ক্লিভল্যান্ড রক এন্ড রোল মিউজিয়ামে “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” -এর গানের সিডি কিনতে না পারার কষ্ট এবং আমার এতদিন পরের আশা আর হতাশা
লিখেছেন লিখেছেন তবুওআশাবা্দী ৩১ জুলাই, ২০১৬, ১১:৪২:৪৬ সকাল
(আমেরিকার দিনগুলি -৪)
না পাবার ব্যাথা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে কত লেখা আছে জানিনা | যে সংখ্যাটা মনে আসছে তা অসংখ্য | কবিতার কথাই যদি ধরি, না পাবার বেদনা নিয়ে কত কবিতাই না লেখা হলো বাংলা সাহিত্যে | খাবার কেনার টাকা নেই তাই ক্ষুধার জ্বালা নিয়ে অসাধারণ আর মহৎ কত গল্প কবিতা বাংলা সাহিত্যের পাতায় পাতায় | প্রেম পাওয়া গেলো না সেই বিরহী ব্যথা নিয়েই না বাংলা সাহিত্যে লেখা হলো কত অসংখ্য কবিতা, গল্প আর ছোট গল্প | রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, থেকে শুরু করে হাল আমলের সুনীল বন্দোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুন সবাই না পাবার ব্যাথা নিয়ে কতই না কবিতা লিখলেন এবং এখনো লিখেই চলেছেন | শুধু সাহিত্যের কবিতা গল্পই কেন ? না পাবার বেদনা থেকে এই হালের্ বাংলাদেশেইতো দেখছি কত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটছে | গত কয়েক ঈদেইতো দেখলাম "কিরণ মালা" নামের একটি ড্রেস না পেয়ে কতগুলো মেয়ে আত্মহত্যা করলো! না পাবার বেদনা, না কিনতে পাবার যন্ত্রনার ছবি গল্প, কবিতা পার হয়ে আজ ঘরে ঘরেই | সেই ছোট বেলার একটি দিনের কথা মনে আছে ঢাকায় এক্সপোর্ট ফেয়ার দেখতে গিয়েছি আম্মার সাথে | কি একটা কিনতে না পেরে কি যে কান্না এলো ! আমার মন খারাপ দেখে আম্মা শেষ পর্যন্ত সেটা আমাকে কিনে দিয়েছিলেন |
কিন্তু খুব করে কিনতে চাওয়া কিছু কিনতে না পারলে কি কারো মন ভালো হয়? কখনো কখনো কিছু না পাওয়া যে কষ্ট না বাড়িয়ে মনে বসন্তের ঝিরি ঝরি মাতাল হওয়ার মতো অবিশ্রান্ত সুখের আনন্দ বইয়ে দিতে পারে তা সত্যিই আমার জানা ছিল না |এমন একটা উল্টো অভিজ্ঞতাও হলো আমার দূর আমেরিকার ক্লিভল্যান্ড শহরে | এইতো মাত্রই শেষ হলো আমেরিকার দুই বড় রাজনৈতিক দলের প্রেসিডেন্ট নমিনেশনের কনভেনশন | রিপাবলিকান পার্টির কনভেনশন হলো ওহাইও স্টেটের ক্লিভল্যান্ডে আর ডেমোক্র্যাটিক পার্টির কনভেনশন হলো পেনসিলভ্যানিয়ার হিস্টোরিক ফিলাডেলফিয়া শহরে | সামারের খানিকটা অবসরে এবার কনভেনশন দুটোই দ্যাখ্যা হলো অনেকটাই | ক্লিভল্যান্ডে রিপাবলিকান পার্টির কনভেনশনে সব বক্তারই লাগাতার নেতিবাচক কথাবার্তা, একটি অসুখী ভবিষ্যতের ছবি আকার নিরন্তর চেষ্টা দেখেই অনেক বছর ধরে মনের গভীর ভিতরে জমে থাকা ক্লিভল্যান্ড শহরেরই কিছু সুখের স্মৃতি মনে পড়লো |
আমেরিকায় তখন মাত্রই গিয়েছি | পিটসবার্গে | ফার্স্ট সেমিস্টার চলছে | দিনরাত না থামা স্নোর সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে অবিরাম পড়াশোনা | কোনো সকাল সন্ধ্যা নেই, উইক ডেজ -উইকএন্ড নেই জোরে জোরে, একটানা, থেমে থেমে, ইলশে গুড়ির ধারায় -মানে রোদ উঠেছে কিছুক্ষন আবার তার মধ্যেই স্নোও পড়ছে | প্রথম স্নো পড়ার বৈচিত্র দেখে যে অবাক হবো, মন ভরাবো বাংলাদেশের শ্রাবণ দিনের বৃষ্টির দেখার মতো করে সে অবস্থা নেই | পড়ার চাপে চিরে চ্যাপ্টা হবার জোগাড় দিনে আর রাত্রে |
তখন নিজের কোনো ল্যাপটপ নেই | আসলে তখন এতো ল্যাপটপই বাজারে ছিলোনা | যে ল্যাপটপগুলো ছিল সেগুলোও খুব একটা সস্তা না | আমাদের স্কুলের সব আমেরিকান ষ্টুডেন্টদেরও তখন ল্যাপটপ ছিল না | অনেকের অবশ্য বাসায় ডেস্কটপ ছিল তাই তাদের সব সময় স্কুলে আসার দরকার হতো না | আমার অবস্থা সেরকম নয় | তাই সকালে স্কুলে আসি কম্পিউটার ল্যাবে বসে হোম ওয়ার্ক করি | দুপুরে একঘন্টার জন্য বাসায় যাই | লাঞ্চ করে আবার স্কুলে আসি | অনেক রাত পর্যন্ত স্কুলে থাকি | তারপর বাসায় যাই | কোনো দিন এতো ক্লান্ত লাগে যে কোনোরকমে একটু খেয়েই ঘুম | কোনো দিন একগ্লাস দুধ খেয়েই শুয়ে পড়ি |মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয় যে সপ্তাহ চলে যায় কারো সাথে বাংলায় কথা হয় না | মোনা খালার বাসায় যাবার সময় পাই না পড়ার চাপে | আর বাংলাদেশেও সব সময় কথা বলতে পারিনা | তখন আমেরিকা থেকে বাংলাদেশে কল করা খুবই এক্সপেন্সিভ ছিল | দশ ডলারের একটা ফোন কার্ড দিয়ে দশ পনেরো মিনিট কথা বলতে পারতাম | তাই প্রতি সপ্তাহেই কল করা হতো না |
জানুয়ারি থেকে শুরু করে মার্চের মাঝামাঝি প্রায় পাগল হয়ে গেলাম পড়াশোনার কারণে | এর মাঝে মিড্ টার্মগুলো শেষ হলো | ভালোই হলো মিডটার্মগুলো | মিডটার্ম শেষ করার পর এলো স্প্রিং ব্রেক | একসপ্তাহ কোনো ক্লাস নেই | আমার ধারণা বেশির ভাগ আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতেই এই স্প্রিং ব্রেক আছে | এমন কি আমার ছেলে মেয়েদের স্কুলেও স্প্রিং ব্রেক আছে | এটা পড়াশোনার চাপ থেকে সেমেস্টারের মাঝে ষ্টুডেন্টদের বেশ খানিকটা রিলিফ হয় | সেমেস্টারের শুরু থেকে এরকম এক্সটেন্সিভ এনগেজমেন্টের পর এই ব্রেকটা খুব কাজের হয় | অন্তত পিটসবার্গের সেই প্রায় প্রতিদিন স্নো পড়া উইন্টার সেমিস্টারে এই ব্রেকটা আমার জন্য খুব কাজের হয়েছিল |
সাত দিনের স্প্রিং ব্রেকের প্রথম ক'দিনের জন্য আমি ওহাইও স্টেটের ক্লিভল্যান্ড যাবো বলে আগেই ঠিক করেছিলাম | লেক ঈরির তীরে খুবই সুন্দর ছবির মতো শহর ক্লিভল্যান্ড | পিটার্সবার্গের থেকে প্রায় ১২০/১২৫ মাইল দূরে | আমার বন্ধু মেহনাজ তখন পিএইচডি করছে ক্লিভল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আরবান পলিসিতে |
স্প্রিং ব্রেকের প্রথম দিন দুপুরে গ্রে হাউন্ড বসে চড়ে বসেছি | অল্পই দূর ক্লিভল্যান্ড কিন্তু বাস সরাসরি না গিয়ে যাবে একটু ঘুরে | সে'জন্য লাগবে চার ঘন্টা | খানিকটা উত্তেজনা নিজের মধ্যেই | অনেকদিন মেহনাজের সাথে দ্যাখা হয় না | মেহনাজ আর আমি একই ডিপার্টমেন্টে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি | ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনাও আমরা একসাথে করতাম একটা টিম হিসেবে | পড়াশোনার কাজগুলো ভাগ করে নিতাম নিজেদের মধ্যে অনার্স আর মাস্টার্সে থাকার সময় | ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে একই প্রফেসরের আন্ডারে রিসার্চ করেছি অনার্স ফাইনাল ইয়ার আর মাস্টার্সের সময়গুলোতে |আমি আমেরিকায় আসার আগেই মেহনাজ কানাডায় এসেছিলো মাস্টার্স করতে |তারপর মাস্টার্স শেষ করে ক্লিভল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি করা শুরু করেছে আমি আসার এক বছর আগে | ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমাদের ব্যাচ থেকে আমরা দুজনই শুধু পড়তে এসেছিলাম আমেরিকায় | আমাদের ব্যাচের আরো কয়েক জন ইউরোপ পড়াশোনা করেছে | আমেরিকাতে পরে এসে অন্য সাবজেক্টে পরেছে আর এখন আমেরিকাতে চাকুরী করে এমন কয়েক জন বন্ধুই আছে আমাদের | কিন্তু মেহেনাজ আর আমিই শুধু পিএইচডি করেছি আমেরিকায় | তাই ঠিক হলো এক সপ্তাহের স্প্রিং ব্রেকে নিউ ইয়র্কে কাজিনদের বাসায় নয় মেহনাজের ওখানেই বেড়াতে যাবো |
শেষ বিকেলে এসে আমাদের বাস ক্লিভল্যান্ডে পৌছুলো | বাস থেকে নেমে নিজের ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নিয়ে স্টেশনের গেটের দিকে এগুতেই কাঁচের জানালা দিয়ে দেখি মেহনাজ হাত নাড়ছে আমাকে দেখে | অল্প রোদের আলোয় তখনও ভরা সেদিনের বিকেল | হালকা ঠান্ডা | ডাউন টাউনের গ্রে হাউন্ড বাস স্টেশন থেকে কাছেই ক্লিভল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটি | ইউনিভার্সিটির অল্প দূরেই ইউক্লিড এভিনিউতে মেহনাজের এপার্টমেন্ট | কাছেই একটা সিটি বাস স্টপের থেকে মেহনাজের বাসায় যাবার বসে উঠলাম । মাইল দুয়েক গিয়ে নেমে পড়লাম আরেকটা স্টপেজে । বাস স্টপেজের কাছেই একটা কফি শপ থেকে কফি কিনে হাটতে হাটতে আমি আর মেহনাজ ওর এপার্টমেন্টে পৌঁছে গেলাম |ষ্টুডেন্টদের জন্য বিশেষ ভাবে করা এক রুমের এই এপার্টমেন্টগুলোকে বলা হয় ষ্টুডিও | এগুলো সাধাহরণ একটি রুমের চেয়ে বড় | এগুলোতে আছে কিচেনের ব্যবস্থা , বাথরুম আর থাকার জায়গা | এর বিশেষত্ব হলো এই ষ্টুডিয়োগুলোতে কিচেন আলাদা একটা রুম হিসেবে সম্পূর্ণ পৃথক নয় |
যা হোক অনেক দিন পর দ্যাখ্যা | পুরোনো দিনের অনেক কথা, শেষ হতে না চাওয়া অনেক গল্পে গল্পেই রাতের বেশির ভাগই কাটলো | অনেক রাতে শুতে গেলাম |ওর পাশের এপার্টমেন্টেই থাকে ইন্ডিয়ান মেয়ে সুতপা | সুতপা স্প্রিং ব্রেকে বেড়াতে গেছে নিউইয়র্ক | মেহনাজ ওর রুমেই আমার থাকার ব্যবস্থা করেছে | আমি তথাস্ত বলে তাতেই রাজি হয়েছি | পরের দিন উঠলাম অনেক বেলা করে প্রায় সাড়ে দশটার দিকে |
দুপুরে আমাদের সঙ্গী হলো নওশীন-মেহনাজের ছোট বোন | নওশীন ডিবি ভিসা পেয়ে ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েই চলে এসেছিলো আমেরিকায় প্রায় পাঁচ বছর আগে | ডেলাওয়ারে (আমেরিকার সবচেয়ে ছোট স্টেট) ওর মামার বাসায় থেকে আন্ডার গ্রাজুয়েট করেই ওহাইওর ইউনিভার্সিটি অফ একরণে পিএইচডি করছে | নওশীনকে আমি শেষ দেখেছি সেই ওর ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষার পর | সেদিনের ছোট নওশীন হবে আজকে আমাদের ড্রাইভার আর গাইড | ওর গাড়িতেই আমরা ঘুরতে বেরুবো ক্লিভল্যান্ড শহর দেখতে | রাতের মতোই আরেক দফা জমিয়ে আড্ডা দিতে দিতে দুপুরে আমাদের খাওয়া দাওয়া হলো ভুনা খিচুড়ি, সালাদ আর চিকেন কারী দিয়ে |
খাওয়া দাওয়ার পর আমরা বের হলাম ক্লিভল্যান্ড শহর দেখবার জন্য | ক্লিভল্যান্ড স্টেট ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস, শহরের আসে পাশটা,গ্রেট লেক সাইন্স সেন্টার ঘুরে গিয়েছি রক এন রোল হল অফ ফেম দেখতে | লেক ঈরির একদম পাশ ঘেঁষেই আধুনিক স্থাপত্যের চূড়ান্ত সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে Rock N Roll হল অফ ফেম বিল্ডিং | এর কথা প্রথম পড়েছিলাম অর্গানাইজেশন বিহেভিয়ার বইয়ে | কিভাবে এই প্রচণ্ড ব্যয় বহুল একটা প্রজেক্ট একসময় অর্থনৈতিক ভাবে চাপে পড়া একটি শহরকে চাঙ্গা করে তুললো সেটার উদাহরণ হিসেবে | ১৯৯৫ সালে বানানো এই Rock N Roll হল অফ ফেম" আমেরিকার গত পঞ্চাশ বছরের পপ মিউজিকের বিবর্তনের একটা ছবি ধরে রেখেছে | এখানে আছে পপ গায়িকা জ্যানিস জপলিনের রক এন রোল দর্শনের ছবি আঁকা ওয়ান অফ এ কাইন্ড বিখ্যাত সেই পোর্শে গাড়িটি, মাইকেল জ্যাকসনের ঝিকিমিকি গ্লাভস থেকে শুরু করে বিখ্যাত অনেক গানের অরিজিনাল লিরিক লেখা পাতা, আইকনিক স্টেজ কনসার্টগুলোতে বাজানো গায়ক গায়িকাদের মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট সহ রক এন রোলের অসংখ্য স্মারক |
Rock N Roll মিউজিয়াম ভিজিটকারী নয় মিলিয়ন দর্শকের একজন হয়ে আমিও ঢুকে পড়লাম ভেতরে | আমি খুব যে রক এন রোল গানের ভক্ত তা নয় | কিন্তু সেসময় অল্প হলেও গান শুনতাম | আমার পপ মিউজিক শোনা শুরু স্কুল সময় থেকেই | আমার কিছু বন্ধু ছিল সাংঘাতিক রক এন রোল ভক্ত | ওদের থেকেই শোনা কিছু গান কখন যে এক সময় খুব ভালোও লেগে গেছে বুঝিনি | স্কুলে আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল চঞ্চল | আমরা একসাথে ঢাকা কলেজেও পড়েছি | চঞ্চলের চেয়ে কারো পপ মিউজিকের বেশি কালেকশন আমি দেখিনি | সিগারেট খেত না, চা খেত খুব কম, সিনেমা দেখার নেশা ছিল না | পাগল ছিল রক এন রোল গানের | একটাই নেশা ছিল রক এন রোল মিউজিক সিডি কেনা | ঢাকা কলেজ থেকে প্রতি সপ্তাহেই বাসায় ফেরার সময় আমরা এলিফেন্ট রোডে এসে নামতাম | এলিফেন্ট রোডের দোকানগুলো থেকে ও সিডি কিনতো বেশিরভাগ সময় অবশ্য গান পছন্দ করে সিডি গুলো ওর জন্য রেকর্ড করে দেবার জন্য বলতো | ওর সাথে থেকে আমারও গানের পপ মিউজিকের সিডি কেনার অভ্যেস হয়েছিল এক সময় | সে সব ভাবতে ভাবতেই ঘুরে ঘুরে দেখছি Rock N Roll হল অফ ফেম | নানান দামের সিডি, ক্যাসেট | কত আর্টিস্টের যে সিডি ! পাঁচ ডলার থেকে সাত ডলারের মধ্যেই বেশির ভাগ আর্টিস্টের সিডি | তার মধ্যে বিখ্যাত আর্টিস্টরা জর্জ মাইকেল, মাইকেল জ্যাকসন, মেডোনা থেকে শুরু করে তখনকার নতুন সেনসেশন ক্রিশ্চিনা আগুইলেরাসহ সবার ক্যাসেট, সিডিই আছে |
অসংখ্য সেই সব স্মারক দেখতে দেখতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে থমকে গেলাম | আমেরিকার বিখ্যাত সব স্টেজ কনসার্টের সিডি আর স্মারক | সেখানে গ্লাসের একটা কেইজে (কাঁচের বাক্সে) একটা সিডি ডিসপ্লে করা আছে | সিডিটার নাম দেখে চমকে উঠলাম | সিডিটার নাম কনসার্ট ফর বাংলাদেশ | ১৯৭১ সালে বাংলাদশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পন্ডিত রবিশংকরের উদ্যোগে তার শিষ্য বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড গ্রূপ বিটলের খ্যাতিমান গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনের চেষ্টায় নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে বাংলাদেশের সমর্থনে এই কনসার্টটি হয়েছিল | সেই কনসার্টে গান গেয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন স্বয়ং, এরিক ক্ল্যাপটন, বব ডিলান, বিটলের ড্রামার রিংগো ষ্টার, লিওন রাসেল, বিলি প্রেস্টনের মতো বিখ্যাত পপ আইকনরা | পন্ডিত রবি শঙ্কর তাতে সেতার বাজিয়েছিলেন | এই কনসার্টটিকে পপ কালচারের প্রতিনিধিত্বকারী অন্যতম বিখ্যাত ম্যাগাজিন "রোলিংস্টোন" মানবিকতার কারণে উৎসর্গিত সর্বকালের সবচেয়ে সফল দশটি মিউজিক কনসার্টের একটি হিসেবে উল্লেখ করেছে | এই কনসার্ট থেকে তাৎক্ষণিক ভাবে পাওয়া আড়াই লক্ষ ডলার ইউনিসেফকে দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানুষকে সহায়তার জন্য | এই কনসার্টে স্টেজ পারফর্মেন্স করা গানগুলোকে পরে তিনটি এলপি হিসেবে বের করা হয় | যা থেকে পাওয়া টাকাও পরে বাংলাদেশের সহায়তা করার জন্য দেওয়া হয় |
ডিসপ্লে সিডির পেছনে সেই কনসার্টের অরিজিনাল একটা পোস্টার | সামনে আরো কতগুলো সিডি সাজিয়ে রাখা বিক্রির জন্য | বাংলাদেশ কনসার্টের এই সিডিটা আমি সামনে সামনি কখনো নিজে চোখে দেখিনি | কখনো নিজ হাতে ধরে দেখিনি আগে | আইকনিক ষ্টার নামে ভর্তি সিডির লাইন আপ | খুব কিনতে ইচ্ছে হলো সিডিটা | হাত বাড়িয়ে নিলাম একটি সিডি | কিন্তু দাম দেখে চমকে গেলাম | সিডিটার দাম ত্রিশ ডলার ! ত্রিশ ডলারে পিটসবার্গ শীতে পড়বার মতো জ্যাকেট কিনতে পাওয়া যায় ! কোনো ব্র্যান্ডের নয় কিন্তু খুবই ভালো সেসব জ্যাকেট | সেলে থাকলে ব্রান্ড জ্যাকেট পাওয়াও অসম্ভব নয় ! মেহনাজ আর নওশীন আমি ত্রিশ ডলারে সিডি কিনবো বলেছি শুনে অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে | দুজনের মুখ দেখেই পরিষ্কার বুঝলাম ওরা বলতে চাইছে আমি ষ্টুডেন্ট | ত্রিশ ডলার দিয়ে সিডি কেনার বিলাসিতা আমার সাজে না | হাতে নিয়েও তাই সিডিটা নামিয়ে রাখলাম |
রক এন রোল হল অফ ফেম ঘুরে বাইরে এসেছি | পাশেই বিশাল লেক ঈরি | আমি ছোট বেলার একটা সময় কাটিয়েছি চিটাগাঙে | পতেঙ্গায় সাগর বেলায় মালেক স্যারের ভূগোল ক্লাসে পড়া গ্রেট লেকের পাঁচটা লেকের একটা লেক হলো এই লেক ঈরি ! ছোট বেলায় কত অলস দুপুরে মালেক স্যারের ক্লাসে পড়া লেক ঈরির কাছে দাঁড়িয়ে কত যে কথা মনে হলো ! লেক ঈরির কাছে দাঁড়িয়ে কোনো দিন ফটো তুলবো তা কি কোনো দিন তখন স্বপ্নেও ভেবেছিলাম !সেই সেদিনের কোনো বন্ধুর সাথেই আজ যোগাযোগ নেই | তারা কে কোথায় আছে তাও জানি না | তবুও লেক ঈরির পাশে দাঁড়িয়ে অনেক অনেক পেছনে ফেলে আসা সেদিনগুলোর কথা হঠাৎ মনের পর্দায় নক্ষত্রের আলোর উজ্জ্বলতা নিয়ে ভেসে উঠলো যেন | মার্চের সেদিন শেষ বিকেলে খুবই হালকা শীত | লেক ঈরির বিচ ঘেঁষে, রক এন রোল হল অফ ফেমের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা কিছু ফটো তুললাম | আমি মনে হয় খানিকটা আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম | হঠাৎ মেহনাজের কথায় ঘুরে তাকালাম ওর দিকে | ও বলছে আমাকে, তুই মনে হয় এখনো সিডিটা নিয়ে ভাবছিস | অত দাম দিয়ে সিডিটা না কিনে তুই বরং কম দামের একটা মিক্সড সিডি কিনে নে যেগুলোর মধ্যে কনসার্টের পছন্দের কতগুলো গানও থাকবে ওই আর্টিস্টদের |
মেহনাজ ঠিকই বলেছে | অত দাম দিয়ে সিডিটা কেনার কোনো মানে হয় না এই অবস্থায় | লেক ঈরির থেকে হালকা শীতের আমেজ মাখা বাতাস এসে ছড়িয়ে যাচ্ছে আমাদের সবার সারা মুখে আর শরীরে | চুলগুলোও বাতাসের সাথে উড়ছে সবার | সেই বাতাস যেন উড়িয়ে নিলো আমারও মনের ভেতর বয়ে চলা সিডিটা কিনতে না পাবার কষ্টটা | মেহনাজের কথা শুনে মনে হলো তাইতো এতো বড় বড় আর্টিস্টদের গানের সিডি এখানে, সবার সিডির দামই পাঁচ ডলার থেকে সাত ডলারের মধ্যে | ইচ্ছে করলেই যে কারো একটা সিডি আমি কিনতেই পারি | কিন্তু "কনসার্ট ফর বাংলাদেশ" সিডিটা কত দামি! এই আমেরিকারই এক রিপাবলিকান পার্টির সরকার আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল ১৯৭১ সালে | স্বাধীনতার পর পরই স্বাধীন বাংলাদেশকে বটমলেস বাস্কেট বলেও উপহাস করেছিল সেই রিপাবলিকান সরকারেরই সেক্রেটারি অফ স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার | কিন্তু আমেরিকার জনগণ আমাদের দেশের স্বাধীনতার দাবিকে সমর্থন জানিয়েছিল | আমেরিকার উত্তাল তারুণ্য বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো এসেছিলো মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে টিকিট করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সহায়তা করতে স্বাধীনতার জন্য গাওয়া কনসার্ট ফর বাংলাদেশের গান শুনতে | সেই কনসার্টটাকে করেছিল ইতিহাসের অঙ্গ | সেই কনসার্টের সিডির সাথে জড়ানো আমাদের স্বাধীনতার স্মৃতি | বাংলাদেশের স্বাধীনতার সেই কনসার্টের সিডিটা দামি হলেতো আমাদেরই গর্ব হবার কথা ! আমার একার না কেনার জন্যতো বাংলাদেশের সেই গর্বকে নষ্ট করা যায় না | লেক ঈরির পাশে রক এন রোল মিউজিয়ামে সেই সিডিটা ষ্টুডেন্ট হিসেবে টাকার কথা ভেবে না কিনতে পাড়ার কষ্টটা সহসাই তাই মিলিয়ে গেলো খুশির আনন্দে আর দেশের গর্বের কথা ভেবে |
রিপাবলিকান পার্টি আর ডেমোক্রেটিক পার্টির কনভেনশনে সবার স্পিচগুলো শুনছি | একটা কমন থিম দুটো জায়গায়ই আছে যদিও একটু ভিন্ন ভাবে, ভিন্ন ভাষায় | তাহলো দুটো দলই তাদের দেশের সন্মান অন্য সব দেশের চেয়েই উপরে দেখতে চায় | আমি কনভেনশন স্পিচগুলো শুনি আর আমাদের দেশের সরকারের কথা ভাবি |
১৯৭১ সালে যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মাটি, সীমানা কত সহজেই বিলীন আজ ! আমাদের মাটির উপর দিয়ে, আমাদের স্রোতস্বিনীর প্রবহমান গতিধারা বাঁধে মুড়ে সেই নদীর বুকের উপর দিয়ে এক টাকা টোকেন ট্যাক্সের বিনিময়ে এখন কত স্বচ্ছন্দে চলাচল করে প্রতিবেশী দেশের ট্রাক বহর | আমাদের নদীর নাব্যতা উপেক্ষা করে সেখান দিয়ে কত অবাধ চলাচল প্রতিবেশী দেশের জাহাজ বহরের | সেই পরিবহনের উপযুক্ত ট্যাক্স দাবি করার সাহসও আমাদের সরকারের আজ নেই | সীমান্তে নির্বিচারে নিহত দেশের নিরপরাধ জনগণ | তাতেও মুক্তিযুদ্ধ চেতনার সরকারের কিছু যায় আসে না | এমনকি আমাদের প্রধানমন্ত্রী সেই মার্কিন সেক্রেটারি অফ স্টেট হেনরি কিসিঞ্জারের হাত থেকে হাসি মুখে নাম না জানা অখ্যাত কোনো স্মারক মেডেল নিতেও দ্বিধা করেন না কিসিঞ্জারকেই তার পিতার হত্যার সাহায্যকারী বলার পরও । নিজেদের ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা, দেশ বিক্রি করে, দেশের সন্মান ধূলায় মিশিয়ে দিতেও আমাদের সরকারের বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই ক্ষমতা পাকাপোক্ত রাখতে । হায়, স্বাধীনতার ছিচল্লিশ বছর পর এই লজ্জ্বা কোথায় লুকাই আমি ! রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্টশিয়াল কনভেনশন দেখতে দেখতে অনেক দিন আগে সেই একই ক্লিভল্যান্ড শহরে রক এন রোল হল অফ ফেমে কর্নসার্ট ফর বাংলাদেশের সিডি কিনতে না পাবার ঘটনাটা হঠাৎ আবার মনে হলো | মনের যে দুঃখগুলোর জন্য কতো দিন, কতো অবেলায় ছটফট করেছি তার জন্য আজ আর কোনো খেদ নেই | আমাদের সরকার নিজ স্বার্থে প্রতিবেশী দেশের কাছে দেশ বিক্রি করে দিলেও অর্ধেক পৃথিবী দূরে,প্রশান্ত মহাসাগরের অন্য পাড়ে পৃথিবীর একটি দেশে হলেও আমাদের হৃদয়ে থাকা বাংলাদেশ আজো ভালোবাসার পুরো গৌরব নিয়ে মাঁথা উঁচু করে বেঁচে আছে | সেই দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের ছিচল্লিশ বছর পর উনিশশো একাত্তরে হওয়া কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সিডি এখনো বড় বড় রক এন রোল স্টারের সিডির দামের চেয়ে অনেক বেশি দামি | সেই বেশি দামেই শ্রোতারা সেই সিডি এতদিন পরও কেনে |সেই ভীষণ গৌরবে গরবিনী বাংলাদেশর স্বাধীনতা স্মৃতি জড়ানো "কনসার্ট ফর বাংলাদেশ" সিডি আমার মতো একজন বা আরো অনেক ষ্টুডেন্ট টাকা না থাকার কারণে কিনতে না পারলেও কোনো ক্ষতি নেই |
বিষয়: বিবিধ
২৮৩০ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমরা এখন জাতী হিসাবে আমাদের আত্মসন্মানবোধ ও হারিয়ে ফেলেছি।
মাশাআল্লাহ দারুণ অনুভূতির আলোকে লিখা। প্রতিটি ছত্রে ছত্রে হৃদয়ের দরদ ঢেলে লিখেছেন যেন। দেশের জন্য আসলেই প্রাণ কাঁদে।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
দারুণ লিখা/
একটানে পড়ে ফেললাম! ওয়াও ! চমৎকার অনুভূতি!
এরকম কিছু না পাওয়ার কষ্টানুভূতিও বোধকরি কোনো বিশেষ মুহূর্তকে স্মৃতিরপাতায় চির উজ্জল করে রাখে, না পাওয়ার বেদনা উদ্ভাসিত হয় বার বার তবু অমলীন, ধ্রুব সত্যের বার্তা নিয়ে ....
শুকরিয়া ।
আমাদের দেশের ক্ষমতা লোভী শাসকশ্রেণীর জন্য দেশটা শেষ হয়ে যাচ্ছে তবু আশাহত হইয়েই না ভাইয়া আশা রাখেন একদিন না একদিন আমাদের দেশ ভাল হবে । ইনশা আল্লাহ !
মন্তব্য করতে লগইন করুন