[b]তৃতীয় শক্তিতে আবির্ভূত হেফাজতে ইসলাম আল্টিমেটামে বাঁধা বাংলাদেশ আবদুল কাইয়ূম[/b]
লিখেছেন লিখেছেন কাইয়ূম আবদুল্লাহ ১০ এপ্রিল, ২০১৩, ০৭:২৬:৪৪ সকাল
অভূতপূর্ব ও স্মরণীয় এক লংমার্চের নজির স্থাপন করলো হেফাজতে ইসলাম। ৬ই এপ্রিলের এ লংমার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অহিংস আন্দোলনের উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে থাকবে। আশংকা অনুযায়ী বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই লংমার্চের সফল সমাপ্তি হলেও এর আয়োজকরা বাংলাদেশকে কঠিন এক আল্টিমেটামে বেঁধে দিয়েছেন। দাবী না মানলে ৫ মে ঢাকা অবরুধের মতো কঠোর কর্মসূচীর ঘোষণা দিয়েছেন তারা। তাদের এ ঘোষণার মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা থেকেই গেলো। রাজনৈতিক বিশেহ্মষকরা মনে করছেন হেফাজত ঘোষিত মাসব্যাপী কর্মসূচীর পর ৫ মে’র ঢাকা অবরুধের গতিবিধির উপরই নির্ভর করছে বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনৈতিক ভাগ্য। হেফাজতের লংমার্চকে কেন্দ্র করে নানা আশংকা আর উৎকণ্ঠার জন্ম হয়েছিলো জনমনে। শেষ পর্যন্ত সরকারের অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা, অলিখিত নিষেধাজ্ঞা এবং গণজাগরণ মঞ্চসহ বাম রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত অগণতান্ত্রিক প্রতিরোধ ও প্রতিহতের সর্বাত্মক চেষ্টাকে পরাভূত করে হেফাজতের নেতৃত্বে তৌহিদী জনতার লংমার্চ অনুষ্ঠিত হলো ঢাকায়। গণজাগরণের পর মহাগণজাগরণ, দুই জাগরণ সামাল দিতে গিয়ে চরম বেকায়দায়ই পড়েছে সরকার। হেফাজতের আন্দোলনকে প্রতিহত করা কঠিন বুঝতে পেরেই প্রকাশ্য কোনো বাধা না দিয়ে সরকার শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নানা প্রলোভনে ভোলাবার চেষ্টা করেছে। লংমার্চের প্রধান উদ্যোক্তা আলহ্মামা আহমদ শফি তার লিখিত বক্তব্যে তাদের দাবীসমূহ মেনেই কাউকে মতায় থাকতে বা আসতে হবে বলে হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন। তাই তাদের প্রস্তাবকৃত ১৩ দফা ঘোষণার পরপরই সররকারের তরফে তা বিবেচনার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি, জামায়াত, বিকল্পধারাসহ ১৮ দলীয় জোট আগে থেকেই হেফাজতের লংমার্চ সমর্থন করে আসছে। শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রতিনিধিরা এসে সংহতিও প্রকাশ করেছেন। আর মহাজোটের অন্যতম শরীক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদতো পানি পান করানোতেই ব্যস্ত ছিলেন পুরোদিন। তবে এর একদিন পর বিবিসিকে দেয়া সাক্ষা”কারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্লাসফেমি আইন প্রত্যাখানের পাশাপাশি বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপও দৃঢ়ভাবে নাকচ করে দিয়েছেন। অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক ডা. ইমরান এইচ সরকার হেফাজতে ইসলামের বিরশুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলাম ও ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হবার ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষ হয়েছে ময়মনসিংহেও। অন্যদিকে, বিরোধীদলের ৩৬ ঘন্টার হরতাল মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক সমঝোতার পথ না ধরে রাজনীতিবিদরা যে সংঘাতের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে যাচ্ছেন এটা এখন সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এতোদিন শুধু গুঞ্জন আর আশংকা ছিলো যেকোনো মূহুর্তে তৃতীয় কোনো শক্তির উত্থান ঘটতে পারে। অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের ঐতিহাসিক লংমার্চের মাধ্যমে সেই তৃতীয় শক্তিরই উত্থান দেখেছে বাংলাদেশ। তবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সর্বস্তরের মানুষ যে অপশক্তির আশংকা করছিলেন সেটি কিন্তু সে রকম কিছু হয়নি। হয়েছে স্বস্থির, অহিংস নতুন এক তৃতীয় শক্তির উত্থান। রাজনৈকি বিশ্লেষকরা ইতোমধ্যে যাকে দেশে নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটেছে বলে অভিহিত করেছেন। এ উত্থানের মাধ্যমে রাজনীবিদ, সমাজবিদ, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবিসহ সাধারণ মানুষের দুঃশ্চিন্তার অন্যতম কারণ ক্যান্টনমেন্ট তথা অরাজনৈতিক কোনো শক্তির হাত থেকে আপাতত রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশ। সৃষ্ট রাজনৈতিক অরাজকতার সুযোগে ২০০৭ সালের ওয়ান ইলেভেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ভয়াবহ ত রেখে গেছে তা শুকাতে না শুকাতে সেরকম আর কোনো কিছুর পুনরোত্থানের কল্পনা করতে পারছিলেন না কেউই। সৃষ্ট অচলাবস্থা দূর করতে বিভিন্ন মহল থেকে তাই বার বার তাগাদা আসছিলো জাতীয় সংলাপ বা রাজনৈতিক সমঝোতার। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এখনো এরকম কোনো নজির স্থাপিত হয়নি। আমাদের রাজনীতিবিদদের জনাকাংখা পুরোপুরি বুঝতে না পারা কিংবা খামখেয়ালির কারণে রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের ক’বছরের মধ্যেই শোকাবহ ১৫ আগষ্ট, স্বাধীনতার অর্ধশতক পুরো হবার আগেই ’৯০ এর গণঅভূত্থান এবং ওয়ান ইলেভেনের মতো কলংকিত ইতিহাসের জন্ম হয়েছে বাংলাদেশে। তবে আমাদের রাজনীতিবিদরা যে একেবারে বুঝেন না তা কিন্তু নয়। তারা বুঝেন তখন যখন সবকিছু বদলে যায়। বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারই পূণরাবৃত্তি ঘটলো আলোচিত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিতর্কত যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট গণজাগরণ মঞ্চের তথাকথিক কিছু বহ্মগারদের ধর্ম বিদ্বেষ, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলমানদের ধর্ম ইসলাম এবং নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে কটাক্ষের অভিযোগসহ বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক দাবীকে কেন্দ্র করে। বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ প্রচলিত আইনেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। যদিও সে সুযোগ এখনো কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। আইনজীবীরা বলছেন ৫৪ ধারা অনুসরণের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের যে নির্দেশনা রয়েছে তা মেনে চলছে না সরকার। বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে ব্লগারদের গ্রেফতার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘প্রচলিত আইনে গ্রেফতার করেছি, সেই আইনেই বিচার করা যাবে। তবে এখন সবাই সবার মৃত্যুদন্ড চায়। মত্যুদন্ডাদেশ দেওয়ার মালিক তো আর আমি না। দেশে কোর্টকাচারি রয়েছে। তারাই ঠিক করবে, কার মত্যুদন্ড হবে বা কার হবে না। সেটা আমরা করব কীভাবে। এটা সরকার করবে না, সরকারের দায়িত্ব নয়। অর্থা” প্রধানমন্ত্রী পরিস্কার করে দিয়েছেন কারো ফাঁসী দাবি করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এর মধ্যে দিয়ে পরিস্কার হয়ে গেল গণজাগরণ মঞ্চে যে সব সরকারি দলের নেতারা একাত্মতা ঘোষণা করতে গিয়েছিলেন তা সঠিক ছিল না। এখন গণজাগরণ মঞ্চ উল্টো সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। নির্দেশনা দিচ্ছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কী নিতে হবে। এদিকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সম্পৃক্ততার অভিযোগ নাকচ করে সংগঠনটির আমীর আলহ্মামা শাহ আহমদ শফি সরকারকে চ্যলেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন, মিডিয়া যতই মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করশুক না কেন, দেশের ইসলামপ্রিয় জনতা এতে বিভ্রান্ত হবে না। জামায়াত থেকে টাকা নেয়ার কল্পকাহিনীও প্রচার করছে কিছু মিডিয়া। তিনি বলেন, সরকার দুই নৌকায় পা দিয়েছে। সরকারকেই অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। দেশের নব্বই ভাগ লোকের যে ধর্ম সরকার কী তার পক্ষে থাকবে নাকি গুটিকয়েক নাস্তিক ধর্ম বিদ্বেষীদের কথায় উঠবে বসবে? লংমার্চের অনুমতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সরকার আগেই টের পেয়েছে, অনুমতি না দেয়ার পরিণাম কী হতে পারে। লংমার্চে অনুমতি দেয়া না হলে সেদিন সারাদেশে ‘শহীদ’ হতো কয়েক হাজার মানুষ। জামায়াত কিংবা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের লংমার্চ হলে এভাবে সাড়া দিত না সাধারণ মানুষ। মিডিয়াকে তিনি আরো বলেছেন, কোনো প্রলোভন কিংবা কোনো মোহে হেফাজতে ইসলাম বিক্রি হবে না। হেফাজতে ইসলাম মৌলিক অরাজনৈতিক নীতিমালা তথা ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়াদির বাইরে কোনো রাজনৈতিক ভূমিকায় জড়াবে না। হেফাজতের অরাজনৈতিক ইমেজ অব্যহত থকবে। তিনি বলেন, তাদের আন্দোলন ঢালাওভাবে সব বহ্মগ বা ব্লগারদের বিরুদ্ধে নয়। আলেম ও মাদ্রাসা ছাত্রদের মধ্যেও অনেক বহ্মগার আছে। তিনি বলেন, লংমার্চ ও মহাসমাবেশে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি নাস্তিক-মুরতাদদের দেখিয়ে দিয়েছে ইসলামের শক্তি ও সামর্থ্য। তার মানে রাজনীতিতে নতুন হিসাব নিকাশ চলছে হেফাজতকে নিয়ে। রাতে দিনে হরতাল ডেকে সরকার সমর্থকরা হেফাজতের যাত্রা বাধাগ্রস্ত করতে চেয়ে পারেনি। এ ধরনের অপচেষ্টায় ছাত্রলীগ এখনো মাঠে। কিন্তু হেফাজত প্রমাণ করেছে তারা একটা শক্তি। ফুঁ মেরে উড়িয়ে দেয়া যাবে না তাদেরকে। বিদেশী সংবাদ মাধ্যমও হেফাজতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তবে দেশের নারীবাদীরা হেফাজতের সমালোচনা করছেন। হেফাজতের অকস্মা’ অভূতপূর্ব আন্দোলনের পর একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বিস্মিত হলেও অনেকে একে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছেন। তাদের মতে, নিজের মত প্রকাশ ও শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করার অধিকার বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিকের আছে। হেফাজতের ১৩ দফা আমরা সমর্থন করি বা না করি নাগরিক হিসাবে আমাদের স্বীকার করতে হবে যাদের আমরা সমাজের বাইরে রেখে দিয়েছি, কথা বলতে দেইনি, যাদের বিষয়ে ব্যাপারে অযৌক্তিক আতংক আমাদের মধ্যে কাজ করে - এই সমাজ ও রাষ্ট্র তাদেরও। অন্যের অধিকার অস্বীকার করলে নিজের অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তাও হারিয়ে যায়। অন্যকে ’অশিক্ষিত’ ’বর্বর’ ও ’অসভ্য’ বলার মধ্যদিয়ে নিজের অশিক্ষা, বর্বরতা ও অসভ্যতাইর প্রকাশ পায়। যে কারুরই আমরা বিরোধীতা করতে পারি, সমালোচনা করতে পারি, কিন্তু তার নাগরিক অধিকার যদি স্বীকার না করা হয় তাহলে বাংলাদেশকে আরও অন্ধকার গহবরের দিকে ঠেলে দেয়া হবে। ৯৩ বছর বয়সী আল্লামা আহমেদ শফি কোনদিন রাজনীতি করেননি। মাদ্রাসার ছাত্র আর আলেমদের মধ্যে তার কি যে প্রভাব রয়েছে তা লংমার্চে প্রমাণ হয়েছে। শত ইন্ধন আর প্রলোভনের মধ্যেও তিনি হটকারিতাকে বেছে নেননি। চাপ ছিল তাকে ১৩ দফা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শাপলা চত্বরে বিপহ্মবের সূচনা করতে। সতীর্থদের তিনি বলেছেন, সরকারকে সময় দিতে হবে। দেখি না সরকার কি করে? একমাস পর ভাববো কি করা যায়। পরিবেশগতভাবে বাংলাদেশের আবহাওয়ায় চৈত্র-বৈশাখ অসহিষ্ণু ও বিরূপতার কাল। বাংলাদেশের ঈশান কোণে যে কালো মেঘের ঘনঘটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তার শেষ পরিণতি কী হবে - কাংখিত দিগন্তপ্লাবী বৃষ্টি নাকি কালবৈশাখীর তান্ডবের মধ্য দিয়ে! সেই উৎকণ্ঠায় দিন গুণছেন বাংলাদেশসহ বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুরো বাঙালি জাতি।
বিষয়: বিবিধ
১৩৬২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন