মঈন ইউ আহমেদের ঘোড়া এবং একজন মাহমুদুর রহমানের কলমযুদ্ধ
লিখেছেন লিখেছেন কাইয়ূম আবদুল্লাহ ১৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০৬:০২:৫৭ সকাল
আজ বার বার মনে পড়ছে ভারত থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ৮টি ঘোড়ার কথা। ঘোড়াগুলির প্রাপক বাংলাদেশের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জে. (অব.) মঈন ইউ আহমেদের স্বদেশ সুখকর না হলেও তারা আছে বহালতবিয়তে। সঠিক যতœ-আহলাদ পেলে তারা হয়তো এখন আরো স্বাস্থবতী হয়েছে। করেছে বংশবৃদ্ধিও। কথা সে প্রসঙ্গে নয়। আসল কথা হলো Ñ মঈন ইউ আহমেদ যখন সুখস্বপ্নে বিভোর হয়ে উপহার পাওয়া ঘোড়ার পাছায় ছড়ি মেরে দেশে ফিরছিলেন তখন বুদ্ধিজীবীসহ সচেতন নাগরিক মহল দু’চোখে সর্ষেফুল দেখছিলেন। সর্বত্র বেশ আলোচিত হচ্ছিল, অশনিসংকেতের আভাস দিচ্ছিল যে Ñ এই বুঝি গণতন্ত্র পীষ্ট হয় অশ্বারোহীর খুরের নিচে!
বাংলাদেশের সার্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় একটি কথা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলো যে, এক ঘাটে বাঘে-ছাগলে জলপান করানো সম্ভব হলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রশ্নে দুই নেত্রীকে একসাথে বসানো বা ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব না। কিন্তু জেনারেল মঈন ঠিকই পারলেন। তিনি দুই নেত্রীকে পাশাপাশি বাড়িতে রাখলেন তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম প্রচন্ড প্রতাপাশালী এই দুই নেত্রীর অসহায়ত্ব দেখলো জনগণ। তাদের দলের শীর্ষ নেতাদের অনেকে সুযোগ নিলেন, পরিবারতন্ত্রের যাঁতাকলে পীষ্ট নেতৃত্ব থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করলেন। কিন্তু প্রথমেই বাঁধ সাধলেন সমাজ ও জাতির অগ্রসর চিন্তক সেই লেখক-কলামিস্ট, বুদ্ধিজীবীসমাজই। গুটি কয়েক সুবিধাবাদী গণমাধ্যম ও লেখক-বুদ্ধিজীবী ছাড়া বাকী সবাই দু’নেত্রীর ভুল-ভ্রান্তির উর্ধ্বে দেশের গণতন্ত্রের পূনরুদ্ধারের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিলেন। ভয়, শঙ্কা, রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শুরু হলো কলমযুদ্ধ। এ যুদ্ধে অনেকটা অপরিচিত আনকোরা একজনকে দেখলাম ধুমকেতুর মতো ছুটে আসতে। তিনি আর কেউ নন আজকের বহুল আলোচিত এবং রাষ্ট্রীয় পেশীশক্তির নির্যাতনে পর্যুদস্ত ব্যক্তিত্ব, কলমযোদ্ধা মাহমুদুর রহমান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অগণতান্ত্রিক তৃতীয় শক্তির উত্থান প্রচেষ্টা যাদের লেখনী সংগ্রামে চরমভাবে ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হয়ে দেশ যে গণতান্ত্রিক ধারায় প্রত্যাবর্তন করলো তাদের মধ্যে মাহমুদুর রহমানের নাম উজ্জ্বল ও সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
মানুষের কিছু জন্মগত বৈশিষ্ট থাকে। কেউ লাজুক, কেউ খেলামেলা আবার কেউ কেউ একরুকো। মাহমুদুর রহমানের একরুকোমী হলো যে, তিনি স্বৈরশাসন কিংবা গণতন্ত্রের আবরনে কোনো একনায়কতান্ত্রিকতাকে প্রশ্রয় দেবেন না বা মেনে নেবেন না Ñ এতে তার যা-ই হোক। যার প্রমাণ একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বিপুল জনসমর্থনে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের দেশ পরিচালনার সূচনা থেকে নানা অসংগতি ও দুর্নীতির মুখোন্মুচন করতে গিয়ে লাঞ্ছনা, কারাভোগ এবং রিমান্ডের নামে নির্মম নির্যাতনের কাহিনী। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন বলছি একারনে যে, যে মঈনুদ্দিন-ফখরুদ্দিনরা দুই নেত্রীকে কারাবন্দি করলো, আজকের প্রধানমন্ত্রীকে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করলো। সেই তিনি আবার কোন্ এক মহাপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় শাস্তির পরিবর্তে তাদের সব কৃতকর্মকে বৈধতা দেবার ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন Ñ তা এখনও রহস্যাবৃত। অপরদিকে বিএনপি ও জামায়াত তা আঁচ করতে পেরে প্রথমদিকে তাদের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেও শেষ পর্যন্ত দেশের মঙ্গল ও গণতন্ত্র ফিরে পাবার একমাত্র ভরসা ভেবে তাতে রাজী হয়ে যায়। নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেবার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের স্বপ্ন পূরণের পাশপাশি হঠাৎ করে রাজনীতি বিলাসি, দেশ তোলপাড়কারী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ইচ্ছেমতো হেনেস্তাকারী তৃতীয় শক্তি পার পেয়ে গেলেও রাজনৈতিক বিভীষিকা থেকে উত্তরণ ঘটলো না বিএনপি ও জামায়াতের। সেই রাজনৈতিক বিভীষিকায় এখনো হাবুডুবু খাচ্ছে তারা। ‘উত্তরপাড়া’র সেই তৃতীয় শক্তি পরাস্ত করণ আন্দোলনের কমলসৈনিকদের অন্যতম সেই মাহমুদুর রহমান বিশ্রামের সুযোগ পেলেন না। নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে ফের কলম ধরার অপরাধে এই সরকারের হানিমুন পর্বেই কারাবরণসহ অকথ্য নির্যাতনের শিকার হতে হলো তাকে। আর এখন চলছে চূড়ান্তপর্বের বিভীষিকা।
মাহমুদুর রহমান কী এমন মহা অপরাধ করেছিলেন এবং এখনো করছেন যার জন্যে তাকে জোরপূর্বক হলেও গ্রেফতার করতে হবে তা সাধারণ্যে পরিষ্কার নয়। একজন জ্বালানী বিশেষজ্ঞ হিসেবে সরকারের জ্বালানী বিষয়ক দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করার অপরাধে কারাভোগসহ রিমান্ডে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হলো তাকে। এখানেই শেষ নয়, এখন তাকে ‘উসকানি’ দেয়ার অভিযোগে আবার গ্রেফতার করা হলো। শাহবাগ চত্বরের আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত কয়েকজন ব্লগার অন্যের ধর্ম বিষয়ে বিষোদগার বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম এবং মোহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে ধৃষ্টতাপূর্ণ কটুক্তিতে লিপ্ত। বলা হচ্ছে তাদের অনেকে নাস্তিক। আস্তিক কিংবা নাস্তিক হওয়া যার যার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু কারো ধর্মানুভূতিতে আঘাত কখনো সমর্থন বা সহনীয় বিষয় হতে পারে না। সেই তারা শাহবাগে গণজাগরণের নামে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধ বিচারের রায়ের বিরোধীতা করার পাশাপাশি ধর্মীয় রাজনীতি, ইসলামী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দাবী করছে। আর এতে সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ পদস্থ কর্মকর্তারা স্বশরীরে উপস্থিত থেকে সমর্থন করে যাচ্ছেন, ইসলামী দলগুলোর প্রতি বিষোদগার করছেন। যখনই এর প্রতিবাদে ইসলামী দলগুলো আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ছে সরকার তাদের কঠোর হাতে দামিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। যার ফলশ্রুতিতে অসংখ্য প্রাণ হারাতে হয়েছে। সরকার যখন দেখছে অবস্থা বেগতিক, কোনো কিছুতেই ইসলামী দলগুলোর আন্দোলন দমিয়ে রাখা যাবে না বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামের ঐতিহাসিক লংমার্চ এবং এর পরবর্তী কঠোর কর্মসূচীতে ভীত হয়ে এখন সুর পাল্টে বলছে সব ইসলামী বা ধর্মীয় রাজনৈতিক দল নয় শুধু জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে।
বাংলাদেশের বহুল আলোচিত যুদ্ধাপরাধ বিষয়ের অসংগতি বিশেষ করে বিচারকদের স্খলনজনিত স্কাইপ সংলাপ প্রকাশ করার দুঃসাহস দেখিয়ে আমার দেশ‘র সম্পাদক মাহমুদুর রহমান আবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আসেন, সরকারেরও চক্ষুশোলে পরিণত হন। স্কাইপ স্ক্যান্ডালের অভিযোগ মাথায় নিয়ে স্বয়ং ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম পদত্যাগ করলেও সরকারের উপরমহল থেকে দায়ী করা হচ্ছে মাহমুদুর রহমানকে। সরকারও এই স্খলনের জন্য দায়ী বিচারপতিকে এব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ বা বিচারিক আওতায় না এনে বরং তাকে প্রমোশন দিয়ে পুরষ্কৃত করেছে। আর আক্রোসের সব তীর ছুড়তে থাকে আমার দেশ ও এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের দিকে। ট্রাইব্যুনাল তথা যুদ্ধাপরাধ বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মাধ্যমে পুরো সরকারকেই ধরাশায়ী করে ফেলেন মাহমুদুর রহমান। সেই থেকে সরকারের রোষানল আর পিছু ছাড়ছে না তার। তখন থেকে শোনা যাচ্ছিলো যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন মাহমুদুর রহমান। গ্রেফতার এড়াতে ১৩ ডিসেম্বর থেকে আমার দেশ কার্যালয় থেকে বের হচ্ছিলেন না তিনি। অফিসে থেকেই খাওয়া-দাওয়া চলছিলো, চলছিলো তার অকুতোভয় কলমযুদ্ধও। সম্প্রতি ‘ট্রাম কার্ড’ শিরোনামে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখে সরকারের ভিত আরেকবার নাড়িয়ে দেন। ভাবা হচ্ছিল কর্মক্ষেত্র থেকে ধরে আনার মতো জঘন্য কাজ হয়তো সরকার করবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারও তোয়াক্ষা না করে কমান্ডো স্টাইলে তাকে তার কর্মক্ষেত্র থেকে ধরে এনে সরকার শক্তি প্রদর্শনের নামে কাপুরুষতারই বহিঃপ্রকাশ ঘটালো। এ থেকে প্রমাণিত হয় মঈন উ আহমদদের অশ্বশক্তির উপর ভর করেই চলছে বর্তমান সরকার। আর সেই অশ্বারোহীদের পায়ের নিচে একে একে পৃষ্ট হচ্ছে মানবতা ও মানবাধিকার।
বিষয়: বিবিধ
১৪৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন