ক্যাথিরিনের চিঠি
লিখেছেন লিখেছেন তবুওআশাবা্দী ০৬ নভেম্বর, ২০১৬, ০৪:২৩:৫১ রাত
ক্যাথিরিনের সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি | ও দেখতে কেমন বা কেমন বয়সী তাও আমার কখনো জানা হয় নি| ক্যাথিরিন কোনো কল্প লোকের চরিত্র নয় | সে এখনকার আমেরিকারই একটি মেয়ে | ক্যাথিরিনের পুরো নাম ক্যাথিরিন পেটিটো | শুধু ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট পার্কিঙে ও গাড়ি পার্ক করে, গাড়ি ড্রাইভ করে, আর দুপুর তিনটার সময় ওর ক্লাস থাকে এ থেকে আমি ভেবে নিয়েছি ক্যাথিরিন আন্ডার গ্রাজুয়েট প্রোগ্রামে পড়া আঠারো -বিশ বছরের আধুনিক কোনো মেয়ে |না দেখা ক্যাথিরিনের অপরূপা একটা ছবি আমার মনে আঁকা আছে | আমাকে লেখা ক্যাথিরিনের একটা চিঠি অনেক দিন থেকেই আমার কাছে আছে | আমাকে সম্বোধন করে ক্যাথিরিনের সেই চিঠিটা আমি মাঝে মাঝেই খুলে দেখি | গোটা গোটা ইংরেজিতে লেখা সেই চিঠিটা আমি এতদিন পরে পড়েও আশ্চর্য হই |
আমার এই লেখাটা কোনো প্রেমের কাহিনী নয় | ক্যাথিরিনের চিঠিটাও আমাকে লেখা আন্ডার গ্রাজুয়েট শ্বেতাঙ্গিনী আমেরিকান কোনো মেয়ের প্রেমপত্র নয় |ক্যাথিরিনের কথা আরো বলবার আগে এই চিঠির সাথে জড়িত কিছু বিষয় বলে নেই | তাহলে ক্যাথিরিনকে নিয়ে আমার ভাবনাগুলো বলতে বা বোঝাতে সুবিধা হবে |
প্রাণী হিসেবে মানুষ খুবই রাশোনাল (Rational)| মানে আমরা আমাদের ভালো মন্দের মধ্যে পার্থক্যের মধ্যে তুলনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারি | যে জিনিসগুলো আমরা আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় বলে মনে করি এবং যা তুলনামূলক ভাবে কম ব্যয়ে কিনতে বা কনজিউম করা যায় সেগুলোই আমরা কিনতে বা ব্যবহার চাই | অন্য ভাবেও কথাটা বলা যেতে পারে, তাহলো মানুষ তার কাজ কর্ম করে লাভ লোকসানের হিসেবের ভিত্তিতে | যে কাজটা করলে মানুষ নিজের লাভ হবে বলে মনে করে সেই কাজটাই মানূষ করতে চায় | যে কাজ করলে নিজের লোকসান হবে সেই কাজটা মানুষ করতে চায় না |তাত্বিক ভাবে এটাকেই বলে রাশোনালিটি (Rationality ) আর এই বৈশিষ্ঠ্য আছে বলেই মানুষ রাশোনাল | রাশোনালিটি মানুষের বেঁচে থাকার, টিকে থাকার ক্ষেত্রে একটি জরুরি বৈশিষ্ট্য | অর্থনৈতিক সামর্থ্যের দিক থেকে আমরা যে যেমনি হইনা কেন সবাই বেশির ভাগ সময়ই এই রাশনালিটির ভিত্তিতেই আমাদের কাজের সিদ্ধান্তগুলো নেই | কিন্তু আমাদের সমাজটাকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে এই রাশনালিটির বাইরেও নানান মূল্যবোধের প্রয়োজন | যেমন সততা, মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সত্য অনুশীলন এবং এরকম মূল্যবোধগুলো একটি সমাজে যত বেশি অনুশীলন করা হবে সেই সমাজ ততো বেশি সামাজিক ভাবে ততই সমৃদ্ধ হবে | সেই সামাজিক সমৃদ্ধি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিরও পৃষ্ঠপোষক | যে সমাজ যত বেশি এই মূল্যবোধগুলো প্রতিষ্ঠার উপর জোর দেয় সেই সমাজ ততো সমৃদ্ধ হয় অর্থ সামাজিক ভাবে | এখন বলি আমাকে লেখা ক্যাথিরিনের চিঠির সাথে এই মূল্যবোধের সম্পর্ক কোথায় আর কেনই বা এই চিঠি এতদিন পরেও আমাকে আপ্লুত করে আবেগে |
কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির মাস্টার্স প্রোগ্রাম শেষ করে তখন মাত্রই ওয়াশিংটন ডিসি এলাকায় এসেছি | নর্দান ভার্জিনিয়ার এনানডেলে থাকি | পিএইচডি প্রোগ্রামে এডমিশন নিয়েছিওখানকারই একটি ইউনিভার্সিটিতে | বাসার থেকে সাত/আট মাইল দূরে ইউনিভার্সিটি | ইউনিভার্সিটির কাছে বাসা পাইনি | কাছের যেসব বাসা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো ষ্ট্যুডেন্ট হিসেবে সেগুলোর রেন্ট আমার জন্য অনেক বেশি | বাসে করে স্কুলে যাই | বাসা থেকে মাইল তিনেক যেয়ে বাস চেঞ্জ করে ইউনিভার্সিটিতে যেতে হয় | প্রায় আধাঘন্টা লাগে | সমস্যা হলো এনানডেলের বাস সার্ভিস খুব সীমিত | প্রতি ঘন্টায় একটি করে বাস আমার বাসার কাছ থেকে ইউনিভার্সিটির দিকে যায় | একদিনতো সেই বাসটাও এলোনা কোনো কারণে | সেদিন আর ইউনিভার্সিটিই যাওয়া হলো না | তাছাড়া আমার ক্লাস থাকে বিকেল ছয়টার থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত | রাতের বাস কোনো কারণে না চললে খুবই ঝামেলা | ট্যাক্সি ক্যাব ছাড়া বাসায় আসা যাবে না | আর অতো রাতে ট্যাক্সি ক্যাব পাওয়াও সব সময় সহজ হবে না ইউনিভার্সিটির লোকেশনের কারণে | তাছাড়া আমার বাসা পর্যন্ত ট্যাক্সিতে আসা খুব কস্টলি |
ইউনিভার্সিটিতে এডমিশনের পরপরই তাই একটা গাড়ি কেনার কথা ভাবতে হলো | ভেবেছি একটা ইউজড কার কিনবো | বেশ কয়েকদিন পেপারের গাড়ি বিক্রির এডভার্টাইসমেন্ট দেখে একদিন বেরুলাম গাড়ি কিনতে | সাথে আমার দুই স্কুলের বন্ধু | ওয়াশিংটন ডিসির ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হেড অফিসে চাকুরী করা তারিক আর নর্দান ভার্জিনিয়ারই একটি কোম্পানির কর্মকর্তা সোহেল | ওরাই নিয়ে গেলো কয়েকটা ডিলারের কাছে | ইউজড কার কিনতে গিয়ে একটা নতুন গাড়ি কিনে বাসায় এলাম | ইউনিভার্সিটির এসিস্ট্যান্টশিপ আর উইকএন্ডে বাইরে যে কাজ করি তা থেকে মাসে মাসে টাকা দিয়ে পাঁচ বছরে গাড়ির দামটা শোধ করা যাবে | নতুন গাড়ি দেখে আমার চার বছরের মেয়ে, তার মা সবাই খুশি | আমার মেয়ে সেই গাড়ির নাম দিয়েছে টেরি | নতুন গাড়ি কেনার পর জীবন যাত্রায় বেশ পরিবর্তন হলো | নিজে ড্রাইভ করে ইউনিভার্সিটি যাই | মেয়ে প্রিস্কুলে ভর্তি হয়েছে | টেরিতে চড়িয়ে তাকে প্রিস্কুল থেকে আনা নেয়া করি গাড়িতে | গ্রোসারি থেকে বিকেলে পার্কে যাওয়া আসা, আসে পাশে বেড়াতে যাওয়া নিজের গাড়ি হবার পর অনেক কিছুই সহজ হয়ে গেলো |
নতুন গাড়ি কেনার পর ইউনিভার্সিটিতে যাই গাড়ি ড্রাইভ করে | গাড়ি পার্ক করি ইউনিভার্সিটির ষ্ট্যুডেন্ট পার্কিঙ A-তে | আমার ডিপার্টমেন্ট বিল্ডিং থেকে এই পার্কিংটাই সবচেয়ে কাছে | অন্য ষ্ট্যুডেন্ট পার্কিঙেও পার্ক করা যায় গাড়ি কিন্তু সেগুলো আবার একটু দূরে হয়ে যায় | ষ্ট্যুডেন্ট পার্কিঙে শুধু ষ্ট্যুডেন্ট রাই গাড়ি পার্ক করতে পারে | ফ্যাকাল্টি আর স্টাফ পার্কিং পুরোপুরি আলাদা | প্রতি সেমিস্টারে প্রায় দুইশ ডলারে করে ফি দিয়ে পার্কিং পাস (এরা বলে পার্কিং ডিকেল) কিনতে হয় | সেই ডিকেল উইন্ড শিল্ডের ডান কোনায় নিচে লাগাতে হয় | বড় ইউনিভার্সিটি পার্কিং লট তাই সব সময়ই ষ্ট্যুডেন্টদের গাড়িতে ভর্তি | মাঝে মাঝেই পার্ক করতে খুবই ঝামেলা হয় | অনেক সময়ই এসে দেখি কোনো পার্কিঙ লটে স্পেস নেই | অপেক্ষা করতে হয় | ক্লাস শেষ করে ষ্ট্যুডেন্টরা কেউ কেউ গাড়ি নিয়ে চলে যায় | তখন সেই এম্পটি স্পেসে পার্ক করি |
তেমনি একদিন দুপুরে অনেক ঝামেলা করে গাড়ি পার্ক করে স্কুলে গেছি | স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টের আন্ডার গ্রাজুয়েট প্রোগ্রামে টিচিং এসিস্ট্যান্টশিপের কাজ করি | প্রায় সোয়া ঘন্টা করে আন্ডার গ্রাজুয়েট ক্লাস | সপ্তাহে দুটো ক্লাস নিতে হয় | সেদিন আন্ডার গ্রাজুয়েট প্রোগ্রামে একটা ক্লাস নিতে হবে অর্গানাইজেশন বেহেভিয়রের | সোয়া এক ঘন্টা ক্লাসের পর আরো কিছুক্ষন ষ্ট্যুডেন্টদের সাথে কথা বার্তা বলে পার্কিঙে এসেছি | দরজা খুলে ইগনিশনে মাত্রই চাবি ঢুকিয়েছি | হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার উইন্ড শিল্ডের নিচে সাদা একটা এনভেলপ চাপা দে'য়া | এখানে অনেক সময়ই নানা ধরণের প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের এডভারটাইসমেন্ট লিফলেট উইন্ড শিল্ডের নিচে চাপা দিয়ে যায় | কিন্তু সেগুলো কখনোই ইনভেলাপে দেয় না | পুলিশ অবশ্য এখানে ইনভেলাপে টিকেট দেয় | টিকেট মানে এখানে গাড়ির চালানোর সময় যেকোনো আইন ভাঙলে, মানে ট্রাফিক রেড লাইটে না থেমে চলে গেলে, স্পিডিং করলে বা পার্কিং রুল ভায়োলেশন হলে পুলিশ তাৎক্ষণিক ভাবে ফাইন করে প্রিন্টেড ফর্মে ফাইনের পরিমান উল্লেখ করে সেটা ড্রাইভারের হাতে বা উইন্ড শিল্ডের নিচে রেখে চলে যায় | ফাইনের সেই টাকা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে না দিলে গাড়ি পুলিশ সিজ করতেতো পারেই রাস্তায় পার্ক করা অবস্থায় তাছাড়াও কোর্ট কাচারীর ঝামেলা আছে |পুলিশ এসে গাড়ির চাকায় একধরণের হেভি মেটালের কভার পরিয়ে লক করে দেয় | ওটা না খুলে গাড়ি চালানো অসম্ভব | ওগুলো পুলিশের সাহায্য ছাড়া আনলক করা সম্ভব নয় | ইউনিভার্সিটি পুলিশও ক্যাম্পাসের মধ্যে এই টিকেট দেবার কাজ করতে পারে স্পিডিং বা পার্কিং রুল ভায়োলেটের কারণে | ভাবছি আমিতো ষ্ট্যুডেন্ট পার্কিঙেই পার্ক করেছি | আমার পার্কিং ডিকেল ভ্যালিড তাহলে আবার আমাকে ইউনিভার্সিটি পুলিশ টিকেট দেবে কেন ? ভাবতে ভাবতেই গাড়ির দরজা খুলে বের হলাম ইনভেলাপটা নিতে | ইনভেলাপটা হাতে নিয়ে দেখি অরে এটাতো পুলিশের কোনো টিকেট নয় !
ইউনিভার্সিটি ষ্ট্যুডেন্ট পার্কিঙে পাওয়া এই চিঠিটাই ক্যাথিরিনের চিঠি | যা আমি এতদিন পরেও মাঝে মাঝেই মনে করি | চিঠিটা খুলে দেখলাম | ক্যাথিরিন লিখেছে : Dear Sir, I am very sorry. I hit your back bumper and damaged it. I will pay your all repairment costs for this damage. Please call my number and provide me your repairment work invoice. Sorry for your inconvenience.Sincerely, Kathyrin Petito. চিঠির নীচে ক্যাথিরিন তার নিজের ফোন নাম্বার আর বাসার ঠিকানা দিয়েছে | ক্যাথিরিনের চিঠিটা পরে আমি গাড়ির পেছনে গিয়ে দেখি আমার নতুন গাড়ির প্যাসেঞ্জার সাইডের ব্যাক বাম্পারের ডান দিকের কোনায় চলটা উঠে গিয়েছে বেশ খানিকটা | সম্ভবত ব্যাক করে নিজের গাড়ি বের করতে গিয়ে উল্টোদিকে রাখা আমার গাড়ির সাথে লেগে গিয়েছে | গাড়ি পুরোন হলে এই ড্যামেজটা ইগনোর করা যেত সহজেই | অনেক বড় নয় কিন্তু তবুও আমার নতুন গাড়ির গায়ে চাঁদের কলংকের মতো লাগছে চলটা উঠা জায়গাটা | মনটা একগাদা খারাপ করে গাড়ির ড্যামেজটার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষন | এই ছোট ড্যামেজটা ঠিক করতে প্রায় একহাজার ডলার লাগবে তা সহজেই বুঝতে পারছি | কিন্তু ক্যাথিরিনের চিঠিটার কথা মনে হতেই ঝিরি ঝিরি এক পশলা বৃষ্টির মতোই একরাশ শান্তি আর স্বস্তির বন্যা বয়ে গেলো মনের ভেতর দিয়ে | মনটা ভালো হয়ে গেলো | যাক এই ড্যামেজটা রিপেয়ার করার জন্য প্রায় হাজার ডলারের পুরোটা এই মুহূর্তে আমার হয়তো দিতে হবে না |
মনে একটু সন্দেহ, একটু অস্বস্তি আর এই দুইয়ের যোগফলের চেয়েও মনে অনেক অনেক বেশি পরিমান দুশ্চিন্তা নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে বাসায় ফিরে এলাম | ড্যামেজটা রিপেয়ার করার হাজার ডলারের দুশ্চিন্তা মাথা থেকে আর যাচ্ছে না | সত্যি সত্যি কি এই মেয়ে এতো টাকার রিপেয়ার কস্ট দেবে ? এই মুহূর্তে এক হাজার ডলার দিতে হলে সত্যি ঝামেলায় পরে যাবো | বাসায় এসেই ক্যাথিরিনের নাম্বারে ফোন করলাম | ফোন ধরলো ক্যাথিরিন নিজেই | আমি নিজের পরিচয় দিলাম | থ্যাংকস বললাম চিঠিটার জন্য | ক্যাথিরিন আমাকে আমার রিপেয়ারমেন্ট ওয়ার্ক ইনভয়েস পাঠাতে বললো ওর এড্ড্রেসে | ও রিপেয়ারমেন্টের পুরো খরচটাই আমাকে দেবে | আমি ওকে জানালাম আমি উইক এন্ডে আমার গাড়ি ডিলারের কাছে নিয়ে যাবো | তারপর রিপেয়ারের কস্ট ওকে জানাবো | উইক এন্ডে গাড়ি নিয়ে গেলাম ডিলারের কাছে | ডিলার টয়োটার অথারাইজড সার্ভিস সেন্টারের ঠিকানা, সেখানে কার সাথে কথা বলতে হবে সে সব জানিয়ে দিলো | সার্ভিস সেন্টার গাড়ির ড্যামেজ রিপেয়ারমেন্টের একটা এস্টিমেট দিলো | তিনদিন লাগবে গাড়ি ডেন্ট পেন্ট করে আমাকে ফেরত দিতে | সেই তিন দিনের জন্য গাড়ি রেন্ট করার কস্ট কত হবে সেটাও দিলো | সবশুদ্ধ খরচ হবে সাড়ে সাতশো ডলার | আমি ক্যাথিরিনকে ফ্যাক্স করে সেদিনই ইনভয়েসটা পাঠিয়ে দিলাম |
ফ্যাক্স করার দুদিন পড়ি দেখি প্রায়োরিটি মেইলে আমার বাসার ঠিকানায় সাড়ে সাতশো ডলারের চেক এসেছে ক্যাথিরিনের | চেকটা সম্ভবত ওর বাবার | যাহোক আমার গাড়ি যথা সময়ে ঠিক হলো | সার্ভিস সেন্টারের নিখুঁত কাজে চাঁদের কলঙ্ক দূর হলো | গাড়ির দাগ দূর হয়ে গাড়ি আবার নিখুঁত | ক্যাথিরিনের চেকটা ডিপোজিট করে সেখান থেকেই আমি পেমেন্টটা করলাম | গাড়ি ঠিক ঠাক হবার পর আমি একটা থ্যাংকস জানিয়ে একটা চিঠি লিখলাম ক্যাথিরিনকে |
প্রেম ক্ষয় হয় | ধূসর হয় | প্রেমের চিঠিও সময়ের সাথে মলিন হয়, ফুটো হয়ে ছিড়ে বা পোকায় খেয়ে যায় বা ধ্বংস হয়ে যায় | ক্যাথিরিনের চিঠিটা কোনো প্রেমের চিঠি নয় | তাই সেই চিঠিটা আমি অনেক দিন যত্নের সাথে রেখেছি | আমার ছেলে মেয়ে দুজনই এখন নীতি মুল্যবোধ বোঝার মতো বড় হয়েছে | তাদের সাথে নানা সময়ে সত্য মিথ্যা, সততা, নীতি মূল্যবোধ নিয়ে যখন আমার কথা হয় তখন এতদিন পরেও আমি ক্যাথিরিনের কথা বলি | ক্যাথিরিনের সেই চিঠিটাও আমি তাদের অনেকবার দেখিয়েছি | তাদের ক্যাথিরিনের সততার কথা বলেছি | পার্কিঙে আমার গাড়িকে ড্যামেজ করার সময় আমি দেখিনি | অন্য কেউ দেখেছে কিনা তা আমি জানি না | আমার বাম্পারের যে ক্ষতিটুকু হয়েছিল তার থেকে এটা ভাবার কারণ আছে যে অন্য কেউ সেই কলিশনটা লক্ষ্য করেনি | তবুও ক্যাথিরিন নিজেই সে ড্যামেজটার দায় নিয়ে আমাকে সেটা জানিয়েছে !
আশ্চর্যের বিষয় হলো আমেরিকার ক্যাপিটালিস্ট সমাজে বড় হওয়া আমার ছেলে মেয়ের কাছে ক্যাথিরিনের চিঠিটা বেশি অবাক করা কোনো বিষয় নয় | তারা তাদের এলিমেন্টারি স্কুল থেকেই এটা শেখে | নিজের কথা আর কাজের রেসপনসিবিলিটি নিজের নিতে হবে | সত্যি কথা বলতে হবে | মিথ্যা কথা বলা যাবে না | আশ্চর্যের বিষয় হলো আমেরিকার মতো একটি ক্যাপিটালিস্ট সমাজেও এই শিক্ষাটা কিন্তু এরা এদের ভবিষ্যতের কর্ণধার শিশুদের দেয় | এদের শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে এথিক একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় |পাবলিক বা প্রাইভেট দু'ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে তারা এথিক সম্পর্কিত শিক্ষাগুলো মেন্ডেটরি করে রেখেছে | বাংলাদেশে আমরা স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটি কোনো পর্যায়েই এথিক আলাদা সাবজেক্ট হিসেবে পড়িনি (এখনো সম্ভবত বাংলাদেশে ইউনিভার্সিটির কোনো প্রোগ্রামেই এথিক রিকোয়ার্ড সাবজেক্ট হিসেবে পড়ানো হয় না ) | সেগুলোর কোনো অস্তিত্বই ছিলোনা আমাদের সিলেবাসে | কিন্তু আমি আমেরিকায় আমার মাস্টার্স, এমবিএ আর পিএইচডি প্রোগ্রামে রিকোয়ার্ড কোর্স হিসেবেই এথিক পড়েছি পাবলিক আর প্রাইভেট দুধরণের ইউনিভার্সিটিতেই | আন্ডার গ্রাজুয়েট আর মাস্টার্স প্রোগ্রামে আমি নিজেই এথিক ক্লাস পড়িয়েছি | এথিক অনুশীলনে জোর দেবার কারণেই আঠারো/ বিশ বছরের ছোট একটা মেয়ে হয়েও ক্যাথিরিন অন্যের গাড়ি ড্যামেজ করার পর হাজার ডলারের দায় সহজেই নিজের কাঁধে নেয় |
বিদেশে বসে পেছনে ফেলে আসা দেশের সব কিছুই ভালো লাগে | বাদুড় ঝোলা হয়ে ইউনিভার্সিটির “শ্রাবন” বসে করে আসা যাওয়া, শান্ত নির্মল কোনো হালকা শীতের সকালে ককটেল আর গোলাগুলিতে ক্যাম্পাস উত্তপ্ত হওয়া, প্রাণ হাতে নিয়ে এদিক সেদিক দৌড়োদৌড়ি, হরতাল ধর্মঘটে যখন তখন ইউনিভার্সিটি বন্ধ হওয়া, চার বছরের ইউনিভার্সিটি প্রোগ্রাম আট বছরে শেষ করা, ঘন্টার পর ঘন্টা ট্রাফিক জ্যামে আটকে যাওয়া, সেই জ্যামে বাস ট্রাক থেকে কালো বিষাক্ত ধোয়া এসে নাকে মুখে ঢোকা কোনো কিছু নিয়েই আজ আর কোনো অভিযোগ নেই | কিন্তু যখন দেখি ন্যায় নীতি মূল্যবোধগুলো দেশের থেকে একটা একটা করে বিদায় নিচ্ছে তখন খুব খারাপ লাগে |
আমাদের দেশের ক্ষমতার উপরের তলায় যে রাজা বাহাদুররা রাজত্ব করেন তারা যখন নীতি মূল্যবোধের কোনো ধার ধরেন না তখন অসহায়বোধ না করে আর পারা যায় না | মূল্যবোধের প্রতিটা স্তম্ভ গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে দেশে | ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের জন্য ক্লাসের পাঠ্য বই পরে যে নীতি, নৈতিকতা আর সততার মূল্যবোধগুলো শেখার সুযোগ ছিল সেগুলোও যেন কার অদৃশ্য ইঙ্গিতে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে | নবী, রসূল, সাহাবী, আম্বিয়া, স্বরণীয় ব্যক্তিদের জীবনী পাঠ্য বই থেকে বাতিল করে দেশের সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিহীন কবিতা গল্পে এখনকার পাঠ্য বই ভরপুর | একটা অনৈতিক জাতি গঠনের কাজ নিপুন দক্ষতায় সম্পন্ন করা হয়েছে গত কয়েক বছরে | একটা অগণতান্ত্রিক সরকারের দুই বা তিন মেয়াদের অপশাসনের ক্ষত হয়তো দেশ পূরণ করতে পারবে কঠোর পরিশ্রম করে | কিন্তু এই সরকারের মেয়াদে যে কিরণমালা বা ভারতীয় সিরিয়াল কেন্দ্রিক প্রায় মূল্যবোধহীন একটি প্রজন্ম বেড়ে উঠছে এর ক্ষতি দেশ কত দিনে পূরণ করতে পারবে সেটা ভাবতেই ভয় লাগে | আমেরিকার মতো একটি শক্তিধর, উন্নত দেশও তাদের নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থাটা ঠিক রাখে | আন্ডার গ্রাজুয়েট পড়া একজন ক্যাথিরিন তাই অন্যের গাড়ি ড্যামেজ করে হাজার ডলারের দায় সহজেই নিতে পারে |
শতকরা পাঁচ ভাগ ভোট না পড়লেও সেই ভোটেই আমাদের সরকার নির্বাচিত হয় ! সেই সরকারের আবার শত মন্ত্রী উপ মন্ত্রী থাকে ! তাদের কেউ কেউ আদালতের রায়ে তিরস্কৃত হন, আদালতের কাছে তাদের আচরণের জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে জরিমানা থেকে মুক্তি পান তবুও লোভনীয় মন্ত্রিত্ব ছাড়তে চান না ! সংসদে জ্বালাময়ী ভাষায় বিরোধী দলকে আক্রমণ করে বক্তিতা দিতেও তাদের লজ্বা করে না ! প্রায় প্রতিটা মন্ত্রণালয়ের, ডিভিশনের উন্নয়ন কাজে হাজার কোটি টাকার প্রত্যক্ষ দুর্নীতির পরও মন্ত্রীরা নিজ মন্ত্রণালয়ের সেই দুর্নীতির দায়িত্ব না নিয়ে বহাল তবিয়তে ক্ষমতায় থাকেন | সরকারি ব্যাংক থেকে দলীয় লুটেরাদের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা স্রেফ লুটপাট হয়ে যাচ্ছে | সেই টাকা ফিরে পাবার কোনো সক্রিয় প্রচেষ্টা নেই ! তার জন্য কারো কোনো দায়বদ্ধতা নেই | সব মন্ত্রীর মন্ত্রী, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর মুখে খিস্তি খেজুরের ভাষা লেগেই থাকে তবুও তার কোনো বিকার নেই | সত্যি প্রকাশে অনিচ্ছুক আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রীর দরকার হয় হানিফ আর হাসান মাহমুদ সাহেবদের মত মিথ্যা আর বাগাড়ম্বরবাজ মুখপত্র | নীতি,নৈতিকতা আর সততার মতো মূল্যবোধগুলো শিখবার মতো কোনো জায়গা নেই, শেখানোর কেউ নেই আজ আমাদের দেশে |
কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের মাননীয় এক সরকারি সংসদ ইয়াবা চোরাচালানের কারণে সম্ভবত আদালতে দন্ডপ্রাপ্ত হয়েছেন ! এই সংসদের বিরুদ্ধে মাদক চোরা-চালানির অভিযোগ কিন্তু নতুন নয়, বহু পুরোনো | কিন্তু সরকারি সাংসদ হবার কারণে তিনি সবসময়ই এই অভিযোগ থেকে মুক্ত থেকেছেন | এবার আদালতে দন্ড প্রাপ্ত হলেও তার আদৌ কিছু হবে কিনা সেই নিয়েও মানুষের মনে বিস্তর সন্দেহ আছে | বাংলাদেশে নীতি নৈতিকতার এই সর্বগ্রাসী পচন যখন দেখি সরকারের উচ্চতম স্থান থেকে সর্বনিম্ন স্তর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে তখন আমার ক্যাথিরিনের চিঠিটার কথা মনে হয় | আমাদের সরকারের প্রধানমন্ত্রী থেকে, মন্ত্রী, সাংসদসহ সরকারপন্থী সমস্ত বুদ্ধিজীবীদের মূল্যবোধের সাথে আন্ডার গ্রাজুয়েট প্রোগ্রামে পড়া একজন টিন এজার ক্যাথিরিনের মূল্যবোধকে যখন আমি মাপতে যাই তখন ক্যাথিরিনের সততা আর মূল্যবোধে ভরা অস্তিত্বই আমার ভাবনায় শুধু উজ্জ্বলতর হয় | কিন্তু নিজ দেশের সরকারের উচ্চতম পর্যায়ের সর্বগ্রাসী সততাহীনতায় আমেরিকার মতো এই বিশাল দেশেও লজ্জ্বায় মুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়না | এই রকম সর্বগ্রাসী লজ্বার মখোমুখি হয়েই হয়তো রামায়ণের সীতা নিজ সম্ভ্রম বাঁচানোর তাগিদে মাটির নিচে লুকিয়ে লজ্জ্বার হাত থেকে বাঁচতে চেয়ে মা ধরণী দ্বিধা হও বলেছিলেন | আমি সীতার মতো তা বলতে পারিনা আমার বিশ্বাসের কারণেই | সীতাকে বস্রহরণের সেই সর্বগ্রাসী লজ্জ্বার থেকে বাঁচাতে স্বর্গের দেবতা নেমে এসেছিলেন | তার বরে সীতার শরীরের কাপড় অনিঃশেষ হয়ে পরে আর সীতাও বস্রহরণের লজ্জ্বা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন | কিন্তু আমি সীতার মতো ভাগ্যবান নই | আমাকে লজ্জ্বার হাত থেকে বাঁচাতে স্বর্গের থেকে কোনো দেবতা নেমে আসেন না | কোনো দেবতা আমার লজ্জ্বার চারদিকে অনিঃশেষ কাপড়ের আড়াল তুলে আমাকে বাঁচাবার বর নিয়ে আসেন না | তাই সর্বগ্রাসী সম্ভ্রমহানির এই তীব্র লজ্জ্বা থেকে লুকিয়ে বা অন্য কোনো উপায়েই আমারও আর মুক্তি পাওয়া হয় না |
বিষয়: বিবিধ
১৯৮৪ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নির্বাচন নিয়ে কিছু লিখলেন না। মাএ কয়দিন বাকী। জানি না, হিলারী জিতে কিনা।
যাদের ফেলে এসেছি তাদের জন্য আমরা দায়ী হব না কিন্তু যাদের রেখে যাব তাদের জন্য আমরা দায়ী হব ।
।তাই আমরা আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে কোথায় রেখে যাচ্ছি সেটা নিয়ে কিছু বেশী বেশী ভাবেন ।ামরা সবাই মিলে একটা সুন্দর পৃথিবী গড়ব । ইনশা আল্লাহ ।
জী ভাইয়া এদের ঈমান নেই এথিক আছে আমাদের দেশের মানুষের এথিক নেই ঈমান আছে ।
এখন বলেন ভাইয়া কোনটা ভাল বা কোনটা খারাপ ?
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর বাইরে পড়তে যাওয়ার ইচ্ছা হয়েছিল। তখন ইংল্যান্ড এর কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করি। সবকিছুর কাগজপত্রের সাথে সিলেবাস ও থাকত। অবাক হয়েছিলাম এথিক্স নামে একটা বিষয় দেখে। যেখানে ৪ ক্রেডিট ও থাকত। অথচ দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে এই বিষয় এর দেখা পাইনি। অন্যদিকে যে ধর্মিয় ও পারিবারিক মুল্যবোধ আমাদের সমাজে ছিল সেটাও এখন নেই। একজন ছাত্রর এই শিক্ষা কি করে হবে যখন সে দেখছে তার অভিভাবক রাই অম্লান মুখে সরকারি সম্পদ এর অপচয় করে চলছে। রাস্তায় সামান্য থুথু ফেলার সময় যারা সাবধান হয়না তাদের মধ্যে মুল্যবোধ কি করে আসবে।
ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন