কুরআনের গল্প : কুরআনের রঙে রঙিন হলো দস্যু ফুদাইলের জীবন

লিখেছেন লিখেছেন তবুওআশাবা্দী ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৬, ০৬:৪৮:৫০ সকাল

"যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি...?" (৫৭:১৬)।

ফুদাইল ইবনে আয়াদ(রঃ) ছিলেন সাহাবী পরবর্তী ইসলামের প্রথম যুগের অন্যতম মুসলিম স্কলার| ৭২৬ সনে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন | তার জন্মস্থান কোথায় সেটা নিয়ে খানিকটা অস্পষ্টতা আছে | ফুদাইল ইবনে আয়াদের (রঃ) জন্মস্থান হিসেবে সমরকন্দ ,বলখ, বা মসুলের কথা উল্লেখ করা হয়েছে | জাতি হিসেবে তাই তিনি আফগানী বা ইরাকি হতে পারেন | ফুদাইল ইবনে আয়াদ (রঃ) জীবনের শেষ দিকের একটা বড় অংশই কাটান মক্কায় | তার ছাত্রদের থেকে তার সম্পর্কে অনেক ঘটনা জানা যায় | তাছাড়া ইমাম যাহাবীর(রঃ) রিজাল শাস্রের গবেষণা থেকে আমরা তার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি | ইমাম আহমেদ ইবনে হাম্বলও (রঃ) ফুদাইল ইবনে আয়াদের (রঃ) ব্যাপক ইসলামী জ্ঞান সম্পর্কে তার লেখায় বলেছেন |

মুসলিম বিশ্বের শাসন তখন আব্বাসীয়দের হাতে | বাগদাদ তাদের রাজধানী | পৃথিবীর সব রাস্তা গিয়ে যেন মিশেছে বাগদাদে | অনেক আগে পরাক্রান্ত সিজারের শাসনামলে রোম নগরী সম্পর্কে যেমন বলা হতো মহান খলিফা হারুন আর রশিদের শাসনে মুসলিম বিশ্বের রাজধানী বাগদাদ সম্পর্কেও তখন তাই বলা হয় | বাগদাদকে কেন্দ্র করে খলিফা হারুনুর রশিদের সুশাসনে আর মুসলিম সভ্যতার আলোকচ্ছটায় সারা বিশ্ব তখন আলোকিত | ঠিক সেই সময়ে ফুদাইলের জীবনের প্রথম দিকটা ভরা ছিল ভুল ভ্রান্তির ঘন অন্ধকারে | জীবনের প্রথম দিকটার সেই সময়ে ফুদাইল ইবনে আয়াদতো দুর্ধর্ষ দূস্যু ! আলো ঝলোমল বাগদাদ নগরীর সীমানার বাইরে থেকে সিরিয়ার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তার সংঘবদ্ধ বাহিনী নিয়ে মরুভূমির ভ্রমণকারীদের কাফেলায় দস্যুতা করে বেড়ানোই তার পেশা | নিজে ছিলেন বাহিনীর সর্দার |এক পর্যায়ে তার কুখ্যাতি এমন ছড়িয়ে পড়লো যে সে অঞ্চলের ব্যবসা বাণিজ্যই কমে গেলো ফুদাইল বাহিনীর দস্যুতার কারণে | তার দলের দস্যুতার ভয়ে রাতে সে এলাকায় বাণিজ্য কাফেলার চলাচল কমে গেলো আশংকাজনক ভাবে |

গভীর রাত | চারদিক ঘন আঁধারে ঢাকা | উপরে অযুত নক্ষত্র মিটি মিটি মিটি জ্বলছে | তার আলো এসে যেন হারিয়ে যাচ্ছে নীচে মরুভূমির বালিয়াড়িতে | সেই আঁধো অন্ধকারে বাণিজ্যের এক কাফেলা চলেছে বাগদাদ থেকে দূর সিরিয়ার দিকে | কাফেলা অনুসরণ করে ফুদাইল এসে দাঁড়ালেন অন্ধকার এক বাড়ির প্রাচীরের আড়ালে | নিঃশব্দে প্রাচীর বেয়ে উপরে উঠে বসলেন কাফেলার উপর নজর রাখতে | চারদিকের নিঃসীম নীরবতা | সেই নীরবতার মধ্যে বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে এলো কুরআন তেলাওয়াতের আওয়াজ | খুবই সুললিত গলায় বাসার ভেতরে কেউ কুরআন তেলাওয়াত করছে | রাতের উষ্ণতা তাড়িয়ে হঠাৎ বইছে ঠান্ডা হাওয়া |সে হওয়ায় ভেসে আসা কুরআন তেলাওয়াত যেন তন্ময় করে দিলো দস্যু ফুদাইলের মনকেও | সূরা হাদিদের ষোলো নাম্বার আয়াতের "আলাম ইয়ানি লিল্লাযীনা আমানু -আন্তাকশা'আ কুলুবুহুম লিজিকরিল্লাহি ওমা নাজলা মিনাল হাককি ..." অর্থাৎ "যারা মুমিন, তাদের জন্যে কি আল্লাহর স্মরণে এবং যে সত্য অবর্তীর্ণ হয়েছে, তার কারণে হৃদয় বিগলিত হওয়ার সময় আসেনি…?” এই অংশের তেলাওয়াতটুকু শুনতেই ফুদাইলের মনে খুবই ভাবান্তর হলো | উপরে জ্বালা অযুত নক্ষত্রের আলো এসে যেন হারিয়ে যাচ্ছে নীচে মরুভূমির বালিয়াড়িতে | সেই অযুত নক্ষত্রের আলোও দূর করতে পারছে না চারদিক ঢাকা গারো ঘন অন্ধকার |কিন্তু কুরআনের বাণীর শাশ্বত আহ্বান যেন সেই গভীর রাতের আঁধারেও অপূর্ব সুন্দর আলো ঝলোমল একটা ভোর নিয়ে এলো ফুদাইলের মনে | সেই গভীর রাতে দস্যুবৃত্তির আশায় উঁচু প্রাচীরের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ফুদাইল প্রাচীরের উপরে বসেই বলে উঠলেন, হে আল্লাহ, নিশ্চিতভাবেই সেই সময় এসেছে | আমি আপনার ডাকে সারা দিলাম |এই বলে নিঃশব্দে তিনি প্রাচীর থেকে নেমে এলেন |

যাত্রী কাফেলার বিপরীত দিকে একমনে হেটে চলেছেন ফুদাইল | মনে উথাল পাতাল ভাবনা | একটা ভাঙা বাড়ি দেখে তাতেই রাততা কাটিয়ে দেবার কথা ভাবলেন | সেই পর বাড়ির মধ্যে ঢুকতে গিয়ে তিনি দেখলেন বাড়ির সীমানার অল্প দূরেই অন্যপাশে অল্প কিছু লোকের একটা ছোট কাফেলা | দূর থেকেও তাঁবুর আলো চোখে পড়ছে | ফুদাইল নিঃশব্দে এসে তাঁবুর বাইরে দাঁড়ালেন | ভেতরে করা যেন কথা বলছে | তারা দ্বীনের আলোচনা করছিলেন | কিছুক্ষন পর তাদের থেকে একজন বলে উঠলেন, এখন আমাদের আবার রওনা হওয়া উচিত | অন্য আরেকজন সাথে সাথে বলে উঠলেন আমাদের ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করাই ভালো | কারণ কে জানে এই পথের কোথায় ফুদাইল তার বাহিনী নিয়ে আমাদের সম্পদগুলো লুট করার জন্য অপেক্ষা করছে | এটা শুনে তিনি ভাবলেন, হায় আমি কেমন মানুষ ! সারা রাত ধরে আমি পাপ কাজ করে বেড়াই ! আর এখানে কিছু মুসলিমও আমার ভয়ে পথের মধ্যে আটকে থাকে ! ফুদাইল মনে মনে আবার বললেন, হে আল্লাহ নিশ্চিত ভাবেই সেই সময় এসেছে| আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাই আমার সব ভুল ভ্রান্তি আর দোষ ত্রূটির জন্য |

পরদিন সকালে তিনি তার দস্যু দল ভেঙে দিলেন | বাড়িতে ফিরে দস্যুতা করে জমানো তার সব সম্পদ বের করলেন | সেই বিস্তীর্ণ এলাকায় যে সব লোকদের তিনি সম্পত্তি লুন্ঠন করেছিলেন সেসব মালিকদের ফিরিয়ে দেবার একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা করলেন | লুন্ঠিত সম্পদ ফিরিয়ে দিতে দিতে এক সময় জমিয়ে রাখা অর্থের সব শেষ হয়ে গেলো | যাদের সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব হলো না লুন্ঠিত সম্পদের সেই সব মালিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি ক্ষমা চাইলেন তার সম্পদ ফিরিয়ে দেবার অসামর্থ্যের কারণে | ভয়ঙ্কর দস্যু আল ফুদাইল ইবনে আয়াদ তাদের দুয়ারে দুয়ারে কাঁদছে তাদের সম্পদ না ফিরিয়ে দেবার কারণে লোকেরা খুবই অবাক হলো এই ঘটনায় | ভবিষ্যতে আর তাদের বাণিজ্য কাফেলা আর কেউ লুটে নেবেনা তাতেই খুশি হয়ে সবাই ফুদাইলকে ক্ষমা করলো | এক ইহুদি তার পাওনা ক্ষমা করলো না | সে তার লুন্ঠন করা সম্পদের বিনিময়ে ফুদাইলকে তার বাড়ির পেছনের অনেক দিনের জমানো ময়লা পরিষ্কারের দাবি করলো | ফুদাইল সেই প্রস্তাবেই খুশি হয়ে রাজি হলো | বেশ কয়েক দিনের পরিশ্রমে তিনি অনেকখানি ময়লা পরিষ্কার করলেন | কিন্তু তখনও অনেক বাকি সেই ময়লা পরিষ্কার করতে | তখন একটা অবাক ঘটনা ঘটলো | একদিন রাতে ভয়ংকর ঝড় বাকি ময়লাগুলো উড়িয়ে নিয়ে গেলো এমন ভাবে যে সকালে তার কোনো চিহ্নই কেউ পেলো না |ফুদাইল সকালে ময়লা পরিষ্কারের জন্য এসে দেখতে পেলেন ঝড় সব ময়লা উড়িয়ে নিয়েছে | তিনি অঝোরে কাঁদলেন তা দেখে | দৌড়ে গেলেন সেই ইহুদির কাছে বললেন, দেখেছো আল্লাহ আমার তওবা কবুল করেছেন,তোমার ময়লা ঝড় এসে উড়িয়ে নিয়ে গেছে|

এই ঘটনার পর ফুদাইল (রঃ) ইরাকের কুফায় চলে যান | সেখানে উনি ইমাম জাফর সাদিকের (রঃ) কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন | ইমাম জাফর সাদিকের (রঃ) কাছে শিক্ষা গ্রহণ শেষে তিনি বসরায় যান প্রখ্যাত তাবেয়ী হাসান বসরীর (রঃ) কাছে শিক্ষা লাভের জন্য | তিনি যখন বসরায় পৌঁছুলেন তখন হাসান বসরী (রঃ) ইন্তিকাল করেছেন | তিনি তখন তাবেয়ী হাসান বসরীর (রঃ) বিখ্যাত ছাত্র আব্দুল ওয়াহিদ বিন জাইদের (রঃ) কাছে ইসলামী শিক্ষা গ্রহণ করেন |

বসরা থেকে ফুদাইল (রঃ) হজ্বে যাবার নিয়ত করলেন | পবিত্র অবস্থায় মক্কায় হজ্বে উপস্থিত হবার ইচ্ছা নিয়ে এক নক্ষত্রের রাতে তিনি একাকী রওনা হলেন | মক্কায় হজ্বের যাত্রা পথে আল্লাহর কাছে তার অতীতের ভুল-ভ্রান্তি আর দোষ-ত্রূটির জন্য ক্ষমা চাইতে অল্প কিছুদূর পাড়ি দেবার পর পরই তিনি নফল নামাজ আদায় করতে মনস্থির করলেন | সে এক স্বর্গীয় দৃশ্য ! উপরে হাজার লক্ষ নক্ষত্রের আলোর ঝিকিমিকি আর তার সেই আলোকময় আকাশের নীচে মৃদু আলোয় একাকী এক মরুভূমির যাত্রী তন্ময় হয়ে আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন | সারা রাতে তার নামাজে সেই মৃদু আলো ঘিরে থাকা আঁধার তাড়াতেই যেন নক্ষত্ররা আলোর প্রদীপ জ্বেলে সারি বেঁধে আকাশ যাত্রায় স্থির হয়ে আছে ! দিনেও সেই একই দৃশ্য | মাথার উপরে মরুভূমির সূর্য তার সব আলো মেলে যেন আকাশ যাত্রায় চলছে | তার আলোর ঝলকানি এসে পড়ছে দিগন্ত জোড়া মরুভূমির অসীম বালি রাশির উপর | ফুদাইলের (রঃ) আসে পাশের বালিতে তার পুন্য আত্মার স্পর্শে সূর্যের প্রতিসরিত আলো যেন আলোর ঝর্ণাধারা বইয়ে দিয়েছে |সেই উত্তপ্ত সূর্যের বালুকা বেলায় ধ্যানগ্রস্ত মুনির মতো আল্লাহর নামাজ আদায়েরত রাত এক নিঃসঙ্গ পথ যাত্রী ! এভাবে ইরাক থেকে মক্কায় হজ্বে উপস্থিত হতে তার দুই বছর লেগে গেলো |

সূর্যের আলোয় রাঙা মরুভূমির উজ্জ্বল এক ভোরে তার অন্তহীন পথ যাত্রার অবসান হলো | দূরে দেখা যাচ্ছে মক্কার পাহাড় ! এই পাহাড়ের কোনো এক গুহায়ই কতদিন আগে আইয়ামে জাহেলিয়াতের আঁধার শেষ নবী মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহর নবুয়তের নূরে আলোকিত হয়ে উঠেছিল | এই পাহাড়ের উপর থেকেইতো শেষ নবী তার লোকদের তাওহীদের বাণীর প্রথম প্রকাশ্য দাওয়াত দিয়েছিলেন ! মক্কার মানুষ তাওহীদের বাণীর সেই আলো দেখতে না পেরে মহানবীকে মক্কা ছাড়তে বাধ্য করেছিল | তারপর কত ত্যাগ, কত যুদ্ধ, কত শহীদের রক্তে ভিজে ইসলাম আবার মক্কায় এসেছিলো বিজয়ী বীরের বেশে ! বায়তুল্লাহকে মুক্ত করেছিল ওজ্জা, লাত, আর হোবলসহ তিনশ' ষাট মূর্তিসজ্জার অভিশাপ থেকে | ঐতো দেখা যায় ইসলামের কিবলা হজরত ইব্রাহিম (সাঃ) আর ইসমাইলের (সাঃ) তৈরী সেই বায়তুল্লাহ -আল্লাহর ঘর !অন্তহীন পথ চলা শেষ করে একদিন ফুদাইল (রঃ)এসে পৌঁছুলেন স্বপ্নের বায়তুল্লাহর সামনে | মরুভূমির তপ্ত বালুতে পথ চলা সারা শরীর ঝলসে গেছে রোদে পুড়ে, পায়ের এখানে ওখানে ফোস্কা পরে গেছে, গায়ের জামা ছিন্ন মলিন কিন্তু তার মনে তখন মসজিদুল হারামে পৌঁছুবার, হজ্বে যোগদানের অপার আনন্দ ! মসজিদুল হারামের কাছে এসেই তিনি পেলেন তার হারানো শান্তি | দস্যুবৃত্তির পংকিলময় জীবনের ভুল ভ্রান্তি থেকে ইসলামের পথে তার ফিরে আসার পর আল্লাহর ক্ষমা ভিক্ষার মাঝে যেই শান্তি তিনি খুঁজছিলেন সেটাই বুঝি এতদিন পর এসে দেখা দিলো তার কাছে |তিনি মক্কায়ই বাকি জীবন থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন | এই মক্কাতেই তিনি সংস্পর্শে আসেন ইমাম আবু হানিফার (রঃ)| তাঁর কাছেও ফুদাইল ইবনে আয়াদ (রঃ) শিক্ষা গ্রহণ করেন | তার বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রখ্যাত তাবে তাবেয়ী ইব্রাহিম বিন আদহাম (রঃ) |

মক্কা জীবনে ফুদাইল ইবনে আয়াদ(রঃ) আড়ালে থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন | তার কাছে নানা কারণে মানুষ আসতে চাইতো কিন্তু তিনি একাকী আল্লাহর ইবাদতে সময় কাটাতেই বেশি পছন্দ করতেন | তার সঙ্গী আবু আলী তার সম্পর্কে বলেছেন, আমি দীর্ঘ ত্রিশ বছর শায়খ ফুদাইল ইবনে আয়াদের সাথে থেকেছি | এই দীর্ঘ সময়ে আমি একবার মাত্র তাকে হাসতে দেখেছি ! মানুষের ভিড়ে তিনি একেবারেই আসতে চাইতেন না | সারাদিন নিজের ইবাদত বন্দেগীতে তিনি এতই ডুবে থাকতেন যে একবার তিনি বলেছিলেন আমি সেই মানুষকে ভালোবাসি যে আমাকে দেখেও অভ্যর্থনা জানায় না এমকি আমি অসুস্থ্য থাকলেও আমাকে দেখতে আসেনা | মানুষের ভিড় তার এতই অপছন্দ ছিল | একবার খলিফা হারুন রশিদ এসেছেন মক্কায় হজ্ব করতে | হজ্ব শেষ করে তিনি জানতে পারলেন ফুদাইল ইবনে আয়াদ (রঃ) তখন মক্কায়ই আছেন | তিনি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলেন | তার সভাসদরা তাকে খুঁজে পেতেই গলদঘর্ম হয়ে গেলো | কারণ হজ্ব মৌসুমের ভিড় এড়াতে তখন তিনি অজ্ঞাতবাস করছেন | খলিফার লোকেরা অনেক খুঁজে তাকে বের করলো | খলিফা তার সাথে দেখা করতে চান শুনে তিনি বড়ই বিরক্ত হলেন | খলিফার উজির হন্তদন্ত হয়ে এলেন তার কাছে খলিফাকে দেখা করতে দেবার অনুরোধ জানাতে | তিনি উজিরকে বললেন তার মতো দরিদ্র লোকের সাথে খলিফার কোনো দরকার থাকতে পারেনা তাই তিনি খলিফার সাথে কথা বলতে চান না | অনেক অনুরোধের পর ফুদাইল ইবনে আয়াদ (রঃ) রাজি হয়েছিলেন খলিফা হারুন আর রশিদের সাথে দেখা করতে | তাদের দুজনের কথা অর্থাৎ সেই সাক্ষাৎকারে হারুন আর রশিদকে দেওয়া তার উপদেশের বর্ণনা ইসলামের ইতিহাসের পাতায় আজো উজ্বল হয়ে আছে|

খলিফা হারুন আর রশীদ ফুদাইল ইবনে আয়াদকে (রঃ) বললেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন |

ফুদাইল(রঃ):হে খলিফা,আপনার পূর্বপুরুষ রাসূলের (সাঃ) চাচা হজরত আব্বাস (রাঃ) একদিন রাসূলের (সাঃ) কাছে কোনো একটি জায়গার শাসনকর্তা হবার ইচ্ছে করেছিলেন|উত্তরে রাসূল (সাঃ)তার চাচাকে বলেছিলেন হে আমার চাচা, শেষ বিচারের দিনটা শাসকদের জন্য খুবই কঠিন হয়ে যাবে | সেদিন যদি নেতৃত্ত্বের ভার ছাড়া আপনি সেখানে উপস্থিত থাকতে পারেন তবে সেটাই আপনার জন্য মঙ্গল |

খলিফা হারুন আর রশিদ: আমাকে আরো কিছু উপদেশ দিন |

ফুদাইল (রঃ): হে খলিফা, আল্লাহ কে ভয় করুন | আল্লাহর কাছে জবাবদিহির জন্য প্রস্তুত থাকুন | শেষ বিচারের দিন, আল্লাহ আপনাকে আপনার রাজ্যের সব মানুষের জন্যই জিজ্ঞাসাবাদ করবেন | এমনকি আপনার রাজ্যের একজন বৃদ্ধা মহিলাও যদি অভুক্ত হয়ে রাতে ঘুমুতে যায়, হাশরের দিন সেও আপনার বিরুদ্ধে অভুক্ত থাকার অভিযোগে আল্লাহর কাছে ন্যায় বিচার চাইতে পারে |

খলিফা : আমাকে আরো কিছু নসিহত করুন |

ফুদাইল (রঃ) : হারুন আর রশীদের সুন্দর মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন কিছুক্ষন | তার পর বললেন, হে সুন্দর মুখের মানুষ, আপনি আপনার প্রজাদের অন্যায় শাসন করে, তাদের ন্যায় অধিকার থেকে বঞ্চিত আর শোষণ করে এই সুন্দর মুখকে জাহান্নামের খোরাকে পরিণত করবেন না |

৮০৩ সনে ৭৭ বছর বয়সে মক্কায় ফুদাইল ইবনে আয়াদ (রঃ) মারা যান | মসজিদুল হারামের অদূরে মক্কার জান্নাতুল মাওলা কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয় | মক্কার এই কবরস্থানেই শুয়ে আছেন উম্মুল মুমেনিন হজরত খাদিজা (রাঃ) |

এই লেখার একটা ছোট উপসংহার আছে | আমার এই লেখা নতুন বছর ২০১৭ আগের প্রহরে সবাইকে স্বাগত জানবার লেখা, সবার জন্য নতুন বছরের শুভ কামনা জানিয়ে লেখা | এই লেখা শুরুর আগে আমি অবশ্য এই লেখা নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানবার লেখা হবে তা ভাবিনি |ফুদাইল ইবনে আয়াদের (রঃ)উপর পড়তে যেয়ে কুরআনের আলোয় তার আঁধার জীবন আলোকিত হবার ঘটনায় আমি অভিভূত হলাম | আমাদের নিজেদের জীবন আরো সুন্দর, আরো আলোকিত করে তুলতে নিউ ইয়ার ইভে শুরু হওয়া নতুন কিছু ফেসটিভিটির কথাও মনে হলো | আসছে নতুন বছরের প্রথম রাত বাংলাদেশে আলোয় আলোয় ভরে থাকবে | অতিরিক্ত পুলিশে, বিজিবিতে ভরা থাকবে দেশের প্রধান সব শহর | মফস্বলগুলোও থাকবে অতিরিক্ত নিরাপত্তায় ঘিরা | নাচে গানে প্রাণবন্ত থাকবে প্রধান শহরের কেন্দ্রগুলো, তা আমি জানি | কিন্তু আমি জানিনা নিউ ইয়ার্স ইভের রাতভর উদ্দাম নাচে গানের সেই পার্টিগুলো সত্যিকারের আলোয় ভরা থাকব কি না ? পার্টিতে নাচে গানে নিউ ইয়ার্স ইভ পালনের ব্যাপারে আমার কোনো বক্তব্য নেই | আমেরিকা থেকে অনেক দূরে নিজ দেশের এই পার্টিতে মাতোয়ারা মানুষদের জন্য আমার কোনো দায়ও নেই | আমি আমাদের দেশের কোনো নেতা বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি নই তাই এই নিউ ইয়ার্স ইভের উদ্দাম পার্টিতে অংশ নেবার জন্য যদি দেশের মানুষের কোনো দোষ হয়ে থাকে, আমি আশাকরি সেজন্য আল্লাহ আমাকে দায়ী করবেন না | কিন্তু ফুদাইল ইবনে আয়াদের (রঃ)উপর পড়তে গিয়ে একটা কথা আমার মনে হলো -কুরআনের ডাকে আন্তরিক ভাবে সারা দিলে সবার জীবনই আলোয় আলোয় ভরে ওঠে| নতুন বছরের আলোহীন চাকচিক্যময় রাতের উদ্দাম পার্টির মতো উৎসাহ নিয়ে কুরআন পড়ে যদি আমরাও খুশিতে মাতোয়ারা হতে পারতাম তবে কে জানে আমাদের জীবনও হয়তো আঁধার কাটিয়ে আলোর রশ্নিতে ভরে যেত হাজার বছর আগে যেমন ভরে গিয়েছিলো দস্যু ফুদাইল ইবনে আয়াদের জীবন | নিউ ইয়ার্স ইভ পালনের মেকি উৎসবে আমাদের স্বপ্নের ফানুস উড়িয়ে জীবনের আলোর মিছিলের খোঁজ করতে হতো না | যে যেভাবেই নিউ ইয়ার্স ইভ পালন করুন না কেন কুরানকেও সাথে রাখুন |শুধু কুরআনের রঙেই চাকচিক্যময়,রঙিন করুন নিজেদের জীবন| নতুন বছরে কুরআনের আলোয় সবার জীবন আরো আলোকিত আর স্বার্থক হয়ে উঠুক সেই কামনা রইলো |

বিষয়: বিবিধ

২৬৯১ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

381041
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ দুপুর ১২:৪৬
সন্ধাতারা লিখেছেন : Salam. Very beautiful writing mashaallah. Jajakallahu khairan.
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ রাত ০৮:০৮
315269
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : সন্ধ্যাতারা: অনেক ধন্যবাদ লেখা পড়া আর মন্তব্য করার জন্য|একটা সুন্দর নতুন বছরের কামনা রইলো আপনাদের জন্য|
381047
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ দুপুর ০২:২৩
কুয়েত থেকে লিখেছেন : লেখাটি ভালো লাগলো তবে আল্ কুরআন মানুষকে দুনিয়াদারী ছেড়ে বৈরাগী সাজতে বলেনাই মর্দেমুমিন হতে এবং আমরবিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকারের কাজ করতে বলেছেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ রাত ০৮:১৬
315270
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ লেখা পড়া আর মন্তব্য করার জন্য|"আল্ কুরআন মানুষকে দুনিয়াদারী ছেড়ে বৈরাগী সাজতে বলেনাই মর্দেমুমিন হতে এবং আমরবিল মারুফ ওয়া নাহি আনিল মুনকারের কাজ করতে বলেছেন"। এই মন্তব্য ফুদাইল ইবনে আয়াদ(রঃ)সম্পর্কে করেছেন কিনা জানি না|উনি একা একা থাকতে পছন্দ করতেন ঠিকই কিন্তু তাই বলে অন্য সব দায়িত্বও পালন করতেন না সেটা মনে হয় না |উনি অনেক বিখ্যাত ছাত্রেরই শিক্ষক ছিলেন|তার অনেক বইও আছে দ্বীনের চর্চার উপর|একটা সুন্দর নতুন বছরের কামনা রইলো আপনাদের জন্য |
381051
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ দুপুর ০৩:৩৯
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : শিক্ষনিয় লিখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ রাত ০৮:১৬
315271
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ লেখা পড়া আর মন্তব্য করার জন্য|একটা সুন্দর নতুন বছরের কামনা রইলো আপনাদের জন্য|
381052
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ সন্ধ্যা ০৬:২১
আবু সাইফ লিখেছেন : আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ..

ফুদাইল ইবনে আয়াদ (রঃ) ও খলিফা হারুনুর রশীদের(রঃ) একটা গল্প আমাদের শৈশবে পাঠ্য ছিল!

উপসংহারটি খুব সুন্দর হয়েছে!

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ
৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ রাত ০৮:৩৯
315272
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ লেখা পড়া আর মন্তব্য করার জন্য|ভালো থাকুন |একটা সুন্দর নতুন বছরের কামনা রইলো আপনাদের জন্য|
381097
০২ জানুয়ারি ২০১৭ দুপুর ০৩:৪১
কাব্যগাথা লিখেছেন : খুবই ভালো লাগলো আপনার লেখাটা| অনেক ধন্যবাদ|শুভ নববর্ষ|
০২ জানুয়ারি ২০১৭ রাত ০৮:০৪
315288
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : অনেক ধন্যবাদ লেখা পড়া আর মন্তব্য করার জন্য|ভালো থাকুন |একটা সুন্দর নতুন বছরের কামনা রইলো আপনাদের জন্য|

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File