবোট থেকে মুহুর্মুহু গাওলা ভেসে আসছিলো তাদের দিকে । যার ফলে একসময় পিছু হটার মত অবস্থা হয় । এদিকে রসদও ফুরিয়ে আসছে । বুলেট প্রায় শেষের দিকে, সহযোদ্ধারা তাকে পিছু হটতে বললেন । কিন্তু না তিনি গোয়ারের মত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান, পিছু হটাটা তার কাছে কাপুরুষতা বলে হয় । তিনি বললেন “আমি যাবো না, হয় এখানেই মরবো নয় জয়ী হবো” । সঙ্গীকে একা ফেলে যেতে কেউ রাজি ছিলো না । সবাই আবার নিজেদের সর্বোচ্চটা নিয়ে ঝাপিয়ে পরলেন । কিন্তু গুয়োর্তুমির ফল যা হবার তাই হলো । রসদ ফুরিয়ে গেলো এদিকে পাকিদের আরেকটা বোট এসে হাজির । সঙ্গীদের পিছু হটার নির্দেশ দিয়ে তিনি রয়ে গেলেন সামনে । সঙ্গীদের পালিয়ে যাওয়ার জন্য কাভার ফায়ার করতে লাগলেন । পরে নিজে পিছু হটার সময় ধরা পরলেন রাজাকারদের হাতে ।
তাকে নিয়ে যাওয়া হলো পাকি ক্যম্পে । জিজ্ঞাসাবাদের নামে ডান হাতে একটা রশি দিয়ে বেঁধে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হলো পুরো দুইটা দিন । কোন খাবার দেওয়া হয়নি উপরন্তু দমাদম খেতে হয়েছে মোটা রুলারের বাড়ি, কিন্তু তিনি কিছুই ফাঁশ করেননি, তার কাছে বারবার জানতে চাওয়া হয়েছে মুক্তিক্যাম্পটা কোথায় তার মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করতে পারে নি পাকিরা । তৃতীয়দিন হঠাত মুক্তিফৌজ আক্রমণ করে বসলো সেই ক্যাম্প । তুমুল যুদ্ধের পর বিজয়ী মুক্তিবাহীনির সদস্যরা যখন তাকে উদ্ধার করে, তখন প্রায় মৃত তিনি ।
তাঁকে উদ্ধার করে পাঠিয়ে দেওয়া হলো আগরতলা । সেখানে চিকিৎসার পর যখন সুস্থ হলেন তখন দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে । সদ্য স্বাধীন দেশে ছোট ভাইকে নিয়ে বীরের মত প্রবেশ করলেন এই যোদ্ধা । চলে গেলেন নিজের বাড়িতে ।
সেখাতে থেকে স্বাধীন দেশে মেট্রিক দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন । কিন্তু তার শরীর সম্পুর্ণভাবে সুস্থ হয়নি । আবার অসুখে পড়লেন । সুস্থ হলেন প্রায় ছয় মাস পর । পরীক্ষা দেওয়া হলো না । অবশেষে ১৯৭৪এ মেট্রিক দিলেন । সাফল্যের সাথে সকল বিষয়ে লেটার সহ প্রথম বিভাগে পাশ ও কুমিল্লা বোর্ডে দ্বিতীয় অবস্থান । মেধাবী ছিলেন । এরপর এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স । তখন এরশাদের সময় । বাংলাদেশ ব্যঙ্কে চাকুরী করতেন, সারাজীবন সৎ ছিলেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় তাঁকে হত্যার হুমকি দেওয়া হলো পদে পদে বাঁধার সৃষ্টি করা হলো । ভাবতে অবাক লাগে মুক্তিযোদ্ধা বলে কোণ কোন যায়গায় নিগৃহীতও হতে হয় তাকে । শেষ পর্যন্ত চাকুরী ছাড়তে বাধ্য হলেন তিনি । তারপর আবার দুর্বল হয়ে পরলেন তিনি ডান হাতের সেই পুরাতন ব্যাথা আবার নতুন করে জেগে উঠলো । অনেক চিনিতসার পরও ঠিক হলো না । অবশেষে এক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের চিকিৎসায় কিছুটা উন্নতি হলো । কিন্তু সারা জীবনের জন্য তাঁকে বাঁহাতি হয়ে যেতে হলো । এখন বাঁহাতেই লিখেন, ডান হাতে ভারি কোন কাজ করতে পারেন না । বাংলাদেশ ব্যঙ্কের চাকুরী ছেড়ে দেওয়ার পর শিক্ষকতাকে বেঁছে নেন পেশা হিসেবে । আজো আছেন কিছুদিনের মধ্যেই অবসরে যাবেন ।
তার একটা মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট ছিলো যা স্বয়ং ওসমানী দিয়েছিলেন । কিন্তু পরে যখন দেখলেন মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি নিয়ে ভন্ডামী শুরু হয়েছে, রাগে দুঃখে ক্ষোভে অভিমানে সার্টিফিকেটটি পুড়িয়ে ফেলেন । এরপর থেকে আর কখনো মুক্তিযোদ্ধের কথা বলেন নি । তার ছেলেমেয়েদের কখনই শুনাননি তার যুদ্ধের ইতিহাস । তারা বরং শুনেছে তাদের মায়ের কাছে, দীদার কাছে চাচার কাছে তাদের বাবার যুদ্ধের কাহিনী । তাই কাহিনীগুলো এতো ঝাপসা ঝাপসা । তার বড় ছেলের সাথে তার প্রায়ই তর্ক হয় কেন তিনি তার সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেললেন ? কেন তিনি নতুন করে তা তুললেন না । তাহলে হয়তো আজ তার ছেলের ভবিষ্যতে চাকুরী পেতে সুবিধা হতো । জবাবে একটা কথাই বলেন তিনি, “বাবারে আমি যুদ্ধ করছিলাম দেশটার স্বাধীনতার জন্য, দেশ স্বাধীন হইছে, এর বেশি কিছু আমি তো আমি চাইছিলাম না চাইও না, তুই যদি নিজের যোগ্যতায় কিছু করতে পারোস তবে কর, আমি কোন সুবিধা নেওয়ার জন্য যুদ্ধ করি নাই” ।
এই কিশোরটিকে আমি আমার জন্মের পর থেকেই চিনি, খুব ভালো করেই চিনি, আমার আদর্শ আমার প্রেরণা আমার দেবতা এই ব্যক্তিটিই ।
বিষয়: বিবিধ
১২০৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন