রূপে ঝলমল নিঝুম দ্বীপ
লিখেছেন লিখেছেন ভন্ড বাবা ১৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০১:০৪:২০ দুপুর
দ্বীপের নাম নিঝুম দ্বীপ। বাংলাদেশের অন্যতম রূপসী এলাকা এটি। নিঝুম দ্বীপ হলো ম্যানগ্রোভ বনে ঘেরা। লবণাক্ত পানির তীরে মানে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় অবস্থিত বনকেই বলে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা বন। অর্থাৎ যে বনে লোনা পানি ঢোকে সেটাই ম্যানগ্রোভ বন। পৃথিবীর সবচে' বড় ম্যানগ্রোভ বন হলো সুন্দরবন। আর এ তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে নিঝুম দ্বীপ। নিঝুম দ্বীপের অবস্থান হাতিয়া ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণে। মেঘনা নদীর মোহনায় নোয়াখালী জেলায় নিঝুম দ্বীপের অবস্থান। নিঝুম দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের কাছে হলেও এর চারপাশে সাগর নেই। আছে মেঘনা নদী।
মজার ব্যাপার হলো অনন্য সুন্দর এই দ্বীপটি অনেক দিন কিন্তু পানির ভেতরে লুকিয়ে ছিল। ১৯৭২ সালের দিকে বন বিভাগের লোকজন এ দ্বীপটি আবিষ্কার করে। তখন তারা দ্বীপটিতে কেওড়া গাছ লাগিয়ে দিয়েছিল। কেওড়া গাছের বৈশিষ্ট্য হলো এতে শ্বাসমূল থাকে। বনে লোনা পানি ঢুকে গেলে গাছগুলো আর মাটি থেকে শ্বাস নিতে পারে না। তখন শ্বাসমূলগুলো দিয়ে তারা নিঃশ্বাস নেয়। এ জন্য যেখানে পানি বেশি ওঠে সেখানে শ্বাসমূলও বেশি লম্বা হয়। শ্বাসমূল থাকে বলেই কেওড়া গাছ লোনা জলেও ভালোভাবে বাঁচতে পারে। তবে দ্বীপের যে অংশে মানুষ থাকে সেখানে বিভিন্ন ফুলেরও দেখা মেলে। তবে সেগুলো মানুষই আশপাশের দ্বীপগুলো থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছে।
নিঝুম দ্বীপের বনে আগে তেমন কোনো প্রাণীই ছিল না। এখন কেবল হরিণ আছে। হরিণের মোট সংখ্যা কম করে হলেও এখন ২০ হাজার। ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবন থেকে মাত্র ৮টি হরিণ এনে এখানে ছেড়ে দিয়েছিল। সেগুলোই এখনকার ২০ হাজার হরিণের পূর্বপুরুষ। বক, চখাচখি, গাংচিল, আরও কত পাখি! সব মিলিয়ে কম করে হলেও ৩৫ প্রজাতির পাখি আছে সেখানে। শীতকালে আবার এদের সঙ্গে যোগ দেয় নানা নামের আর নানা রংয়ের অতিথি পাখি।
নিঝুম দ্বীপ সত্যিই অসাধারণ জায়গা। যেমন সুন্দর, তেমনি রোমাঞ্চকর। নদী আছে, বন আছে, গ্রামের সরল মানুষ আছে, অসাধারণ সুন্দর সব পাখি আছে আর আছে হরিণ। দ্বীপে নেমেই যে কাজটি করা যেতে পারে তা হলো নদীতে গোসল করা। তবে বেশিক্ষণ লাফালাফি করা যাবে না। লোনা পানিতে বেশিক্ষণ থাকলে সমস্যা হয়। গা চুলকায়। সুতরাং গিয়ে ঝটপট নদীতে গোসল সেরে নিতে হবে। আর লোনা পানিতে গোসল করতে না চাইলেও সমস্যা নেই। নদীর তীরগুলো এত সুন্দর, সেখানে সারাদিন বসে থাকতে ইচ্ছা করবে। জোয়ারের পানি চলে যাওয়ার আগে বালুময় মাটিতে নানা নকশা এঁকে যায়। আর তার মাঝে একটু একটু পানি জমে সেই নকশাকে করে তোলে আরও জীবন্ত। তাকে আবার ছোট ছোট কচি সবুজ ঘাস রঙ্গিন করে তোলে। আর রাতে নদীর তীরে যেতে পারলে তো কথাই নেই। পূর্ণিমা হলে সারারাত চাঁদ দেখেই কাটিয়ে দিতে পারবে। আর অমাবস্যা হলে ভুতের গা-ছমছম করা গল্পের আসর যে দারুণ জমবে তা কি আর বলতে হয়!
নদীগুলোর মজা কিন্তু এখানেই শেষ নয়, বনের ভেতর চিকন চিকন খাল হয়ে ঢুকে গেছে নদীগুলো। একটা আরেকটাকে জড়িয়ে ধরেছে প্রাণের বন্ধুর মতো। এসব খাল ধরে চলে যাওয়া যায় বনের অনেক ভেতরে যেখানে হরিণ থাকে। সে জন্য অবশ্য ট্রলার ভাড়া করতে হবে। তবে ওগুলো নামেই ট্রলার। আসলে কিন্তু একটা মাছধরা নৌকায় নিয়ে যায়।
নিঝুম দ্বীপে অসংখ্য হরিণ থাকলেও গভীর বনে না গেলে হরিণের দেখা মিলবে না। গভীর বনে যেখান দিয়ে ঢুকতে হবে, সেটা কিন্তু বেশ মজার একটা জায়গা। তিন দিকে বন, মাঝখানে ফুটবল খেলার মাঠের মতো বিশাল জায়গায় কোনো গাছই নেই। সামনে যেখানে পানি সেখানেও গভীরতা খুবই কম। ডাঙা থেকে অনেক দূর চলে আসার পরও দেখা যাবে পানি কোমরের কাছেও আসেনি। তবে নৌকা থেকে নেমে হাঁটার সময় একটু সাবধানে পা ফেলতে হবে। সেখানকার মাটি এতই পিচ্ছিল যে, পা ফেলতে একটু এদিক-ওদিক করলেই ধপাস করে পড়ে যেতে হবে। আর ভুলেও স্যান্ডেল পরে হাঁটা যাবে না। অবশ্যই স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে নিতে হবে।
সেখান দিয়ে বনে ঢোকার সময়ই হয়তো হরিণের পায়ের ছাপ দেখা যাবে। ছোট ছোট দুটো খুরের পাশাপাশি দুটো গোলগোল দাগ। এখানে হরিণ আসে অনেক রাতে, পানি খেতে। তারপর হয়তো হরিণের দু'একটা কঙ্কালও দেখা যেতে পারে। এখানকার কুকুরগুলো সুযোগ পেলেই হরিণ মেরে খায়। তবে সহজে পারে না। কারণ হরিণ খুবই সতর্ক প্রাণী। আর দৌড়াতেও পারে বেশ।
বনের মধ্যে বেশ খানিকটা ভেতরে গেলে তবেই হরিণের দেখা মিলবে। তবে সেক্ষেত্রে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। কারণ হরিণ যদি পায়ের শব্দ পায়, ভোঁ দৌড়। তবে হরিণের পালের দৌড় দেখাও বেশ মজার। একপাল সোনালি রংয়ের হরিণ দূর দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে আর গাছের আড়াল থেকে তা দেখার মজাই আলাদা। তবে ভুল করেও কিন্তু গ্রীষ্মকালে নিঝুম দ্বীপে যাওয়া উচিত নয়। তখন বনে গিয়ে হরিণ দেখা দূরে থাকুক, ভেতরে ঢুকে দাঁড়ানোই যাবে না। মশা পারলে তুলে নিয়ে যায়।
নিঝুম দ্বীপ নোয়াখালী জেলার মধ্যে পড়লেও যাওয়ার সময় কিন্তু নোয়াখালী গেলে চলবে না। সেজন্য হাতিয়া পার হয়েও আরও অনেক দূর যেতে হবে। ঢাকা থেকে প্রথমে লঞ্চে যেতে হবে হাতিয়ার তমরুদ্দি ঘাটে। ঘাটে নেমে একটা কাঠের তৈরি অনেকটা টেম্পোর মতো বাসে করে যেতে হবে বাজারে। সেখান থেকে আবার রিকশায় করে নিঝুম দ্বীপে নামার বাজারে। এরপর একটা বড় গাং আছে, মানে নদী। মেঘনারই কোনো একটা শাখা নদী। ট্রলারে করে পার হতে লাগবে ৫ মিনিটের মতো। এটাই নিঝুম দ্বীপ। তবে এটি আসলে নিঝুম দ্বীপের একপ্রান্ত। নিঝুম দ্বীপের আসল সৌন্দর্য দেখতে হলে যেতে হবে অন্যপ্রান্তে। সে জন্য তোমাকে আবার রিকশা নিতে হবে। পুরো দ্বীপে ঐ একটাই রাস্তা। সেটাও অবশ্য পুরো পাকা নয়, বেশিরভাগই ইট বিছানো। একটু পরেই শুরু হবে কেওড়া বন। নিচু জায়গা তাই পানিও জমে থাকে। আর সেখানে কত যে পাখি। তবে তমরুদ্দি ঘাট থেকে এত কষ্ট করে না গিয়ে একবারে ট্রলারে করেও যাওয়া যায়। নিঝুম দ্বীপে কোনো আবাসিক হোটেল নেই।
তবে থাকার জায়গা আছে। একটা সরকারি বাংলো আছে, তবে সেটার ভাড়াও বেশি, সুবিধাও নেই কোনো। ফ্যান লাইট সবই আছে, কিন্তু বিদ্যুৎই তো থাকে না। বিদ্যুৎ আসে রাত ৮টার দিকে। আর চলে যায় রাত ১০টায়। তবে প্রায় সব দোকানেই দেখবে এরপরও লাইট জ্বলছে। সেগুলো জ্বালানো হয় সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে। প্রায় প্রত্যেকটি দোকানেরই ছাদে সোলার বোর্ড লাগানো আছে। সেখানে সারাদিনে যত সূর্যের আলো পড়ে তত বিদ্যুৎ তৈরি হতে থাকে। এ বিদ্যুতই রাতে আলো দেয়।
বিষয়: বিবিধ
১২২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন