কিছু অতৃপ্তির সমাপ্তি, কিছু না পাওয়া

লিখেছেন লিখেছেন শাহজাদা ইয়ামেন ২৯ অক্টোবর, ২০১৪, ১২:৪০:৩৪ রাত

(১)

খোলা আকাশের নিচে একা বসে আছি । কিচুক্ষন আগে বৃস্টি হয়ে গেছে সামান্য ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছে আবার ভালো ও লাগছে ।কতদিন পর খোলা বাতাসের স্বাদ পেলাম । জেলখানার বদ্ধ ঘরে বিশটা বছর কাটালাম একা একা । যখন গিয়েছিলাম তখন ছিলাম ২৬ বছরের টগবগে যুবক আজ ৪৬ বছরের প্রৌড়। যৌবনের পুরাটা সময় কাটালাম একটা বদ্ধ ঘরে , তোমার অপেক্ষায় । আমার বিশ্বাস ছিল তুমি আসবে ।কিন্তু তুমি আসোনি । আমি কিছুই মনে করিনি ।তোমার বাবার টাকা আর ক্ষমতার কাছে আমি ছিলাম অসহায় ।তারপরও একটা দুঃখ ছিল তুমি কি করে বিশ্বাস করতে পারলে আমি খুন করেছি তাও আবার আমার চৈতিকে । ঠিক যেন ছিনেমার গল্প । এজলাসে জজসাহেব যখন আমার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করছিলেন তখন তোমার মুখে দুঃখ বেদনা ঘৃনা একসঙ্গে দেখেছিলাম । তুমি আমকে ভুল বুঝাতে সেদিন জজসাহেবকে একদম আপন মনে হচ্ছিল যেন উনি আমার মনের কথাটাই বলেছেন ।কিন্তু কিসুদিন পর বিজয়দিবসে রাষ্ট্রপতি আমার শাস্থি কমিয়ে যাবজ্জীবন করে দেন । কিন্তু আমতো তা চাই নি ।জেলের ভেতর আত্মহত্যা করতে চেয়েও পারি নি । জেলে বসে শুনেছিলাম তুমি বিয়ে করেছো, রায়ের এক মাস পরেই ।

(২)

আজ আমার জন্মদিন । বাবা দশহাযার টাকা দিয়েছে পার্টি করার জন্য । আজই আমার আঠার বছর হল ।কি যে মজা এখন থেকে আমি বড় হয়ে গেছি । চুপিচুপি বলে রাখি এডাল্টও হয়ে গেছি , হি হি হি । বাইরে এসে দেখি বৃষ্টি । ভুলে ছাতাটা আনিনি । বাবা বলেছিলো গাড়ি আনতে আমি চাইনি । রিক্সায় চড়ার মজাই আলাদা । বন্ধুদের সাথে মজা করত্র করতে পার্কে গেলাম । বৃষ্টির পর প্রকৃতিটা এত ফ্রেশ লাগছে যে বলার মত নয় ।

-এই মীম , কেক আনছিস ?

-হুম ।

-চল কেটে ফেলি , ঐ যে লেকের পাশে চল অখানে খালি জায়গা আছে গিয়ে বসি ।

- হ্যাঁ , চল । এই সবাই চল ওখানে বসি ।

(৩)

আমি একটা পার্কে বসে আছি ঝিলের পাশে । বার বার রোকেয়ার কথা মনে পরছে ।

আচ্ছা ও কি সুখে আছে ?

বাচ্চা কাচ্চা হয়েছে ?

অর সাথে কি দেখা করবো ?

না থাক কি দরকার এতদিন পর আবার পুরনো দুঃখ জাগিয়ে দেওয়ার ।

একপাল ছেলেমেয়েকে দেখছি এদিকে এগিয়ে আসতেছে । মনে হয় অরা কোন অনুষ্ঠান করতে চায় । আমি উঠে গেলাম গিয়ে একটু দূরে বসে দেখতে লাগলাম ওরা কি করে । মনে হয় ওদের কারো জন্মদিন । কিন্তু একি অই মেয়েটা দেখতে অবিকল রোকেয়ার মতো ! ওরই কি জন্মদিন ? ভালো করে দেখলাম । নাহ মেয়েটা হুবহু রোকেয়ার মত না । রোকেয়া আরো ফর্সা ছিলো এই মেয়েটা একটু শ্যামলা গোছের । এখন আবার মেয়েটা কেকের টুকরো নিয়ে আমার দিকে আসছে কেন ? হায় হায় তার হাটার ভঙ্গিটা যে একদম রোকেয়ার মত ! ঠিক যেন আমার রোকেয়া আমার দিকে আসছে ! আমি কি ঠিক দেখছি ? নাকি আমার মাথাটা একদম গেছে ?

(৪)

ধুর লেকের পারে একটা আধবয়সী বুড়ো বসে আছে । লোকটা অনেকটা মেয়েদের মতো ফর্সা আর সুন্দর যে দেখে মনে হয় কোন্দিন সূর্যের আলো লাগে নি । আমাদের দেখে লোকটা দূরে গিয়ে বসে পরলো । যাকগে, আমাদের মজা আমরা করতে লাগলাম । কেক কাটলাম ছবি টবি তুললাম । হঠাত দেখি লোকটা আমার দিকে ড্যব ড্যব করে তাকিইয়ে আছে । বুড়ো হয়েছে কিন্তু রঙ যায়নি । যাই ব্যাটার সাথে কথা বলে আসি ,

-এই সুমি একটা কেক দে তো, বুড়োটাকে দিয়ে আসি ।

-বাহ বাহ এখন কি বুড়োর সঙ্গে প্রেম করবি নাকি ?

-ধুর কি যে বলস ? লোকটিকে কেন যানি মায়া মায়া লাগছে যাই একটু কথা বলে আসি ।

(৫)

-হাই আঙ্কেল, কেমন আছেন ?

-ভালো মা তুমি কেমন আছো ।

-নিন কেন খান । আজ আমার জুন্মদিন তো তাই বন্ধুদের সাথে পার্টি করতে আসছি ।

-দাও মা দাও ! আজ তোমার জন্মদিন বুঝি ? কতো বছর হলো ?

-১৮ বছর ।

-ও খুব ভালো মা, তোমার নামটা কি ?

-নাদিয়া সুলতানা মীম । আপনার ?

-আমার ? আমার নাম একটা ছিলো বটে । জাকির হোসাইন ।

-ও

হঠাত জাকির সাহেব তার ২০ বছরের পূরানো প্যান্টের পকেটে কি জানি খুজতে লাগলো । খুজে পেতে অবশেষে একটি ছোট্ট আংটি বেড় হলো ।

-এই নাও মা, তোমার জন্মদিনে এই বুড়োর ছোট্ট উপহার ।

-আরে আরে আঙ্কেল লাগবে না । কি যে করেন !

-কেন মা, এই বুড়োর উপহার কি পছন্দ হয় নি ?

-কি যে বলেন না । এত্ত সুন্দর আংটি ! কোথায় পেলেন ?

-একজনকে দিবো বলে বানিয়েছিলাম, কিন্তু আর দেওয়া হয় নি । তুমিই নাও ।

একথা বলেই জাকির উদাস হয়ে কি যেনো ভাবতে ভাবতে চলে গেলো ।

(৬)

আংটি হাতে হতভম্ব মীম কি করবে বুঝতে পারছে না । জাকিরের গমনপথে তাকিয়ে আছে ।

-এই মীম দেখি ! ওমা কি সুন্দর আংটি ! দেখি দেখি , নিশ্চই ডায়মন্ড ।

-আরে ধুর এই বুড়ো ডায়মন্ড পাবে কোথায় ?

-কি জানি বাবা ? চুরি টুরি করে নি তো ?

-নাহ, দেখেতো চোর মনে হয় না । ভালো মানুষই মনে হলো ।

-থাক ওসব, চল বাসায় যাই ।

-হু, চল ।

(৭)

আমি রোকেয়া বিশটা বছর ধরে একটা অস্বস্থিভরা দুঃখ নিয়ে বেঁচে আছি । আমার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসাটা আজ বিশ বছর পরেও ভুলতে পারি নি । আজ আমার একটা মেয়ে আছে মীম, আঠারো বছরের মেয়ে, আজই আঠারো হলো । বিয়ে হলো প্রায় বিশ বছর । কিন্তু নাহ আমার স্বামীকে আমি ভালোবাসতে পারি নি । বেচারা কখনৈ আমার ভালোবাসা পায় নি । আজ কেমন জানি লাগছে । বারবার বিশ বছর আগের সেই দিনের কথা মনে পরছে । যেদিন এজলাসে বিচারক আমারই বান্ধবী রিয়াকে হত্যার কারনে জাকিরের মৃত্যুদন্ড দেন । পরে অবশ্য জানতে পারি রিয়াকে জাকির হত্যা করে নি । জাকির যেদিন হীরের আংটিটা দেখিয়ে প্রপোজ করেছিলো, ও বলেছিলো এঙ্গেজমেন্টের দিন এই আঙ্গটিটা হাতে পরিয়ে দেবে । সেই এঙ্গেজমেন্টই আর হলো না । কিন্তু বারবার ওর কথা মনে পরছে কেন ? কেন মনে হচ্ছে ওর সাথে আবার যোগাযোগ হবে ? ওতো সেই বিশ বছর আগেই চলে গেছে বুকভরা দুঃখ আর অভিমান নিয়ে । ধুর কিছুই ভালো লাগছে না । আবার টিভির সামনে বসে বাংলা নিউজ দেখতে বসে আছি । মীম দেখলে হয়তো খুব রাগ করবে । আমার কেন জানি মনে হয় কোন একদিন জাকিরের খবর শুনতে পাবো ।

(৮)

বাসায় এসে দেখি মা তার স্বভাবমতো বসে বসে নিউজ দেখছে । মাকে কখনো নিউজ ছাড়া অন্য কোন চ্যানেল দেখতে দেখি নি । আজব এক মহিলা ।

- মা তুমি আবার নিউজ চ্যানেল ছেড়ে বসে আছো ?

- হু, তোর পার্টিকেমন হলো ?

- মা, জানো; আজ না এক আজব লোকের সাথে পরিচয় হলো ।

- কেমন আজব বলতো শুনি ।

- সুন্দর আর খুবই ফর্সা একটা লোক । কেমন জানি, দেখলেই মায়া মায়া লাগে । একা একা পার্কে বসে ধ্যান টাইপ কি জানি করতে ছিলো । আমি গিয়ে জন্মদিনের কেকের একটা টুকরা দিলাম । আর জানো মা, লোকটা আমার জন্মদিন শুনে এই আংটিটা দেলো !

মা অবাক হয়ে আংটির দিকে তাকিয়ে আছে । আর কি জানি বিরবির করছে । মাকে কখনোই বুঝতে পারি না । কেমন জানি আজব এক মহিলা ।

(৯)

এই মীম মেয়েটার স্বভাব একদম রোকেয়ার মতো । কি ভয়ানক চটপটে ! ওকে দেখে পুরানো ক্ষতটা আবার জ্বলতে লাগলো । আমার কাছে থাকা রোকেয়ার শেষ নিদর্শনটা ওকে দিয়ে দিলাম । আজ আমি স্বাধীন আমার কোন পিছুটান নেই । এখন শান্তিতে মরতে পারবো । রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাটছি । ঢাকার রাস্তার অনেক উন্নতি হয়েছে । উড়াল সেতু হয়েছে, প্রাইভেট কারের সংখ্যা বেড়েছে । ট্রাকের সংখ্যাটাও কি বেড়েছে ? মনে হয় বেড়েছে । হাটছি মাঝপথ দিয়ে । এখন মাঝরা, রাস্তাটা ট্রাকের অধিনে । ওইতো একটা বিশাল ট্রাক আসছে, হেডলাইটটা যেনো রাগি কোন প্রাণীর চোখ । আমি এগিয়ে যাচ্ছি, যাচ্ছি, যাচ্ছি,......... হঠাত তীব্র ধাক্কা । চোখের সামনে একটা পর্দা দেখতে পাচ্ছি । আচ্ছা এটাই কি মৃত্যু ?

(১০)

উফ, মাথাটা ঝিম ঝিম করছে । রাতে ভালো ঘুম হয় নাই । মা সেই যে দরজা বন্ধ করেছে আর খোলে নাই । কি হইছে কি জানি বড়ই আজব মহিলা । বাবাও দরজা খুলতে পারেনি শেষ পর্যন্ত গেস্ট রুমে থাকতে হয়েছে । বাবাকে লোকটার কথা বললাম । বাবা কিচ্ছু বলে নি, যা ভয় পেছিলাম বকাঝকা করে কিনা । শুধু আংটিটা দেখে বলেছিলো, “হুম খাটি হীরের আংটি, এখনের হিসেবে আশি নব্বই আজারের কম না”। কফিটা নিয়ে বসলাম টিভির সামনে একটা মুভি দেওয়ার কথা । ঘুরতে ঘুরতে কেন জানি নিউজ চ্যানেলের একটা নিউজে চোখ আটকে গেলো । ওমা ! এ দেখি সেই লোকটা ! কি যেন নাম ??? ও হ্যাঁ জাকির হোসেন । লোকটা দেখি এক্সিডেন্ত করেছে ।

- মা দেখে যাও, সেই লোকটা এক্সিডেন্ট করেছে, টিভিতে নিউজ দিচ্ছে । ইশ একেবারে মারাই গেছে ।

মা দরজা খুলে দৌড়ে এলো । দেখি মা নিউজটা দেখে থরথর করে কাঁপছে । চোখে পানি ! আজব বড়ই আজব মহিলা । মাকে কখনই বুঝতে পারি না । এই লোকটাকে কি মা আগে থেকেই চিনতো ?

রাতে বাবা আসার পর বাবা আর মা ঝগড়া করলো । খুবই খারাপ ধরনের ঝগড়া । পরদিন দেখি বাবা ডিএমসি মর্গ থেকে ওই লোকটার লাশ এনে জানাজা পড়াবার ব্যাবস্থা করলো দাফন করলো । আজব ! লোকটাকে কি বাবাও চিনতো ?

(১১)

জাকির বন্ধু আমার । তুই যে বেঁচে ছিলি জানতাম না রে ! তোর সাথে একটা ভুল করেছিলাম, ক্ষমা চাওয়ার সুযোগটাও দিলি না । রিয়াকে তুই খুন করিসনি জানতাম শুধু মাত্র আমি । সাক্ষীটা দেই নি রে, কারণ রোকেয়াকে ভালোবাসতাম তাই ক্ষনিকের চাওয়া ছিলো তুই মরে যা । তাহলেই রোকেয়া আমার । বিয়েটা করেছিলাম রে । কিন্তু রোকেয়াকে নয়, তার দেহটাকে রোকেয়াকে পাই নি । রোকেয়া সেদিনই মরে গেছিলো যেদিন তোররায় হয়েছিলো । বিশটা বছর এই মর্মবেদনা নিয়ে আছি । ঘর করে চলেছি এক মৃত মানুষের সাথে । আমার সাস্থি আমি পেয়েছি । তুই আমায় ক্ষমা করে দিস । তোর এই বন্ধু হাসানকে ক্ষমা করে দিস ।

বিষয়: সাহিত্য

১২৩৪ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

279144
২৯ অক্টোবর ২০১৪ রাত ০৪:৪৭
রাইয়ান লিখেছেন : খুব ভালো লাগলো আপনার গল্পটা , লিখতে থাকুন। অনেক শুভকামনা রইলো .....
৩০ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ১২:৩৫
223329
শাহজাদা ইয়ামেন লিখেছেন : Happy Happy
279174
২৯ অক্টোবর ২০১৪ সকাল ০৮:০৫
মামুন লিখেছেন : লেখাটি খুব ভালো লেগেছে। অনেক ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা রইলো। Thumbs Up Thumbs Up Thumbs Up
৩০ অক্টোবর ২০১৪ দুপুর ১২:৩৫
223330
শাহজাদা ইয়ামেন লিখেছেন : Happy Happy

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File