ব্লগে রমজান আলোচনা :রোজা দেশে, বিদেশে এবং বিমানে-২
লিখেছেন লিখেছেন তবুওআশাবা্দী ০২ জুলাই, ২০১৬, ০১:৫২:৪০ দুপুর
(আমার লেখাগুলোর দৈর্ঘ্য নাকি প্রায়ই বেশ বড় হয়ে যায় |তিন বছর আগে ব্লগে আমার প্রথম লেখার প্রথম মন্তব্যকারী প্রিয় ব্লগার প্রবাসী আব্দুল্লাহ শাহীন প্রথম মন্তব্যতেই খুবই বিনয়ের সাথে সেটা আমাকে বলেছেন | আমি মনে রাখার চেষ্টা করি সবসময়ই তার মন্তব্যটা | সেই কথা মনে করেই আমার বিদেশের ইউনিভার্সিটির প্রথম রোজাটা দ্বিতীয় পর্বে লিখলাম | এই লেখাটা পোস্ট করে মনে হলো গাজী সালাহউদ্দিনের কাছে করা রমজান আলোচনার লিখার ওয়াদাটা পূরণ হলো | )
গত কয়েকটা রোজাই এখানে হলো সামারে | প্রায় সতের /সাড়ে সতের ঘন্টা রোজা আমাদের এখানে |বাংলাদেশের চেয়ে রোজার দিনগুলো এখানে অনেক বড় | সামারের এই রোজাগুলো গত কয়েক বছর ধরেই রাখতে হচ্ছে সামারের সোলাস্স্টিসের দিনগুলোতে | জুন ২১ হলো সেই দিন | এদিন নর্দান হেমিস্ফেয়ারে সবচেয়ে বড় দিন হয় | আমাদের এখানে প্রায় আঠার ঘন্টা | আরো উত্তরে যেমন কানাডার কিছু অংশে, আলাস্কায় এই দিনের দৈর্ঘ্য ২0-২১ ঘন্টাও হতে পারে | এই বিরাট দৈর্ঘ্যের দিনগুলো ছাড়া রোজা নিয়ে কি লিখা যায় ভাবছিলাম | রোজা আমাদের মুসলিমদের জন্য ফরজ তা পৃথিবীর যেখানেই আমরা থাকিনা কেন | রোজা শুরু শেষ সবই পূর্ব নির্ধারিত | এতে কোনো পরিবর্তনের কোনো বিষয় নেই | রোজার কাজগুলো মুটামুটি পুরোই স্কিজিউল্ড আর প্রিডিটারমিন্ড | নতুন আর কি থাকবে তাতে ? নতুন আর কি লিখব? এসব ভাবতে ভাবতেই পিটসবার্গের প্রথম রোজা নিয়ে লেখবার কথা মনে হলো | যেহেতু একটা রোজায় আমি এসেছিলাম আমেরিকায় তাই প্রথম সেমেস্টারের প্রথম দিন থেকেই আমার রোজা রাখা শুরু |
প্রথম দিন এডমিশনের কাজ আর বিকেলে প্রথম ক্লাস এটেন্ড করে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত |আমার আগের একটা লেখায় লিখে লিখেছিলাম যে পিটসবার্গে প্রথম এসে আমি আমার এক বন্ধুর খালার বাসায় উঠেছিলাম | নিউ ইয়র্ক থেকে সকালে যখন এসে পিটসবার্গে খালার বাসায় উঠেছিলাম তখন খালু অফিসে চলে গেছেন | ইউনিভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে দেখি খালু তখনও জেগে আছেন আমার জন্য | আমি তখনি খালুকে প্রথম দেখলাম | মোনা খালা দোতলায় আমার শোবার রুমটা আবার দেখিয়ে দিলেন | দেখি রুমে বালিশ, কম্ফোটার দিয়ে সুন্দর করে বিছানা করা | আমি দোতলা থেকে নিঁচে নেমে খানিক্ষণ খালুর সাথে কথা বলছি | খালা কিছুক্ষণ আমাদের সাথে গল্প করে শুতে চলে গেলেন | খালু টিভিতে নিউজ চ্যানেল দেখতে দেখতে আমার সাথে কথা বলছেন |খালু একসময় ঢাকা ইউনিভার্সিটির আই বি এ (IBA) ইনস্টিটিউটে টিচার ছিলেন | অনেক বছর আগে আমেরিকা এসেছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গে পিএইচ ডি করতে |তারপর যা হয় আমাদের দেশের ইউনিভার্সিটি গুলোতে |রাজনীতির মারপ্যাচে চাকুরী হারিয়ে আর দেশে ফেরা হয়নি | আমাদের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র কিছু টিচারদের চিনলেন যারা তার সমসাময়িক কিন্তু আমাদেরও পড়িয়েছেন| তাদের সাথে একসময় যোগাযোগও ছিল কিন্তু অনেক দিন থেকে কারো সাথে আর তেমন যোগাযোগ নেই| আমি রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে পড়াতাম শুনে ওখানকার কিছু টিচারের কথাও জানতে চাইলেন যাদের সাথে তার আমেরিকায় মাস্টার্স আর পিএইচডি প্রোগ্রামে পড়ার সময় খুব ভালো পরিচয় হয়েছিল | দেখা গেলো তাদের অনেককেই আমি চিনতাম রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে থাকতে |যাতায়াতের ক্লান্তি তখনও কাটেনি তার উপর তিন ঘন্টা ক্লাস শরীর মনে হয় অবশ হয়ে আসছে | কিছুক্ষণ গল্প করার পর আমি উঠে দাড়ালাম | খালু জিজ্ঞেস করলেন আমি রোজা রাখি কি না | আমি উত্তরে হা বললাম? খালু বললেন সেহেরিতে উনি উঠে আমাকেও জাগিয়ে দেবেন | আমি আচ্ছা বলে নিজের রুমে ঢুকে পরলাম |
সেহেরিতে খালু যখন আমাকে ডাকলেন তখন মনে হলো আমিতো মাত্রই ঘুমুতে এলাম |মিনিট খানেকের বেশি ঘুমাইনি | এর মধ্যেই সেহেরির সময় হলো | দু’তিনবার ডাকবার পর রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে চোখ খুললাম | ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় চারটে বাজে | নিচে কিচেনে খালু একাই সেহেরির আয়োজন করছেন | খালু আর খালা নাকি ভাত খান না তেমন | সকালে ব্রেড-বাটার, মিল্ক-সিরিয়াল, দুপুরে অফিসে টরটিলা দিয়ে করা বারিটো (এই খাবারটা রুটির মধ্যে ছোটো ছোটো কাটা বেকড বা বারবিকিউ চিকেন, সালাদ দিয়ে রুটি মুড়িয়ে করে), ফ্রূটস, রাতে রাতে বেশিরভাগ দিনই সবজি দিয়ে টরটিলা, চিকেন, দুধ এগুলোই বেশি খাওয়া হয় | উইক এন্ডেই ভাত খাওয়া হয় | অন্য সময় কম |নীচে নামতে নামতে চোখ পড়লো খালুর সেহেরীর আয়োজনে | সেহেরির জন্য টেবিলে রাখা খালুর আইটেমগুলো হলো এক বোল ভর্তি সিরিয়াল আর স্কিম মিল্ক, বিরাট একটা সাগর কলা, এক কাপ কফি | তা দেখে আমার বাঙাল মন হাহাকার করে উঠলো | চোখের সামনে ভেসে উঠেছে বাসার সেহেরির ধোয়া ওঠা গরম ভাত, মুসুর -মুগ ডাল, আম্মার হাতের ভুনা গোশত, বেগুন ভাজি ! কোনো রকমে দীর্ঘ নিশ্বাস চেপে এগিয়ে গেলাম কিচেনের দিকে|
আমাকে দেখে আমি কি সিরিয়াল আর মিল্ক খাবো নাকি জিজ্ঞেস করলেন? সিরিয়ালের প্যাকেটটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি | সিরিয়াল যে বড়দের খাবার হতে পারে তাই আমার জানা ছিল না | সিরিয়াল বলতেই আমার সবসময় মনে হয় বাসার গাদু গুদু গোলগাল ছোটো বাচ্চাগুলোর কথা | কেমন করে একজন বড় মানুষ যে এ'রকম সিরিয়াল খেতে পারে সেটা ভাবছি তখন | উত্তর দিতে একটু দেরী আর আমার অবাক মুখের অবস্থা দেখেই হয়তো উনি নিজেই বললেন আমি কলা আর পাউরুটিও খেতে পারি চাইলে | ফ্রিজে ব্রেড আছে | ক্রিকেট খেলার সময় অনেক সময় আমরা লাঞ্চ করতাম বার্গার , কলা | সেটা সিরিয়ালের মতো অখাদ্য হবেনা ভেবেই কলা পাউরুটি দিয়ে সেহেরি করায় সায় দিলাম |
টেবিলে রাখা সাগর কলাগুলো দেখবার মত | একেকটা মনে হয় একফুট লম্বা | পুরো কলার মধ্যে কোনো কালো দাগ নেই | যেন আঁকা ছবি| ছোটো বেলায় মেলা থেকে কেনা মাটি দিয়ে বানানো দাগহীন পুরুষ্টু কলাগুলোর কথা মনে হলো | পোস্টারে ফ্রূট বাস্কেটে সাজিয়ে রাখা ফলের মধ্যে যে কলাগুলো থাকে ঠিক সেরকম দেখতে কলাগুলো | আমার মনে হলো হায় হায় কলাগুলো টেবিলে প্লেটে কেন ? ধুয়ে মুছে ফ্রূট বাস্কেটে সাজিয়ে রাখি টেবিলের ঠিক মধ্যে| কলাগুলো এতই সুন্দর যে দেখে খাবার চেয়ে না খাবার ইচ্ছেই হয় বেশি !
আমি পাউরুটি আর কলা খাবো শুনে নিজেই ফ্রিজ খুলে প্যাকেট না খোলা একটা পাউরুটি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন | মাল্টি কালারের কি বাহারি প্যাক ! আমাদের বাংলাদেশের মডার্ন ব্রেডের প্যাকেটটের কথা ভেবে ভারী দুঃখ লাগলো মনে ! মডার্ন ব্রেডের প্যাকেটটার ছবিটাকে এর সামনে এতিম এতিম মনে হলো | পাউরুটি আর কি খাব তার প্যাকেট দেখেই পেটের অর্ধেক ক্ষিধে চলে গেল | এমন সুন্দর প্যাকেটে কিছু থাকলে সেটা আর কারো খেতে চাইবার কথা নয় | শোকেসে রেখে দেবার কথা | আমাকে ভুলে সেটা দিয়ে দিলেন কিনা সেটা জিজ্ঞেস করব ভাবছি |এমন সময় প্যাকেট খুলে খালু নিজেই দুই স্লাইস পাউরুটি এগিয়ে দিলেন | হুইটের পাউরুটি |খালু বললেন ফ্লাওয়ার ব্রেডের চেয়ে নাকি হুইট ব্রেড বেশি হেলদি | মানুষ যে কত কথা বলে ! আমি এসেছি বাংলাদেশ থেকে | ঢাকা ইউনিভার্সিটির আর্টস ফ্যাকাল্টির চারতলায় নান্নু মামু আর ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির কোনায় রোকেয়া হলের গেটের ঠিক উল্টো দিকে হাকিম চত্তরে চা ( চা খাবার পর চায়ের কাপগুলো একটা গামলার পানিতে ধোয়া হত | নতুন করে আবার কাস্টমারকে চা দেবার পর আবার গামলার সেই একই পানিতে কাপগুলো ধোয়া হত |এভাবেই সারাদিন বা অর্ধেক দিন সেই এক গামলা ‘হলি ওয়াটারে’ কাপের পর কাপ ধোয়া হত ! অলৌকিক ব্যাপারটা হলো সেই কাপে চা খয়ে পেটের সমস্যায় কেউ হসপিটালাইজড হয়েছে এটা আমরা কেউ শুনিনি!), আর হলের পঞ্চাশ বছর আগের ডাল (প্রচলিত কথা হলো দিন শেষে যে ডাল থাকে এরা তার মধ্যেই ডাল পানি দিয়ে আবার পরের দিনের ডাল করে | পঞ্চাশ বছর আগের ঐতিহাসিক ডালের কিছুটা তাই আজকের ডালের মধ্যেও আছে ) খাওয়া মানুষ !আমার স্বাস্থ্যে পরজীবী হয়ে ঢুকবে এই শহুরে প্যারাসাইট ! হা হা |
পাউরুটির মধ্যে একটু বাটার লাগিয়ে মুখে দিলাম আর সেই সাথে সাগর কলার একটা বাইট | ইয়াক | কলা পাউরুটি দুটিই ডিসটেস্ট ফুল | কলায় কোনো স্বাদ নেই | এই কলা আমাদের দেশের সাগর কলার নখের যোগ্যও নয় | আমাদের দেশের সাগর কলা এই গুনহীন ঢ্যাঙা দশা সই সাগরকলাগুলিকে দুই কান ধরে অনায়াসে গোটা কয়েক চড় কষিয়ে দিতে পারে কলা জাতির গায়ে কলঙ্ক মাখার জন্য | অনেকদিন আগে সাহিত্যিক যাযাবর বলেছিলেন বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ | এখন দেখছি যাযাবরের কথার সাথে আরো কিছু যোগ করে বলতে হবে বিজ্ঞান হাইব্রীড ফলমূল করেছে দেখতে সুদৃশ্য, স্বাদ করেছে অদৃশ্য| হাইব্রীড করা কলা দেখতেই শুধু সুন্দর |হাইব্রীড টেকনোলজি দিয়ে বিজ্ঞান প্রতিদিনের ফল মূল, শাক-সবজি, গোশত -মাছ এসবই দেখতে খুবই দর্শনীয় করেছে | কিন্তু অদৃশ্য হয়েছে এগুলোর স্বাদ-খাবার তৃপ্তি |
বাঙালি নাকি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা জানেনা | এ'কথাটা হঠাতই মনে হলো | দেশে থাকতে আমাদের দেশের হাতে বাজারের খাটি দেশীয় শাকসব্জি, মাছ গোশত যে কত আশীর্বাদের এটা কখনো বুঝিনি | কিন্তু আমেরিকার একটি বড় শহরের একটি বাসায় বাহারি মোড়কে পাউরুটি আর হাইব্রীড সুদৃশ্য কলা দিয়ে সেহেরি করতে যেয়ে মনে হলো আমাদের দেশের কত দামী জিনিস কে যে কত মূল্যহীন ভেবেছি ! সব সময়ই আমরা বেশি নজর দিতাম সুপার স্টোরগুলোর প্যাকেট ফুড গুলোর দিকে | টিভি রেডিও সেগুলোরই দিনভর বিজ্ঞাপনে সয়লাব | সেই প্যাকেট ফুডের দাপটে আমাদের দেশের খাটি খাবার গুলো সবসময়ই কোনঠাসা থাকত | বাসায় বানানো পিঠের চেয়ে বেকারির পেস্ট্রি, এক স্লাইস চলকেট কেক সব সময়ই বেশি পছন্দ ছিল | আর এখন দর্শনীয় কলা আর এই সুদৃশ্য মোড়কে মোড়ানো খাবারও মনে হচ্ছে পুরো অখাদ্য | অনেকদিন আমেরিকায় থেকে খালুর স্বাস্থ্য চেতনা পুরোই আমেরিকানদের মতো | খাবারে স্বাদের চেয়ে স্বাস্থ্যসম্মত গুনটাই বেশি খোঁজেন | খালু বলছেন এই কলাগুলো আমাদের দেশের কলার চেয়ে বেশি ভালো | এগুলো হাইব্রীড করা দেখে এতে কোনো ব্যাকটেরিয়া থাকেনা |মানুষের প্রয়োজনীয় ভিটামিনগুলো আর্টিফিশিয়ালি এগুলোতে ইনজেক্ট করাতে এগুলো আরো বেশি হেলদি | গুরুজন পৃত্রীতুল্য | আমি আর কিছু বললাম না | বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানিদের চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করতে করতে অখাদ্য হুইট পাউরুটি আর হাইব্রীড কলায় আবার একটা বাইট দিলাম | আবার ইয়াক |
বেশি সময় নেই আর সেহেরির | কাল রোজা রাখতে হবে, ক্লাসও আছে |প্রায় পাঁচটা বাজে | ঢাকায় এখন সময় প্রায় বিকেল তিনটা | আম্মা নিশ্চিত ভাবেই রান্না ঘরে তদারকি করছেন সেদিনের ইফতার আর রাতের সেহেরীতে কি খাওয়া সার্ভ করা হবে সেই আয়োজনের |বদ্ধ দরজা জানালার বাধা পেড়িয়ে মনে হয় ঢুকে পরছে ঢাকায় বাসায় রান্না করা সেহেরির তেল পিয়াজের স্বর্গীয় সুঘ্রান | চোখের সামে মনে হলো দেখতে পাচ্ছি ধোয়া ওঠা গরম ভাত, বেগুন ভাজি, মূগ ডাল, ভুনা গরুর গোশতের ছবি | মনে মনে ঢাকার সেই সেহেরির সুঘ্রান পেতে পেতে, সেই সেহেরির ছবিগুলো দেখতে দেখতেই আর বেশি না ভেবে আমি খালুর সাথে খুশি খুশি মুখে অখাদ্য হুইট ব্রেড আর বিস্বাদ কলাতে সেহেরি খেতে থাকলাম | কি আশ্চর্য ঢাকার সেহেরীর স্বাপ্নিক সুঘ্রাণে দেখি সেই অখাদ্য হুইট ব্রেড আর হাইব্রীড কলার সেহেরীও বেশ লাগছে ! সেহেরীতে সত্যিই বরকত আছে ! স্বপ্নের দেশে আমার দুঃস্বপ্নের সেহেরি একসময় শেষ হলো |
বিকেলে ক্লাসে ঢুকেছি | সাড়ে চারটায় ক্লাস শুরু হয়েছে | ইফতারের সময় সেদিন ছয়টার দিকে | আমাদের ইন্সট্রাক্টর ডক্টর ক্রিস ব্রিসিয়ালিস এনভায়রনমেন্ট পলিসির উপর লেকচার দিচ্ছেন | মনোযোগ দিয়ে শোনার আর তার চেয়েও বেশি তার কথা বোঝার চেষ্টা করছি | কিন্তু পেটের এনভায়রনমেন্টে তখন তুমুল ক্ষিধের সুনামির তান্ডব | মনোযোগ দিতে দিচ্ছে না | সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে | মোনা খালার বাসা থেকে ক্লাসে এসেছি কিছু না নিয়েই |আমি যখন ক্লাসে এসেছি তখন খালা খালু কেউই বাসায় ফিরেন নি | তাই কোনো ধরনের স্ন্যাকও সাথে নিয়ে আসার প্রশ্ন নেই | প্রথম দিনের ক্লাস | তখনও পরিচিত হয়ে উঠিনি বিল্ডিঙ্গের সাথে | কোথায় কি আছে তখনও জানি না |তাই ভেন্ডিং মেশিন থেকে যে কুকি, ক্যান্ডি বা কাপ কেক ধরনের কিছু কিনে ক্লাসে ঢুকবো ইফতারের জন্য সেটা মাথায় আসেনি | তিনঘন্টার ক্লাস | দেড়ঘন্টা একটানা ক্লাসের পর ফিফটিন মিনিটের ব্রেক |
এক সময় ক্লাস ব্রেক হলো |মনে হলো যেন যুগ জনমের পর যেন বন্ধ দরজা খুললো আমাদের ক্লাসের | ব্রেকের সময় সবাই উঠেছে একে একে |ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে | আমি তখনও বসে | খুব বেশি কিছু তখন চিনিনা তাই কোথাও যাবার প্রশ্ন নেই|তাছাড়া ক্ষিধেও লেগেছে খুব | তখনও ক্লাস শেষ হতে আরো দেড় ঘণ্টা | তাই এনার্জি লস করার প্রশ্নই নেই |এমন সময় দেখি আমার ঠিক বিপরীত দিকে বসা একটা মেয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে | আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো, আই হার্ড প্রফেসর সেড ইয়োর নেইম | আর ইউ এ মুসলিম ? আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম, ইয়াপ |আমার নামটা আবার বললাম | মেয়েটা তার হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললো, আই এম আয়িশা মাহমুদ | আমি ওর হাতটা একটু ঝাকিয়ে বললাম, গ্লাড টু মিট ইউ আয়িশা |
আয়িশা আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো হ্যাপি রামাদান |দেশের থেকে বারো হাজার মাইল দূরে একটা সম্পূর্ণ একটা নতুন পরিবেশে সব অপরিচিত মানুষের ভিড়ে আইশার হ্যাপি রামাদান কথাটা শুনতে কি যে ভালো লাগলো ! প্রথম দিনের প্রথম ক্লাসের প্রথম ক্ষণেই আমার স্বপ্নের কার্নেগি মেলোন ইউনিভার্সিটি যেন ঘর ছাড়া, পথ ভোলা এক পথিককে পরম আন্তরিকতায় জড়িয়ে নিলো| আয়িশা জানতে চাইলো আমি রোজা কি না |মাথা ঝাকিয়ে সে দিতেই ও বললো লেটস গো টু দ্য লবি | ইউ ক্যান হ্যাভ কফি এন্ড স্ন্যাকস |
বেসমেন্টের ক্লাস রুম থেকে এলিভেটরে আমরা লবিতে এলাম | লবিতে তখন প্রচুর ছেলে মেয়ের ভিড় | আয়িশা জানালো ক্লাস ব্রেকে আমাদের প্রোগ্রামের ছাত্র ছাত্রীদের জন্য লবির এক কর্নারে ছোট একটা কফি পার্লারের মতো আছে, সেখানে কফি, আইস টি, চিপস রাখা আছে | যে যার পছন্দ মতো নিজেই নিয়ে নিচ্ছে ঢাকা ইউনিভার্সিটির আর্টস ফ্যাকাল্টির চারতলার ক্যান্টিনের মতো কোনো নান্নু মামু নেই চা, কফি সার্ভ করার জন্য | আমাদের ইন্সট্রাক্টর ডক্টর ব্রিসিয়ালিসকেও দেখলাম কফি খেতে খেতে গল্প করছেন কয়েকজনের সাথে | আমিও এগুলাম আয়িশার সাথে কফি পার্লারের দিকে | চিপস শেষ ততক্ষনে | শুধু কফি আর ডি ক্যাফ রয়েছে | আমি একটা পেপার কাপ নিয়ে তাতে একটু কফি নিলাম | নিয়ে পড়লাম বিপদে | একটা হাফ এন্ড হাফের ছোট মিল্ক রয়েছে কিন্তু সুগার প্রায় শেষ | অল্প একটু সুগার কাপে মিশিয়ে বিসমিল্লাহ বলে একটা চুমুক দিলাম | আমেরিকায় এসে আমার প্রথম ইফতার | ও মাইগড ! এতো কড়া কফি ! চিনি কম বলে মনে হলো সক্রেটিসকে দেওয়া হ্যামলক বিষ মনে হয় খাচ্ছি এক কাপ | ইয়াক | থুহ করে যে কোথাও ফেলবো সেই উপায়ও নেই | এদিকে দেখি সবাই আবার ক্লাসের দিকে রওনা হয়েছে |
আমিও সবার সাথে মিলে নিচে নামতে শুরু করলাম ক্লাসের উদ্দেশ্যে | মোঘলের সাথে খানা মোঘলাই | দেশ থেকে অনেক দূরে ইফতারে কেউ আমার জন্য বুট, মুড়ি, পেঁয়াজু , মামা হালিম নিয়ে বসে নেই | নেই ঢাকার বিখ্যাত বিশাল জিলিপির মতো রসরাজ কোনো আইটেম | এ' এক নতুন দেশ , নতুন কালচার তার মধ্যে ডার্ক রোস্ট কফি খেয়েই শুরু হলো আমার ইফতার | পূর্ণ হলো একটা রোজা |
দেশ ছেড়ে আসার এতো দিন পর আমিও বেশ খানিকটা বদলেগেছি মনে হয় | আজ এত দিন পরে যখন কার্নেগি মেলোন ইউনিভার্সিটির প্রথম দিনের সন্ধ্যার ইফতারের কথা লিখছি তখন আর তেমন অবাক লাগছে না | এর পরও অনেক দিন কফি আর চিপস দিয়েই ইফতার করতে হয়েছে | এতদিন পরে এখনো মাঝে মধ্যে তেমনই ইফতার করতে হয় |আপনাদের কাছে আমার প্রথম ইফতারের বর্ণনা শুনে অবাক লাগলো কি? আমার কেন জানি লাগছে না | মনে হচ্ছে এই সাধারণ ঘটনাটা নিয়ে না লিখলেই বা ক্ষতি হতো ?
বিষয়: বিবিধ
১৯৮৯ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমিও লিখতে গেলে লেখাগুলো বড় হয়ে যায় অনিচ্ছাতে। ছোট বেলায় সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের জবাব লিখতে গেলেও কেন যেন রচনামূলক হয়ে যেত। আর স্কুলের ম্যাডাম বলতেন এটা যদি হয় সংক্ষিপ্ত তো রচনামূলক কোনটা? একথা বললেও নম্বর কম দিতেন না। জাযাকুমুল্লাহ।
শুভেচ্ছা....
আরে বড় ভাই এ তো চমৎকার রসালো সুখাদ্য লেখা। সাংঘাতিক মিঠা লাগল। আজ ২৯ রোজা,২ ঘন্টার পর ইফতার,লেখাটা উপভোগ করলাম জাজাকাল্লাহ
মন্তব্য করতে লগইন করুন