ব্লাসফেমি আইন কি?

লিখেছেন লিখেছেন মুহম্মদ কামরুল হাসান ১১ এপ্রিল, ২০১৩, ১১:৫২:৩৫ সকাল

ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, ধর্ম অবমাননা, ব্লগারদের শাস্তি দাবি, ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা বেশ জোরালো হয়ে উঠেছে আমাদের দেশে। এক পক্ষ বলছে ধর্মানুভূতির কথা, অন্য পক্ষ বলছে বাক-স্বাধীনতার কথা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা। অনলাইনে বিশেষত ব্লগে ইসলামসহ নানা ধর্মকে কটাক্ষ করা, পোস্ট দেয়া এসব নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। এসব আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্লাসফেমি আইন সম্পর্কে পাঠকের মনে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।

ক’দিন আগেও রাসূল (সাঃ) এর জীবনচিত্র ব্যঙ্গ করে ফুটিয়ে তোলা শর্টফিল্ম ‘ইনোসেন্স অফ মুসলিম’ নিয়ে সমগ্র পৃথিবীতে প্রতিবাদ -সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিলো। বিশ্বের অনেক দেশেই তা সহিংস রূপ ধারণ করে। দেশে ব্লগার রাজিব হত্যাকাণ্ডের পর এবং তার নামে অনলাইনে কিছু বিতর্কিত পোস্ট আসায় ( যদিও পোস্টগুলো নিয়ে নানা মহলে সন্দেহ রয়েছে) অনলাইনের প্রতি নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ আরোপে জোরারোপ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বেশ কয়েকজন ব্লগারকে। ফেসবুক স্ট্যাটাসে মহানবী (সাঃ) এর অবমাননার জের ধরে কক্সবাজারের রামু, উখিয়ায় বৌদ্ধ বিহারে হামলা হয়েছিলো। এর আগেও বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের ফান ম্যাগাজিনে একটি ব্যঙ্গাত্মক কার্টুন ছাপা হওয়ার প্রতিবাদে এ রকম জটিলতা সৃষ্টি হয়েছিলো যা আদালতের সিদ্ধান্তে স্থিমিত হয়।

ব্লাসফেমি আইন কি

ব্লাসফেমি শব্দের অর্থ'- 'ধর্ম নিন্দা' বা 'ঈশ্বর নিন্দা' গ্রিক শব্দ ‘ব্লাসফেমেন’ থেকে এসেছে। এর অর্থ কারো ওপর অপবাদ বা কলঙ্ক আরোপ করা বা সম্মানে আঘাত করা। তবে ব্লাসফেমি বলতে প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অসম্মান বোঝায়। কোন ব্যক্তি এইসব অপরাধ করলে যে আইনে তার বিচার করা হয়, সেটাকেই ব্লাসফেমি আইন বলে। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ইউরোপে ব্লাসফেমির উদ্ভব হয়েছিল। সে সময় রাজা বাদশাদের বলা হত ঈশ্বরের প্রতিনিধি,তাই রাজাদের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বলা,এইভাবে রাজার অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগনের আন্দোলন যাতে গড়ে না উঠতে পারে সেই জন্য ওই সময় ব্লাসফেমি নামের এই কালো আইন তৈরি হয়েছিল। ইউরোপে সর্বপ্রথম এই আইনের প্রবর্তন করা হয়। বর্তমানে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সোমালিয়া, মালয়েশিয়াতে ব্লাসফেমি আইন চালু রয়েছে।

ব্লাসফেমি আইনে অতীতে বিচার

এই আইনের পোলিশ বিজ্ঞানী কোপারনিকাসের সেই 'দ্য রেভোলিওশনিবাস' বইটি ধর্মের বিরুদ্ধে যাওয়ায় গির্জার পাদ্রীরা বই টিকে নিষিদ্ধ করে দেয়। কারণ ওই বইটিতে লেখা ছিল পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, কিন্তু বাইবেলে লেখা ছিল পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে। ১৫৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী তিনি মারা যান। এরপর ইতালিয় বিজ্ঞানী জিয়দারনো ব্রুনো সেই অপ্রকাশিত সত্য উদ্ঘাটন করেন, এবং তা তিনি প্রচার করতে শুরু করলেন। এ কারণে তার প্রতি ধর্ম যাজকরা ক্ষিপ্ত হন এবং কঠোর শাস্তি প্রদানের উদ্যোগ নেন। বাধ্য হয়ে ইতালি ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে যায়, সেখানেও তিনি একই কারণে বহিষ্কৃত হন। পোপের নির্দেশে একের পর এক দেশ ব্রুনোর জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়, এই সময় পোপের এক গুপ্তচর এক মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে ব্রুনোকে ইতালিতে নিয়ে আসে। ১৫৯২ সালের ২৩ মে বিজ্ঞানী ব্রুনোর বন্দি করে তার উপর শুরু হয় নির্যাতন, টানা আট বছর ধরে সীসের ছাদের নিচে রেখে বিচারের নামে প্রহসন চালায়,শেষে বিচারের রায় হল 'পবিত্র গির্জার আদেশে পাপী ব্যক্তির এক বিন্দু ও রক্ত নষ্ট না করে হত্যা। অর্থাৎ আগুনে পুরিয়ে হত্যা ১৬০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রুনোকে নিয়ে যাওয়া হল এক বধ্যভূমিতে। তার জিভ শক্ত করে বাঁধা ছিল, যাতে শেষ বারের মত ও তার আদর্শের কথা না বলতে পারে,আগুনে পুরিয়ে এই বধ্যভুমিতে বিজ্ঞানী ব্রুনোকে হত্যা করা হয়।এখানেই শেষ নয়,ব্রুনোর পর ব্লাসফেমির আরেক শিকার বিজ্ঞানী গ্যালিলিও তার শেষ আট টি বছর কারাগারে দিনকাটায় এবং সেখানে তার মৃত্যু হয়।

আইনের সাম্প্রতিক প্রয়োগ

স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত ‘ব্লাসফেমার’ হলেন ইরানের সালমান রুশদী। ৭০ দশকের দিকে ‘স্যাটানিক ভার্সেস’ লেখার জন্য তার বিরুদ্ধে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেন ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ইমাম খোমেনী। পাকিস্তানে এই আইনের ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক মানুষের যাবজ্জীবন,মৃত্যুদণ্ডের ঘটনার অনেক নজির আছে, পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে ১৯৯৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারী ২৯৫ (গ) ধারায় একটি মামলায় আজও একজনের বিচার চলছে। পাঞ্জাব প্রদেশের ভাওয়ালপুর ১৯৯৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ২৯৫ (গ) ধারায় এক ব্যক্তিকে মৃত্যু দণ্ড দিয়েছিল। পাঞ্জাবে ১৯৯২ সালের ২ নভেম্বর কোর্টে মাত্র একজনের সাক্ষীর ভিত্তিতে ৪২ বছরের একজনের মৃত্যু দণ্ড দেন। (অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ১৯৯৪ সালে মুক্তির নির্দেশ দেন) বাংলাদেশে সর্বশেষ ব্লাসফেমির অপরাধে বিচার হয়েছিলো ২০০৭ সালে। ধর্মীয় উস্কানিমূলক কার্টুন প্রকাশের দায়ে সে সময় কার্টুনিস্ট আরিফুর রহমানকে দুই মাসের জেল এবং ৫০০ টাকা জরিমানা করা হয়।

দেশে ব্লাসফেমি আইনের আদলে ধারা

পাকিস্তানের স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউল হক ইসলাম ধর্মের বাতাবরণে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখার স্বার্থে মধ্যযুগের এই বর্বর কালো আইনটিকে ধার করেছিলেন। পাকিস্তানের দণ্ডবিধিতে ১৯৮২ সালে ২৯৫ (খ) এবং ১৯৮৬ সালে ২৯৫ (গ) ধারা সংযুক্ত করা হয়েছিল। ঠিক সেই দুটি আইনকে জামায়াত সাংসদ নিজামী সেটাকে বাংলাদেশের দণ্ড বিধির ২৯৫ (খ) ও ২৯৫ (গ) ধারা হিসাবে সংযুক্ত করার জন্য বিল আকারে সংসদে পেশ করেন। ২৯৫ (খ) ধারায় বলা আছে, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কোরআন কিংবা এর কোন অংশের কোন অবমননা, ক্ষতিসাধন ও পবিত্রতা হানি করে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করা হবে।

২৯৫ (গ) ধারায় বলা আছে, ব্যক্তি মৌখিক কিংবা লিখিত ভাবে, ইঙ্গিতে বা বাহ্যিক ব্যবহারের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর পবিত্র নামের অবমাননা করবে সে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হবে কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করবে এবং তাকে জরিমানাও করা যেতে পারে।

ধর্ম অবমাননায় শাস্তি

সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৩৯ এর ২ (ক) ও ২(খ) অনুযায়ী বাকস্বাধীনতা আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ব্যাপারে উল্লেখ করা আছে। এছাড়া কথা বা লেখার মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানা বা ধর্মীয় কোনও প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিসাধন করা বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ২৯৫ ও ২৯৫(ক) অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। উক্ত দুই ধারার অধীনে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানার বিধান আছে। এছাড়া ফৌজদারী কার্যবিধির ৯৯ (ক) ধারা অনুযায়ী সরকার এই ধরণের যেকোনো প্রকাশনা বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা রাখে। বাংলাদেশের সাইবার জগতের নিয়ন্ত্রক একমাত্র আইন – তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬ এর ৫৭ ধারা অনুসারে, যদি ইন্টারনেটে কোন ব্যক্তির কোন লেখা “রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তিক্ষুণ্ন করে বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করে” তাহলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে এবং এই কাজের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে দশ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ‘এক কোটি টাকা’ জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। আইনের ৬৮ ধারায় বলা হয়েছে যে এই আইনের অধীনের সংঘটিত অপরাধের বিচার কেবলমাত্র সাইবার ট্রাইবুন্যালেই হতে হবে যার গঠন করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কোন সাইবার ট্রাইবুন্যাল গঠন করা হয়নি। অবশ্য আইনের ৭৪ ধারায় যতক্ষণ ট্রাইবুন্যাল গঠিত না হচ্ছে, ততক্ষণ বিচারের দায়িত্ব ফৌজদারী আদালতের হাতে দেয়া থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক স্ট্যাটাস সংক্রান্ত বেশ কিছু মামলা হয়েছে যা হাইকোর্টের কোন বেঞ্চের স্বপ্রণোদিত রুলের মাধ্যমে জারি ও নিস্পত্তি করা হয়েছে।

‘ব্লাসফেমি' আইন হচ্ছে না

সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ায় '৭২-এর আদি সংবিধান পুনঃস্থাপিত হয়েছে উল্লেখ করে হাইকোর্ট বলেছে, বাংলাদেশ এখন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ গত ২২ আগস্টের এক রিটের চূড়ান্ত রায়ে এ অভিমত দেন। ফলে প্রত্যেক নাগরিকের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনের অধিকার ফিরে এসেছে বলে মত দিয়েছে আদালত। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে কোনো ব্যক্তিকে কোনো ধর্মীয় পোশাক পরতে বাধ্য করা যায় না। সব ধর্মের মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। কোনো ধর্মীয় পোশাক কারো ওপর চাপিয়ে দেয়া যাবে না। একই কারণে কাউকে কোনো ধর্মীয় পোশাক পরতে নিষেধও করা যাবে না। প্রতিটি মানুষের শালীনতা বজায় রেখে তার পছন্দ অনুযায়ী পোশাক পরিধানের অধিকার রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিবিসিতে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ব্লাসফেমি আইন হচ্ছে না। ধর্ম অনুভূতিতে আঘাত হানলে দেশের প্রচলিত আইন-অনুযায়ী বিচার করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে শেখ হাসিনা বিবিসিকে জানিয়েছেন। এই অপরাধে কাউকে সাজা দেয়ার এখতিয়ার আদালতের হাতে রয়েছে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

বর্তমান বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে স্বাধীন মতপ্রকাশ আর মুক্তচিন্তার ধারনা ক্রমশ বিকশিত হচ্ছে, তাই ব্লাসফেমি আইনের বিস্তৃতিও ধীরে ধীরে কমে আসছে। তবে মনে রাখতে হবে, মুক্তচিন্তা মানে যা খুশি তাই বলার স্বাধীনতা নয়। অপরের বিশ্বাসে আঘাত হানার নামও বাক স্বাধীনতা নয়। আবার, একটি রাষ্ট্রে ব্লাসফেমি আইন যেন কোনোভাবেই নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে হিসেবে ব্যবহৃত হতে না পারে, অথবা প্রকৃতার্থেই মুক্তচিন্তার পথকে রুদ্ধ করতে না পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা প্রতিটি গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব।

লেখাটি লিখেছেন পরিবর্তন ডট কমের আলমগীর কবীর

Click this link

বিষয়: বিবিধ

২১২১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File