প্যালিষ্টিনের বিপন্ন মুসলিম , আমাদের রোজা আর আমাদের দু’য়া
লিখেছেন লিখেছেন তবুওআশাবা্দী ২৪ জুলাই, ২০১৪, ০৭:২৬:০৫ সন্ধ্যা
সতের ঘন্টার রোজাগুলোও আল্লাহর রহমতে খুব সহজই লাগছে | রোজা শুরুর আগে আমরা সবাই ভেবেছিলাম এত বড় গ্রীষ্মকালের দিনে রোজাতে হয়ত একটু কষ্ট হবে| বিশেষ করে আমাদের দুই ছেলে মেয়ে রোজাগুলো সব রাখতে পারবে কিনা এ'নিয়েই চিন্তাটা ছিল বেশি | কিন্তু এই বড় গ্রীষ্মের রোজাগুলোও সহজেই চলে যাচ্ছে একটার পর একটা | রোজার মাসটাইতো প্রায় শেষ হয়ে আসলো ! এই রোজায় প্রথম পনেরদিনের মধ্যে কুরআন শরিফ খতম করার যে নিয়ত ছিল তাও আল্লাহর ইচ্ছেয় করতে পেরেছি |আমরা দুজন মিলে দৃতীয় খতম করার যে নিয়ত করে ছিলাম তাও আলাহর ইচ্ছেয় প্রায় শেষের পথে | ইনশাআল্লাহ এই খতমটাও আশাকরি হয়ে যাবে দু'তিন দিনের মধ্যে | কোনো কিছু নিয়েই অভিযোগ করার মত কিছু ঘটেনি | কিন্তু হঠাত এই রোজার মাসের শান্তিটা নষ্ট হয়ে গেল প্যালিষ্টিনের গাজার নিরস্শ্র মানুষগুলোর উপর ইসরাইলি আর্মির কাপুরষোচিত হামলায়|
আমার সেল ফোনে আমার ছেলে মেয়ে দুজনেরই ফটো আছে |আমদের দুই ছেলেমেয়েরই পাঁচ -ছয় মাস বয়সের ফটো | যখন একা থাকি বা আমার ছেলে মেয়ে যখন স্কুলে থাকে আমি সবসময়ই দেখি ওদের ফটোগুলো | এছাড়া ওরা আমাকে ওদের ফোন থেকে কল করলেও ওদের সেই স্ক্রিন শট নেয়া ফটোগুলো ফোন স্ক্রীনে ভেসে আসে |কত বছর হলো কত হাজার বার দেখা ফটোগুলো তবুও এখনো দেখি| পুরনো হয়না কখনো | আমাদের এলবামে আরো একটা ফটো আছে | আমার মেয়েকে তার মা বুকে জাপটে ধরে রেখেছে | ফটোটা আমি বাইরে আসার পরের ছবি | সেদিন নাকি আমার মেয়ের একটু পেটে বাথা হয়েছিল | আমাদের ছোটটো মামনিকে বুকে জাপটে ধরা আমার স্ত্রীর মন খারাপ করা ফটোটা দেখলে আজ এত বছর পরেও আমার মনটা এখনো খারাপ হয়ে যায়| কষ্টে ভরে ওঠে |আমি সবসময়ই আমার দুই ছেলে মেয়েকে বলি, আম্মু যা বলে সবসময়ই তা শুনবে |আম্মুর অবাধ্য হবেনা আর আম্মু কষ্ট পায় এরকম কিছু করবে না | ফটোটা দেখিয়ে আমি বলি দেখো কত যত্ন করে আম্মু তোমাদের বড় করেছে! মেয়েকে আকুল করে জড়িয়ে তাদের আম্মুর গভীর বিষাদমাখা মুখটা দেখে আমার দুই ছেলেমেয়ে সবসময়ই চুপ থাকে | আমার মনেহয় তাদের ছোটো বয়সেও ফটোটা দেখে তাদের আম্মুর সেদিনের কষ্টটা অনুভব করতে পারে আর ভালোবাসাটা বুঝতে পারে |
আমার ধারণা আমি খুবই কঠিন টাইপের মানুষ | ছোটখাটো কারণে আপ্লুত হইনা |খুব ছোটো বেলা থেকেই সাহসী বলে বন্ধুদের মাঝে আমর পরিচয় | তখন থেকেই আমি আমার চেয়ে দুই তিন ক্লাস বয়সে বেশ বড়দের সাথে ফুটবল আর ক্রিকেট খেলে বড় হয়েছি | সেই ক্রিকেট আবার যেমন তেমন নয়, রীতিমত প্যাড গ্লাভস পড়ে কাঠের বল দিয়ে খেলা | কোনো দিন এই মনে করে ভয় পাইনি যে আমার চেয়ে এত বড়দের সাথে খেলতে গিয়ে খুব ব্যথা পেতে পারি |
তারপর সময় থেমে থাকেনি কখনো | আমিও বড় হয়েছি | কলেজ, ভার্সিটির দিনগুলো কারণে অকারণে রক্তাক্ত হতে দেখেছি | আম্মার চোখের জলে ভিজে সেই কবে এসেছি এই বিদেশে হাইয়ার স্টাডিজের জন্য ! বিদেশে বসে শুনেছি জামিল ভাইয়ের, আমাদের ডিপার্টমেন্টের কিংবদন্তি ছাত্র, অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়তে পরতেই যার ইন্টারনাশনাল ফিনানশিয়াল অর্গানাইজেশনের ওপর বই পাবলিশ হয়েছিল,দুর্ঘটনার কথা| | আইভি লীগের ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসেছিলেন আমেরিকায় তারপর ফিরে গেছেন বাংলাদেশে ডিগ্রী না করেই | এখন পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছেন | আমার এখনো মনে পরে কল্যাণপুরে জামিল ভাইদের বাসা থেকে আমরা রিক্সায় সোনারগা হোটেলে এসেছিলাম উনার এয়ার টিকেট কনফার্ম করতে| রিজভী ভাই, ডিপার্টমেন্টের আরেক তুখোর ছাত্র, বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ফরেন সার্ভিসে জয়েন করেছিলেন | কত রেফারেন্স, কত বই যে তার কাছ থেকে নিয়েছি কোর্স মেটারিয়াল হিসেবে | শ্রীলঙ্কায় পোস্টিং এ থাকা অবস্তায় কত অল্প বয়সে মারা গেলেন ! মনে হয় যেন এইতো সেদিন সারা রাত ভরে টেকনিকাল সাপোর্ট সার্ভিসের হেল্প নিয়ে ইন্টারনেট বেইজড ফোনের কানেকশনটা এক্টিভেট করলাম | তিরিশ ডলারে এক মাসে পাঁচ হাজার মিনিট বাংলাদেশে কথা বলা যাবে ! ভেবেছি এত একযুগের সমান সময় |ফরেন স্টুডেন্ট হিসেবে এত সাক্ষাত হাতে চাঁদ পাওয়া ! কত দিন আম্মার সাথে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলা হয় না ! আমদের রাত চারটায় কানেকশনটা পেয়েই প্রথম ফোনটা যখন করলাম আম্মাকে| তখন বাংলাদেশের দুপুর দুটো | বাসায় মেহমানের দায়িত্ব বোনের হাতে দিয়ে আম্মা কত যে কথা বললেন | অনেকদিন পর আম্মার সাথে অনেকক্ষণ আরাম করে কথা বললাম | পরের দিন | রাতের আঁধার নিয়ে আসা ডিসেম্বর মাসের সেই ভোর সকালের কথা কি আর ভোলা যায় ! ফল সেমেসটারের শেষ উইক -ড: পিটার্সের সেমেসটার পেপারের কাজ করছি| মাঝ রাত পর্যন্ত কাজ করে ঘুমুতে গিয়েছি | খুব ভোরে ফজরের নামাজের আজানেরও কিছুটা আগে ঘুমটা ভাঙ্গলো সেল ফোনের রিঙে| অবাক হলাম খুবই | এই শেষ রাতে কে আবার ফোন করলো | নিউইয়র্ক থেকে আমার কাজিন রুনি ফোন করেছে | অন্য ঘর থেকে রুনির আম্মার কান্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে |রুনি জানালো আমার আম্মা আর নেই | আমি শুধু ওকে জিগ্যেস করলাম আমি তো কাল দুপুরেই আম্মার সাথে কথা বললাম | দিব্ব্যি সুস্থ আমার আম্মা আমার ফোনের অপেক্ষায় না থেকে চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে | আমি জানি না কোথা থেকে আমার ভাবনাটা এলো | রুনির ফোন রেখে আমি ধীর স্থির ভাবে অজু করে দুই রাকাত দুরাত নফল নামাজ পরলাম -শুকরিয়া জানালাম আল্লাহর কাছে আম্মাকে অনেকদিন অসুস্থ না রেখে, না কষ্ট দিয়ে পৃথিবীর থেকে নিয়ে যাবার জন্য | বড় আত্নসন্মান সচেতন ছিলেন আম্মা | আম্মার মৃত্যুতেও আমি এতটুকু কাঁদিনি | কানাডা থেকে আমাদের বন্ধু তুহিন ফোন করে আমাকে বলেছে কাঁদো, কাঁদলে কষ্টগুলো একটু হালকা হবে| তবু আমি কাঁদতে পারিনি|
কিন্তু সেদিন কাঁদলাম | বর্বর ইসরাইলি বাহিনীর আক্রমনে মারা যাওয়া প্যালিষ্টিনের শিশুগুলোর ফটো দেখে কাঁদলাম | কোন একটা ওয়েবসাইটে যেন দেখলাম একটা ফটো বাবা মাথার খুলি উড়ে যাওয়া আদরের ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে আকুল হয়ে কাঁদছেন | মনটা অবশ হয়ে এলো ফটোটা দেখে | আমার মামনিকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল চেপে আমার ফোনের ফটোটা দেখি আর ভাবি প্যালিষ্টিনের বাবাটার কেমন কষ্ট হয়েছিল আদরের বাচ্চাটার এই অবস্তাটা দেখে | আরেকটা ফটোও অবশ করে দিল মনটা | কাফনের কাপড়ে জড়ানো পাঁচ ছয় মাস বা বড়জোর এক বছরের বাচ্চাটাকে হাত বাড়িয়ে ধরতে চেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরা মার ফটোটা দেখে | কি যে বিষাদ ভরা চোখ সেই মার ! আমাদের মামনির একদিন একটু পেটে ব্যথা হবার জন্য তার মার আকুল করা ছবিটা দেখে আমি ভাবার চেষ্টা করি প্যালিষ্টিনের সেই মার কষ্টটা | ভেবে কুল পাইনা| প্রেস টিভির রিপোর্টার হাল্লা আল সাফাদী লাইভ রিপোর্টের সময় ইসরাইলিদের নিশংস হামলার বর্ণনা দিতে গিয়ে যখন কাঁদলেন তখন না চেনা , না জানা প্যালিষ্টিনের অসহায় মুসলমানদের জন্য আমিও কাঁদলাম |
ছাপ্পান্নোটি মুসলিম দেশ এই পৃথিবীতে । এই এতদিন ধরে হামলা হবার পরেও কোনো প্রতিবাদ নেই তাদের পক্ষকে থেকে । প্রতিবাদ করলো শুধু টার্কিশ প্রাইমমিনিস্টার এরদোগান ! যাকে না কি আবার আমরা ট্যাগ দেই খাঁটি নয় লিবারেল মুসলমান হিসেবে ! এই দু:খ কোথায় রাখি । আর বলিহারি আমাদের প্রধান মন্ত্রী । মুসলিম সংখা গরিষ্ঠ একটি দেশের নেত্রী হয়েও বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই এ ব্যাপারে । তিনি গেলেন কিনা বালিকাদের খাতনা বিষয়ক সন্মেলনে যোগদান করতে! আই এম কাইন্ড অফ স্পীচলেস বাই আওয়ার গভর্মেন্ট রোল ইন দিস হোল ইনসিডেন্ট । মনের ভাবটা বোঝাতে কবিগুরুর স্বরণ নিতে হচ্ছে -সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি । আমি শিওর এরা বাঙ্গালীই রয়ে গেছে ,মানুষ হতে পারেনি এখনো। আমাদের আরো আছে একপাল পোষা লেখক বুদ্ধিজীবী যারা নিজেদের গণতন্ত্র আর মানবতার সোল এজেন্ট মনে করেন। তাদের কর্মকান্ডে আমি আরো তাজ্জব । এরা এত বেশুমার মৃত্যুর পরেও স্পিকটি নট । মানে তাদের কোনো সারা শব্দ নেই । মনে হচ্ছে তাদের কলমের কালী ফুরিয়ে গেছে বা প্রিন্টারের কার্টরিজ কেনার টাকা ফুরিয়েছে| এর মধ্যে ভালো লাগলো ছয় জন নোবেল লোরিএটের সাথে যুক্ত ভাবে আমাদের নোবেল জয়ী ড: ইউনুসও এই যুদ্ধকে অন্যায় বলে ইটা থামাবার জন্য বিবৃতি দিয়েছেন দেখে।নোওম চমস্কি , রবার্ট ফিস্ক সহ অন্য আরো কিছু লেখক সাংবাদিকদের সমর্থনে বিবৃতিটাও এই দারুন হতাশ সমেয়ে মনে খানিকটা শান্তি এনে দিয়েছে | এখনো মানবতার কথা বলার মানুষ আছে ! অনলাইনে ইসরাইল হেরে যাচ্ছে একটিভিস্টদের কাছে | ইউটিউবে হাজার মানুষের ডাউন লোড করা ছোটো ছোটো ভিডিওগুলো হামাসের মিসাইলের চেয়েও অনেক বেশি ধংসাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে ইসরাইলের জন্য |দেশের লেখকদের মধ্যে অসাধারণ লেগেছে ফরহাদ মাজহারের "কেন হামাস রকেট ছোড়ে" লেখাটা |
মনের কষ্টগুলো মনেই জমিয়ে রেখে আল্লাহর কাছে হাত তুলেছি । দুয়া করেছি ইয়া আল্লাহ ইসরাইলিদের এই আক্রমন যদি অন্যায় হয়ে থাকে তবে তাদের কঠিন প্রতিদান দিন আপনি । সেদিন কিয়াম উল লায়িলের শেষে আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেব দুয়া করেছেন প্যালিসটিনের মুসলমানদের জন্য । অন্য আরো শ' খানিক মানুষের সাথে আমিও চোখের জলের সাথে বলেছি আমিন । রমজান মাসের শেষ আশারা চলছে । বড় ফজিলতের দিন এগুলো ।আসুন আমরা সবাই রোজার এই শেষ ক'দিন প্যালিসটিনের মুসলমানদের জন্য খাস দিলে দুয়া করি আল্লাহ যেন তাদের এই পরীক্ষা সহজ করে দেন । তাদের যেন জয়ী করেন এই বর্বর ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে ।মূসাদ্দাদ (রহঃ) এবং জারীর ইবনু আবদুল্লাহ আল বাজলী (রাঃ) বর্ণনা করেছেন: “আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাতে বায়’আত গ্রহণ করেছি সালাত (নামায/নামাজ) কায়েম করার, যাকাত দেওয়ার এবং সকল মুসলিমের কল্যাণ কামনা করার”
(সহীহ বুখারি (ইফা),ইসলামিক ফাউন্ডেশন , অধ্যায়ঃ ২/ ঈমান | হাদিস নাম্বার: ৫৫)| আসুন আমরাও এই রোজায় মুসলিম উম্মার কল্যাণ কামনা করি | আর বেশি করে দুয়া করি প্যালিষ্টিনের মুসলমানদের মঙ্গলের জন্য |
বিষয়: বিবিধ
১৩০১ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন