আমেরিকায় এন্টি মুসলিম সেন্টিমেন্টের উত্থান, নও মুসলমান ব্রাদার ‘মুসলিম’ এবং আমার কিছু ভাবনা
লিখেছেন লিখেছেন তবুওআশাবা্দী ১৯ মার্চ, ২০১৬, ০৪:৩৪:০০ রাত
গত কিছুদিন থেকেই নানা কারণে মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে | ঠিক কেন বুঝতে পারছি না |
আমার মেয়ে স্কুল থেকে এসেছে খুব মন খারাপ করে | তাদের সোশ্যাল সাইন্স ক্লাসে টেররিজম নিয়ে ডিসকাশনে ইসলাম নিয়ে বাজে কথা বলেছে ক্লাসের অনেক ছেলে মেয়ে | মুসলিমরা টেররিস্ট | আইসিস মানুষের গলা কেটে মেরে ফেলে | উওমেন আবিউজ করে | মেয়েদের জোর করে হিজাব পরায়, মেয়েদের স্বাধীনতা দেয় না | মুসলিমরা খারাপ | পঁচিশ ত্রিশ জন ছাত্র-ছাত্রীর ক্লাসে একলা মুসলিম বলে তার লজ্বা লেগেছে | ওবামার প্রেসিডেন্ট হবার পর থেকে ইসলাম নিয়ে তুমুল নেতিবাচক প্রচারণা খানিকটা হলেও কমেছিল | ডেমোক্রেটিক পার্টির একজন সেন্টারিস্ট নেতা হিসেবে ওবামা আমেরিকার সব ধর্মীয়, এথনিক গ্রূপকে নিয়ে সমঝোতা করে দেশ চালাতে চেয়েছেন বলে কখনই কোনো এক্সট্রিম অবস্থান নিজেও নেননি, অন্যদের সেটা নিতে উত্সাহ দেন নি |
কিন্তু হঠাৎ করেই দু’টি সাম্প্রতিক ঘটনা এই পরিস্থিতিত বদলে দিয়েছে |প্রথমটি হলো গত বছর প্যারিসের সন্ত্রাসী হামলা আর দ্বিতীয়টি হলো আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ইলেকশন | এই বছরের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে | এখানে একটু মনে হয় ব্যাখ্যা করা দরকার কেন নয় মাস আগে থেকেই মুসলিম বিষয়টা রাজনৈতিক ইস্যু হলো | আমাদের দেশের নির্বাচনের সাথে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, সিনেট আর কংগ্রেস প্রতিনিধি নির্বাচনের পার্থক্যটা খুবই বড় এবং চোখে পরার মত |এখানে মূল প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটা হবার আগে প্রায় বছরব্যাপী সারা আমেরিকার পঞ্চাশটা স্টেট জুড়ে প্রেসিডেন্ট ক্যান্ডিডেট নির্বাচনের জন্য একটা প্রাইমারি নির্বাচন হয় | কোন দল থেকে কে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হবেন তা নির্ধারিত হয় স্টেট ভিত্তিক দলীয় কর্মীদের ভোটের উপর ভিত্তি করে, কোনো কেন্দ্রীয় নেতার নেত্রীর সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নয় | তাই এই বছরব্যাপী প্রাইমারি নির্বাচন হয় খুবই উৎসাহ আর উৎসবের আমেজে | প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এই প্রাইমারির সাথে স্থানীয় নির্বাচন যেমন স্টেটগুলোর গভর্নর বা স্টেট সিনেটের নির্বাচনগুলোও একই সাথে হয় | আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় চার বছরের জন্য | আমেরিকার পার্লামেন্ট নির্বাচন চার বছরের জন্য হলেও পুরো পার্লামেন্টের নির্বাচন একই সাথে বা একই বছরে হয় না | একটু ব্যাখা করি বিষয়টা |
আমেরিকার পার্লামেন্ট দু'টি স্তর যাকে প্রচলিত বাংলায় আমরা দ্বি কক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট বলি সেরকম | একটি সিনেট আরেকটি কংগ্রেস বা হাউস অফ রিপ্রেজেনটিটিভ নামে পরিচিত |পঞ্চাশটা স্টেট থেকে দুজন করে মোট একশ' জন সিনেটর সিনেটে আছেন | আর হাউস অফ রিপ্রেজেনটিটিভ ইলেক্টটেড মেম্বারের সংখ্যা ৪৩৫ জন, যা আইন করে নির্ধারণ করে দেওয়া আছে | জনসংখ্যা অনুযায়ী আনুপাতিক হারে প্রতিটি স্টেটের জন্য এই রিপ্রেজেনটিটিভ সংখ্যা নির্ধারিত আছে | সবচেয়ে জনবহুল স্টেট হিসেবে ক্যালিফর্নিয়ার জন্য সর্বোচ্চ ৫৩ জন রিপ্রেজেনটিটিভ এবং আলাস্কা, ডেলাওয়্যার,মন্টানা, নর্থ ডাকোটা, সাউথ ডাকোটা, ভারমোন্ট, আর ওয়াইওমিং এই সাতটি স্টেটের রিপ্রেজেনটিটিভ সংখ্যা এক জন করে | এখানে খুবই সুচিন্তিত একটা নির্বাচনী ব্যবস্থা দু’শ বছরেরও আগে আমেরিকার "ফাউন্ডিং ফাদাররা" দেশের জন্য নির্ধারণ করেছেন |যেই বছর প্রেসিডেন্ট ইলেকশন হয় সেই বছর সিনেট আর হাউজ অফ রিপরেজেন্টেটিভের অর্ধেক সদস্যের জন্য ইলেকশন হয় | তার দুবছর পর বাকি সিনেট আর হাউজ অফ রিপরেজেন্টেটিভের সদস্য নির্বাচনের ইলেকশন | কোনো ধরনের প্রাকিতিক দুর্যোগ বা যুদ্ধের কারণে যদি নির্বাচন না হয় এবং প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার মেয়াদ যদি পার হয়ে যায় তাহলে যেন কোনো সাংবিধানিক সংকট দেশে সৃষ্টি না হয় তার জন্য এই ব্যবস্থা | আমেরিকায় তাই পুরো দমে চলছে প্রেসিডেন্ট ইলেকশনের প্রচারণা এন্ড প্রাইমারি ইলেকশন | রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট প্রত্যাশীরা প্যারিস আক্রমনকে এই নির্বাচনী প্রচার করেছে রিপাবলিকান পার্টির রক্ষনশীল বেস ভোটারদের আকর্ষণ করতে |
যা হোক, যত সুষ্টু নির্বাচনী ব্যবস্থার কথা আমেরিকার "ফাউন্ডিং ফাদাররা" দেশের জন্য চিন্তা করেছিলেন তত সুষ্টু ভাবে এবার নির্বাচনের কিছুই যেন হচ্ছে না | রিপাবলিকান পার্টির বর্তমান ফ্রন্ট রানার মার্কিন বিলিয়নিয়ার ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী প্রচারে তচনচ করে দিয়েছেন এতদিনের সব প্রচলিত মূল্যবোধ, নিয়ম নীতি | নির্বাচনী প্রচারে আমদানি করেছেন আক্রমনাত্মক ভাষা, উস্কে দিয়েছেন রেসিজম | হিস্পানিক, আফ্রিকান-আমেরিকান আর মুসলিমদের লক্ষ্য করে করে চলেছেন একের পর এক অপমানজনক মন্তব্য |বিশেষ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তার ভাষা খুবই রেসিস্ট | যেমন ট্রাম্প সিরীয় শরণার্থীদের আমেরিকায় জায়গা না দেবার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই মতামত দিয়েছেন | আইসিসের বিরুদ্ধে কার্পেট বম্বিং আইডিয়াটা সমর্থন করে সন্ত্রাসীদের পরিবার পরিজনদেরও বিনা বিচারে হত্যায় সমর্থনের কথা বলেছেন | সিএনএনের সাথে প্রাইম টাইমের এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন তিনি মনে করেন ইসলাম পাশ্চাত্যকে ঘৃনা করে তাই আমেরিকায় মুসলিমদের সব ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করার পক্ষে মতামত দিয়েছেন কোনো লুকোচুরি না করেই | হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট গ্রূপ এই নির্বাচনে তাদের সমর্থন ঘোষণা করেছে ট্রাম্পের প্রতি | কু ক্ল্যাক্স ক্ল্যানের (KKK) সাবেক নেতা ডেভিড ডিউক প্রকাশ্যেই সাদাদের আধিপত্য বজায় রাখতে ট্রাম্পকে ভোট দেবার আহবান জানিয়েছেন | কু ক্ল্যাক্স ক্ল্যানের সাপোর্ট নিতে অস্বীকার করে ট্রাম্পের কোনো বিবৃতি দিতে না চাওয়া, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সভাগুলোতে KKK-এর পোস্টার, স্লোগানসহ শরীরে KKK -র উল্কি আঁকা লোকজনের আনাগোনা অনেককেই ভাবিয়ে তুলেছে | তাছাড়া নাত্সী কায়দায় তার সমর্থকদের স্যালুট, শপথ নেওয়া এইসবই হচ্ছে ট্রাম্পের নির্বাচনী সভাগুলোতে | এরই মধ্যে ট্রাম্পের নির্বাচনী সভায় প্রতিবাদ করার জন্য বিনা উস্কানিতে শারীরিক ভাবে আক্রমনের স্বীকার হয়েছেন আফ্রিকান মার্কিন তরুণ,তরুণী এবং নারী সাংবাদিক সহ অনেকে | তার সভা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে হিস্পানিক টিভি স্টেশন টেলিমুনডুর বিখ্যাত হোস্ট হোজে রামোসকে |
ট্রাম্পের এইসব রেসিস্ট কমেন্টের বিরুদ্ধে জোর উত্তাল সারা আমেরিকা | আমেরিকায় মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সংঘঠন কাউন্সিল অন আমেরিকান ইসলামিক রিলেশনস (CAIR) টিভি প্রেস রিলিজ দিয়ে ট্রাম্পের এই মুসলিম বিরোধী অবস্থানের কঠোর প্রতিবাদ জানিয়েছেন | খোদ রিপাবলিকান পার্টির মধ্যে থেকেও ট্রাম্পের মুসলিম বিরোধী অবস্থানের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে | ২০১২ সালের ইলেকশনে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট নমিনি মিট রমনি বিশেষ প্রেস কনফারেন্সের মধ্যে দিয়ে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগের সাথে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃনা ছড়ানোর অভিযোগ আনেন | মিডিয়ার লিবারেল হোস্টরাও সবাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরোধিতা করছেন বিশেষ করে তার ইসলাম সম্পর্কে ঘৃনা ছড়ানো মন্তব্যের জন্য | এই লিবারেল টিভি ব্যক্তিত্বদের মধ্যে রয়েছে স্টেফেন কোলবেয়ার, জন অলিভার, সেথ মায়ার, ট্রেভর নোয়া আর সামান্থা বী-র মত বিখ্যাত টিভি হোস্টরা | কনজারভেটিভদের মধ্যে রেডিও হোস্ট গ্লেন বেক ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শুরু থেকেই কঠোর অবস্থান নিয়েছেন | এরই মধ্যে বিরোধীদের প্রবল প্রতিবাদে শিকাগোতে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নির্বাচনী সভা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছেন | ষাট দশকের পর মনে হয় এই প্রথম আমেরিকার রাস্তায় সহিংসতা হলো রাজনীতিকে কেন্দ্র করে |এতো সবের পরও ডোনাল্ড ট্রাম্প ইলিনয়ের সুপার টুইসডের প্রাইমারিতে সহজেই প্রতিদ্বন্দীদের হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন | ফ্লোরিডায় মিলিয়নেরও বেশি ভোট পেয়েছেন | সুপার টুইসডের পাঁচটি স্টেট প্রাইমারির চারটিতেই জিতেছেন |
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই উত্থান সব মাইনরিটি গ্রূপকেই ভীত সন্ত্রস্ত তুলেছে | বিশেষ করে মুসলিমদের বিরুদ্ধে তার প্রকাশ্য বিষাদ্গার, ইসরাইলের প্রতি ভোকাল সমর্থন এই সব মিলিয়ে মুসলিমদের মধ্যে একটি দারুন উতকন্ঠা দেখা দিয়েছে | এরই মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থক এক তরুণ কোনো একটি ভার্সিটির ক্যাম্পাসে মনে হয় একজন হিস্পানিক আর একজন মুসলিম ছাত্রকে আক্রমন করে আহত করেছে | মার্কিন আরব মুসলিমরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইসরাইলি নীতির প্রতিবাদে ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বার্ণি সানডারসের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে |
অন্যদের মতো এত চিন্তা না করলেও কিছু চিন্তা যে হচ্ছে না আমার সেটাও সত্যি না | এর উপর মরার উপর খারার ঘার মতো উড়ে এসে বসেছে আরেক সমস্যা | অনেক বাংলাদেশীই আবার ইসলাম, মুসলিম জাতীয় সব চিহ্নই মুছে ফেলতে কোমর বেঁধে লেগেছেন এই সোশ্যাল আন রেস্টের দোহাই দিয়ে | এক বিরাট বাংলাদেশী ব্যাবসাহী তার মুকিত রহমান নামকে অবলীলায় বানিয়ে ফেলেছেন মাইক রহমান | আরেকজন বাংলাদেশী প্রায় বিশ বছর ধরে পশ্চিমে থাকার পর তার মুহাম্মদ নাম "মো" তে বদলে দেখি মহাখুশি | তার সহকর্মী সবাই দেখি তাকে মো বলেই ডাকছে আর তাতেই উনি খুশিতে ডগমগ | কানাডায় থাকেন আমাদের কিছু পরিচিত দুমাস আগে বেড়াতে এসে ছিলেন আমাদের বাসায় | সেই কর্তার বক্তব্য উনি উনার মিসেসকে বাংলাদেশী আর ইসলামী সব ধরনের চিহ্নই পোশাক আশাক থেকে মুছে ফেলতে নিরন্তর উত্সাহ দিয়ে যাচ্ছেন মুসলিম হিসেবে আইসিসের সাথে কোনো সংযোগের জন্য যাতে ঝামেলা না পোহাতে হয় তার জন্য আর ওয়াইফের ব্যাঙ্কের পস কারিয়ারের উন্নতির জন্য | ফেরারী পাখি আর কুলায় ফেরে না| বাংলাদেশী মেয়ে তার মিসেসও টরেন্টোর জলবায়ু আবহাওয়ায় বদলে গেছেন আলোর গতিতে | নামাজ কালামতো দুরের কথা মাথায় কোনো ধরনের কাপড় রাখাও এখন গেও গ্রামের মানুষের মতো মনে হয় |বাংলাদেশীদের এসব কাজ কাছে থেকে দেখে আমার ছেলে মেয়ের মধ্যেও এর প্রভাবটা পরেছে | যেহেতু বড় হচ্ছে তাই নানান প্রশ্ন আম্মুর হিজাব পরে বাইরে না গেলে কি হয়? মসজিদে গিয়ে নামাজ না পড়লে কি হয়? বাইরে বেড়াতে গেলে নামাজ না পড়লে কি হয়? ছেলে মেয়েদের এই সব ডিলিম্মা দূর করা সবসময় সহজ নয় |
যাহোক এই সব বিষয় নিয়ে মনটা মোটেই ভালো যাচ্ছিল না |জুম্মার নামাজে গিয়েছি | সাথে ছেলে | তাদের স্কুলের সেকেন্ড ট্রাইমিস্টার শেষ হয়েছে গতকাল |আজ শুক্রবার বন্ধ | তাই ছেলেও এসেছে জুম্মার নামাজ পড়তে |খুতবা শুরু দেড়টায় আর দুপুর দু' টোয় জুম্মার জামাত শুরু হবে | অন্য দিনের থেকে একটু দেরী হয়ে গেছে আসতে |মসজিদে তখনও খুব বেশি মানুষ এসে পৌছে নি | প্রথম কাতারে বসে সাথে রাখা ট্যাবলেটে ডাউনলোড করা কুরআন শরীফ থেকে সুরা কাহফ পরছি আর ছেলেকে দিয়েছি ইংরেজি অনুবাদসহ কুরআন শরীফ |একজন দুজন করে মুসল্লি আসছে | আফ্রিকান আমেরিকান কনভার্ট মুসলমান ব্রাদার মুসলিম এলেন তার ফোল্ডিং হুইল চেয়ার নিয়ে | লিগামেন্টের প্রবলেমের কারণে তার সামনে সার্জারী হবার কথা | গত প্রায় ছয় সাত মাস ধরেই তাই হুইল চেয়ার ব্যবহার করছেন | তারপর একে একে এলেন ব্রাদার জব্বার, ব্রাদার মিকাইল আরো দুই আফ্রিকান মার্কিন কনভার্ট | এদের মধ্যে ব্রাদার মুসলিম আর ব্রাদার জব্বার মসজিদে খুবই নিয়মিত | ফজরের নামাজের মুসুল্লি | ব্রাদার মিকাইল তার নতুন চাকুরিতে একটু ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সবসময় মসজিদে আগের মত নিয়মিত আসতে না পারলেও একদম অনিয়মিতও নন | দুপুর দেড়টায় ব্রাদার নুমান -আমাদের ইমাম সাহেব খুতবার জন্য উঠলেন মিম্বরে |খুতবাতেও উঠলো নির্বাচনী রেসিজমের কথা, ইসলামের প্রতি ঘৃণার কথা আর এতে আমাদের করণীয় কাজের বিষয় |
জুম্মার জামাত শেষ হতে হতে দুটো দশ বেজে গেল | নামাজ শেষ করেগাড়ি স্টার্ট দিয়েছি | ছেলেকে তার বাস্কেট বল প্রাকটিসের জন্য ড্রপ করতে হবে | নানা কারণে তখন মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে | মসজিদের পার্কিং লট থেকে বেড়িয়ে অল্প দুরেই বড় রাস্তায় উঠার জন্য দাড়িয়ে আছি | আমার গাড়ির সামনে আরেকটা এসইউভি বড় রাস্তায় উঠার জন্য অপেক্ষা করছে | হঠাত পাশ থেকে আমার ছেলে হাত দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করে বলে উঠলো “ডাড লুক এট দ্যা লাইসেন্স প্লেট | ইট'স ভেরি ইন্টারেস্টিং” | তাকিয়ে দেখি সত্যিতো সামনের গাড়ির সেক্রেটারি অফ স্টেট থেকে ইস্যু করা লাইসেন্স প্লেটটাতে জ্বল জ্বল করছে এনগ্রেভ করা বড় বড় করে ইংরেজিতে লেখা “MUSLIM” | খেয়াল করে দেখি এটাতো ব্রাদার মুসলিমের গাড়ি | ছেলেকে বললাম এটা যার গাড়ি তিনি একজন কনভার্টেড মুসলমান আর তার নাম মুসলিম | মসজিদ থেকে নামাজ পরে ফিরছেন | ছেলেকে আর বললাম না কিন্তু মুহুর্তের মধ্যেই মনটা ভালো হয়ে গেল | ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে আমাদের মত মুসলিম ইমিগ্রান্টদের কি হবে, গত প্রায় ছয় সাত মাস ধরে এই লোক আমেরিকার সমাজে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কি পরিমান ঘৃনা উস্কে দিয়েছে, কত অপমানজনক কথা বলেছে এর কিছুই আর মনে রইলো না | এক দারুন রোমাঞ্চে মনটা ভরে উঠেছে তখন |
ছেলেকে তার বাস্কেট বল প্রাকটিসের জন্য ড্রপ করে একাকী গাড়ি ড্রাইভ করছি | দু’দিকে ঘন গাছের মধ্যে দিয়ে উচু নিচু টিলার মধ্যে দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছি আর আর কতকিছু যে মনে হচ্ছে! ইসলাম নিয়ে আল্লাহ পবিত্র কুরআন শরীফে সুরা সুরা আল আন আম -এ বলেছেন “তোমাদের কাছে যা ঘোষণা করা হচ্ছে তা বাস্তবায়িত হবেই, তোমরা ব্যর্থ করতে পারবে না” (৬:১৩৪) |সেই প্রায় পনেরশত বছর আগে কুরানে আল্লাহ যা বলেছেন তাই ঘটছে এখন ! ইসলাম সম্পর্কে প্রবল ঘৃনা ছড়ানোর পরও ইসলাম বিজয়ীর বেশেই মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে | ছয় বিলিয়ন মানুষের এই পৃথিবীতে এক বিলিয়ন মানুষের ধর্ম ইসলামই আজ বেড়ে চলেছে | পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে যেখানে বিগত শত শত বছর ইসলাম তেমন করে প্রবেশ করতে পারেনি এখন সেই সব দেশেও ইসলাম নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে | শত বছর আগে আফ্রিকার মুসলিম ক্রীতদাসদেরউপর অমানুষিক অত্যাচার করে তাদের তাদের ধর্মের শেকর কেটে আর তাদের উদয়াস্ত পরিশ্রমে বাধ্য করে ইউরোপীয় দেশগুলো যে শক্তিশালী সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তুলেছিল ইতিহাসের সেই সুক্ষ ফোকর গলে এখন ওই দেশগুলোতেই ইসলাম বেড়ে উঠেছে সেই আফ্রিকান মুসলিমদের দিয়েই | কলোনিয়াল যুগের সুপার পাওয়ার ব্রিটেনে নাকি মুসলিমরাই সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়ে উঠবে আগামী পঞ্চাশ বছরে ! কমুনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল কেন্দ্র যা এখনকার রাশিয়ার রাজধানী মস্কো, যেখানে প্রায় শত বছর ইসলাম ছিল নিষিদ্ধ, তার আঙিনায় গির্জার বিল্ডিং নিয়ে গড়ে উঠেছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় মসজিদ ! তুমুল ইসলাম বিরোধী ইউরোপীয় দেশ হলান্ডের আকাশও ইসলামের আলো ঝিকমিক করে উঠা উজ্বল সুর্যোদয়ের অপেখ্যায় | ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যান্য সব দেশেই প্রায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর হার বর্ধমান |
সাত সাগর তের নদীর পাড়ের আমেরিকাও ইসলামের এই জয়যাত্রা থেকে থেকে বাদ পরেনি| ক্রীতদাস হিসেবে একদিন আসা আফ্রিকান আমেরিকানরাই ইসলামের অগ্রযাত্রায় আশার আলোকবর্তিকা হয়ে উঠেছে এই দেশে | সেই ম্যালকম এক্স, মুহাম্মদ আলী, করিম আব্দুল জব্বারদের মত কালো আমেরিকানরাই তাই আজও মুসলিম অগ্রযাত্রার সিগনেচার মুখচ্ছবি হয়ে আছেন আমেরিকায় | আমরা বাংলাদেশীরা বা অন্য মুসলিম দেশ থেকে আশা জনগণ যতই স্যেকুলার হবার চেষ্টা করিনা কেন,যতই লিবারেল হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোতে নিজেদের পরিচিত করতে চাইনা কেন, মুসলিম হয়েও দেশে বিদেশে মুসলিম পরিচয় দিতে দ্বিধা করি না কেন, জাগতিক লাভের জন্য নিজের মুসলিম নাম পাল্টে দিতে দ্বিধা করি না কেন ইসলামের বিরুদ্ধে জুডায়ু-ক্রিস্টান এক্সট্রিমিস্ট প্রপাগান্ডার বিরুদ্ধে ইসলামের আলোকবর্তিকাবাহী হিসেবে সামনের কাতারে এসে দাড়িয়েছে ডার্ক কন্টিনেন্ট হিসেবে পরিচিতিও আফ্রিকার থেকে একদার ক্রীতদাস হিসেবে আসা কালো মানুষগুলো |
আমি ভাবি ব্রাদার মুসলিমের কথা | শিকাগোর এক ব্লাক পরিবারে জন্ম নিয়েছেন | সেগ্রিগেশনের সময়, যখন আমেরিকায় কালো সাদা বাচ্চারা এক স্কুলে যেতে পারত না, এক রেস্টুরেন্টে খেতে পারত না, সংখ্যা লঘু হিসেবে বড় হয়েছেন | তবুও সান্তনা ছিল আমেরিকান বৃহত্তম ধর্মীয় জনগোষ্ঠির সদস্য ছিলেন | সুযোগ ছিল মার্কিন মুসলিমদের চেয়ে বেশি ধর্মীয় স্বাধীনতা উপভোগ করার | সেই সব ছেড়ে আমেরিকার সবচেয়ে নিপীড়িত ধর্মীয় গোষ্ঠির অন্তর্ভুক্ত হলেন কিসের আশায় ? বাংলাদেশে আমরা শুনি মিশনারীরা তাদের ধর্মে কনভার্ট করে আর্থিক সহায়তা দেয় | কিন্তু ব্রাদার মুসলিমের কথা ভাবি কি পেলেন ইসলামে কনভার্টেড হয়ে? কসমোপলিটান শহর শিকাগো ছেড়ে আমাদের ছোটো ইউনিভার্সিটি টাউনে থাকেন | বাবা মা আর পরিবারের অধিকাংশ এখনো খ্রিস্টান | সব ছেড়ে এখনো কত হাসিখুশি, সুখী ! মনে পরে যায় , প্রায় পনেরশ' বছর আগে রাসুল্লুলাহ সাল্ল্লাহী আলাইহি ওয়াস সালাম যখন সবাইকে প্রথম ইসলামের দিকে ডাকলেন তখন মক্কায় আবুলাহাব, আবু জহলের মত ধনী আর অভিজাত লোকজন সেই আহবানে সারা দেয়নি | রাসুল্লুলাহ সাল্ল্লাহী আলাইহি ওয়াস সালামের ডাকে সারা দিয়ে যারা প্রথম এগিয়ে এসেছিলেন তাদের বেশির ভাগই ছিল হত দরিদ্র বা ক্রীতদাস |ইসলামকে দ্বীন হিসেবে বিশ্বাস করে মহানবীর নেতৃত্বে এই সাহাবীরা দেশ, পরিবার পরিজনের মায়া ছেড়ে আরব উপদ্বীপ ছাড়িয়ে প্রবল পরাক্রান্ত রোমান আর পারসিক সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন | পাশ্চাত্যে ইসলামের এই সংকটময় মুহুর্তেও আল্লাহ মনে হয় রাসুলুল্লাহ সাল্ল্লাহী আলাইহি ওয়াস সালামের উম্মতের মধ্যে থেকেই সৃষ্টি করেছেন প্রথমযুগের মুসলিমদের মতই তাকওয়ায় পরিপূর্ণ কিছু মানুষ | যারা ঘর বাড়ি, আত্মীয় পরিজন ছেড়ে ইসলামকেই সত্যি ধর্ম মনে করে এর সন্মান রক্ষায় হয়ে উঠেছে অকুতভয় যোদ্ধা | ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুসলিম বিরুদ্ধে ক্রমাগত আক্রমন, তার সাথে যোগ দেওয়া হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট গ্রূপ আর আরো মিলিয়ন আমেরিকানের সমর্থনও তাই ইসলামে কনভার্টেড ব্রাদার মুসলিমের মত মানুষকে ভীত করতে পারে নি | অনেক বড় বড় বিত্তশালী মুসলমান যা পাশ্চাত্যে পারছে না করে দেখাতে তা ব্রাদার মুসলিমের মত নও মুসলিম সহজেই করে দেখাচ্ছে গাড়ির লাইসেন্সে প্লেটে সগর্বে “MUSLIM” নামটা এনগ্রেভ করে |
এই শীতের স্নো মোড়া দিনগুলো মনে হয় এবারের মত বিদায় নিয়েছে | শুক্রবারের দুপুর ভরে আছে ঝকঝকে সূর্যের রাঙা আলোতে | গাছের ফাঁক দিয়ে সেই আলো এসে লুটিয়ে পরছে চারদিকে | গাড়ির উইন্ড শিল্ডের মধ্যে দিয়ে সেই আলো ছায়ার লুকোচুরি খেলা আমাকেউ স্পর্শ করে যাচ্ছে | উচু নিচু টিলার মধ্যে দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছি | টিলার উপর উঠতে উঠতে সূর্যের সে রাঙা আলোর চেয়েও মনে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে ব্রাদার মুসলিমের গাড়ির লাইসেন্স প্লেটের ছবি যাতে হাজার সূর্যের উজ্বলতা নিয়ে জ্বল জ্বল করছে সর্ববোধ্য ইংরেজি ভাষায় লেখা "MUSLIM" কথাটা | এটা যেন কারো আর নাম নয়, একটা পুরো জাতির অকুতভয় যাত্রার গবির্ত পদধ্বনি ছড়িয়ে দিচ্ছে আমেরিকার আকাশে বাতাসে | সংখ্যা লঘিষ্ট একটি ধর্মীয় গোষ্ঠির সদস্য হিসেবে আজ আর কোনো শংকার কথা মনে হলো না | একটা গভীর প্রশান্তিতে মনটা ভরে আছে | মুসলিম হিসেবে আমি আজ খুবই গর্বিত | কোনো কষ্ট নেই , নো রিগ্রেট, নো রিগ্রেট এট অল |নিজের জন্য শুধু এই দোয়া করি আমেরিকায় ইসলামের প্রসারের এই ক্রান্তি লগ্নে আল্লাহ আমাকেও যেন ব্রাদার মুসলিমদের সাথে থাকার তৌফিক দেন |
বিষয়: বিবিধ
২২২২ বার পঠিত, ৩৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মামণির জন্য খারাপ লাগছে, কোন ক্লাসে পড়ছে ও?
মাইক রহমান এর কান্ডে হাসি চেপে রাখার উপায় নাই! এই ধরণের মুসলিম দিয়েই সমাজ প্রায় ভরে গেছে বলা যায়।
ডোনাল্ডের কথা পড়ে মনটা খুব ভালো লগলো, মাশা আল্লাহ! আল্লাহ উনার ঈমানের জযবা বাড়িয়ে দিন। এই ধরণের মুসলিমদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিন। আমীন।
পুরো লিখাটি পড়ে অনেক কিছু জানতে পারলাম , চমৎকার লিখাটি পড়ার সুযোগ করে দেয়ার জন্য জাযাকাল্লাহু খাইর! আশাকরি নিয়মিত লিখবেন।
সারারাত অস্বস্থিতে কেটেছে তাড়াহুড়ায় কি লিখতে কি লিখলাম ভেবে!
ব্রাদার মুস্লিমদের সাথে থাকার তৌফিক কামনা করি।
যায়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জেতার জন্য দরকার ১২৩৭ ডেলিগেট। সমস্ত ষ্টেটে জিতলেও তার তার ডেলিগেট সংখ্যা দাড়াবে ১০৪৯। এরপরও তার দরকার ১৮৮। একমাএ ভাগ্য নির্ধারন হবে রিপাবলিকান কনভেশনে ডেলিগেটদের ভোটের মাধ্যমে। ৪০% রিপাবলিকান সাপোর্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পে কে। সিনেট ও কংগ্রেস সবাই ডোনাল্ড ট্রাম্পে কে সাপোর্ট করে না।ট্রাম্পকে রুখে দেওয়ার জন্য,ডেমোক্রেট ,কিছু রিপাবলিকান, হিস্পানিক, আফ্রিকান-আমেরিকান আর মুসলিমরা তো আছেই। আশা করি ট্রাম্প জিতবে না।
সুন্দর পোষ্টটির জন্য শুকরিয়া। জাযাকাল্লাহ খাইর
ব্রাদার মুসলিমদের মত কিছু সাহসী মুসলমান আছে তাই আমরা আশাবাদী ও এখনো স্বপ্ব দেখি ।
অনেক কিছু জানা হল লিখাটা পড়ে অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া ।
মুমিনদের কাজই ইসলামের সকল কাঠিন্যতা মোকাবেলা করে সামনে এগিয়ে যাওয়া।
ব্রাদার মুসলিমের সত সাহস সবার মধ্যে জেগে উঠুক এই কামনা।
লেখাটা অনেক লম্বা হয়েছে, দুই পর্বে দিলে ভালো হতো।
আল্লাহ্ আপনাদের সকল অবস্থায় হেফাজত করুন।
পোস্ট এবং সকল মন্তব্য পড়লাম,
অনেক কিছুই জানলাম ও বুঝলাম!
নিঃসন্দেহে যথার্থ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ এ মন্তব্য দুটি-
আপনি [তবুওআশাবা্দী] লিখেছেন :
|
জাযাকুমুল্লাহ...
সত্যের বিজয় অনিবার্য,
মিথ্যার বিণাশ অবশ্যম্ভাবী
In La City Hall Muslim rely
মন্তব্য করতে লগইন করুন