ব্লগের রমজান আলোচনা প্রবাসে ঈদ : রোজা দেশে, বিদেশে এবং বিমানে
লিখেছেন লিখেছেন তবুওআশাবা্দী ০২ জুলাই, ২০১৬, ০৮:২৪:৫৬ সকাল
(রমজানের এই শেষ আশারা বাংলাদেশের মানুষের জন্য কতটুকু রহমত নিয়ে আসবে আমি জানিনা, কিন্তু আজ নিশ্চিত ভাবেই বাংলাদেশের জন্য একটি কালো দুঃখের দিন | আমি জানি না সরকার ইসলামকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলার জন্যই এই ঘটনা ঘটলো কিনা | এ'নিয়ে এই লেখার শেষ দিকে আমার কিছু মন্তব্য আছে | তাই অনেক কষ্ট নিয়েই এই লেখাটা পোস্ট করলাম ব্লগের রমজান আলোচনায় "প্রবাসে ঈদ" এই ক্যাটাগরিতে আমার লেখার কথা ছিল বলে |)
তিন বছর আগে ব্লগে ব্লগার ভিশুর উদ্যোগে রোজায় (২০১৪) এ'রকম রমজান বিষয়ক আলোচনায় একটা লেখা দিয়েই আমার ব্লগ পাঠক পরিচয়টা ব্লগ লেখক পরিচয়ে বদলে গেল | তারপর কখনো কখনো আরো নানা নানা বিষয়েই যদিও ব্লগে অনেক বিষয়ভিত্তিক লেখার আয়োজন হয়েছে কিন্তু কখনো কেউ আমাকে বলেনি কিছু লিখতে (স্বীকার করছি ব্লগের কারো সাথেই আমার ব্যক্তিগত বা ফেস বুকে পরিচয় নেই |দেখা বা কথাও হয়নি সামনা সামনি, ফোনে, স্কাইপে অথবা মেসেন্জারে কখনো | তাই বিষয়ভিত্তিক আয়োজনের লেখাগুলো লিখতে পারব কি না সেই সন্দেহ কারো হলে তাকে কোনো দোষ দেওয়া যাবে না আর তার প্রশ্নও অবশ্য নেই )| তাই এবার গাজী সালাহউদ্দিনের একটা পোস্টে রোজা বিষয়ক আয়োজনে একটা ব্লগ লেখার জন্য আমার নামটা দেখতে পেয়ে খুবই অবাক হয়েছি | অবাক হবার মাত্রাটা এতটাই বেশি ছিল যে গাজী সালাহউদ্দিনকে জানাতেও ভুলে গেছি যে তাদের অনুরোধ অনুযায়ী লেখাটা লিখব ইনশা আল্লাহ | বেশ কিছুদিন পর আমার একটা লেখায় মন্তব্য করে গাজী সালাহউদ্দিন সেটা মনে করিয়ে দেবার পর নিজের ভুলটা ধরা পড়ল | আমাকে এসাইনড করা লেখাটা লিখতে বসে ভারী ঝামেলায় পরে গেলাম | কি লিখি সেটা নিয়ে ঝামেলা | আমাকে জানানো হয়েছে বিদেশে রোজা নিয়ে লিখতে | আমার প্রথম বিদেশের রোজা শুরু হয়েছিল দেশে আর তার ইফতার করতে হয়েছিল বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে |এই মাল্টি কান্ট্রি, মাল্টি কন্টিনেন্ট রোজাটা কি পুরোপুরি বিদেশে রোজার ক্যাটাগরিতে পরবে ? এই সব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই লেখাটা শুরু করলাম |
বাংলাদেশ থেকে অনেক দিন আগে একটা রোযায় আমার আমেরিকা আসার ফ্লাইট ছিল | সেটা ছিল জানুয়ারী মাসের নয় তারিখ, সকাল দশটায় | শেষ রাতে বাসার সবাই উঠেছে সেহেরিতে | সেই শব্দে আমারও ঘুম ভাঙ্গলো | উঠে এসে বসেছি টেবিলে সেহেরির জন্য | মেজ ভাই বললেন তোমারতো রোজা নেই | তুমিতো আজ জার্নি করবে | আটচল্লিশ মাইলের বেশি জার্নি হলেতো রোজা করতে হয়না | কিন্তু আমি ঠিক করলাম রোজা রাখব | কারণ হিসেবে দুটো জিনিস ভাবলাম | এক, প্লেনে যাচ্ছি | এসির মধ্যে বসে থাকব সারাটা পথ কোনো কষ্ট হবে না শুধু শুধু রোজা ভাঙবো কেন | সেই ক্লাস ফাইভের পর কোনদিন একটাও রোজা ভাঙিনি | তাছাড়া আরেকটা কারণেও ডিসিশনটা নিলাম | বাস স্ট্রাইক বা হরতাল নানা কারণে অনেক সময়ই প্লেনে ঢাকা থেকে রাজশাহী ইউনিভার্সিটিতে যাতায়াত করতে হত | ঢাকা থেকে রাজশাহী সেই দূরত্বও ছিল আটচল্লিশ মাইলের বেশি | তখন কিন্তু কেউ কখনো বলেনি সেই জার্নিতে রোজা ভাঙতে | তাই তখন যদি রোজা না ভাঙতে হয় তবে এই জার্নিতে কেন রোজা ভাঙতে হবে সেটা মনে করে রোজা রেখেই আমি প্লেনে জার্নিটা শুরু করলাম | ঢাকা এয়ার পোর্ট থেকে প্রায় বারো ঘন্টা দেরী করে আমার যাত্রা শুরু হলো |এই প্লেন জার্নিতেই রোজা নিয়ে খুবই উল্লেখযোগ্য একটা ঘটনা ঘটল | আমি এর পরে অনেকবার অনেক জনের কাছে সেই ঘটনাটা বলেছি | এত বছর পরে এখনো বলি | এখন আপনাদের আবার বলছি |
আমাদের প্লেনটা প্রথমে দিল্লি যাবে | ওখানে একঘন্টা স্টপ বাই করে যাত্রী নিয়ে তারপর যাবে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে | ওখান থেকে রিফুয়েলিং শেষে সেটা ফ্লাই করবে সরাসরি আটলান্টিক পেড়িয়ে নিউ ইয়র্কের জেএফকে এয়ার পোর্টের গন্তব্যে | মুটামুটি এটাই তখন সংক্ষিপ্ততম সময়ে আমেরিকা পৌছানোর সুযোগ | ঢাকা থেকে ব্রাসেলস প্রায় সাড়ে এগারো ঘন্টার জার্নি | প্লেন ফ্লাই করার অল্প পরেই ব্রেকফার্স্ট সার্ভ করা হয়েছে | নানান রকম স্বুসাদু খাবার | ডিমের অমলেট, স্যান্ডউইচ, ফ্রূটস,মিল্ক, ফ্রূট জুস, ড্রিঙ্কস | কে বলবে উন্নয়নশীল বিশ্বের কোনো একটি দেশের রাষ্ট্রীয় এয়ার লাইনার আমাদের বিমান ! একদল ভিশন স্মার্ট আর সুবেশী এয়ার হোস্টেস ট্রলি নিয়ে ঘুরে ঘুরে সব 'রো'তেই প্যাসেঞ্জারদের ব্রেকফার্স্ট সার্ভ করছেন | যাদের ইতিমধ্যে ব্রেকফার্স্ট সার্ভ করা হয়েছে তাদের আরো কিছু লাগবে কিনা সুরেলা গলায় জিজ্ঞেস করছেন | তাদের আদর সম্ভাষণে আমি যারপর নাই অবাক | জানিনা কি কারণে আমার একটা ধারণা ছিল সব এয়ার হোস্টেসই রিজার্ভ হবে আচরণে, কথা বলবে খুব কম, বললেও উচ্ছল গলায় আন্তরিকতা নিয়ে কিছু বলবে না | আমার প্রথম বিদেশ যাত্রায় এই ধারনাটা ভেঙে দিলেন যিনি তিনিও একজন এয়ার হোস্টেস ! যাহোক এক সময় আমাদের 'রো'তেও ব্রেকফার্স্ট সার্ভ করা হলো | আমাদের 'রো' আসলে প্লেনের ডান দিকে উইনডো ঘেষে দুটো সিট | জানালার ধরে বসেছেন একজন প্যাসেন্জার, আমি বসেছি ভিতরের দিকে যাতে সিট ছেড়ে উঠা যায় | আমার পাশের যাত্রী তার পছন্দমত ব্রেক ফার্স্ট নিয়েছেন | এয়ার হোস্টেস আমাকে অবাক করে দিয়ে খুবই আন্তরিক গলায় জিজ্ঞেস করলো আমি ব্রেক ফার্স্টে কি নেবো | আমি বললাম আমার ব্রেকফার্স্টে কিছু লাগবে না | আমি রোজা রেখেছি | এয়ার হোস্টেস একটু মনে হয় অবাক হলো কিন্তু কিছু না বলে মাথা ঝাকিয়ে ট্রলিটা সড়িয়ে নিয়ে অন্য 'রো'য়ের দিকে চলে গেল | দু'দিকে যত দূর দেখতে পাচ্ছি সবাই আরাম করে খাচ্ছেন | আমাদের গন্তব্য তখন দিল্লি |
দিল্লিতে এক ঘন্টার মত স্টপেজ | তারপর প্লেন আবার রওনা হয়ে গেল ব্রাসেলসের পথে | ঢাকা থেকে ব্রাসেলস প্রায় সাড়ে এগারো ঘন্টার জার্নি | আমার সাথে ক্যারি করা হ্যান্ড ব্যাগে কয়েকটা গল্পের বই | তার থেকে একটা বের করে পড়া শুরু করলাম | এরই মধ্যে কখন যেন লাঞ্চ টাইম হয়েছে | আবার এয়ার হোস্টেসরা ঘুরে ঘুরে সবাইকে লাঞ্চ সার্ভ করছে | চিকেন ফ্রাই, বিফ, স্যুপ, ফ্রায়েড ফিশও মনে হয় দেখলাম , তার সাথে আরো আছে ভেজিটেবল, রাইস, ড্রিঙ্কস | মুটামুটি বিয়ে বাড়ির আয়োজনের মত বিশাল আয়োজন | সবাই মহা আনন্দে খাচ্ছে | অনেকেই খাবার প্রথম ইনিংস শেষ করে এয়ার হোস্টেসের কাছে আবার চেয়ে সেকেন্ড ইনিংসে খেয়ে যাচ্ছেন | আমার পাশের যাত্রীও আমার দিকে একটু করুনার দৃষ্টিতে চেয়ে দেখি মহা আনন্দে খাওয়া শুরু করেছেন | চারদিক মুটামুটি খাবারের গন্ধে মৌ মৌ করছে | সবার ভিতরেই উত্সব উত্সব একটা ভাব | ছেলে- মেয়ে, ছোটো- বড় সবাই মহা আনন্দে খেয়ে যাচ্ছেন | আমাদের দেশের ক্রিকেটের এখনকার সেনসেশন ‘ফিজের’ লেট কাটারেও তাদের সেই ইনিংস তাড়াতাড়ি শেষ হতো কিনা আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে | রহমতের মাস রোজায় দিনে দুপুরে এমনই নিখুত কায়দায় খাবার দাবার চলছে |
রাইট ব্রাদার্সের ডানায় ভর করে ত্রিশ হাজার ফুট উঁচু দিয়ে বিমানের ডিসি টেন তখন প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দুরের ব্রাসেলসের পথে সগর্জনে উড়ে চলেছে | ছোটো জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেসে যাওয়া সাদা মেঘের পর মেঘ | ফাঁকে ফাঁকে নিল আকাশ উঁকি দিয়ে আবার চকিতেই লুকিয়ে যাচ্ছে | হালকা ঘুম আসছে কিন্তু পুরোপুরি ঘুম আসছে না | আমি আবার হাতের বইটার পাতার দিকে তাকালাম | কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না | যখন ঘুম ভাঙ্গলো আমাদের প্লেন তখন এশিয়া পেড়িয়ে ইউরোপের আকাশে | ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় নয় ঘন্টা ঘন্টা জার্নি ইতিমধ্যে করে ফেলেছি | ঢাকার সাথে ব্রাসেলসের সময়ের পার্থক্য প্রায় চার ঘন্টা | আমরা যখন ব্রাসেলসে পৌছুব তখন সেখানকার সময় হবে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা | যাহোক হঠাত মাইক্রো ফোনে ভেসে আসলো পাইলটের গলা | আর ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমদের প্লেন ব্রাসেলস ইন্টার ন্যাশনাল এয়ার পোর্টে ল্যান্ড করবে | পাইলটের এনাউন্সেমেন্ট শুনে শুনে নড়ে চরে বসলাম |
প্লেনের রেস্টরুমে গিয়ে ঠান্ডা পানিতে ধুয়ে আসার পর খুব ফ্রেশ লাগছে | এয়ার হোস্টেসরা তাদের কাজগুলো শেষ করতে ব্যস্ত | আমাদের 'রো' তে ব্রেক ফার্স্ট আর লাঞ্চ সার্ভ করেছিল যেই এয়ার হোস্টেস তাকেও দেখলাম ভীষণ ব্যস্ততার সাথে কাজগুলো শেষ করার চেষ্টা করছেন | হাতের বইটা পরার চেষ্টা করছি | হঠাত মনে হলো কেউ মনে হয় ঠিক আমার পাশে এসে দাড়িয়েছে | মুখতুলে তাকালাম |দেখি পাশেই দাড়িয়ে আমাদের 'রো'তে লাঞ্চ সার্ভ করেছিলেন যেই এয়ার হোস্টেস তিনি | খানিকটা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি | আমাকে আরো অবাক করে দিয়ে এয়ার হোস্টেস জিজ্ঞেস করছেন আমি কিছু খেতে চাই কি না | আমার অবাক দৃষ্টি দেখেই মনে হয় এয়ার হোস্টেস ব্যাখ্যা করতে চাইলেন ব্যাপারটা | আমকে বললেন, প্লেনের সব প্যাসেঞ্জারই খেয়েছেন | শুধু আপনিই এই সারা জার্নিতে কিছু খাননি | এখন সন্ধ্যা | বেলজিয়ামে এখন ইফতারের সময় হয়েছে | আপনি এখন চাইলে ইফতার করতে পারেন | আমি আপনার জন্য ইফতার আনতে পারি | এতক্ষণ ক্ষিধেটা তেমন করে টের পাইনি | কিন্তু ইফতারের কথা শুনেই মনে হয় ক্ষিধেটা ঘুমন্ত গডজিলার মত পেটের ভেতর সব কিছু ভেঙ্গে চুরে ঘুম ভেঙে জেগে উঠলো | অবাক হবার ভাবটা গোপন না করে আমি বললাম, থ্যান্কস এ লট | আমি অল্প করে হালকা কিছু খেতে পারি | আচ্ছা, আমি আপনার জন্য ইফতার আনছি , বলেই এয়ার হোস্টেস দ্রুত কিচেনের দিকে ছুটে গেল | প্যাসেঞ্জারদের অনেকের মধ্যেই তখন নেক্সট স্টপেজে নামবার ব্যস্ততা শুরু হয়েছে | কিছুক্ষণ পরেই একগাদা খাবার নিয়ে উনি আবার ফিরে এলেন | ট্রেতে প্লেট ভর্তি একটা চিকেন স্যান্ডুইচ, এক স্লাইস চিজ কেক, একটা সমুচা, একটা অরেঞ্জ, চিলড এক গ্লাস ফানটা, একটা ওয়াটার বটল(এই আইটেমগুলো সকালের ব্রেক ফাস্টে ছিল না | মনে হয় এই স্ন্যাকগুলো শুধু ক্রূদের জন্য ) | আমাকে আরেক বার অবাক করে এয়ার হোস্টেস বললেন, আপনার আর কিছু লাগলে আমাকে বলবেন | উত্তরে আমি আবার থ্যান্কস বললাম | স্যান্ডুইচ, সমুচাটা গরম আর মনেই হচ্ছে খুব মজার | ক্ষিধের গডজিলাটাকে শান্ত করতে মনেহয় সব কিছুই খেতে হবে | আমি বিসমিল্লাহ বলে চুপচাপ ইফতার শুরু করলাম |
ইফতার শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ | আর কিছুক্ষণের মধ্যে ব্রাসেলস এয়ারপোর্টে আমাদের প্লেন ল্যান্ড করবে | ব্রাসেলসে বিমান প্রায় দুই ঘন্টার মত থামবে | নতুন প্যাসেঞ্জার আর ক্রূ নিয়ে বিমান রওনা হবে নিউ ইয়র্কে | তখন বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটের সব ক্রূ বদল হত ব্রাসেলসে | পুরো নতুন একটি ক্রূ গ্রূপ ব্রাসেলসে থেকে নিউ ইয়র্ক যেত | সম্ভবত তারাই আবার ফিরতি ফ্লাইটটা বাংলাদেশে নিয়ে যেত | ব্রাসেলস এয়ার পোর্টে নেমে হাটছি | বাংলাদেশ থেকে ঝকঝকে তকতকে ব্রাসেলস এয়ারপোর্টে নেমে চোখ জুড়িয়ে গেল | সাদা নিয়ন গুলোর উজ্বলতা চোখ ধাধিয়ে দিচ্ছে | কিন্তু তখনো তার চেয়েও মনে বেশি আলো ছড়িয়ে আছে কিছুক্ষণ আগের প্লেনের ঘটনাটা | ইসলামের প্রতি ভালোবাসা আমাদের মানুষের প্রাচীন | কিন্তু বাংলাদশ বিমানের নিউ ইয়র্ক ফ্লাইটের অতি আধুনিকা কোনো এয়ার হোস্টেসের কাছ থেকে সেই একই আনতরিকতা আর ভালবাসা আমি আশা করিনা কখনই (অনেক আগেও করতাম না এখনো করিনা)| কিন্তু সেই ঘটনাটাই ঘটেছে | আমি কোনো বিখ্যাত মানুষ নই | আমার চেহারাও মিশন ইম্পসিবল সিনেমার নায়ক টম ক্রূজের মত আকর্ষনীয় নয় | ইফতারের ঘটনাটা ইসলামের জন্য মনের কোণে লুকিয়ে থাকা ভালবাসার জন্যই ঘটেছে বলে আমার বিশ্বাস | সেটাই আমি তখনো ভাবছি | হঠাত খেয়াল করলাম এক ঘন্টারও বেশি সময় চলে গেছে | আমি আমাদের প্লেনের ডিপার্চার ডোর থেকে বেশ খানিকটা দুরেও চলে এসেছি | তাড়াতাড়ি আবার ফিরে গেলাম প্লেনে | নতুন কিছু প্যাসেঞ্জার, নতুন ক্রূ নিয়ে আমাদের প্লেন আবার রওনা হলো | বেশির ভাগ প্যাসেঞ্জারই ঘুমাচ্ছে | আমার কেন জানি ঘুম আসছে না | ফ্লাইট শুরুর আগে এয়ার হোস্টেসরা প্রত্যেকতা 'রো'তে ঘুরে ঘুরে সবার সিট বেল্ট ঠিকঠাক মত বাধা হয়েছে কিনা চেক করছে | আমাদের "রো"তেও এলো ভিশন স্মার্ট আর সুবেশী এয়ার হোস্টেস | পরিপাটি করে পোশাক পড়া নতুন একজন | তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে আমর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল সিট বেল্ট বেধেছি কিনা | গারো ঘুমে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে | তার কঠিন গলা শুনেও আমি কিছু মনে করলাম না |
বাংলাদেশ বিমান এখন আর নিউ ইয়র্কের জেএফকে আসতে পারে না | সেই ভিশন স্মার্ট, সুবেশীনী আর সুভাষিনী এয়ার হোস্টেসের সাথে আর কখনো দ্যাখ্যা হয় নি | উনি এখনো বাংলাদশ বিমানে এয়ার হোস্টেসের চাকুরী করেন কিনা আমি জানি না | কিন্তু তবুও আজ এত বছর পরেও যখন বিদেশে রোজা আসে তখন কেন জানি আমার আমেরিকা আসার প্রথম দিনের কথা, বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট, প্লেনে ইফতারের কথা, সেই এয়ার হোস্টেসের কথা মনে হয় | এই পুরো ঘটনাটা আজ যখন আমি ভাবি তখন বদলে যাওয়া এখনকার বাংলাদেশের কনটেক্সট মনে করে নানান কারণেই আমার খুবই কষ্ট হয় | এর একটা বড় কারণ হলো অনেক বছর আগে আমি যখন বাংলাদেশ ছেড়ে আমেরিকায় আসি তখন বাংলাদেশে মুসলিম জাতীয়তা নিয়ে কোনো বিতর্ক ছিল না | ইসলাম আর সরকার পরস্পরের প্রতিপক্ষ হয়ে দাড়ায় নি | ইসলামী মূল্যবোধের সাথে সরকারের কোনো দ্বন্দ্ব তৈরী হয় নি | ছেলেরা দাড়ি টুপী, পাঞ্জাবি পরে ঝামেলায় পরবে, মেয়েরা হিজাব পড়ার জন্য প্রকাশ্যে হেনস্থা হবে তা ছিল অকল্পনীয় | মসজিদে পুলিশী তান্ডব হবে, বাংলাদেশেই আল্লাহ, রাসুল (সাঃ), কুরআনের অহরহ অবমাননা হবে, সরকার দলীয় নেতারাও ইসলামের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কথা বলবেন এগুলি ছিল ভাবনার বাইরে | জাতীয় পাঠ্য পুস্তকে ইসলামী মুল্যবোধ, ইসলামী স্কলারদের জীবনী বাদ দিয়ে দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসের বিপরীত মূল্যবোধের প্রচার হবে এমন অবস্থাও তখন তৈরী হয়নি | একসময় আমরা শুনতাম সোভিয়েত ইউনিয়নে ইসলাম পালন করার জন্য মুসলিমদের অত্যাচার করা হয়, চীনের কমুনিস্ট শাসক উইঘেরের মুসলিমদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায় | এখন মুসলিম নির্যাতনের খবর জানতে বিদেশ নয়, বাংলাদেশের খবরের কাগজ দেখলেই চলে | আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই কাল বেলায় ওআইসি সন্মেলনে যেতে রাজি হন না কিন্তু পৃথিবী ঘুরে বিশাল রাজবহর নিয়ে তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেনীর এমন সব সস্তা সন্মেলনে যেতে অক্লান্ত উত্সাহ দেখান যেসব সেমিনারে টাকা দিয়ে ইনভাইটেশন কেনা যায়, যেখানে কোনো সরকার প্রধান যান না বা যেতে চান না | এখন ক্ষমতা পাকাপোক্ত রাখতে ইসলামকে হেনস্থা করতে কি অক্লান্ত প্রচেষ্টা দেশের সরকারী বেসরকারী দুই পক্ষেরই !
তাই রোজার মাস যখন আসে তখন সব সময়ই ভাবি নিউ ইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্টে বিমান নিষিদ্ধ হয়ে ভালই হয়েছে | নইলে আবার রোজায় ফ্লাইট প্রটোকল ভেঙে কোনো রোজাদারকে দুরের ফ্লাইটে ইফতার দেবার ঘটনা শুনে সরকার হয়ত ইসলামের প্রতি সহানুভূতিশীল কোনো এয়ার হোস্টেসের চাকুরীই নট করে দিত | এগুলো নিয়ে পানি যাতে বেশি না গড়ায় তার জন্য সেই এয়ার হোস্টেসকে গুমই করে ফেলত কি না কে জানে | এ'রকম কতইতো হচ্ছে, অহরহই হচ্ছে দেশে এখন | আল্লাহ দ্বীনকে আমাদের জন্য সহজ করে দিয়েছেন | আমার মত নগন্য বান্দার ভাগ্যেও হাজার মাইল দুরে দেশের বাইরে , মাটি থেকে ত্রিশ হাজার ফুট উপরে আকাশে উড়ে চলা প্লেনেও আল্লাহ রোজায় পর্যাপ্ত ইফতার রেখেছেন | কিন্তু আমার মত নগন্য, গুনাগার বান্দার জন্য মনের কোনায় ইসলামের জন্য হয়ত অল্প একটু কিন্তু অকৃত্রিম ভালবাসা জমিয়ে রাখা কোনো মানুষের কঠিন শাস্তি হোলে সেটা বড়ই অশান্তির বিষয় হয়ে যেত নিজের কাছেই |
---------------------
(আর দশ মিনিটের মধ্যেই তারাবির জন্য বেরুবো | এখন রাত শোয়া দশটা বাজে | তারাবির পর মসজিদে জামাতে কিয়ামুল লাইলের নামাজ পড়ে ফিরতে ফিরতে রাত আড়াইটা বেজে যায় | এই লেখাটা পোস্ট করার কথা বাংলাদেশ সময় জুলাই ২ তারিখ বেলা এগারোটায় | তাই একটু আগেই পোস্ট করলাম | কারণ পরে বেশি দেরি হয়ে যাবে বলে )
বিষয়: বিবিধ
১৯৬৩ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক মনোযোগ দিয়ে আপনার লিখাটি পড়লাম। মা-শা আল্লাহ, আপনার উপলদ্ধি ও উপসংহার এক কথায় চমকার। জাযাকাল্লাহ খাইর
আসলে ইসলাম এমন জিনিস মানুষের হৃদয়ে তা খেকে যায়। আপনার মত এমন একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার বড় ভাই এর ভারতে। কলকাতার এক অতি আধুনিকা মুসলিম মেয়ে যার মামা ভারতের কেন্দ্রিয় মন্ত্রি ছিলেন এবং তার কাজিন এখনও লোকসভার সদস্য। তিনি নিজে রোজা রাখতেন না। এক বন্ধুর সাথে আত্মিয়তার সুত্রে তার বাসায় গেলে তিনি শুধু ইফতার ই করান নি বরং সেহরির জন্যও অনেক সুস্বাদু খাবার রান্না করে দিয়েছিলেন। হোটেলে সেহরির অসুবিধা হলে যেন তাকে জানান হয় সেই কথাও বলেছিলেন।
Wherever that sister( air crew) is now,
May Allah grant her success in all the good she does!
মন্তব্য করতে লগইন করুন