আল্লাহ কি সত্যিই আছেন ?

লিখেছেন লিখেছেন তবুওআশাবা্দী ২৪ জানুয়ারি, ২০১৬, ০৮:৩৪:০৮ সকাল

বেশ অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশে বিশেষ একটা ট্রেন্ড লক্ষ্য করছি| আমাদের কিছু ব্লগার ধর্মের ব্যাপারে খুবই নাখোশ | আল্লাহ আছেন কিনা তা নিয়ে খুবই গুরুগম্ভীর লিখা লিখছেন | কিছু কিছু ব্লগার বিজ্ঞানকে ব্যবহার করে আল্লাহর অস্তিত্ব অপ্রমানের নানান চেষ্টা করে যাচ্ছেন | এদের ব্যাকগ্রাউন্ড জানিনা আর তাছাড়া আল্লাহ আছেন কি নেই এ'সম্পর্কে তাদের নিজস্ব হালকা যুক্তি এসব নানা কারণেই এ নিয়ে কখনো একটা পাল্টা লেখার ইচ্ছা হয় নি | এর মধ্যে কিছুদিন হলো জনৈক ব্লগার যিনি এখন জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন তার একটা লেখা বিডি টুডে ম্যাগাজিনে পড়লাম | এখানে মজার একটা কথা লিখেছেন এই ব্লগার | তিনি লিখেছেন ধর্মের উপর তার পড়াশোনা থেকে তিনি বুঝতে পেরেছেন ধর্মের কারণে কত অন্যায়, কত হত্যা হয়েছে পৃথিবীতে | আর তা থেকেই তার ধর্মের উপর অবিশ্বাস এসেছে | এখানে মজার ব্যাপারটা হলো যে আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে | পঞ্চাশ মিলিয়ন মানুষের এই হত্যাযজ্ঞের মূল হোতা ছিল হিটলার আর তার জার্মানি | এখনো জার্মানিতে নাত্সী পার্টির প্রভাব রয়েছে | হিটলারের আর্য শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী নব্য নাত্সী পার্টি এখন সম্ভবত জার্মানির স্থানীয় নির্বাচন্গুলোতেও অংশ নেয় | আমাদের ধর্মের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিপ্লবী এই ব্লগার কিন্তু পঞ্চাশ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর মূল হোতা হিটলার আর তার দেশ জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিতে অসুবিধা বোধ করেন না | এছাড়াও ইউরোপের দেশগুলো যে প্রায় পাঁচ -সাতশ বছরব্যাপী সারা বিশ্বে কলোনিয়াল রুল চালিয়েছে তাতে যে অমানিবকতা আর হত্যার জন্য তাদের দায়ী করা যায় তত অমানবিকতা , হত্যা বা ক্ষয় ক্ষতি ধর্মীয় কারণে আধুনিক সময়েতো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসেই কখনই হয় নি | এই কারণে আমাদের এই ধর্ম বিরোধী ব্লাগারদের কোনো সমালোচনা আছে বলে দেখিনি | উন্নত দেশগুলির রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিনিময়ে তারা হয়ত সেসব দেশগুলোকে সেসব লোমহর্ষক হত্যা আর অমানবিকতা থেকে দায় মুক্তি দিয়েছেন | এদের সমস্যা শুধু ইসলাম ধর্ম নিয়ে | আমি পুরোপুরি নিশ্চিত যে এই বিপ্লবী ব্লগার বা এর সহযোগী অন্য বীর ব্লগার যারা বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন তারা কিন্তু সেসব দেশের প্রধান ধর্মের বিশ্বাসগুলোর বিরুদ্ধে বা এর সমস্যাগুলো নিয়ে এক কলমও কিছু লিখবেন না |

আমার আজকের লেখাটা এইসব ব্লগারের আল্লাহকে অপ্রমানের বৈজ্ঞানিক যুক্তিগুলো আর এ'সম্মন্ধে বর্তমান সময়ের বৈজ্ঞানিকদের ধারণা এবং অনুভবগুলো নিয়ে | আমার আজকের লেখাটা মাস্যাচুসেট ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি বা সংক্ষেপে এম এই টি (MIT)র প্রফেসর, ফিজিসিস্ট এবং নভেলিস্ট ডঃ এলান লাইটম্যানের, যিনি নিজেকে একজন এথিয়িস্ট হিসেবে পরিচয় দেন, একটা লিখার ভিত্তিতে তৈরী | মূল লিখাটি ২০১১ সালে আমেরিকার বিখ্যাত অনলাইন ম্যাগাজিন সালনে (SALON) “ Does God Exist-The case for reconciling the scientific with the divine -- and against the anti-religion of Richard Dawkins” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল | এই লেখায় ডঃ এলান লাইটম্যান, নিজে একজন এথিয়িস্ট হয়েও আল্লাহকে বর্তমানের জ্ঞান এবং টেকনোলজি দিয়ে অপ্রমানের সীমাবদ্ধতাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন |

প্রায় দশ বছর আগে (২০১১ সাল থেকে ) থেকে আমি নিয়মিত বিজ্ঞানী, এক্টর, নাট্যকারদের একটি ছোটো গ্রূপের সাথে এম আই টির একটি সুসজ্জিত কনফারেন্স রুমে আলোচনায় মিলিত হওয়া শুরু করি | আমাদের আলোচনা হত মূলত কেমন করে বিজ্ঞান এবং কলা শাখার মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে | আমাদের আলোচনার বিষয়ের বিস্তৃতি ছিল বৈজ্ঞানিক আবিস্কারের ইতিহাস থেকে মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রকৃতি এবং পদ্ধতির মত বিশাল বিষয় নিয়ে | কোনো স্থির এজেন্ডা ছাড়াই আমাদের আলোচনা শুরু হত এবং বিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা অনুভব করতাম আমরা যে কোনো একটি বিষয়ে সবাই আলোচনায় মগ্ন হয়ে গেছি |

আমাদের আলোচনার যে বিষয়টি আমাকে খুবই বিস্মিত করত তা হলো কিভাবে ধর্মের বিষয়টি আলোচনায় বার বার ফিরে ফিরে আসছে | আমাদের আলোচনার অন্যতম অংশগ্রহণকারী নাট্যকার, পরিচালক এবং এম আই টি -র নাট্য বিভাগের প্রফেসর অ্যালেন ব্রডি এ'সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, আমাদের থিয়েটার কর্মকান্ড সবসময়ই ধর্ম ভিত্তিক | আমরা সেই বিশ্বাসগুলি সম্পর্কেই থিয়েটারে বলি যেসব বিশ্বাস নিয়ে আমরা বাঁচি | এবং বিজ্ঞান হলো একবিংশ শতাব্দীর একমাত্র ধর্ম |

কিন্তু বিজ্ঞান যদি একবিংশ শতাব্দীর ধর্ম হয় তবে এখনো কেন আমরা স্বর্গ -নরক, মৃত্যু পরবর্তী জীবন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলি? গ্রূপের অন্যতম সদস্য বিগ ব্যাং তত্ত্বের স্ফীতি ভার্সনের অন্যতম পথিকৃত পদার্থবিদ এলান গুথ (Alan Guth), যার গবেষণা মহাবিশ্বের সৃষ্টির পরমুহুর্তের অর্থাত সেকেন্ডের ট্রিলিয়ন ভাগের একভাগেরও কম সময় পরে যখন t =0 ছিল তখনকার অবস্থা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে সম্প্রপ্সারিত করেছে, জীব বিজ্ঞানী ন্যান্সি হপকিন্স, যার গবেষণা জিন কিভাবে জীবিত প্রাণীর শারীরিক এবং মানসিক গঠন এবং বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করে সে সম্পর্কে আমাদের বিসতৃত ধারণা দেয় | গুথ এবং ন্যান্সির এবং আধুনিক বিজ্ঞানের এধরনের অন্যান্য গবেষণা আর আবিস্কারগুলি কি ঈশ্বর ধারনাটিকে ঘরের এক কোনায় ঠেলে দিয়ে কোনঠাসা করে অথবা পুরোপুরি অনাবশ্যক ফেলেনি ? বিভিন্ন জরিপের ফলাফল কিন্তু তা বলে না | এখনো তিন চতুর্থাংশ আমেরিকান মিরাকল, পরকাল আর ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, অবিশ্বাসী বিজ্ঞানী, একাডেমিকদের ইদানিং প্রকাশিত অসংখ্য বই এবং ইশ্বরের বিরোধিতা সত্বেও বিজ্ঞানের পাশাপাশি এখনো ধর্ম সভ্যতার অন্যতম নিয়ামক হয়ে রয়েছে | আমাদের বিজ্ঞানী আর শিল্পী নিয়ে গঠিত ছোটো গ্রূপ সদস্যদের কাছে মানুষের এই দ্বান্দ্বিক পারস্পরিক বিশ্বাসগুলো, এবং মানুষের পৃথিবীকে বোঝার বহুমুখী চেষ্টা আমাদের সবসময়ই বিস্ময়ের বিষয় ছিল | এবংএটাও আমাদের বিস্ময় সৃষ্টি করে যে কেমন করে বিজ্ঞান এবং ধর্ম আমাদের মনে সহাবস্থান করতে পারে | একজন বিজ্ঞানী এবং মানব্সেবি হিসেবে আমি সব সময়ই জ্ঞান অর্জনের বিভিন্ন দাবিগুলোর সঠিকতা উপলব্ধি করার সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি | কিন্তু সবশেষে আমার চূড়ান্ত এমন একটি উপলব্ধি হয়েছে যাতে ব্যক্তির ধর্ম বিশ্বাস এবং বিজ্ঞান সহাবস্থান করতে পারে |

পৃথিবীর মূল ধর্মগুলো যেমন খৃস্টানিজম,জুডাইজম, ইসলাম, হিন্দুইজম প্রতিটিই একজন ইন্টারভেনশনিস্ট ঈশ্বরের দাবি করে যিনি প্রাকৃতিক নিয়মের উপর ক্ষমতাধারী যা বিজ্ঞানের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক |শুদ্ধ যুক্তি দিয়ে একজন ব্যক্তি এ'পর্যন্তই যেতে পারে | মহাবিশ্ব সৃষ্টির পর প্রাকৃতিক নিয়ম কানুনের উপর কোনো হাত না দিয়ে বসে সময় কাটান এমন একজন ঈশ্বরের ধারণা ছাড়া আর যে কোনো ঈশ্বরের ধারনায় বিজ্ঞানের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক |

ঈশ্বর এবং বিজ্ঞানের সহাবস্থানের বিষয়ের সমস্যাটি আসলে আরো জটিল | বিজ্ঞানী নন কিন্তু ধর্মপরায়ণ মানুষের অধিকাংশই বিজ্ঞানের মূল্যবোধগুলির সাথে একমত | এবং কিছু বৈজ্ঞানিক আবার বিশ্বাস করেন যে কিছু কিছু বিষয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি দিয়ে ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ করা যায় না বা যেগুলো এমনকি বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত নিয়ম নীতির সাথে সাংঘর্ষিক |

জীবিত বিজ্ঞানীদের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যা আন্তরিক ভাবে অর্থডক্স অর্থেই ধর্মে বিশ্বাসী | আমেরিকার হিউস্টনের বিখ্যাত রাইস ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানী এলিন হায়ওয়ার্ড একল্যান্ড পরিচালিত আমেরিকার এলিট ইউনিভার্সিটি গুলোর ১৭০০ জন বিজ্ঞানীর উপর একটি জরিপে দেখা যায় এদের শতকরা ২৫ ভাগ ঈশ্বরে বিশ্বাসী | ফ্রান্সিস কলিন্স, ১৯৯৩ - ২০০৮ পর্যন্ত বিখ্যাত "National Human Genome Research Institute (NHGRI) প্রজেক্টের ডিরেক্টর এবং মানব জিন নিয়ে গবেষনায় অবদানের জন্য ২০০৭ সালে আমেরিকার সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব "প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম " প্রাপ্ত, 'নিউজউইক' -এর সাথে একটি সাক্ষাত্কারে বলেন যে “সাতাশ বছর বয়স থেকে আমি বিশ্বাসী আর তখন থেকে আমি কখনো সমস্যার মুখোমুখি হইনি আমার বিশ্বাস এবং বিজ্ঞানের কারণে... আপনি যদি আপনার অনুসন্ধিত্সাকে সীমাবদ্ধ করেন এমন সব প্রশ্নের মধ্যে যা শুধু বিজ্ঞানের পক্ষে করা বা উত্তর দেওয়া সম্ভব তবে আপননাকে এমন অনেক বিষয়ই ত্যাগ করতে হবে যা আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি | যেমন কেন আমরা এখানে, জীবনের অর্থ কি, ঈশ্বর আছেন কি না ইত্যাদি | এসবের কোনটাই বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন নয়”| এম এই টি-র নিউক্লিয়ার সাইন্স এবং ইঞ্জিনীয়ারিং বিভাগের প্রফেসর আয়ান হাচিনসন, আল্যান লাইটম্যানকে বলেন যে মহাবিশ্বের অস্তিত্ব আছে ঈশ্বরের কারণেই | যে সমস্ত মৌল নীতিকে আমরা 'প্রাকৃতিক নিয়ম' বলি সেসবই ঈশ্বর রক্ষনাবেক্ষণ করেন এবং সেসবই আমাদের কাছে স্বাভাবিক (নরমাল ) আচরণের উধাহরণ যা ঈশ্বর বিশ্বের জন্য আদেশ করেছেন | আম মনে করি 'মিরাকল' এখনো ঘটে এবং ইতিহাসে এর অনেক উদহারণই আছে | এখানে প্রফেসর হাচিনসন জেসাস ক্রাইস্টের রিজারেক্শনের উধাহরণ দিয়েছেন (আমি এই জায়গায় রিজারেক্শনের নয় কিন্তু তাঁর ফিরে আসার ব্যাপারটি কে ভেবেছি) যে এই ঘটনা ব্যাখ্যার কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিরই অবকাশ নেই " | হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির 'অ্যাস্ট্রোনমি এবং হিস্ট্রি অফ সাইন্স' বিভাগের প্রফেসর এমিরিটাস ওয়েন গিংরিচ (Owen Gingerich) বিশ্বাস করেন যে " আমাদের এই দৃশ্যমান বিশ্ব কোনো অতিন্দ্রীয় বা স্পিরিচুয়াল একটি বিশ্বের অংশ যার সীমানায় মিরাকলগুলো ঘটে | পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক দিকটি গুরুত্বপূর্ণ | কিন্তু শুধু সব কিছু অনুসন্ধানেই বিজ্ঞানের প্রয়োগ করা যায় না | এমনকি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিত্সাতেও আমরা অনেক কিছুই সতসিদ্ধ বলে ধরে নেই | বিশ্বাস হলো একটি 'আশা' , এটা কোনো প্রমানের অপেক্ষা রাখেনা” |

গভীর ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী বৈজ্ঞানিক কলিন্স, হাচিনসন এবং গিংরিচ তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং বিজ্ঞানের মধ্যে সমন্বয় করেছেন একজন ইন্টারভেন্শনিস্ট ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে এমন একটি বিশ্বদর্শনের (worldview ) মাধ্যমে যার অধীনে পদার্থবিদ্যা, জীব বিজ্ঞান, রসায়নের নিয়মগুলো আপাত: স্বাধীনভাবে দৃশ্যমান জগতের কার্যক্রমগুলো নিয়ন্ত্রণ করে | তাদের এই দর্শন অবশ্যই গুরুত্বের সাথে আলোচনার দাবি রাখে |যদিও মাঝে মাঝে ঈশ্বর এই আপাত ব্যতিক্রমহীন এই সমস্ত প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটান এবং এই অতিন্দ্রীয় ঘটনাগুলো বৈজ্ঞানিক নিয়মাবলী বা পদ্ধতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না |

একজন নিরীশ্বরবাদী হিসেবে আমি বিজ্ঞানের একটি কেন্দ্রীয় মতাদর্শ (সেন্ট্রাল ডক্টরিন্ অফ সাইন্স) অনুমোদন করি |যদিও এটি বর্তমানে আমার পক্ষে প্রমান করা অসম্ভব | আমি এমন কোনো অস্তিত্ব বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা যে বা যিনি বস্তু ও এনার্জি জগতের বাইরে অবস্থান করতে পারেন এমনকি তিনি প্রাকৃতিক জগতের কাজে প্রভাব বিস্তারে নিস্ক্রিয় হলেও | কিন্তু আমি কলিন্স, হাচিনসন এবং গিন্গ্রিচের সাথে একমত যে জ্ঞান অর্জনের জন্য বিজ্ঞানই শুধু একমাত্র পথ নয় | অর্থাৎ এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং আকর্ষনীয় প্রশ্ন আছে যার উত্তর টেস্ট টিউব এবং সমীকরণের ক্ষমতার বাইরে | বিজ্ঞান সবসময়ই দৃঢ় কার্যকরণ সুত্রে আবদ্ধ সমস্যাগুলোর (well posed problem) গবেষণা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে | অবশ্যই, কলা শাখার বিসতৃত একটি ক্ষেত্র যা ব্যক্তির আত্ত্বিক প্রশ্নগুলোর সাথে জড়িত সেগুলো বিজ্ঞানের সুত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না |

ডঃ এলান লাইটম্যান বিশ্বাস করেন এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলো আমরা বিশ্বাস দিয়েই গ্রহণ করি কোনো প্রাকৃতিক প্রমান ছাড়াই, অনেক ক্ষেত্রে প্রমানের কোনো পদ্ধতি ছাড়াই | যেমন আমরা কখনো কোনো ভাবেই প্রমান করতে পারি না কোন পরিস্থিতিতে কোনো মানুষ তার সন্তানের জন্য নিজের জীবন উত্সর্গ করতে পারে ? আমরা প্রমান করতে পারিনা আমাদের জীবনের অর্থ কি বা আদৌ এর কোনো অর্থ আছে কি না | এসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা তথ্য সংগ্রহ করতে পারি কিন্তু দিনের শেষে আমরা সিদ্ধান্ত নেবার কোনো পদ্ধতি সম্পর্কেই একমত হতে পারি না যেমন একজন পদার্থবিজ্ঞানী জানে এক ফুট লম্বা একটি পেন্ডুলাম ঠিক কত সেকেন্ডে পুরো একবার ঘুরবে | এছাড়া এমন প্রশ্নও আছে যেগুলোর হয়ত সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর আছে কিন্তু আমরা কখনো হয়তো তা জানতে পারব না | ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি না সম্ভবত তেমন একটি প্রশ্ন | মানুষ হিসেবে আমাদের কি উত্তরহীন কিছু প্রশ্ন থাকবে না যেমন আছে সুনির্দিষ্ট উত্তরের প্রশ্ন ?

সাম্প্রতিক কালে কসমোলোজি, বায়োলজি, বিবর্তন তত্বের বিকাশের ভিত্তিতে কিছু বিজ্ঞানী, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলেন ব্রিটিশ বিবর্তনবাদী বায়োলজিস্ট রিচার্ড ডকিন্স,বিজ্ঞানকে ব্যবহার করেছেন ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অসার প্রমান করতে | তার বহুল পঠিত "ঈশ্বর বিভ্রান্তি" (The God Delusion) বইটিতে ডকিন্স আধুনিক জীববিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, বিবর্তনবাদ তত্ত্ব, এবং পরিসংখ্যান ব্যবহার করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে দুটি যুক্তি খন্ডনের চেষ্টা করেন: প্রথমত, বিশ্ব সৃষ্টির পেছনে রয়েছে একটি অসীম বুদ্ধিমান অস্তিত্ব এবং তার বুদ্ধিদীপ্ত নক্সা ( ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন); দ্বিতীয়ত, শুধুমাত্র ঈশ্বরের কাজ এবং ইচ্ছাই একজন মানুষের নৈতিকতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে এর বাইরে অন্য কোনো কিছু দিয়েই একজন মানুষের প্রয়োজনে অন্য মানুষের এগিয়ে আসার বা সাহায্য করার প্রবণতাকে ব্যাখা করা যায় না|

ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে প্রথমোক্ত যুক্তি খন্ডন করে ডঃ ডকিন্স পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন এই বলে আমাদের গ্যালাক্সিতে জানা মতেই বিলিয়নরও বেশি সোলার সিস্টেম রয়েছে এবং গ্রহগুলো তাদের নিজস্ব কেন্দ্রীয় নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে নান দূরত্বে থেকে ঘুরছে | এই বিলিয়ন গ্যালাক্সির সোলার সিস্টেমে অধিকাংশ গ্রহই কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের নানান দুরুত্ব থেকে একে প্রদক্ষিন করছে | কিন্তু বেশির ভাগ গ্রহই সঠিক দুরুত্ব থেকে কেন্দ্রীয় নক্ষত্রকে প্রদক্ষিন করছে না যা সেসব গ্রহে প্রাণ সৃষ্টির মূল উপাদান তরল পানি তৈরী করতে পারে | খুবই কম ক্ষেত্রেই এই দূরত্ব সঠিক | আর আমরা তেমনি একটি গ্রহে বসবাস করি | আমাদের পৃথিবীও যদি সূর্য থেকে সঠিক দূরত্বে না থাকত তবে আমরাও এখানে থাকতাম না | দ্বিতীয় যুক্তির বিরুদ্ধে ডঃ ডকিন্সের বক্তব্য হলো আমাদের নৈতিকতা আর পরার্থপরতার প্রবৃত্তিগুলো প্রাকৃতিক নির্বাচন, ব্যক্তির জিন থেকে আসতে পারে কোনো ঈশ্বরের ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন ছাড়াই | মজার ব্যাপার হলো যদিও ডঃ ডকিন্স ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমান করেছেন বলেই দাবি করেন কিন্ত তার তার বইয়ের একটি অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন "কেন প্রায় নিশ্চিত ভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই" (Why There Almost Certainly Is No God) |

রিচার্ড ডকিন্সের যুক্তিগুলো সুচিন্তিত বলে মনে করেও এলান লাইটম্যান বলেছেন আমি মনেকরি ডঃ ডকিন্স স্বীকার করবেন যে কোনো যুক্তিকে অপ্রমানের চেষ্টা করে কোনো পরিকল্পনা প্রস্তাবই সেই যুক্তিকে অপ্রমান করে না |বিজ্ঞান কখনই জানতে পারবে না ঠিক কি বা কোন কারণ আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে | এমনকি কাল যদি আমরা দেখি আরেকটি মহাবিশ্ব আমাদের মহাবিশ্ব থেকে সৃষ্টি হয়েছে, জ্যোতির্বিদ্যার কিছু তত্ব অনুযায়ী যা সম্ভব, তবুও আমরা কখনো জানতে পারব না কি বা কে আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছিল | যতক্ষণ পর্যন্ত ঈশ্বর সমসাময়িক মহাবিশ্বের কর্মকান্ডে এমন ভাবে হস্তক্ষেপ না করছেন যা প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটায় ততক্ষণ পর্যন্ত বিজ্ঞানের পক্ষে কোনো ভাবেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত জানা সম্ভব নয় |

ডকিন্সের যে কথাগুলো আমাকে বিব্রত করে তা হলো তার ধর্মকে এবং ধর্মীয় অনুভুতিকে পুরোপুরি ভাবে অস্বীকার করা | আমি মনে করি ধর্ম সম্পর্কে ডকিন্সের ধারণা সীমিত | বিজ্ঞানের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক এমন যে কোনো কিছুকে আমি সবার আগে অভিযুক্ত করি | কিন্তু আমি আগেই বলেছি যে এমন কিছু বিষয় আমরা বিশ্বাস করি যাতে বিজ্ঞানের পদ্ধতিতে বিচারযোগ্য নয় | বিশ্বাস, এর সর্ব বিসতৃতো অর্থে , শুধু ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানা বা বিজ্ঞানের নিয়মাবলী গুলোর সাথে দ্বিমত পোষণ করার মধ্যেই সীমিত নয় | বিশ্বাস হলো যে জিনিসগুলো আমরা পুরোপুরি বুঝতেও পারিনা সেসব বিষয়ের কাছে আমাদের নিঃশর্ত আত্ম সমর্পর্নের ইচ্ছা | বিশ্বাস হলো আমাদের নিজেদের চেয়ে মহত্তর কিছুর উপর নিঃশর্ত নির্ভর করা |

ডকিন্সের লেখায় ছেড়া ছেড়া ভাবে একথার সুরও পাওয়া যায় যে ধর্ম হলো সভ্যতার একটি ধ্বংশাত্মক শক্তি | এটা সত্যি যে মানুষ অনেক সময়ই ধর্মের নাম অন্য মানুষের ক্ষতির কারণ হয়েছে | কিন্তু বিজ্ঞানওতো সেই একই অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে বিশেষ করে বিংশ শতাব্দিতে জীববিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী আর রসায়নবিদদের দ্বারা তৈরী মারনাস্রের কারণে |বিজ্ঞান এবং ধর্ম উভয়ই মানুষের মঙ্গল এবং অমঙ্গলের জন্য একই রকম ভাবে ব্যবহত হতে পারে |মানুষ অনেক সময়ই ধর্মীয় প্রীয়নায় উদবুদ্ধ হয়ে স্কুল, হাসপাতাল তৈরী, মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করে যেমন বিজ্ঞান রোগ নিরাময়ের চিকিত্সা করে, কৃষির উন্নয়ন, এই বস্তু জগতের চাহিদা পূরণের ও সুবিধা বৃদ্ধির ,এবং যোগাযোগের উন্নয়নের চেষ্টা করে |

ডঃ অ্যালেন লাইটম্যানের লেখাটা এখানেই শেষ | এই লেখায় ডঃ লাইটম্যান ঈশ্বরের অনস্তিত্বের বিষয়ে বর্তমানে যে বিষয়গুলো আলোচনা করা হয়, সে বিষয় গুলোর বিরুদ্ধে কিছু যুক্তি তুলে ধরেছেন | এ প্রসঙ্গে একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হলো কি ভাবে বিগ ব্যাং হলো তা আমরা জানি | কিন্তু কি কারণে বিগ ব্যাংটা হলো, বিগ ব্যাঙের শক্তিগুলো কত সময় ধরে পুঞ্জিভূত হলো বা সেই বিশাল শক্তি পুঞ্জিভূত হবার আগে কত সময় ধরে আলাদা ছিল ?সেই বিশাল শক্তি ছিলই বা কোথায়? এই প্রশ্নগুলো জটিল | এর উত্তর সহজ সাধ্য নয় | তাত্ত্বিক ভাবে এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অসম্ভব | এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা জানতে পারব না কোনো দিনই | কারণ এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বিজ্ঞানের ক্ষমতার বাইরে | আমদের জ্ঞান-বিজ্ঞান সবই শুরু হয়েছে বিগ ব্যাঙের উপর ভিত্তি করে | কিন্তু বিগ ব্যাঙের আগের ঘটনাগুলো বিজ্ঞানের বিষয় নয় | এ প্রশ্নগুলো সম্পর্কে বিজ্ঞান শুধু ধারণা করতে পারে, প্রমান নয় | কারণ বিগ ব্যাং হবার আগেতো কোনো "সময়" বা "স্পেস" সৃষ্টি হয়নি | তাই কত সময় ধরে ধরে বিগ ব্যাঙের শক্তি পুঞ্জিভূত বা আলাদা ছিল, বা কোথায় ছিল এর তাত্বিক এবং তর্কাতীত উত্তর দেওয়া খুবই কঠিন | এছাড়া আরো একটা প্রশ্নও এখানে আছে সেটা হলো বিগ ব্যাঙের পর একটা প্রাকৃতিক নিয়ম তৈরী হয়, যা আমরা এখন দেখতে পাই প্রকৃতির মধ্যে | যেমন চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘরে, পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘরে ইত্যাদি | তাহলে বিগ ব্যাঙের আগে যখন সময়, স্পেস কিছুই ছিল না কোনো নিয়ম কানুনও ছিল না তখন সেই বিশাল এনার্জি কোন নিয়মে পরিচালিত হতো? কোন নিয়মেই বা পুঞ্জিভূত হলো?কেউ কি সেটা পুঞ্জিভূত করে বিগ ব্যাং ঘটিয়ে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছিল ? এই সব প্রশ্নের তর্কাতীত উত্তর না দিয়ে একজন সৃষ্টি কর্তার অস্তিত্ব অস্বিকার করা সহজ নয় | পরে অন্য কোনো লেখায় ডঃ ডকিন্সের আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বিকার করে লেখাগুলোর অসামঞ্জস্য নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছে রইলো |

বিষয়: বিবিধ

৩৫৮১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

357558
২৪ জানুয়ারি ২০১৬ দুপুর ১২:১২
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
আসলে বিজ্ঞান দিয়ে আল্লাহর অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব প্রমান করার চেষ্টাটাই বিজ্ঞান এর আওতার বাইরে।
২৪ জানুয়ারি ২০১৬ দুপুর ১২:৩৭
296663
অপি বাইদান লিখেছেন : ঠিক তাই! ৬০০ ডানার জিবরাইল ফেরেস্তার আল্লা নামক ভাইরাসের ওহি বহন করার আজগুবি কিচ্ছা কাহিনী বিজ্ঞানের আওতার বাইরে।
357779
২৭ জানুয়ারি ২০১৬ সকাল ০৮:১৮
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : রিদওয়ান কবির সবুজ: অনেক ধন্যবাদ লেখাটা পড়ার আর মন্তব্যের জন্য|
357780
২৭ জানুয়ারি ২০১৬ সকাল ০৮:২৫
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : অপি বাইদান:আপনার মন্তব্যটা ঠিক বুঝিনি|মন্তব্যটা শুধু রিদওয়ান কবির সবুজের মন্তব্যের উত্তরে প্রতি মন্তব্য হিসেবেই করলেন নাকি আমার লেখার ব্যাপারেও|যাহোক,লেখা পড়েছেন বলে ধন্যবাদ নিন|

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File