আমেরিকার দিনগুলি-৩: কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটির পথে
লিখেছেন লিখেছেন তবুওআশাবা্দী ২৬ মে, ২০১৬, ০৭:১৮:৫০ সন্ধ্যা
(আগের লেখা "আমেরিকার দিনগুলি -২")
বাংলাদেশে এক সময় খুবই একটা প্রচলিত কথা ছিল (এখনও সেটা প্রচলিত আছে কিনা জানিনা ) "নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে"? বাংলাদেশের সময়মত কিছু না হবার বেহাল দশা বোঝাতেই এই ধরনের কথাগুলো প্রচলিত হয়ে যায় | আমি বাংলাদেশের ঠিক এখনকার অবস্থার কথা জানিনা | কিন্তু আমি আগের কথ বলছি, তখন অনেক ক্ষেত্রেই এই কথাটা পুরোপুরি সত্যি ছিল বাংলাদেশে | বিশেষ করে বাস, ট্রেন,লঞ্চ এগুলোর ছাড়ার ক্ষেত্রে সময়ের এত হেরফের হত যে বেশিরভাগ সময়ই এটা বিরক্তির পর্যায়ে পৌছে যেত | বিটিভির প্রোগ্রামগুলোও টিভি গাইডের সময় অনুযায়ী কখনই প্রচারিত হত না | কোনো প্রোগ্রাম শুরু হবার ঘোষণা দেবার পর শুরু হত বিজ্ঞাপন | কখনো কখনো এই বিজ্ঞাপন চলত আধা ঘন্টা তারপর শুরু হত ঘোষিত অনুষ্ঠান | এমনকি ব্যক্তি মালিকানাধীন যেসব ব্যবসা যেমন সদর ঘাট থেকে দক্ষিনের জেলাগুলিতে ছেড়ে যাওয়া লাক্সারী লঞ্চগুলোও কখনো সময়মত ছাড়ত না | সময়ের ঘন্টা পড়েও সেগুলো আরো যাত্রী নেবার জন্য অন্তহীন অপেক্ষা করতে থাকত |একই ঘটনা ঘটত লাক্সারী বাসগুলোর ক্ষেত্রেও |চরম একটা আনপ্রফেশনালিজম সরকার নিয়ন্ত্রিত ও ব্যক্তি মালিকাধীন সব প্রতিষ্ঠানগুলোতেই একটা সময় ছিল | কিন্তু এখানে তেমন কিছুই হলো না | কান ঝালাপালা করা হৈ চৈ নেই | অপ্রয়োজনীয় মানুষের ভীর নেই | লাগেজ টানাটানির ব্যাপার নেই | টিকিটের কালো বাজারী নেই | টিকিট নিয়ে তাই অযথা যন্ত্রণাও নেই | এত কিছু নেই হলে যে মন ভালো হতে পারে তাও আমার জানা নেই (তখন ছিল না ) |
১৮৩০ সালে নির্মিত এবং তার পর একশ' বছর ধরে নানা স্ট্রাকচারাল চেঞ্জের মধ্যে দিয়ে ভিক্টোরিয়ান ধাঁচে গড়া এখনকার গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন বিশাল দজ্ঞ যজ্ঞর ব্যাপারের মতই একটা এলাহী ব্যাপার | এই স্টেশন একই সাথে সাবওয়ে (মাটির নিচে দিয়ে চলা ট্রেন),রেল, গ্রে হাউন্ড বাস, ট্যাক্সি ক্যাব, নিউইয়র্ক সিটি বাস এগুলোর সবারই 'হাব' (HUB) মানে এমন একটা জায়গা যেখান থেকে বিভিন্ন রুটে (এখানে এরা রুট বলে না বলে রাউট) বাস ট্রেন ছেড়ে যাওয়া বা বিভিন্ন দূর পাল্লার রাউটে যাতায়াতকারী বাস বা ট্রেনের চেঞ্জের ক্ষত্রে মূল কেন্দ্র | নিউ ইউয়র্কের অন্যতম ল্যান্ডমার্ক এই গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন একটা খুবই ব্যস্ত শপিং সেন্টার এবং ডাইনিং-এর কেন্দ্র হিসেবেও খুবই বিখ্যাত | গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৬ মিলিয়ন বা ৬০ লক্ষ যাত্রী নিউ ইয়র্কের সাবওয়ে ব্যবহার করে | এর একটা বড় অংশই এই গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন ব্যবহার করে তাদের যাতায়াতের গেটওয়ে হিসেবে | মাল্টি স্টোরেড এই স্টেশনে তাই হাজার হাজার মানুষ সারা দিন রাত ধরেই তাদের প্রয়োজনীয় নানা কাজের জন্য এখানে আসছে | আমি একটা কোয়াটার কয়েন হোলে ঢুকিয়ে গেট পেরিয়ে নিচে নামলাম গ্রে হাউন্ড বাস স্টেশনে যাবার জন্য | গ্রেহাউন্ড স্টেশনে ঢুকে দেখি টিকিট কাউন্টারে তেমন ভীর নেই | কোনো ঝামেলা ছাড়াই তাই টিকেট কাটা গেল | টার্মিনালের ভিতর থেকে অনেক দরজা | এরাইভাল আর ডিপারচার লেখা | দরজার উপরে নিয়ন সাইনে কোন বাস কোন সিটিতে যাবে তা লেখা | বড় মনিটরে কোন বাস কখন কোন গন্তব্যে যাবে তার টাইম দেখাচ্ছে | সেই টাইম টেবিলে আরো দেখা যাচ্ছে গ্র্যান্ড সেন্ট্রালের দিকে আসা বাসগুলোর তাত্ক্ষণিক অবস্থান | তাই কখন বাস আসবে তা বার বার জিগ্গেস করার ঝামেলা নেই | আমি যে বাসে যাব সেটা সেটা গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশনেই আছে | জানালা দিয়েই দেখলাম ঠিক পিট্সবার্গ লেখা বোর্ডের সামনেই বাসটা পার্ক করা | যাহোক, কিছুক্ষণ পর মাইক্রো ফোনে পিট্সবার্গের প্যাসেঞ্জারদের দরজায় আসতে বলার সাথে সাথে ডিপারচার ডোরটা ওপেন হলো | দুহাতে আমার রোলিং স্যুটকেস দুটোকে নিয়ে আমিও ডিপারচার ডোরের দিকে এগুলাম | দুটো স্যুটকেসেই আমার নাম,ডেসটিনেশন লেখা | বাসের ড্রাইভার আর একজন গ্রেহাউন্ড কর্মী আমাদের স্যুটকেসগুলো বাসের লাগেজ ক্যারিয়ারে উঠিয়ে রাখল ডেস্টিনেশন হিসেবে | কাছের যাত্রীদের লাগেজ আগে, যাতে লাগেজ নামানোর সময় কোনো ঝামেলা না হয় | বাসে বেশি প্যাসেঞ্জার তখনও উঠেনি | পছন্দ মত জানালার পাশে একটা সিটে বসে পড়লাম | মাইক্রো ফোনে যাত্রার ঘোষণা দিয়ে আমার বাস কিন্তু রাত দশটায়ই ছাড়ল | আমার ঘড়ির সাথে দু'এক মিনিট হয়ত পার্থক্য আছে গ্রেহাউন্ডের সেটা ছাড়া আর সব একদম ঠিকঠাক |
এ’রকম রাতের বাসে করেই একসময় চাকুরীর জন্য কত ঢাকা-চিটাগাং, ঢাকা-রাজশাহী জার্নি করতে হয়েছে ! আজও তেমনি একটা জার্নি করতে হচ্ছে কিন্তু দেশ থেকে, প্রিয় শহর ঢাকা থেকে কত দুরে আমি ! অচেনা একটা দেশে তারচেয়েও অচেনা একটা শহরের উদ্দ্যেশে আমি জার্নি করছি ! সেখানে তিন নদীর তীরে পাহাড়ের উপরে আঠার শতাব্দীর শেষ দিক থেকে শুরু করে উনিশশ' শতাব্দীর প্রথম দিকে আমেরিকার ইন্ডাসট্রিয়ালাইজেশনের অন্যতম পুরোধা আইরিশ বিলিয়নিয়ার স্টিল রেল ব্যবসায়ী এনড্র্রু কার্নেগী, পিট্সবার্গকে গড়ে তুলেছিলেন পৃথিবীর স্টিল ক্যাপিটাল হিসেবে | ফ্রান্সের সিন নদীর উপরের সতেরোটা ব্রিজের মতই পিট্সবার্গের তিনটি নদীরউপরে ১৯২০-৪০ সালের মধ্যে কার্নেগী তৈরী স্টিলের বড় বড় সব ব্রিজ | পাহাড় নদী মিলিয়ে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের মতই অপরুপা পিট্সবার্গ | প্রায় একশ' বছর পর সেই ব্রিজগুলো পিট্সবার্গের বিভিন্ন অংশের মধ্যে এখনো মেলাবন্ধন হয়ে রয়েছে | সেরকম একটা ব্রিজ পেড়িয়ে আমাকেও আজকে ঢুকতে হবে তিনটি নদীর সঙ্গমে পাহাড় ঘেষে দাড়িয়ে থাকা অপরুপা পিট্সবার্গে | স্বপ্নের শহর পিটসবার্গকে পৃথিবীর সেরা একটা শহর হিসেবে গড়ে তোলার এক পর্যায়ে বিদ্যানুরাগী এনড্র্রু কার্নেগী, “কার্নেগী ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি” প্রতিষ্ঠা করেন ১৯০০ সালে | উনিশশ পঞ্চাশ দশকের শুরুর দিকে বিখ্যাত “ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো” থেকে হার্বার্ট সায়মন নামের পি এইচ ডি করা এক তরুণ যোগ দেন কার্নেগী ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে | তার সব্যসাচী প্রতিভা আর গবেষণায় আলোকজ্জ্বল “কার্নেগী ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি” তার যোগদানের অল্প পরেই ১৯৬৭ সালে আমেরিকার অন্যতম বড় কমার্শিয়াল ব্যাঙ্কের মালিক পিটসবার্গের বিখ্যাত ব্যবসায়ী মেলন ফ্যামিলির “মেলন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডাস ট্রিয়াল রিসার্চ”–এর সাথে এক হয়ে আমেরিকার অন্যতম সেরা প্রিমিয়ার রিসার্চ ইনস্টিটিউট -কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটির যাত্রাশুরু হয়| শুরুর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমেরিকার সীমানা পেড়িয়ে -কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটি পরিচিতি হয় সারা পৃথিবীরই অন্যতম সেরা ইউনিভার্সিটি হিসেবে | আমাদের এই সময় হলো টেকনোলজির যুগ | কম্পিউটার আর রবোটিক্সের যুগ | এই রবোটিক্সের গবেষণা প্রথম শুরু হয় এই কার্নেগী মেল্ন ইউনিভার্সিটিতে | নব্বুই দশকের শুরুতে 'ডিপ বুলু' ( Deep Blue) নামের যে কমপিউটারটা তখনকার অবিসংবাদিত ওয়ার্ল্ড চেস চ্যাম্পিয়ন গ্যারি ক্যাস্পারভ্কে হারিয়ে সারা পৃথিবীকে স্তম্ভিত করে ছিল সেটা এই কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটিতেই বানানো হয়েছিল | কম্পিউটার এর আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্সের মূল গবেষণাগুলোর শুরু হয় এখানেই | আজকে আমরা কমপিউটারে বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করছি | কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটির আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্সের সফল রিসার্চের সরাসরি ফলাফলই হলো আজকের ইফিশিয়েন্ট এইসব সার্চ ইঞ্জিন |
গ্রে হাউন্ড বাস চলছে পিট্সবার্গের গন্তব্যে | রূপকথার রাজ্যের শহর পিট্সবার্গের রূপকথার রাজকন্যার মতই স্বপ্নের সেই -কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চলেছি ! বাস্তব, অবাস্তব, স্বপ্ন, সত্যি সব এক সাথে মিশে উথাল পাথাল আবেগে ভরা আমার মনে তখন ব্যাখ্যার অতীত এক অবস্থা | পেছনে ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে ম্যানহাটনের আকাশ ছোয়া হাইরাইজের আলোগুলো | কিছুক্ষণ আগেই যেগুলোর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলাম, অভিভূত হয়েছিলাম সেগুলোর কথা আর মনে থাকলো না | মনের ভেতর কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটিতে পড়ার উত্তেজনা | আসার আগে লিটারেলি ক’দিন ঘুম হয়নি | ইউনিভার্সিটির ছুটি নেবার প্রসেসগুলো শেষ করা, খুবই কম সময়ের নোটিশে (ভিসা পাব কিনা সে অনিশ্চয়তার জন্য আগে থেকেই কোনো কাজই করিনি ) আমেরিকা আসার কেনা কাটা করা, টিকেট কনফার্ম করা, প্রায় বিশ ঘন্টা জার্নি করে নিউইয়র্কে আসার পর প্রায় কোনো রেস্ট না নিয়েই আবার চারশ' মাইল দুরে পিট্সবার্গের দিকে চলেছি | গাড় ঘুমে দু'চোখ জড়িয়ে থাকার কথা | মাঝে মাঝে তন্দ্রা আসছে ঠিকই কিন্তু আমার চোখে কোনো ঘুম আসছে না | রাস্তার পাশে জমে থাকা জমাট বাঁধা স্নো কোনো কোনো জায়গায় প্রায় উঁচু দেওয়ালের মত তৈরী করেছে |সেদিকে একটু তীক্ষ্ন চোখে তাকাতে তাকাতেই তা আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে | আধো ঘুমে মাঝে মাঝে বাইরের আলো আঁধারীতে এসব দেখতে দেখতে পৌছুলাম ইয়ংস টাউনে | এটা ওহিও স্টেটের সেকন্ড লার্জেস্ট সিটি | এখানে একটা গ্রে হাউন্ড স্টেশনে আমাদের বাসটা থামবে আধা ঘন্টার জন্য |রিফুয়েলিং করবে | আর দুই ঘন্টার মধ্যেই বাস পিট্সবার্গে গিয়ে পৌছুবে | এখন আর ঘুমুলে চলবে না | ফিলিং স্টেশনটাকে কেন্দ্র করেই চমত্কার একটা সার্ভিস সেন্টার | সেখানে ফার্স্ট ফুড সার্ভিস, গিফট শপ, রেস্ট রুম দূর দুরান্তের যাত্রীদের প্রয়োজনীয় সবই আছে সেখানে| আমিও সবার সাথে বাস থেকে নামলাম | কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না তাই শুধু কফি শপ থেকে একটা কফি কিনলাম | কলম্বিয়ান ডার্ক রোস্ট | কফিতে কড়া গন্ধ | নিজেই তাতে ক্রিমার আর সুগার মেশালাম | প্রথম চুমুক দিতেই চোখ থেকে খানিকটা ঘুম মনে হয় কেটে গেল | বাস আবার চলতে শুরু করেছে পিট্সবার্গের পাহাড়ি উপত্যকার পথে | বাসের মৃদু ঝাকুনিতে আলতো করে চোখে এসে জড়িয়ে যাচ্ছে ঘুম | আর কিছুক্ষণ পর আমি গিয়ে পৌছুব কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটিতে | সেই একরাশ উত্তেজনা সাথে নিয়েই হঠাত ঘুমিয়ে পরলাম | ঘুম ভাঙ্গলো মাইক্রো ফোনে বাস ড্রাইভারের ঘোষণায় | আমরা এসে পৌছেছি পিট্সবার্গে | সবাই উঠে দাড়িয়েছে বাস থেকে নামার জন্য | মাথার উপর রাখা হাতব্যাগটা নিয়ে আমিও নামার জন্য তৈরী হলাম |
ঠিক সকাল ছয়টায়, নিউ ইয়র্ক থেকে রওনা হবার আট ঘন্টা পর ঠিক সময়মতই বাস এসে পৌছেছে গন্তব্যে | লাগেজগুলো নিয়ে আমি স্টেশনের ভিতরে প্যাসেঞ্জার এরিয়ায় এসে বসলাম | শীতের সকাল তখনও বাইরে অন্ধকার | ঠিক বুঝতে পারছিলাম না সকাল ছয়টায় কারো বাসায় ফোন করা উচিত হবে কি না | আমি যেখানে যাব সেটা আমার বন্ধু ‘তাহা'র খালার বাসা |গ্রে হাউন্ড বাস স্টেশন থেকে খুব বেশি দুরে নয় | আর সেই বাসা থেকে কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটি খুবই কাছে | হেটেও যাওয়া যায় | আমি কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসবো জেনে তাহা নিউ ইয়র্ক থেকে নিজেই তার খালাকে আমার কথা বলেছে | আমি যে কয়দিন নিজের হাউজিং খুঁজে না পাব সে কয় দিন ওখানেই থাকব | আমি 'তাহা'কে ইউনিভার্সিটিতে আমার জন্য একসপ্তাহের থাকার ব্যবস্থা আছে বলাতে সে বলেছে পৃথিবীর সব খালাদের ইতিহাসে সেরা খালা তার এই মোনা খালা | আমার কোনো অসুবিধা হবে না | আমরা যাকে পছন্দ করি তাদের সম্পর্কে বলার সময় বাড়িয়ে বলি | অপছন্দের মানুষের ক্ষত্রে ব্যাপারটা উল্টো | কিন্তু 'তাহা'র মত এত নিরপেক্ষ করে পছন্দের মানুষের ব্যাপারে কাউকে আর বলতে শুনিনি | আমি এর পর দু'বছর পিট্সবার্গে ছিলাম | তার মধ্যেই মোনা খালা আর খালু 'তাহা'র কথা একেবারে একশ ভাগ সত্যি প্রমান করে আমার আর আমার ওয়াইফের (ও আমার আসার একবছর পর এসেছে আমেরিকায়) দুজনেরই খুব প্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছেন | আজ এত দিন পরেও তাদের সাথে আমাদের যোগাযোগ আছে | আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মোনা খালার বাসায় কল করলাম | ফোনটা ধরলেন খালাই | আমার পরিচয় দিতেই আমি কেমন আছি, পথে কোনো অসুবিধা হয়েছে কিনা জানতে চাইলেন | আমি ঠিক ঠাক আছি জেনে বললেন এত সকালে আধারে রওনা না দিয়ে আরেকটু অপেক্ষা করতে সকালের আলোতে একটা ইয়োলো ক্যাব নিয়ে আসতে |
আরো আধা ঘন্টা অপেক্ষা করে সাতটার সময় বের হলাম স্টেশনের বাইরে ইয়েলো ক্যাবের জন্য | স্টেশনের বন্ধ দরজার বাইরে একপা দিয়েই হতভম্ভ হয়ে গেলাম |সারা পৃথিবী মনেহয় স্নোতে মুরে রয়েছে | রাস্তার ফুটপাতে প্রায় ছয় সাত ফুট উচু করে স্নোর পাহাড় | স্টেশনটা ডাউন টাউনের মধ্যেই | সামনেই এভারেস্ট ছোয়া সব বিল্ডিং| অফিস আওয়ার শুরু হবে আর কিছুক্ষণ পরেই | গাড়িতে করে লোকজন সেই স্নোর মধ্যেও অফিসে আসতে শুরু করেছে | সেই সকালেও কিছু বাস চলছে খুবই কম যাত্রী নিয়ে |
বেশি অপেক্ষা করতে হলো না, ইয়োলো ক্যাব পাওয়া গেল | ড্রাইভার নিজেই সুইটকেসগুলো গাড়ির পেছনের ট্রাংকে উঠালো | আমি নিজের ব্যাকপ্যাকটা নিয়ে ক্যাবে উঠে বসলাম | ছয় সাত মাইল দুরে ওকল্যান্ডের কোলটার্ট স্ট্রিট আমার গন্তব্য | পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাস্তা | হাত বাড়ালেই যেন পাহাড়গুলো ছোয়া যাবে এত কাছে |সেই রাস্তা বেয়ে আমার গাড়ি চলছে | পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠছি | নীচে বয়ে চলেছে আলেঘানি রিভার | নদীর অন্য পাড়েও পাহাড়গুলোর চূড়া সাদা স্নোতে মোড়া | সেই পাহাড়ের ঢালে দেখা যাচ্ছে নানান আর্কিটেকচারের বিল্ডিং | গাছের ফাকে ফাকে দেখা যাচ্ছে রাস্তা | রাস্তায় নানান রঙের গাড়ি চকিতে দেখা দিয়েই আবার গাছের ফাঁকে হারিয়ে যাচ্ছে | পাহাড়ের ঢাল বেয়ে আমার গাড়ি উপরে উঠছে | পেছনে ডাউন টাউনের আকাশ ছোয়া স্কাই স্ক্র্য়াপারগুলো একটু একটু করে দুরে সরে যাচ্ছে | সব মিলিয়ে যেন ভ্যান গগের আঁকা চমত্কার কোনো ছবি | মনের ভিতর পিট্সবার্গের যে ছবিটা আঁকা ছিল প্রথম দৃষ্টিতে পিট্সবার্গকে তার চেয়েও আরো অনেক অনেক বেশি সুন্দর লাগলো | সকালের রাশ আওয়ারের ব্যস্ততার মাঝেও খুব তাড়াতাড়িই ওকল্যান্ডে এসে পৌছুলাম | মোনা খালা আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন | কলিং বেল টিপতেই দরজা খুলে দিলেন | খালু আমার জন্য অপেক্ষা করে কিছুক্ষণ আগেই অফিসে গিয়েছেন | উনি আমার জন্য অপেক্ষা করছেন | আজ একটু পরে অফিসে গেলেও চলবে | দোতলায় আমার থাকার ঘরটা দেখিয়ে দিলেন | আমি কিছু খাব কিনা জানতে চাইলেন | বললাম, না | আমার সকাল নয়টার দিকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে শুনে বললেন হেটেই যাওয়া যায় | কিন্তু এই স্নোর মধ্যে আজকে না যাওয়াই ভালো | নিজে তাই একটা ইয়েলো ক্যাব কল করলেন | আমাকে বাসার একটা চাবি দিয়ে বললেন ইউনিভার্সিটির কাজ শেষ করে আমি জেনো আবার বাসায় চলে আসি | উনার অফিস খুবই কাছে | উনি দুপুরে এসে আমার খোঁজ নেবেন | ইয়েলো ক্যাব চলে এসেছে | আমি ক্যাবের দিকে এগিয়ে গেলাম |
কোল্টার্ট স্ট্রিট দিয়ে একটু এগুলেই ফর্বস এভিনিউ | ফর্বস এভিনিউতে উঠে গাড়ি রাইট টার্ন নিয়েছে | অল্প কিছু দূর যেতে হবে | গাড়ির জানালায় বসে আমি বাইরে তাকেয়ে দেখছি | রাস্তার দুদিকে দোকান পাট | খুবই ছিমছাম | ফর্বস এভিনিউ দিয়ে যেতে যেতে দেখতে পেলাম ফরটি ফোর স্টোরি আকাশ ছোয়া ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গের “ক্যাথিড্রাল অফ লার্নিং” বিল্ডিঙ্গ | এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু একাডেমিক বিল্ডিং | এখানে চল্লিশ তলার উপর একাডেমিক ক্লাস হয় | আকাশ ছোয়া ক্যাথিড্রাল অফ লার্নিং বিল্ডিঙটার পাশ ঘেষে যাবার সময় ফেলে আসা ঢাকা আর রাজশাহী ইউনিভার্সিটির কথা মনে পরে মনটা যেন কেমন করে উঠলো | আকাশ সমান উঁচু,মেঘের ছোয়ায় ঢেকে থাকা কোনো বিল্ডিং আমাদের ইউনিভার্সিটিগুলোর নেই, অত উঁচুতে ক্লাসও হয় না, সাদা মেঘের ঘিরে থাকা শুভ্রতাও বুঝি তাই সেগুলোতে নেই | এখানে তাই বুঝি শুধুই বারুদের গন্ধ |আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা চলার সময়ই মধুর ক্যান্টিন এলাকার তুমুল গোলাগুলি, চারতলার এক্সজাম রুমের জানালা ভেঙ্গে ঢুকে পরা গুলির কথা মনে হয় | আকাশ নয় মাটির কাছাকাছি আমাদের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা ইউনিভার্সিটি আর অন্যান্য ইউনিভার্সিটিগুলোর পড়া লেখার মান কার ভুলে যে আকাশ না ছুঁয়ে মাটির এত গভীরে ঢুকে গেল ! পৃথিবীর প্রথম পাঁচশটি সেরা ইউনিভার্সিটির মধ্যেও নাকি এখন আমাদের দেশের কোনো ইউনিভার্সিটি নেই ! “উন্নয়নের স্বর্গভূমি বাংলাদেশ” শিরোনামে বিদেশের পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী | কিন্তু স্বর্গের দ্বার বদ্ধ হয়ে যাওয়া দেশের পাবলিক ইউনিভার্সিটিগুলো দোযখের আগুনে জ্বলে পুরে নিঃশেষ হয়ে গেলেও তার কোনো অসুবিধে হয় না !
ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গ ছাড়িয়ে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে | হাতের ডান দিকে কার্নেগী মিজিয়াম চোখে পড়ল | ডাইনোসরের পূর্ণ ফসিলের কালেকশনের জন্য এই মিউজিয়াম খুবই বিখ্যাত | তার মানে কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটির কাছে চলে এসেছি ! মনের ভেতর চলছে ভীষণ উত্তেজনার কালবৈশেখী ঝর | সেই কত দিন আগে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে থার্ড ইয়ারে মনে হয় প্রথম পরে ছিলাম প্রফেসর সাইমনের নোবেল জয়ী বই "অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিহেভিয়ার" | সেই প্রথম পিটসবার্গের, কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির ছবি আঁকা শুরু মনে | তার পর স্বপ্নের রং তুলিতে ওয়াটার কালারে আঁকা ছবির মতই সেই ছবি দিনের পর দিন উজ্বল থেকে আরো উজ্বল, সুন্দর থেকে আরো সুন্দরই শুধু হয়েছে | সেই স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে | সত্যি কি এসব ঘটছে নাকি আমি আসলেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি ! নিজের শরীরে অজান্তেই একবার চিমটি কাটলাম | ঢাকা ইউনিভার্সিটির আর্টস ফ্যাকাল্টির চার তলায় খান স্যারের অর্গানাইজেশন বিহেভিয়র ক্লাসে বসে সেই স্বপ্ন দেখার প্রথম মুহূর্তগুলোর কথাগুলো মনে পড়ল | ক্লাস চলার সাথে সাথে নীচে বটতলায় মাইকে তীব্র ভাষায় ভাষণও চলছে | বক্তা মনে হয় ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে প্রথম ভাষণ দিচ্ছেন | নেতাদের সুনজর পাবার জন্য ক্ষণে ক্ষণেই তার গলার স্বর বেড়ে যাচ্ছে | আশে পাশে যে ক্লাস চলছে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই | একটু পরেই ধুম ধাম ককটেল ফাটার শব্দ | দৌড়াদৌড়ি, চিত্কার, ধর মার নানান শব্দ | এত জোরে যে চারতলার ক্লাসে বসেও সেগুলোর কিছু কিছু পরিস্কার শোনা যাচ্ছে | সেই তীব্র জ্বালাময়ী ভাষার ভাষণ, হই হুল্লোর, ককটেল ফোটা সেসব থেকে কত দুরে আমি আজ!
ইউনিভার্সিটি অফ পিটসবার্গে পেড়িয়ে কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটির হেইনজ কলেজের সামনে এসে আমার গাড়ি দাড়িয়েছে | যেন স্বপ্নে দ্যাখা রাজকন্যা বাস্তবে দ্যাখ্যা পাবার মতই অবিশ্বাস্য কোনো বাস্তবের মুখোমুখী আমি! সেই একই রকম ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস | ছেলে মেয়েরা রাস্তা দিয়ে পার হচ্ছে | কেউ ঢুকছে, কেউ বের হচ্ছে | মনে হলো সবাই সবার কাজ নিয়েই ব্যস্ত | কোনো মিছিল, শ্লোগান নেই | দেওয়ালে কোনো নেতা নেত্রীর পোস্টার নেই | হঠাত আম্মা আর আব্বা, আমার এক বছরের মেয়ে আর যার কোলে তাকে রেখে এসেছি তাদের কথা খুব মনে হলো | এদের সবার উত্সাহ আর উদ্যোগের কারণেই আমি আজ এই স্বপ্ন পূরণের এত কাছাকাছি | আরো মনে হলো বাংলাদেশের দুটি ইউনিভার্সিটির কথা | ঢাকা ইউনিভার্সিটি যার আমি ছাত্র ছিলাম আর রাজশাহী ইউনিভার্সিটি যেখানে আমার প্রফেশনাল লাইফের শুরুর প্রায় পাঁচটি বছর আমি সবচে আন্তরিকতা দিয়ে পড়ানোর চেষ্টা করেছি- তাদের কথা খুব মনে পড়ল | আমেরিকা আর সারা পৃথিবীরই অন্যতম সেরা একটা ইউনিভার্সিটির সামনে দাড়িয়ে ছাত্র ও শিক্ষক দু'ভাবেই স্মৃতির খাতায় জমে থাকা বাংলাদেশের দুটি ইউনিভার্সিটির সুখ স্মৃতির জমানো মণি-মুক্তাগুলো ছাপিয়ে তাদের দুর্দশার কথাই বেশি করে মনে হলো | দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ইউনিভার্সিটির সর্বোচ্চ পদে এখনো নিয়োগ পায় প্রভু ভক্ত কোনো প্রাণীর মতই সবচেয়ে সরকারভক্ত লোকটি (ভাইস চ্যান্সেলর নামে অবশ্য ) | সেই পদের নির্বাচনের ক্রাইটেরিয়া হিসেবে সরকারী আনুগত্যের অনেক পরে বিবেচনা করা হয় একাডেমিক যোগ্যতা | ইউনিভার্সিটির শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাবার প্রধান দাবিদার হবে সেই ছাত্রকালীন সময়ে যে যত সরকারী দলের পক্ষে ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী ভুমিকা রেখেছে | ইউনিভার্সিটিগুলো শিক্ষক নামের আড়ালে খুনি ধর্ষকদের শেল্টার হয়ে উঠলেও কারো কিছু আসে যায়না এখন আর ! স্ট্রাকচারাল ডিফিসিয়েন্সি, রাজনীতি, ছাত্র রাজনীতির বিষাক্ত ছোবল, আন্দোলন, হরতাল, আর বোমাবাজিতে দিনের পর দিন অচল হয়ে ধুকতে থাকা আমাদের ইউনিভার্সিটিগুলোর চূড়ান্ত দুর্দশার কথা মনে করে কেন যে আজ এত দিন পরেও মনটা খারাপ হয় ! স্নো পড়তে শুরু করেছে আবার | তারই একটা কণা চেখে ঢুকে পরেছে মনে হয় | আঙুল দিয়ে চোখ ডল্ছি হঠাত একফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল | জানি না সে কি দেশে রেখে আসা আমার প্রিয় কিছু মুখ না দেখ্যার কষ্টে, না আমার প্রিয় ইউনিভার্সিটি গুলোর চরম দুর্দশার কথা মনে করে, নাকি স্বপ্ন সত্যি হবার আনন্দে | খুব বেশি ভাবতে পারলাম না | ঘড়িতে নয়টা বাজতে আর কয়েক মিনিট বাকি | আমার প্রোগ্রাম ডাইরেক্টর ডক্টর হ্যারি ফাউল্ক আমার জন্য নিজের অফিসে অপেক্ষা করবেন সকাল নয়টায় | হাত দিয়ে চোখটা মুছে কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটির এইচ জন হেইনজ III কলেজের মূল বিল্ডিঙ্গের রিভলভিং ডোরটা ঠেলে আমি ভিতরে ঢুকে পড়লাম |
বিষয়: বিবিধ
১৫৭০ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যদিও বাইরের দেশগুলোর আকাশচুম্বী উন্নয়ন মনে অনেক কষ্ট বয়ে আনে। আপন দেশটির করুণ চিত্র মনে করে।
সুইজারল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতা আমাকেও ভীষণভাবে তাড়িত করেছিলো।
রমজান নিয়ে ব্লগীয় আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। অংশ নিতে পারেন আপনিও। বিস্তারিত জানতে-
http://www.bddesh.net/blog/blogdetail/detail/9039/GaziSalauddin1/76670" target="_blank" target="_blank" rel="nofollow">Click this link
মতই|
মন্তব্য করতে লগইন করুন