প্রিয় ব্যক্তিত্ত্ব: মা যখন প্রিয় ব্যক্তিত্ব বড় বেলায়ও

লিখেছেন লিখেছেন তবুওআশাবা্দী ০৩ জুন, ২০১৫, ০১:০৩:৪৮ দুপুর

কাউকে প্রিয় ব্যক্তিত্ব কেন বলব? নিজের পরিবারের সবাই-ই প্রিয় হয়, কিন্তু তারাই কি শুধু জীবনে সবসময় প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়? সব সময় হয়তো না | প্রিয় ব্যক্তিত্ব কাউকে বললে, তার মধ্যে কি আসলে দেখতে চাই? নিজের জীবন যাপনে, আচার ব্যবহার,দর্শনে, বিশ্বাসে প্রিয় ব্যক্তিত্বের কোনো প্রভাব কি খুজি আমরা? নাকি নিজস্ব চিন্তা,দর্শন,বা নিজের ব্যবহারিক দিকগুলো বিনির্মাণে যে সাহায্য করে সেই আমদের প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে যায়? খুবই নির্মোহ ভাবে আমি খোজার চেষ্টা করছি এর উত্তরগুলো | আমার মনে হয়েছে, আমাদের সবাইকে নিজেদের মত হয়ে উঠার পেছনে (ব্যক্তিগত বা প্রফেশনালি) যারা সবচেয়ে বেশী প্রভাবক হিসেবে কাজ করে তারাই হয়ত প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে যায় আমাদের জন্য |আমি এই দৃষ্টি কোন থেকেই আমার লেখাটা লিখছি | নানা কারণেই আমার এই আলোচনা থেকে খুব ভেবে চিন্তে আমি আমাদের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের দুরে রাখলাম | একটা কারণ শুধু বলি, এই ধর্মীয় ব্যক্তিরা যে সব কাজ করতে বলেছেন তার খানিকটা অনুসরণ করতে পারলেও আমার আখিরাতের কল্যাণ আল্লাহ নিশ্চিত করে দিতেন | আমি এতই অযোগ্য মানুষ যে তাদের অনুসরণে বেশির ভার সময়ই ব্যর্থ হই | আমার এই স্বল্প যোগ্যতায় তাদের মূল্যায়নের কোনো ক্ষমতাই আমার নেই এটা মেনে নিয়ে আমার লেখাটা শুরু করলাম |

মা কখন প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়? শিশুকালেতো সবারই প্রিয় মানুষ্ মা-ই হবে| কিন্তু বড় বেলায়? তখনও কি মা প্রিয় ব্যক্তিত্ব থাকে সবার? যখন হাই স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে দেশের নামী- দামী সব মানুষগুলো কে দেখছি চোখের সামনেই প্রতিদিন? বা টেলিভিশনে দ্যাখা মানুষগুলোকে যখন নিজের পাশে দেখেছি ? অথবা বিদেশে পড়তে এসে নিজের ইউনিভার্সিটিতে কাছ থেকে যখন কোনো নোবেল লরিয়টকে দেখেছি বা কোনো নোবেল লরিয়টের সাথে যখন প্রায় ঘন্টাব্যাপীকথা বলার অপার্থিব সুযোগ পেয়েছি সেই তন্দ্রাহত অনুভুতির পরেও বাংলাদেশে থাকা মা কি কারো প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে থাকতে পারে কখনও?

ঢাকা কলেজে পড়ার সময় আমাদের বাংলা পড়াতেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার | স্যারকে এখন কত মানুষ চেনে আমি জানিনা (আমি জানি স্যার খুবই সন্মানিত মানুষ দেশে) কিন্তু আমরা যখন কলেজে পরতাম তখন সারা দেশের মানুষই স্যারকে চিনত কারণ বিটিভিতে তার উপস্হাপিত জনপ্রিয় "সপ্তবর্ণা" অনুষ্ঠানের জন্য | এখনো মনে হয় বিটিভিতে ঈদের দিন "আনন্দমেলা" অনুষ্ঠানটি হয় | এই আনন্দমেলা খুব সম্ভবত প্রথম শুরু হয়েছিল স্যারের উপস্থাপনা দিয়েই | স্যার ছিলেন তখনকার সবচেয়ে প্রিয় ও জনপ্রিয় উপস্থাপক এমনকি আমাদের মত ছোটো মানুষদের কাছেও | আমার ছোটো বেলার টিভির এই মহা জনপ্রিয় মানুষটাকে খুব কাছ থেকে দেখলাম, নিজের শিক্ষক হিসেবে পেলাম পুরো একটি বছর ! সেই একই রকম রসিক, তুখোর বক্তা, দেশ নিয়ে সবসময় ভাবনা চিন্তাকারী (ঢাকা কলেজে আমাদের সম্ভবত ফার্স্ট ইয়ার থেকে স্যার বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেন)| বাংলাদেশে এখন ভালো মানুষের আকাল | যাদের ফটো দেখি আমরা টিভিতে, নিউজ পেপারে, সাহিত্তের পাতায় যারা অগ্রগামী হয়ে নীতি ন্যায়ের ফুল ফোটান কবিতা গল্পে, সব্যসাচী বলে নাম কেনেন তাদের কত সহজে কত কম দামে বিক্রি হয়ে যেতে প্রতিদিনই দেখছি! এর মধ্যে খুব কাছে থেকে দেখা দেশের ভবিষ্যত জেনারেশন তৈরির কাজে অক্লান্ত কাজ করে যাওয়া আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ এখনো প্রেরণা দেয় |

বিদেশে পড়তে আসার জন্য আমি আমেরিকার একটি মাত্র ইউনিভার্সিটিতে- পেন্সিলভ্যানিয়া স্টেটের পিটসবার্গের কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটিতে অ্যাডমিশনের জন্য এপলাই করেছিলাম | সেই ইউনিভার্সিটিতে পড়াতেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরুস্কার পাওয়া প্রফেসর হার্বার্ট সাইমন | ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তার নোবেল জয়ী বই "অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিহেভিয়ার" পরে কি যে মুগ্ধ হলাম ! পড়ার বই পরে কেউ এত মুগ্ধ হয় কখন ! ঢাকা ইউনিভার্সিটি অনার্স পরার সময় থেকেই আমার ঝোক প্রফেসর সাইমনের তত্ত্বটা আমার পি এইচ ডি থিসিসের তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরীতে ব্যবহার করবো | কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটির "রিচার্ড কিং মেলন প্রফেসর" ড: সাইমন একধারে ছিলেন পলিটিকাল সায়েন্টিস্ট , ইকনমিস্ট, সোসিওলজিস্ট, সাইকোলজিস্ট, কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট | বিংশ শতাব্দির অন্যতম প্রভাবশালী সামাজিক বিজ্ঞানী হিসেবে ড: সাইমনকে বিবেচনা করা হয় |তার রিসার্চের বিষয় ছিল কগনিটিভ সাইকোলোজী,কগনিটিভ সাইন্স, কম্পিউটার সাইন্স, পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ইকোনমিক্স, ম্যানেজমেন্ট, ফিলোসফি অফ সাইন্স, সোসিওলোজী, পলিটিকাল সাইন্স, ইউনিফাইড ডিসিশন মেকিং স্টাডি | তাঁর রিসার্চ আর্টিকল আর পাবলিশড বই সব মিলে প্রায় হাজার খানেক- যা একটি অচিন্তনীয় সংখ্যা (একাডেমিক আর্টিকল হিসেবে) | আধুনিক বিজ্ঞান শিক্ষার অনেকগুলো শাখার- আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স, ইন্ফর্মাসন প্রসেসিং, ডিসিশন মেকিং, অর্গানাইজেশন বিহেভিয়র এগুলোর অন্যতম ফাউনডিং ফাদার হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা হয়| আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টা কি ? একটা উধাহরণ দেই| গুগুলে কিছু একটা লিখে সার্চ দিলেই আপনার কম্পিউটার ঠিক সেই জিনিসটার সম্পর্কে সব তথ্য বের করে আপনাকে জানায় | কম্পিউটারের এই ইন্তালিজেন্সেটাই বা সক্ষমতাটাই হলো আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স | এই বিষয়টা আবিস্কারের প্রধান ব্যক্তিত্ব হলেন প্রফেসর সাইমন | আমার মত আপনার জীবনকেও প্রফেসর সাইমনের কাজ নিশ্চিত ভাবেই প্রভাবিত করেছে, তাই না ?

অনেক দিন আগে তুষার ঢাকা শীতের এক সকালে আমার জীবন শুরু হয়েছিল কার্নেগী মেলন ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েট প্রোগ্রামে ছাত্র হিসেবে | প্রথম সেমিস্টারের মাঝামাঝি সময়ে একদিন আমার প্রোগ্রাম ডিরেক্টর ড: হ্যারি ফাউল্ক প্রফেসর সাইমনের সাথে এপয়েনমেন্টের ব্যবস্থা করে দিলেন | আমার একাডেমিক ডিসিপ্লিনের স্বপ্নের মানুষ্ প্রফেসর সাইমনের সাথে দ্যাখা হবে! সেই কবে প্রথম ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র থাকা অবস্থা থেকে স্বপ্ন দেখেছি প্রফেসর সাইমনের সাথে সুযোগ হলে কোনো দিন দ্যাখা করবো! চান্স অফ দা লাইফ টাইম! জীবনে প্রথমবারের মতো আমি নিজস্ব ফটোগ্রাফার নিয়োগ করলাম|আমার প্রোগ্রামের ছাত্র ও বন্ধু ইন্দোনেশিয়া গভের্নমেন্টের কর্মকর্তা মাডিয়া গামা আমার ফটোগ্রাফার হয়ে যাবে| বাসায় গিয়ে স্যুট তাই পরে স্কুলে এসে দেখি মাডিয়াও চলে এসেছে|আমার ক্যামেরাটা ওর হাতে দিয়ে দুজন রওনা হলাম| এক ঘোরের মধ্যেই প্রফেসর সাইমনের পার্সোনাল সেক্রেটারির রুমে পৌছে নিজের পরিচয় দিলাম|কিছক্ষন পর প্রফেসর সাইমনের রুম থেকে সেক্রেটারি এসে আমাদের ভিতরে যেতে বলল| এক অন্তহীন ঘোরের মধ্যেই হ্যান্ড শেক করে নিজের পরিচয় দিলাম|মাডিয়াকে পরিচয় করিয়ে দিলাম| আমার কাছে হাতে লিখা আমার নিজের কতগুলো তাত্ত্বিক প্রশ্ন ছিল তার বিখ্যাত “Rational Decision Making Model” প্রাচ্যের দেশগুলোতে, বিশেষ করে ইসলামিক আইনে পরিচালিত দেশ গুলোতে, প্রয়োগের সমস্যা সম্পর্কে|সেগুলো তাকে একে একে জিগ্যেস করলাম|আমার মত একজন নবিশ ছাত্র, যে মাত্র ক'বছর হলো মাস্টার্স করেছে অনগ্রসর কোনো দেশের এক অখ্যাত ইউনিভার্সিটি থেকে তার প্রশ্নের উত্তরও প্রফেসর সায়মন দিলেন সময় নিয়ে|কোনো রকম বিরক্তি বা অধৈর্য প্রকাশ না করেই|আমি জানিও না কখন এক ঘন্টা কেটেছে|আমি উঠে দাড়িয়ে প্রফেসর সায়মনকে বাই বললাম|আমিই মনে হয় এই পৃথিবীরই একমাত্র মানুষ যে প্রফেসর সাইমনের রুম থেকে প্রফেসর সায়মন থাকার অনুরোধ করার পরও চলে এলাম|দরজায় দাড়িয়ে উনি আমাকে বললেন, তোমার আর্গুমেন্টাই ঠিক|আমার theory শুধু আমেরিকার অর্গানাইজেশন সম্পর্কে প্রযোজ্য|এটা প্রাচ্চ্যের কোনো দেশ বিশেষ ভাবে ইসলামিক আইনে পরিচালিত কোনো দেশের অর্গানাইজেশন সম্পর্কে প্রযোজ্য হবে না| এক ঘোরের মধ্যেই প্রফেসর সাইমনের রুমে গিয়ে ছিলাম, আবার এক ঘোরের মধ্যেই সেখান থেকে ফিরে এলাম|পরের দিন স্কুলে এসে দেখি সবাই কেমন করে যেন আমার দিকে তাকাচ্ছে! ওই এক এপয়েন্টমেন্টের কারণেই আমি খুব পরিচিত হয়ে গেলাম আমার স্কুলে! এতদিন পরও সেদিনের প্রফেসর সাইমনের সাথে এপয়েন্টমেন্টের কথা আমর পরিস্কার মনে আছে| আমার একাডেমিক কাজে, রিসার্চগুলোর বিষয়ে তার প্রভাব এখনো অনেক|

স্কুল কলেজ, ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে এলাম কবেই| স্বপ্ন ছিল যে আমেরিকার কোনো ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করবো পি এইচ ডির, সেটাও আল্লাহ পূরণ করেছেন|এতদিন পেরিয়ে আসার পথে কত মানুষের সাথেই না দ্যাখা আর পরিচয় হলো-দেশ বরেণ্য থেকে বিশ্ব বরেণ্য|তারপরও আমার আম্মা আমার কাছে এখনো হয়ে রইলেন সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবেই|এখন বলি, কেন| আমার নানা ছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ফার্স্ট ব্যাচের ছাত্র| ডাক্তারি পাশ করে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের চাকুরে ছিলেন জীবনের বড় একটা সময় পাকিস্থান-ভারত ভাগের আগে|আমার নানী ছিলেন বেশ পড়ুয়া স্বভাবের মহিলা| নিউজ পেপার এত আগ্রহের সাথে পড়তে আমার নানির বয়সী কাউকে আমার ছোটো বেলায় আমি দেখিনি| নানির বাবার ফ্যামিলি ছিল খুবই পড়াশোনা জানা| আমার নানির একমাত্র ভাই সেই পঞ্চাশ দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন| ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে ওখানেই চাকুরী করে স্থায়ী হয়েছেন|নানা নানির কারণেই খুবই পরিশীলিত একটি পারিবারিক সংস্কৃতির মধ্যে বড় হয়েছেন আম্মা| সেই পরিশীলিত পারিবারিক আবহের প্রকাশ হয়েছিল ছিল আম্মার চরিত্রে অনেক ভাবেই |

আম্মা ভীষণ পড়তে পছন্দ করতেন |আমার প্রথম শিক্ষক হলেন আমার আম্মা |আমি এখনো চোখ বুঝলেই দেখতে পাই প্রথম সে দিনটার ছবি-সেদিনের সকালে আমাদের একতলা বাসার ড্রয়িং রুমে আম্মা আমাকে লিখা শেখাচ্ছেন|আমার পড়ার অভ্যেসও তৈরী করে দিয়েছেন আম্মা|নিজে যেমন পরতেন তেমন লিখতেনও | বিয়ের আগে থেকেই বেগমের ঈদ সংখ্যায় গল্প কবিতা লিখতেন|ঢাকার তথা বাংলাদেশেরই অন্যতম সেরা স্কুল বি এ এফ শাহীন স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষকদের মধ্যে আম্মা একজন|আম্মাকে দেখেই আমার বই পড়ার অভ্যেস গড়ে উঠে|আম্মার গড়ে দেয়াএই অভ্যেস গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নেয় আমার এখনকার আমি উঠার ক্ষেত্রে|আমাকে ইউনিভার্সিটি টিচিং এর ক্যারিয়ার বেছে নেবার পেছনে আম্মার প্রভাব অনেক|আমার বাইরে পড়তে আসার এক বিরাট অনুপ্রেরণা আমার আম্মা|নিজে খুব আলোকিত ঘরে বড় হয়েছেন তাই নিজের ছেলে মেয়েদেরও শিক্ষার আলোকে আলোকিত করতে সব ধরনের ত্যাগ স্বীকার করতেই রাজি ছিলেন | আমার মত ঘরকুনো মানুষ সে সাত সাগর পেরিয়ে আমেরিকায় পি এইচ ডি করতে এলো সেটা আমার আম্মার আলোকিত মন মানসিকতার প্রভাবেই |

ভীষণ ধৈর্য ছিল আম্মার | নিজের সুবিধা অসুবিধার কথা কখনই বলতেন না | চুপ চাপ নিজের কাজটা করতেই বেশি পছন্দ করতেন | আমাদের ভাই বোনদের যত কথা সব আমরা বলতাম আম্মার কাছেই | আমাদের সব চাহিদা, আবদার আম্মারই শুনতে হতো | আমার এমন একদিনের কথাও মনে হয়না যে আমাদের প্রবলেমের কথা শুনে আম্মা রাগ করেছেন |আম্মার এই গুনটা সবসময়ই আমি নিজের মধ্যে পেতে চেয়েছি | আম্মার খুব কাছে কাছে থেকেছি সবসময় কিন্তু এই গুনটা এখনো রপ্ত করতে পারিনি |নানা কারণে আমরা এর ওর সমালোচনা করি | কিন্তু খুবই মার্জিত ছিলেন কথা বার্তায় আম্মা | মানুষকে নিয়ে খুব বেশি কথা বলতে পছন্দ করতেন না | এই বিষয়টা আমি খুব মনে করতে পারিনা যে আম্মা কারো সমালোচনা করছেন | আমদের অনেক কাজ পছন্দ না হলে কাছের আত্বীয় স্বজনরাও আম্মাকে বলত | কিন্তু এর উত্তরে আমি কোনো দিন শুনিনি আম্মা অন্য কারো ছেলে মেয়েদের নিয়ে সমালোচনার ভাষায় কোনো কথা বলেছেন |

আম্মার যে গুনটার জন্য মাঝে মাঝে তাঁকে মহামানবের মত মনে হয় আমার সেটা হলো তার মানুষকে আদর অপ্প্যায়ন করার ক্ষমতা|বেড়াতে এসে কেউ একদিন রাতে থেকেছে আমাদের বাসায় কিন্তু পোলাউ কোর্মা(লিটারেলি)খায়নি এটা কখনই হয় নি|আম্মার এই ক্ষমতা আমার কাছে এখনো অসাধাহরণ মনে হয়| আমার মনে আছে আমি তখন খুবই ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়ি|নারায়নগঞ্জে থাকতাম আব্বার চাকুরী করতেন ওখানে|প্রতি বৃহস্পতিবার ছিল হাট বার|আব্বা ওই একদিন পিয়ন নিয়ে নিজেই বাজারে যেতেন |সপ্তাহের মাছ গোশতের কেনা কাটা সেদিনই আব্বা করতেন নিজেই দেখে|প্রতি বৃহস্পতিবার আমাদের বাসায় সেই হাটের দিন রাতে আব্বা একজন ফকিরকে খাওয়াতেন|আম্মাকে সবসময় দেখেছি বৃহস্পতিবারে সেই ফকিরের জন্য রান্নাটাও নিজে তদারক করতেন|রাতে নিজে হাতে হাড়ি থেকে তরকারিগুলো বাটিতে সাজিয়ে দিতেন|বাসার কাজের মানুষ বা আমরাও খাবারগুলো মাঝে মাঝে পরিবেশন করতাম| আমদের মিলের মসজিদের ছোটো হুজুর সপ্তাহে একদিন দুপুরে আমাদের বাসায় খেতে আসতেন| তখনও একই ভাবে যত্ন করে আম্মা সেই খাবার রান্না করতেন|আমদের কাজিনরা সবাই সবসময়ই আমদের বাসায় এসে থাকতে চাইতেন আর বলতেন এই বাসা সবসময়ই তাদের নিজেদের বাসার মতই মনে হয়|এটা আম্মার যত্নের জন্যই বলতেন|

আম্মার আরেকটা অভ্যেস আমার কাছে এখনো রহস্য হয়েই আছে|নিজে বড় হয়েছেন খুবই স্বচ্ছল একটা ঘরে |নিজের ফ্যামিলিতেও অস্বচ্ছলতা ছিল না|কিন্তু নিজের পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারে ছিলেন খুবই সাদাসিদে, খুবই সাধাহরণ|আম্মার দামী সারিগুলো ওয়ার্ডরোবেই থাকত বেশি সময়|আমার মনে আছে যখন ছোটো খালা ঢাকা ইউনিভার্সিটি পড়তেন তখন মাঝে মাঝেই উইক এন্ডে বাসায় বেড়াতে এলে আম্মার শাড়ি নিয়ে যেতেন পরার জন্য|আম্মার ব্যক্তি জীবনের এই গুনটা এখনো আয়ত্ব করার চেষ্টা করে যাচ্ছি|জানি না তার মত আদৌ কোনদিন হতে পারব কি না|খুব কাছে থেকে সবসময়ই দেখেছি বলে অনেক সময়ই ধরতে পারিনি আম্মার গুনগুলো, মনে হয়েছে এগুলোতো এমনি হওয়া উচিত সবার|কিন্তু এখন বড় হয়ে যখন ভাবি আম্মার গুণগুলোর কথা তখন আম্মাকে আর সাধাহরণ কোনো মানুষ মনে হয় না-মনে হয় অন্য গ্রহের |আমেরিকার যে শহরে আমি থাকি সেখানে বাংলাদেশীর সংখ্যা বেশ|সবাই হাইলি কোয়ালিফায়েড|যে সব ফ্যামিলির সাথে আমদের পরিচয় তাদের বেশির ভাগই ডাক্তার,ইঞ্জিনিয়ার বা সাইন্টিস্ট|কিন্তু তাদের অনেককেই কাছ থেকে দেখে আমার আম্মাকে এখন আরো অন্য গ্রহের মনুষ মনে হয়|

২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আম্মা মারা গিয়েছেন হটাত হার্টের প্রবলেমের কারণে | আমার পি এইচ ডি, শেষ করার, আমেরিকার কোনো ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর কোনো কথা তাকে বলা হয় নি | কিন্তু আমি জানি এগুলো হবার পেছনে তার প্রেরণার কথা|আমাকে বাসার সবচেয়ে ছোটো ছেলে থেকে আজকের আমি বানানোর পেছনে অক্লান্ত কারিগর আমার আম্মা|মাঝে মাঝে এত ব্যস্ততার মাঝেও মনটা যেন কেমন করে -আম্মাকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে, কত কথা যে বলতে ইচ্ছে করে!কিন্তু কোনটাই পারি না| আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া যে এখন আম্মার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় যে কথাটা আমি বলতে পারি, সেই কথাটা আল্লাহ তার পবিত্র কোরানে নিজেই আমার মত সন্তানদের বলে দিয়েছেন|পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের শেষে আমিও তাই বলি - রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা, রাব্বির হামহুমা…|আম্মা আপনিকি শুনতে পাচ্ছেন আমি যে কথা বলছি আপনার সাথে ...| দিন আসে, দিন যায় |আজ একলা বসে পেছনের দিনগুলোর কথা আমি যখন ভাবি তখন মনে হয় আমার জীবনে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা না ঘটলেও আমি হয়ত এখনকার এই জায়গায় এসে পৌছুতাম|অনেক মানুষ -এমন কি আমার শিক্ষকদের অনেকে না পড়ালেও হয়তো আজকের একাডেমিক এচিভমেন্টগুলো আটকাত না| কিন্তু আমি শিওর যে আমার আম্মা না থাকলে আজ কে মানুষ হিসেবে আমি যেমন গড়ে উঠেছি তেমন হতে পারতাম না| আজ এত বড় হয়েও, জীবনে এতটা পথ পাড়ি দিয়েও এতদিন পরও তাই আম্মাই আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব হয়ে আছেন|

বিষয়: Contest_priyo

১৯৮৬ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

324339
০৩ জুন ২০১৫ দুপুর ০১:১২
নুর আয়শা আব্দুর রহিম লিখেছেন :
সুন্দর লেখা উপহার দেবার জন্য ধন্যবাদ।
০৩ জুন ২০১৫ বিকাল ০৪:৪১
266062
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : নুর আয়শা আব্দুর রহিম: অনেক ধন্যবাদ আরো একটা বড় লিখা ধৈর্য ধরে পরার জন্য |
324361
০৩ জুন ২০১৫ দুপুর ০৩:৩০
আফরা লিখেছেন : আমি আমার মামনি কে নিয়ে লিখব --- ইনশা আল্লাহ ।

লেখা অনেক সুন্দর হয়েছে ভাইয়া ।
০৩ জুন ২০১৫ বিকাল ০৪:৪৩
266063
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : আফরা:অনেক ধন্যবাদ বড় লিখাটা ধৈর্য ধরে পরার জন্য |মামনি কে নিয়ে লিখাটা এই প্রিয় প্রতিযোগিতাতেই লিখে ফেলেন|অপেক্ষায় থাকলাম |
324363
০৩ জুন ২০১৫ দুপুর ০৩:৩৩
এ,এস,ওসমান লিখেছেন : মা কথাটি সত্য হলেও
কিন্তু যেন ভাই
ইহার চেয়ে নাম যে মধু
ত্রিভুবনে নায়।

আলহামদুল্লিলাহ। ভাল লাগলো।
০৩ জুন ২০১৫ বিকাল ০৪:৪৫
266064
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : এ,এস,ওসমান:অনেক অনেক ধন্যবাদ লিখাটা পড়ার আর মন্তব্যের জন্য|
০৪ জুন ২০১৫ বিকাল ০৫:৪৬
266420
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : ত্রিভুবন শব্দের অর্থ কি ভাইয়া, এ, এস , ওসমান? Happy
324490
০৪ জুন ২০১৫ রাত ০৪:৪১
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : আসসালামুআলাইকুম!

পড়তে পড়তে আমিও ভ্রমন করে এলাম ঢাকা কলেজ থেকে শুরু করে- আমেরিকার ইউনি পর্যন্ত! খুবি সুখপাঠ্য লিখাটি পড়তে পড়তে নতুন ভাবে আবিষ্কার করলাম আমাদের মেধাবী ভাইটিকে!

আপনার মা কে নিয়ে নিয়ে লিখা অনুভূতি সত্যি মন ছুঁয়ে গেলো! অসাধারন একজন মানুষ তিনি! আল্লাহ উনার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়ে উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌসের অধিবাসী হিসেবে কবুল করে নিন!উনার সমস্ত ভালো কাজ গুলোর উত্তম প্রতিদান দান করুন! আমিন!

আল্লাহ আপনাকে দুনিয়া ও আখিরাতে কামিয়াবী করুন!আপনার পিতামাতার জন্য উত্তম সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে কবুল করে নিন!

আপনার সফলতা আন্তরিকভাবে কামনা করছি! শুভাকামনা জানবেন! Good Luck
০৪ জুন ২০১৫ সকাল ০৯:২৩
266330
তবুওআশাবা্দী লিখেছেন : প্রিয় সাদিয়া মুকিম:ওয়ালাইকুমুস সালাম| আমার নিজের খুবই ব্যক্তিগত কিছু বিষয় যা কখনো বলিনি কাউকে বা যা নিয়ে কখনই কিছু লিখিনি আগে সে'রকম কিছু ভালোলাগা, ভালোবাসা আর কষ্টের বিষয় নিয়ে লেখাটা আপনি পড়েছেন জেনে খুব ভালো লাগলো| আরো ভালো লাগলো আপনার মন্তব্য দেখে| আমেরিকাতে এসে প্রথম আমি জানলাম "মাদার্স ডে" বলতে একটা দিন এখানে সেলিব্রেট করা হয়|এখানে বাংলাদেশিরাও এই দিনটা পালন করে|মাদার্সডেটা আমি নানা কারণেই সেলিব্রেট করার সুযোগ পাইনি কখনো| মাদার'স ডেতেও আম্মাকে নিয়ে কিছু লিখতে পারিনি কখনো|এখনতো আম্মাই আর বেঁচে নেই|তাও আম্মাকে নিয়ে এই লেখাটা যে হলো তার পেছনে আপনাদের তাগাদা বা অনুপ্রেরণা যেটাই বলুন সেটা অনেকখানি|আবারও ধন্যবাদ নিন|
০৪ জুন ২০১৫ সন্ধ্যা ০৭:২০
266435
এ,এস,ওসমান লিখেছেন : লিখেছেন : ত্রিভুবন শব্দের অর্থ কি ভাইয়া, এ, এস , ওসমান? Happy

আপু ছোটকালে অনেক কষ্টে মুখস্ত করে ছিলাম কবিতাটাHappy ;Winking কখনও ত্রিভুন মানে খোজার চেষ্টা করি নি Worried Worried যদি জেনে থাকেন তবে এ ছোট ভাইকে লজ্জা না দিয়ে দয়া করে বলে দিন Praying Praying Praying
০৫ জুন ২০১৫ রাত ০৩:১১
266624
সাদিয়া মুকিম লিখেছেন : আমি নিজেও ত্রিভুবন শব্দের সঠিক অর্থের সন্ধানে আছি! সেই ইসলামী সংগিতটি শুনেছিলেন? ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়.. তখন থেকেই ত্রিভুবনের সন্ধানে! বাংলা অভিধানে পেলাম স্বর্গ, মর্ত্য আর পাতাল! যথেস্ট কনিফিউজড আমি এই অর্থ নিয়ে! তাই আপনাকেই জিজ্ঞেস করলাম এই ভেবে আপনার জানা আছে হয়তো!
Praying

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File