রমজান আলোচনা: সুরা হা মিম সিজ্দাহের ১৯-২৩ আয়াত - আর এই রোজায় আমাদের ডু আর ডোন্টস
লিখেছেন লিখেছেন তবুওআশাবা্দী ০৯ জুলাই, ২০১৪, ০৬:৪৪:০৪ সকাল
সুরা "হা মিম সেজদাহ "তে আল্লাহ বলেছেন:
যেদিন (হাশরের দিন) আল্লাহর শত্রুদেরকে অগ্নিকুন্ডের দিকে ঠেলে নেওয়া হবে। এবং ওদের বিন্যস্ত করা হবে বিভিন্ন দলে(৪১: ১৯)|তারা যখন জাহান্নামের কাছে পৌঁছাবে, তখন তাদের কান, চক্ষু ও ত্বক তাদের কর্ম সম্পর্কে সাক্ষ্য দেবে (৪১:২০) । তারা তাদের ত্বককে বলবে, তোমরা আমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিলে কেন? তারা বলবে, যে আল্লাহ সব কিছুকে বাকশক্তি দিয়েছেন, তিনি আমাদেরকেও বাকশক্তি দিয়েছেন। তিনিই তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে (৪১:২১)। তোমাদের কান, তোমাদের চক্ষু এবং তোমাদের ত্বক তোমাদের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেবে না ধারণার বশবর্তী হয়ে তোমরা তাদের কাছে কিছু গোপন করতে না। তবে তোমাদের ধারণা ছিল যে, তোমরা যা কর তার অনেক কিছুই আল্লাহ জানেন না (৪১:২২)। তোমাদের পালনকর্তা সম্বন্ধে তোমাদের এ ধারণাই তোমাদেরকে ধ্বংস করেছে। ফলে তোমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছ (৪১:২৩ )।
সুরা হা মিম সিজ্দাহের এই আয়াতগুলোর ব্যখ্যা স্বাভাবিক ভাবেই অনেক ব্যপক | আমি শুধু আমাদের রোজায় করণীয় কাজের সাথে সম্পর্কিত করেই এই আলোচনা সীমিত রাখছি |
সুরা হা মিম সিজ্দাহের এই আয়াতগুলোর অর্থ যখনি পরী তখনি মনটা খারাপ হয়ে যায় | বার বারই মনে হয় আমরা কুরআন শরীফের অর্থ গুলো ঠিক ভাবে বুঝে আমাদের কাজগুলো করছিতো? রোজার এই মাসে এই চিন্তাটা আমার সবসময় আরো বেশি করে আসে | রোজার মাস এলেই আমরা জেনেরেলাইজ করে ফেলি অনেকগুলো বিষয়কে | আমরা মোটাদাগে একটা হাদিস সবসময়ই বলি রোযার মাস রহমত আর বরকতপূর্ণ মাস| এ মাসে দোজখের দরজা বন্ধ করে হেয়া হয় আর বেহেশতের সবগুলো দরজা খুলে দেয়া হয় (সুনানে নাসাঈ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, অধ্যায়ঃ ১৭/ সাওম,হাদিস নং ২১১০)। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় রোজার মাসকে নিয়ে আমরা একটা ইলুশন তৈরী করেছি নিজেদের মাঝে | রোজার মাস এলেই মসজিদে দিনে রাতে মুসুল্লিদের আনাগোনা, মাসভর ইফতার পার্টি আর বাহারি খওয়া দাওয়া, অথবা লক্ষ টাকার কাপড়ে ঈদ যাপন সব মিলিয়ে রোজার মাসটা অন্কটাই দেশে আনুষ্ঠানিকতায় মুড়ে গেছে| রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে রোযা হলো জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবার ঢালের মত (সহীহ মুসলিম,ইসলামিক ফাউন্ডেশন,অধ্যায়ঃ ১৪/ সিয়াম,হাদিস নং ২৫৭৬)। এখন প্রশ্ন হলো, কেমন করে রোজা করলে তা জাহান্নাম থেকে ঢালের মত আমাদের রক্ষা করবে? ভোর থেকে সন্ধা পর্যন্ত শুধু না খেয়ে থাকলেই বা তারাবী নামাজে মসজিদে মুসুল্লীদের ঢল্ বইয়ে দিলেই রোজা ঢাল হবে আমাদের দোজখের শাস্তি থেকে বাঁচাবার ?
আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআন শরীফে বলেছেন যে,মানুষ আর জীন জাতিকে তার ইবাদত ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেননি | আল্লাহতায়ালা ইবাদতকেই বাক্তির সাফল্যের স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে নির্ধারণ করেছেন | এই ইবাদত যদি আন্তরিক হয় তবে যে আল্লাহতায়ালার যত ইবাদত করবে সে তত সাফল্য পাবে| এই ইবাদতও কি ভাবে করতে হবে আল্লাহ তার রাসুলের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন |এখানে একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ আর তা হলো সুযোগ থাকার পরও এই নির্ধারিত ইবাদতগুলো না করলে অন্য কোনো ইবাদতই আল্লাহতায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না | রোযাকে আল্লাহ একটি ফরজ ইবাদত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন|ইবাদত হিসেবে পরিপূর্ণ ভাবে রোজা পালনের পূর্বশর্ত কিছু বিষয় আল্লাহ তাঁর রাসুলের (সামাধ্যমেআমাদের জানিয়েছেন |যেমন, রোজা আর সংযম দুটি বিষয় একে অপরের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ ভাবে সংযুক্ত |রোজার মাসে এই সংযম শুধু খাবার দাবারেই সীমাবদ্ধ এ’রকম একটা সহজ সরলীকরণ আমরা মনে হয় করে নিয়েছি অনেকেই |যার জন্য আমদের দৈনিন্দিন জীবনে রোজার প্রভাব খুব বেশি দেখা যায়না | এটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সমষ্ঠিগত এবং ব্যক্তিগত দুটি ক্ষেত্রেই মনে হয় সত্যি | রোজার সাথে সংযম এবং ত্যাগের সম্পর্কটা খুবই ঘনিষ্ঠ | কিন্তু সমষ্ঠিগতভাবে বাংলাদেশে এর প্রভাব যে দিনে দিনে প্রায় নেই হয়ে যাচ্ছে এর উদাহরণ আমাদের বাজার ব্যবস্তার মধ্যে সহজেই পওয়া যাবে| রোজা এলেই কোনো যুক্তিগ্রায্য কারণ, যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা ,খরা বা ভূমিকম্প যাতে উত্পাদন ব্যাহত হয়, ছাড়াই বাজারে জিনিস পত্রের দামে আগুন লাগা এখন গা সওয়া |এই বাজার ব্যবস্তার সাথে জড়িত যারা তাদের মধ্যে অনেকেই রোজাদার মুসলমান | কিন্তু ব্লাক মার্কেটিং করে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলোর মুল্য বাড়াতে এই রোজার মাসেও কোনো দ্বৃধা নেই কারুরই | এ ক্ষেত্রে প্রশাসক, ক্রেতা -বিক্রেতা আমরা সবাই যেন সংযম বা ত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছি | যাহোক এ নিয়ে অরন্যে রোদন করার আপাতত কোনো মানে হয়না | আমি তাই এ আলোচনাটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমিত রাখতে চাইছি |
আমরা প্রায় ভুলেই যাই যে রোজারএই সংযম শধু খাবার দাবার এর ক্ষেত্রেই নয় এটা দৈনন্দিন জীবনের সব ক্ষেত্রেই | রোজা, নামাজ বা যে কোনো ইবাদতের ক্ষেত্রেই ‘নিয়ত’ এবং সেই সাথে আন্তরিকতা যাকে ইসলামিক পরিভাষায় "ইখলাস" বলা হয়েছে এই দু'টি খুবই গুরত্বপূর্ণ বিষয় | নিয়ত এবং ইখলাস ঠিক না থাকলে যেকোনো ইবাদতই হবে শুধু আনুষ্ঠানিকতা | দেখা যাক নিয়তের গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিসে কি বলা হয়েছে | মুসলিম ও নাসায়ি শরীফে সহিহ হাদিসে কুদসি থেকে আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম ফয়সালা হবে এক ব্যক্তির যে শহীদ হয়েছিল। তাকে আল্লাহ বলবেন: তুমি কি আমল করেছ? সে বলবে: আমি আপনার জন্য জিহাদ করে এমনকি শহীদ হয়েছি। আল্লাহ বলবেন তুমি মিথ্যা বলেছ, তুমি জিহাদ করেছ যেন বীর বলে তোমার সুখ্যাতি হয় | আমি পৃথিবীতে তোমার চাওয়া পূরণ করেছি| সবাই বীর বলে তোমার সুখ্যাতি করেছে | আজ তুমি আর কোনো প্রতিদান পাবে না | তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। আরও এক ব্যক্তির ফয়সালা হবে যে ইলম শিখেছে, শিক্ষা দিয়েছে ও কুরআন তিলাওয়াত করেছে| তাকে যখন আল্লাহ জিগ্যেস করবেন তুমি পৃথিবীতে কি আমল করেছ? সে বলবে: আমি ইলম শিখেছ, শিক্ষা দিয়েছি ও আপনার জন্য কুরআন তিলাওয়াত করেছি। তিনি বলবেন: মিথ্যা বলেছ, তবে তুমি ইলম শিক্ষা করেছ যেন বলা হয় তুমি আলেম, কুরআন তিলাওয়াত করেছ যেন তোমাকে ক্বারী বলে সন্মান করা হয়| আমি পৃথিবীতে কি আমল করেছ? সে বলবে এমন কোনো খাত নেই যেখানে খরচ করা আপনি পছন্দ করেন আমি তাতে আপনার জন্য খরচ করি নাই। আল্লাহ বলবেন তুমি মিথ্যা বলেছ| তুমি দান করেছ যেন সবাই তোমাকে দানশীল বলে সুখ্যাতি করে|আমি তোমার চাওয়া পূরণ করেছি পৃথিবীতে তাই আজ তোমার জন্য কোনো প্রতিদান নেই | তারপর তোমার চাওয়া পূরণ করেছি পৃথিবীতে তাই আজ তোমার জন্য কোনো প্রতিদান নেই | তারপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।আরও এক লোক যাকে আল্লাহ অফুরন্ত সম্পদশালী করেছেন তার ফয়সালা করার জন্য আনা হবে | তাকে আল্লাহ বলবেন তুমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে (সহিহ হাদিসে কুদসি,ইসলাম হাউস,অধ্যায়ঃ ১/ বিবিধ, হাদিস নং ৫)| ব্যক্তিগত পর্যায়ে কি আমরা রোজার এই নিয়তটা ঠিক রেখে রোজা পালন করতে পারছি তো? নাকি আমাদের রোজাও শুধু না খেয়ে থাকাই হয়ে থাকছে?
ইখলাস কেমন করে ব্যক্তির কাজকে কেমন করে গ্রহণযোগ্য করে তুলে তার একটি উদাহরণও এখানে দেয়া যেতে পারে |ওহুদের রক্তাক্ত যুদ্ধের শেষ হয়েছে | রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীদের নির্দেশ দিয়েছেন হতাহতদের খোজ নিতে| আশহাল গোত্রের লোকেরা তাদের নিজ গোত্রের হতাহতদের খোজ নিতে যেয়ে পেল উসায়রিম আমর ইবনে সাবিত ইবনে ওয়াকাশকে (রাঃ)| রক্তাক্ত আর ভীষণভাবে ক্ষত বিক্ষত প্রায় মুমুর্ষ হজরত উসায়রিম (রাএর প্রাণ স্পন্দন তখনও ছিল | আশহাল গোত্রের সবাই অবাক হয়ে ভাবতে লাগলো উসায়রিম (রা: ) এখানে আসলেন কি করে ? তাঁকে তো অনেকবার ইসলামের দাওয়াত দেয়া হয়েছে | কিন্তু বারবারইতো তিনি ইসলামের ছায়াতলে আসবার আহব্বান ফিরিয়ে দিয়েছেন | তাঁকে জিগ্যেস করা হলো, আপনি এখানে আসলেন কিভাবে ? নিজ গোত্রের জন্য যুদ্ধ করতে না কি ইসলামের প্রতি ভালবাসা থেকে? উসায়রিম (রা বললেন, যখন আল্লাহর রাসুল (সাঃ) ওহুদ যুদ্ধে যাত্রা করলেন তখন আমি ইসলামের সত্যতা উপলব্ধি করলাম | আমি আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসুলের প্রতি ঈমান এনেছি | তারপর আমার তরবারী নিয়ে এই উহুদের প্রান্তরে ছুটে এসেছিলাম রাসুলুল্লাহ (সাঃ) কাছে যাতে তাঁর সমর্থনে যুদ্ধে অংশ নিতে পারি| যুদ্ধে আমি আহত হয়েছি |এই কথা গুলো বলে হজরত উসায়রিম (রা তাঁদের সামনেই মারা গেলেন | বনু আশহালের লোকেরা রাসুলুল্লাহর (রা কাছে হজরত উসায়রিমের (সাঃ) ঘটনা বললেন | সব শুনে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বললেন সে জান্নাতীদের অন্তর্ভুক্ত| পরবর্তী কালে হজরত আবু হুরায়রা (রা বলতেন তোমরা আমাকে বলতে পর কে সেই ব্যক্তি যে জান্নাতে প্রবেশ করবে অথচ সে এক ওয়াক্ত নামাজও পরেনি ? লোকেরা জবাব না দিতে পারে জিজ্ঞাসা করত "কে সেই ভাগ্যবান ব্যক্তি "? তিনি বলতেন বনু আশহালের উসায়রিম আমর ইবনে সাবিত ইবনে ওয়াকাশ(রাঃ)| এই ঘটনার কথা আবু রাসুলুল্লাহর (সাঃ) সিরাহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন |
হজরত আবূ হুরায়রা (রাঃ) এবং হজরত আনাস (রাঃ)বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন যে মানুষ রোজায় অন্যায় কথা বলা (গিবত, মিথ্যা কথা ইত্যাদি ) ছাড়তে পারল না তার না খেয়ে থাকার কোনো দরকার নেই (জামে তিরমিজী,ইসলামিক ফাউন্ডেশন,হাদিস নং-৭০৫)| অর্থাৎ সেই লোকের রোজার কোনো মুল্য আল্লাহর কাছে নেই| এজন্য আমাদের কথা বার্তা, চোখে দেখা, কানে শোনা এই সব বিষয়ের সংযমও না খাবার মতই একই ভাবে বজায় রাখা রোজায় আমাদের সবার জন্যই অপরিহার্য্য | অথচ এই বিষয়গুলোই যেন আমরা সবাই কেমন করে যেন জেনেরেলাইজড করে ফেলেছি | কোনো একটা অদ্ভুত কারণে আমরা ভেবে নিয়েছি যে শুধু না খেয়ে থাকলেই রোজা হয়ে যাবে| অনেকেই আমরা এমনকি নামাজের বিষয়েও উদাসীন থেকে যাচ্ছিএই রোজাতেও| আমাদের নিজেদের কথা বার্তায় লাগাম পড়াতে পারছিনা কিছুতেই | রোজার দিনগুলোও আমরা অন্য যেকোনো দিনের মতই আড্ডা দিয়ে, গল্প গুজবে দিব্বি পার করে দিচ্ছি| অথচ রোজার সিফাত সম্পর্কে রাসুল্লুলাহ (সাঃ) বলেছেন, রোজা (জাহানামের থেকে রক্ষার ) ঢালের মত সুতরাং অশ্লীলতা করবে না আর মুর্খের মত কাজ করবে না | কেউ গালি দিলে বা ঝগড়া করতে চাইলে তাকে বলতে হবে আমি রোজাদার (সহীহ বুখারি (ইফা), অধ্যায়ঃ ২৩/ সাওম,হাদিস নং ১৭৭৩)।
এখন ইন্টারনেটের যুগ | কম্পুটারের এক ক্লিকেই সারা পৃথীবি তার মোহনীয় পাখনা মেলে এসে যাচ্ছে চোখের সামনে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয়, শীল- অশ্লীল সবকিছু নিয়েই | গুগুল, এমএসএন , ফেসবুক বা যেকোনো ওয়েব সাইটের হোম পেইজে নানা বয়সী ছেলে মেয়েদের খোলামেলা ফটো এড এখন খুবই সাধারণ একটি বিষয় | তার উপর রয়েছে ইউটিউবের গ্রাফিক আর চটুল মিউজিক ভিডিওগুলো | তা ছাড়া দেশের টিভি চানেলগুলতো রয়েছেই | ওপেন মার্কেট ইকনমির সুত্রে বন্যার স্রোতের মত ঘরে ঢুকে গিয়েছে ইন্ডিয়ান সিনেমা আর সিরিয়াল | আমরা সবাই হয়ত ব্যক্তিগত ভাবে ডুবে যাচ্ছিনা সেই স্রোতে কিন্তু জাতি যে তাতে হাবু ডুবু খাচ্ছে সেটা পরিস্কার | অপ্রয়োজনীয় এবং বহু ক্ষেত্রেই অশোভনীয় নাচা নাচি সর্বস্ব এই সব সিনেমা সিরিয়াল রোজায় দেখতে থাকলে রোজাটা আদৌ হবে কিনা সেটা নিয়ে আমার বিস্তর সন্দেহ আছে | আমরা কি এই সব টিভি শো, সিনেমা -সিরিয়াল, আর অনৈতিক কম্পিউটার গ্রাফিক্স থেকে নিজেদের চোখ আর কান কে রোজার প্রয়োজন অনুসারে সংযত রাখতে পারছি? সহীহ মুসলিমের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, দু’চোখের জ্বীনা হলো (অনায্য এবং অশ্লীল কিছু ) দেখা , কানের জ্বীনা (অশ্লীল কিছু ) শোনা, জ্বিহবার জ্বীনা (অশ্লীল/অপ্রয়োজনীয় )কথোপকথন, হাতের জ্বীনা (অনৈতিক কিছু) স্পর্শ করা, পা'য়ের জ্বীনা (অনৈতিক কিছুর দিকে) হেঁটে যাওয়া, অন্তরের যিনা (অন্যায় এবং অনৈতিক কিছু ) আকাংখা ও কামনা করা(সহীহ মুসলিম| ইসলামিক ফাউন্ডেশন | অধ্যায়ঃ তাকদীর,হাদিস নং ৬৫১২, ৬৫১৩)।বাক্তিগত এই বিষয়গুলো আমাদের রোজাকেও সংকটের মুখে ঠেলে দেয় |ইন্টারনেট ব্যাবহারে আমরা কি একটু সতর্ক হওয়ার চেষ্টা করতে পারিনা এই রোজায়?
প্রথমেই অনেক বড় আমলের কথা চিন্তা না করে আমর যদি নিজেদের প্রতিদিনের আচার ব্যবহারের ব্যাপারে একটু সংযম করতে পারি আর আমাদের ইচ্ছে গুলোকে একটু নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলেই আমাদের রোজা সত্যিকারের ঢাল হতে পারে আমাদের জন্য | আমরা আমাদের নিজেদের কাছেই প্রশ্ন করে দেখতে পারি যে হাদিসে আমাদের নিজেদের হাত- পা, চোখের মত গুরুত্বপূর্ণ অর্গানগুলোর যে ব্যবহারের কথা নিষেধ করা হয়েছে সেগুলো সেগুলো আমরা এই রোজায় করছি কি না ? করলে এগুলোর কি ভাবে না করা যায় | রোজার এই একটা মাস অন্তত আমরা নিজেদের এইসব অর্থহীন টিভি সিরিয়াল-সিনেমা দেখা থেকে নিজেদের বিরত রাখতেই পারি | অন্য সময় এগুলো না দেখার সময়গুলো ধীরে ধীরে বাড়াতে পারি সহজেই | প্রথম প্রথম কঠিন লাগলেও এগুলো দেখার সময় সীমিত করা সম্ভব সহজেই |এক সময় টিভিতে ইউরোপিয়ান ক্লাবগুলোর সকার খেলা দেখালেই চোখটা গ্লুর মত আটকে যেত স্ক্রীনে | ক্রিকেট খেলাগুলোও ছাড়তে চাইতাম না |এখন বার্সেলোনা,জুভেন্টাস আর লিভারপুলের খেলাও আর দেখা হয়না কত দিন! এবার বিশ্বকাপে জার্মানির খেলাগুলোও আর ঠিক ভাবে দেখছিনা| অথচ এক সময় আব্বার রাগ গায়ে না মেখে ইন্টার মিডিয়েট পরীক্ষার আগের রাতেও রাত জেগে বিশ্বকাপে জার্মানির খেলা দেখেছি! কতই না বদলে গেছে আমার টিভি দেখার অভ্যাস!আমি পেরেছি আমার টিভি দেখার অভ্যাস বদলাতে |আমি শিওর,আপনিও পারবেন|
ওয়েব ব্রাউসিং-এর বিষয়ে আপনি নিজেই ঠিক করতে পারেন আপনার মানদন্ড-ডু আর ডোন্টস | আপনার দৃঢ় ইচ্ছেই এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ |আমাদের অঙ্গগুলো যেমন চোখ, হাত, পা, মুখ এবং অন্য অঙ্গগুলোর ব্যবহারও ইবাদতের অন্তর্গত | এই অঙ্গ গুলোর অপব্যবহার আল্লাহতায়ালার ইবাদতের শর্ত গুলোকে ক্ষুন্ন করে | হাত, পা, মুখ ও আর অন্য সব অর্গানেরই হক্ক রয়েছে আমাদের উপর তাদের সঠিক উদ্দেশে ব্যবহার করার | এর অপব্যবহারের জন্য দায়ী হতে হবে আমাদেরই আল্লাহর কাছে | আনাস ইবনু মালিক (রা বর্ণনা করেছেন হাদিসে কুদসি|একদিন আমরা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছে বসা ছিলাম | হঠাৎ তিনি নিজে নিজেই হাসলেন | তারপর আমাদের জিজ্ঞেস করলেন তোমরা জান কেন আমি হেসেছি? আমরা বললাম আল্লাহ আর তাঁর রাসূলই (সাঃ) ভালো জানেন | আমি হেসেছি বান্দার তাঁর রবকে পাল্টা প্রশ্ন করা থেকে | কিয়ামতের দিন হিসাব নিকাশের এক পর্যায়ে বান্দা আল্লাহকে বলবে,হে আমার রব, আপনি কি আমাকে জুলুম থেকে নাজাত দেননি ? আল্লাহ বলবেন, অবশ্যই দিয়েছি | তখন বান্দা বলবে আমি আমার বিপক্ষে আমার অংশ ছাড়া অন্য সাক্ষী মানিনা |আল্লাহ বান্দাকে বলবেন, আজ সাক্ষী হিসেবে তোমার জন্য তুমিই যথেষ্ট আর দর্শক হিসেবে কিরামান কাতেবীনই যথেষ্ট |এরপর বান্দার মুখে সিল মোহর লাগিয়ে দেওয়া হবে | আর তার অঙ্গ গুলোকে বলা হবে তোমরা বল | তখন বান্দার অঙ্গগুলো বর্ণনা দিবে তাদের আমলের| এরপর বান্দার মুখে সিল মোহর লাগিয়ে দেওয়া হবে | আর তার অঙ্গ গুলোকে বলা হবে তোমরা বল | তখন বান্দার অঙ্গগুলো বর্ণনা দিবে তাদের আমলের| নিজের অঙ্গগুলো যখন তাদের হারাম আমলের কথা প্রকাশ করতে থাকবে তখন বান্দা বলবে তোমরা দূর হও| তোমাদের আনন্দের জন্যই তো আমি এসব করতাম(সহিহ হাদিসে কুদসি,ইসলাম হাউস, হাদিস নং ৭২ )!
ইউটিউবে আপনি যেতেই পারেন| তবে দেশী-বিদেশী চটুল পপ মিউজিক না শুনে কষ্ট করে আপনি শুধু একবার ক্বারী আল ঘামাদির আয়াতুল কুর্সির তেলাওয়াতটা মন দিয়ে শুনুন | আমি নিশ্চিত, পৃথিবীর যে কোনো গানের চেয়েও মন মুগ্ধকর মনে হবে এই তেলাওয়াত| যদি সম্ভব হয় এগুলো শোনার সময়টা একটু বাড়ান দিনে |ইনশাল্লাহ, ধীরে ধীরে দেখবেন চটুল আধুনিক পপ মিউজিকের থেকে এই তেলাওয়াতগুলোই অনেক বেশি ভালো লাগছে আপনার| আসুন আমরা এই রোজায় আমাদের নিজেদের হাত, পা, চোখ আর অন্য অঙ্গগুলোকে সংযমের বাধনে বেঁধে দেই আল্লাহ যেমন নির্দেশনা দিয়েছেন তেমন করে | এর জন্য কোনো বড় ত্যাগের প্রয়োজন সম্ভবত আমদের কাউকেই করতে হবে না | রোজার সংযমের মধে থেকেই আমি শিওর আপনি বিশ্ব কাপের খেলা গুলোও দেখতে পারবেন- ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনা যার সাপোর্টারই আপনি হন না কেন নিজের রোজার কোনো ক্ষতি না করেই | বরং এই সংযমের কারণে আমাদের ইবাদতের বাইরে অন্যান্য সব হালাল কাজই আমাদের জন্য আল্লাহর রহমত ও সোয়াবের কারণ হয়ে যাবে |
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) রোজার অফুরন্ত বরকত এবং নিয়ামতের কথা জানিয়েছেন| রাসুলুল্লাহ (সাঃ)বলেছেন যে আল্লাহতায়ালা বলেন, রোজা ছাড়া বনি আদমের বাদবাকি সব আমল তার নিজের জন্য | রোজা শুধু আমার জন্য আর আমি নিজেই এর প্রতিদান দেব | রাসুলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবীদের জানিয়েছেন যে জান্নাতের একটা দরজার নাম রাইয়ান | এই দরজাটা শুধু রোজাদারদের জন্য খোলা হবে| সব রোজাদারকে এই দরজার থেকে এই বলে ডাকা হবে: রোজাদাররা কোথায়? তোমরা কেন রাইয়ান এর দিকে আসছ না? রোজাদার বান্দারা সবাই যখন রাইয়ান দিয়ে জান্নাতে ঢুকে যাবে তখন এই দরজাটা বন্ধ করে দেয়া হবে| এরপর আর কেউ রাইয়ান দিয়ে জান্নাতে ঢুকার অনুমতি পাবেনা (সুনানে নাসাঈ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, অধ্যায়ঃ ১৭/ সাওম,হাদিস নং ২২৪১) | সুবহানাল্লাহ! আমল হিসেবে রোজাকে কত উচু মর্যাদা দেয়া হয়েছে | অফুরন্ত রহমত আর বরকতপূর্ণ আরেকটি রোজার মাস আমাদের কাছে এসেছে, আলহামদুলিল্লাহ ! আল্লাহ আরো একটি রোজার মাসে আমাদের রোজা পালন করার সুযোগ দিয়েছেন ! এই রোজাই হতে পারে আমাদের যে কারো শেষ রোজা | এই রোজাই হতেপারে আমাদের শেষ সুযোগ আল্লাহকে রাজি করানোর | কিয়ামতের দিন এই রোজার আমলই হতে পারে জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার ঢালের মত, যেমন রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন| আসুন, আমরা আল্লাহর নির্দেশিত ও রাসুলুল্লাহর (সাঃ) প্রদর্শিত পথে এবারের রোজাগুলো রাখার চেষ্টা করি | আর এই রোজায় আমরা দুয়া করি আল্লাহর কাছে যেমন করতেন রাসুলুল্লাহর (সাঃ) সাহাবী হজরত জাবের (র | ইয়া আল্লাহ, এই রোজাকে আমার জীবনের শেষ রোজা করে দিবেন না | আমাকে আরো রোজার মাসে রোজা পালনের জন্য, আপনার মাগফিরাত কামনা এবং ক্ষমা প্রার্থনার জন্য জীবিত রাখুন | আর যদি আপনি এই রোজাকেই আমার জীবনের শেষ রোজা হিসেবে নির্ধারণ করেন তবে আমাকে আপনি পরিপূর্ণ ভাবে ক্ষমা করুন| এই গ্রীষ্মে সারা দিনের রোজার পর আমরা সবাই যখন বাহারি আর মজাদার সব ইফতার নিয়ে বসব , আসুন আমরা সবাই তখন দুয়া করি যেমন রোজায় ইফতারের আগে দুয়া করতেন হজরত বায়েজিদ বোস্তামী (রা| হে আল্লাহ, আমার এই ইফতারে যদি কোনো দরিদ্রের অংশ থেকে থাকে আর আমি যদি তার হক্ক আদায় করতে না পেরে থাকি তবে আমার অক্ষমতার জন্য কিয়ামতের দিন আমাকে দয়া করে অভিযুক্ত করবেন না | আল্লাহ আমাদের সবাইকে পরিপূর্ণ তাকওয়ার সাথে এবারের রোজা গুলো পালনের তৌফিক দিন | আমিন |
(সহ ব্লগার ভিশুর কাছে এপলোজি চাওয়া থাকলো এ'লিখার জন্য | তাঁকে জানিয়ে ছিলাম এ'লিখাটা লিখব রোজার লেট সিডিউলে| কিন্তু হঠাত মনে হলো তাহলে হয়ত বেশি দেরী হয়ে যাবে টপিকটার জন্য | সে জন্যই একটু আগেই এই লেখা )
বিষয়: বিবিধ
২০১৮ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এখানেও আমন্ত্রণঃ
রমযান আলোচনা-বিষয়ঃ সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত ২৯-৩২
ইয়া আল্লাহ, এই রোজাকে আমার জীবনের শেষ রোজা করে দিবেন না | আমাকে আরো রোজার মাসে রোজা পালনের জন্য, আপনার মাগফিরাত কামনা এবং ক্ষমা প্রার্থনার জন্য জীবিত রাখুন | আর যদি আপনি এই রোজাকেই আমার জীবনের শেষ রোজা হিসেবে নির্ধারণ করেন তবে আমাকে আপনি পরিপূর্ণ ভাবে ক্ষমা করুন| আমীন
মন্তব্য করতে লগইন করুন