সম্পত্তি

লিখেছেন লিখেছেন সিকদারর ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭, ০৯:১৮:৪১ রাত

উহ ! কি বৃস্টি ! যেন আকাশ নামক কলসিটার কোথাও বিশাল ফুটো হয়ে গেছে, যেন তার ভেতরকার সব পানি গড়িয়ে জমিনে পড়ছে । পিচঢালা রাস্তা, কিছুদুর পর পর সিটি কর্পোরেশনের লাইট জ্বলছে তাই আছড়ে পড়ার সমস্যা নাই, যতটা সম্ভব দ্রুত হাটার চেস্টা করছি । মোবাইলে সময় দেখলাম রাত একটা চল্লিশ । স্লেট রংগা আকাশে হঠাত হঠাত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মনে পড়ছে ঠিক এমন পরিস্থিতিতে আরেকবার পড়েছিলাম, আজ হতে তিরিশ বছর আগে ।

পূর্বের ঘটনাটা আগে বলি।

তখন আমার বয়স প্রায় পনের কি ষোল বৎসর । আমাদের দুই ভাইকে এতিম করে বাবা মারা গিয়েছেন প্রায় আট মাস আগে । আমার মা গ্রাম্য বিধবা মহিলা । পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী আমার পিতা মারা যাওয়ার পর অভাবে পড়ে গেলেন । আত্মীয় স্বজনের দান-দক্ষিনায় মাস দুইয়েক চলার পর শুরু হল ধার কর্জ । প্রথম প্রথম ধার পাওয়া গেলেও মাসখানেক এর মধ্যও যখন ধারের টাকা ফেরত দিতে পারলেন না , তখন তাও বন্ধ হয়ে গেল । এখন আর কোন উপায় না দেখে আত্মিয়দের পরামর্শে আমাকে ক্লাস টেন থেকে ছাড়িয়ে, শহরে পাঠিয়ে দিলেন চাকরি করার জন্য ।

আব্বা মারা যাওয়ার পর আরেকটা সমস্যা দেখা দিল । আমাদের সম্পত্তির শরিকদাররা যে যেভাবে পারছিল আমাদের অভিভাবকহীন সম্পত্তি গ্রাস করা শুরু করল । গ্রাস করার কারন হল, আমার দাদার কেনা কিছু সম্পত্তি ছিল যা উনি উনার আপন ভাই হতে ক্রয় করে ছিলেন। তখন ব্রিটিশ আমল তাই হয়ত রেজিস্ট্রি করা হয় নাই । যথা সম্ভব মৌখিক ভাবেই বেচা কেনা হয়েছিল। তাই কোন কাগজ পত্র হয়েছিল কিনা তখন আমাদের জানা ছিল না । আমার বাবাও জানতেন কিনা জানিনা । যাই হোক, সেই দাদার ওয়ারিশরা এখন বলছে, এই সম্পত্তি ওদের দাদা আমার দাদার কাছে বিক্রি করেন নাই । আমার দাদা অভাবি ছিল, তাই ব্যাবহার করতে দিয়েছিলেন ।যদিও এতদিন জেনে এসেছি আমার দাদার সাহায্য ওর দাদার প্রায় প্রয়োজন হত ।

এই নিয়ে আগামিকাল গ্রাম্য সালিশি হবে সেখানে আমরা যদি কোন প্রমান দেখাতে পারি যে, আমার দাদা এই জায়গা ক্রয় করেছিলেন, তাহলে আমাদের জায়গা আমাদেরই থাকবে তানা হলে ওরা জায়গা দখল করে ফেলবে।

আমি আজ সন্ধ্যায় আমাদের গ্রামের এক লোক মারফত আগামীকালের সালিশির খবরটা পেয়েছি । আমার বিধবা মা জায়গা বাঁচানোর আর কোন পথ না পেয়ে আমার কাছে খবর পাঠিয়েছেন, যেভাবেই হোক কাল যেন সালিশীতে হাজির থাকি । আমি জানি কিছুই করতে পারব না, তারপরও অসহায় মা আমার কি করে এই সালিশিতে হাজির হবেন।এই ভেবে আমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার মা ছিলেন খুবই দ্বীনদার পর্দানশীন মহিলা।

যাইহো্‌ক, খবর পেয়ে রাত নয়টা বাজে মালিক হতে ছুটি নিয়ে বাস ষ্টেশন আসতে আসতে দশটা বেজে গেল । স্টেশনে এসে দেখি কোন গাড়ি নাই । অনেকক্ষণ অপেক্ষার আমার মত আরও বেশ কিছু যাত্রী পাওয়া গেল । তবে তারা সবাই কাছের যাত্রী । আমার মত দুরের কেউ নাই । কাছের যাত্রিদের নেওয়ার জন্য একটা গাড়ি পাওয়া গেল । কি আর করা যতটুকু এগিয়ে থাকা যায় এই ভেবে আমিও ওই গাড়িতে উঠে পড়লাম।গাড়ি ছাড়ার কিছুক্ষন পর শুরু হল মুষলধারে বৃস্টি । আমি ঘাবড়ে গেলাম, হায় একি অবস্থা মড়ার উপর দেখি খাড়ার ঘা। বের হওয়ার সময় রাতের আকাশ খেয়াল করিনি তাই ছাতিটাও নেওয়া হয় নাই । নিরুপায়, এখন কিছুই করার নাই তাই দেখা যাক কি হয়, এই ভেবে নিজেকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করলাম । আমার বাড়ি হতে দশ মাইল দূরে থাকতেই বাস তার যাত্রা শেষ করল । তখন বাজে রাতের বারটা । বৃষ্টি অনেকটা কমে এসেছে । বাসের সব যাত্রী নেমে যার যার গন্তব্য চলে গেল । আমি একা ছোট নির্জন এক বাজারে দাঁড়িয়ে আছি ।যার দোকানপাট সব বন্ধ । এখান হতে আমাদের বাড়ি আরও দুই মাইলের মত । কি করব ভাবছি , এমন সময় দেখি একটা বেবি ট্যাক্সি এসে দাড়াল । ড্রাইভারের পাশের সিটটা খালি । আমি তাড়াতাড়ি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় যাবে ? ড্রাইভার জায়গার নাম বলতেই বুজতে পারলাম । এই গাড়িতে এক মাইলের মত যেতে পারব তারপরের পথটুকু আমার হেটে যাওয়া ছাড়া আর কোন গতি নাই । যথাস্থানে বেবিট্যাক্সি থেকে নামলাম ।নেমে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলাম ।

মধ্য রাতের সময় পার হয়ে ঘড়ির কাটা প্রায় একটার ঘর ছুই ছুঁই ।ঘুট ঘুটে অন্ধকার কিছুই দেখা যাচ্ছে না । চাঁদ বিহীন আধার রাতেরও একটু আলো থাকে । দূর আকাশের তারার আলো ।, কিন্তু মেঘে ঢাকা আকাশ মনে হয় কবরসম অন্ধকার ।নিজের বাড়ির চেনা পথ তাই হাটতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না । ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে গ্রামের মেঠো পথটা পিচ্ছিল হয়ে আছে । সাথে কোন ছাতা নাই তাই ইতিমধ্য প্রায় কাক ভেজা হয়ে গেছি ।

হাটছিত হাটছি পথ যেন আর ফুরায় না । এখনও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে সেই সাথে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস গায়ের কাপড় ভিজে কাঁপুনি ধরে গেছে , ক্ষনে ক্ষনে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে । বিদ্যুতের আলোয় দেখছি এখনও আরও আধা ঘন্টার রাস্তা বাকি।বাবার রেডিয়ামওলা হাত ঘড়িটা দেখলাম রাত একটা বিশ মিনিট। আঁধারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না । হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে উচু হয়ে থাকা ছোট্ট ঢিবিতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। ঠিক এই সময় কে যেন আমার হাত ধরে টান দিল।চমকে উঠলাম! লোকটির টানে আমি উঠে দাড়ালাম। আঁধারে কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। এই সময় আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠল । দেখতে পেলাম এক বৃদ্ধ লোক । মুখে সফেদ দাড়ি। আমার হঠাত ভয় পেয়ে উঠা বুকটা নির্ভরতায় ভরে গেল। আমার দিকে আন্তরিকতার সাথে মুচকি হেসে তাকিয়ে রয়েছেন । উনাকে দেখে কেমন যেন চেনা চেনা লাগল । কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছি না । স্পষ্ট বুঝতে পারছি উনি আমার খুবই চেনাজানা কিন্তু অনেক চেস্টা করেও উনার পরিচয় মনে করতে পারলাম না । বৃদ্ধ লোকটি বলল “বাড়ি বোধহয় আর বেশি দূরে নাই চল ওই শশ্মানের পথটুকু পাড় করে দেই ।

এতক্ষন শশ্মানের ব্যাপারটা একটুও মনে ছিল না । উনি বলাতে সারা দেহ ভয়ে কেপে উঠল । বৃদ্ধ বোধহয় বুজতে পারলেন। “ ভয় নাই আমি সাথে আছি। তোকে জায়গাটা পার করে দিয়ে যাব।“

আমার ভয় অনেকটা কেটে গেল । শশ্মানটার ভালই বদনাম আছে। অনেকেই এখানে অনেক কিছু দেখে ভয় পেয়েছে । তাই রাতের বেলা কেউ একা শশ্মানটার পাশ দিয়ে যেতে চায় না । তারপরও কেউ যদি একা যায় তাহলে সে ভীতিকর কিছুনা কিছু দেখবেই । এতে অনেকেরই পরবর্তী জীবনে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

দুজনে নীরবে পাশাপাশি হেটে আমাদের পাড়ার মুখে চলে এলাম। বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে গেলেন।আমার হাতে পলিথিনে জড়ানো কিছু কাগজ দিয়ে বললেন “ আগামী কাল অমুক মাতব্বরকে এই কাগজগুলো দিবি। “

আমার হাতে দেওয়া কাগজগুলো দেখার জন্য মাথা নিচু করে আবার তাকাতেই দেখি আশেপাশে কেউ নাই । পাড়ার রাস্তার মুখে এই অন্ধকারে আমি একা বৃস্টিতে ভিজছি । বৃস্টি ভেজা ঠাণ্ডা বাতাসে না ভয়ে কেন জানিনা , আমার শরীর কাঁপতে লাগল । তাড়াতাড়ি বাসায় এলাম। মাকে সব ঘটনা বললাম । মা শুনে তাড়াতাড়ি সুরা ফালাক সুরা নাস পড়ে আমার গায়ে ফু দিতে লাগলেন । কিছুক্ষন পর আমি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর মা পলিথিনের ভিতর থেকে কাগজগুলি বের করে দেখতে দেখতে উনার দুই চোখ খুশীতে ঝলমলিয়ে উঠল আর মুখে অনবরত” সোবহানাল্লাহ ! সোবহানাল্লাহ !” পড়তে পড়তে বললেন “এগুলি তোর দাদার কেনা জায়গার রেজিস্ট্রির দলীল।‘”

তখনই আমি বৃদ্ধ লোকটিকে চিনতে পারলাম। লোকটি ছিল আমার দাদা যিনি আমার দশ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন ।

সেই হতে তিরিশ বছর পর, আজ আবার একই আবহাওয়ায় পড়ে রাতের আঁধারে ভিজে ভিজে বাড়ি যাচ্ছি । কি অদ্ভুত মিল সেই তিরিশ বছর আগের রাতটির সাথে আজকের রাতের। যদিও এই তিরিশ বছরে আমার জীবন অনেক খানিই বদলে গেছে। বয়স বেড়েছে বদলেছে সামাজিক অবস্থান । সেদিন আমি ছিলাম দোকানের সাধারন কর্মচারী আজ আল্লাহর রহমতে আমি চারটি দোকানের মালিক । শহরে নিজের চারতলা বাড়ি। নিজস্ব প্রাইভেট কারে চলেফেরা করি।

আজও বাড়ি যাচ্ছি দাদার সেই জায়গার ব্যাপারে। ওয়ারিশ সুত্রে এখন সেই জায়গার মালিক আমরা দুই ভাই। আমার ছোট ভাই বছর খানেক আগে মারা গেছে। এরপর থেকে ওর সংসারের সম্পূর্ণ ব্যায়ভার আমিই বহন করছি । ভাইটির একমাত্র ছেলে সন্তানের পড়লেখা এবং মা ও ছেলে জিবনযাত্রার যাবতীয় দায়িত্ব আমিই বহন করছি । তারাই নাকি গতকাল আমার দাদার কেনা সেই জায়গা ভাগ করার কথা বলেছে। ভাগ করে দিলে ওরা ওই জায়গায় কিছু গাছ পালা রোপণ করবে। এখন আমার অনুমতি না পেলে ওখানে কিছু করতে পারছে না। আমি ওদের এই কথা শোনার পর মাথার মেজাজ গরম হয়ে গেছে। কারন ওই জায়গাটা সম্পূর্ণ আমার নামে নামজারি করে, সেখানে বাংলো টাইপের একটা বাড়ির করা ইচ্ছা আছে । ওরা ওদের ভাগ খোঁজা কারনে আমার সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম । তাই খবর পাওয়ার সাথে সাথে বাড়ি আসার জন্য চিন্তা করলাম, কিন্তু দোকানের হিসাব কিতাব সারতে সারতে রাত বারটা বেজে যাওয়ায় বের হতে দেরি হয়ে গেল। দেরি হলেও তেমন কোন সমস্যা ছিল না , কারন নিজের প্রাইভেট কারে করে যাব তাই চিন্তা নাই । যথাসময়ে গাড়ি নিয়ে বের হলাম , ভালই চলছিল বাড়ির পথ প্রায় মাইলখানেক থাকতেই হঠাত গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেল । বাইরে বৃস্টি ছাতিটাও আনা হয়নি । তাই কি আর করা এই বৃস্টিতে ভিজেই বাড়ি যেতে হবে । কতক্ষণ গাড়ীতে বসে থাকা যায় । গাড়ি থেকে বের হতে একটু অন্যমনস্ক থাকায় হঠাত করে গাড়ির দরজার উপরের অংশের সাথে বাড়ি খেলাম । ড্রাইভার তাড়াতাড়ি দৌড়ে এল । আমি মাথায় হাত দিয়ে বুজতে পারলাম কপালের চামড়া হাল্কা ছিড়ে গেছে । ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে, ড্রাইভারসহ গাড়ি রেখে, আমি বৃস্টিতে ভিজে হেটে হেটে বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলাম।

উহ! কি বৃস্টি! রাস্তা পিচঢালা। কিছুদুর পর পর সিটি কর্পোরেশনের লাইট জ্বলছে তাই আছড়ে পড়ার সমস্যা নাই। যতটা সম্ভব দ্রুত হাটার চেস্টা করছি । মোবাইলে সময় দেখলাম রাত একটা চল্লিশ বাজে ।বাড়ি এখনো বেশ কিছুটা দূরে। আগে এই পথে একটা শশ্মান ছিল এখন সেখানে পাচতলা মার্কেট । তাই ভুতপ্রেতের সেই পুরাতন কালিন ভয়টা নাই ।হাটতে হাটতে নিজের ভাগ্যকে নিজে বকা দিচ্ছি , হায়রে দুনিয়া যাদের জন্য করি তারা আমাকে ঠকাতে বসে র‍যেছে । বুজলাম, জায়গাতে তোদের ভাগ আছে তাই বলে, আমি যে তোদের জন্য এত কিছু করছি সেই কথাটা একটু ভাবলি না ।

হঠাত শুনি পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল “ ওদের হকের জায়গা ওরা চাইছে এতে তোমার দিতে সমস্যা কোথায় ?

আমি চমকে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম, একলোক আমার পাশে হাটতে হাটতে কথা বলছে। লোকটাকে দেখে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে কিন্তু অনেক ভেবেও মনে করতে পারলাম না । লোকটা মধ্যবয়স্ক , গায়ের রং ফর্সা , মাথায় কাচাপাকা চুল । মুখের দাড়িও কাচাপাকা । কপালে কিছুক্ষন আগে আঘাত পাওয়া ছোট্ট একটা কাটা দাগ।কাটা দাগের উপর হাল্কা রক্ত আসছে বৃস্টির পানিতে আবার ধুয়ে যাছেচ । আমি লোকটাকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম । কোত্থেকে এল? চট করে দাদার কথা মনে পড়ল । না এই দাদার মত নয় । চেনা চেনা লাগছে আমাদের গ্রামের কোন লোক হবে হয়ত । কিন্তু তুমি করে বলছে কেন ? যদিও দুজনেই সমবয়সী হব। শরীরের গঠন গাঠন প্রায় একই কিন্তু তুমি ডাকার মত এমন চেহারার কোন বন্ধুত আমার নাই ।

লোকটি বলতে লাগল “ “ তুমি ওদের সাহায্য করছ ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের দায়িত্ব থেকে ভালবাসা হতে , রক্তের সম্পর্কের টানে , তাই বলে ওদের অভাবের ও অসহায়ত্বের সুযোগ কেন নিবে?তোমার ইচ্ছা না হলে ওদের সাহায্য করবে না। তাই বলে এতিমের হক খাওয়ার জন্য বসে আছ ।

তোমার কি আল্লাহর ভয় নাই আল্লাহ কোরআনে কি বলেছে

“” আর ( এতিমদের সম্পর্কে ) মানুষের ভয় করা উচিত, যদি তারা পিছনে অসহায় সন্তান ছেড়ে যেত (তবে) তারাও তাদের সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হত । অতএব লোকের উচিত ( এতিম-অনাথ সম্পর্কে ) আল্লাহকে ভয় করা এবং ন্যায়সংগত কথা বলা । নিশ্চয় যারা পিতৃহীনদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে , তারা তাদের উদরে অগ্নি ভক্ষন করে, তারা জলন্ত আগুনে জ্বলবে । সুরা নিসা আয়াত চার ও পাঁচ । “”

তারপরও তুমি কেমনে সাহস কর, তোমার অসহায় ভাতিজার সম্পত্তি গ্রাস করার । তোমার কি মৃত্যুর ভয় নাই ? সাবধান সাবধান কেয়ামতের মাঠে এই জমিনের সাতস্তবক তোমার কাঁধে তুলে দেওয়া হবে , সেদিন কোন ক্ষমতা কোন ধন সম্পদ তোমাকে বাচাতে পারবে না ।

লোকটা এক নাগাড়ে কথা বলতে লাগল । আমি যে কিছু বলব সেই সুযোগ পাচ্ছিনা । তারপর সে একটু থামতেই আমি বললাম “ তুমি কে ? আমাকে এই রাতে উপদেশ দিতে এসেছ । আমি কি কোরআন হাদিস তোমার থেকে কম জানি ? আমি যা করছি ন্যায়ভাবেই করছি ।

হ্যা , অপরাধ করার সময় সবাই তাই বলে । যখন অন্য কেউ কোন অপরাধ করে , মানুষ তখন সব সময় তা অন্যায় হিসাবেই দেখে, আর যখন নিজে কোন অপরাধ করে তখন নিজের সেই অপরাধকে জায়েজ করার জন্য নানা ধরনের সত্য মিথ্যা ফতোয়া ও আইনের অবতারনার আশ্রয় নেয় ।

আমি এবার দাঁড়িয়ে গেলাম “ কি ব্যাপার তুমি কোথাকার কে হঠাত মাঝ রাতে আমায় এসেছ উপদেশ দিতে ঘটনা কি বলত ।

“ তুমি আমাকে ভাল করেই চেন ।এখন চিনতে পারছ না কারন তোমার মাথায় এতিমের হক মেরে খাওয়ার চিন্তা ঘুরপাক খাছেচ । তাই চেনা মুখও তোমার কাছে অচেনা হয়ে গেছে । ধিক তোমাকে ধিক ! সাধারন এক সম্পত্তির লোভে এতটা নিচে নেমে গেছ । ভেবে দেখ এই সম্পত্তি তুমি কোন কবরে নিয়ে যেতে পারবে না । এমনকি হাশরের বিচারের পর যখন বেহেশ্তে যাবে তখনও কোন ফেরত নেবে না । কারন বেহেশতের সম্পদের তুলনায় এই সম্পত্তিকে মনে হবে মলমুত্র সম।

আমি বিরক্ত হয়ে গেলাম। এই রাতে আচ্ছা এক ত্যাঁদড় লোকের পাল্লায় পড়েছি । থামছেও না ছাড়ছেও না । কি এক মহা জ্বালায় পড়লাম। ওর উপদেশ ও দিয়েই যাচ্ছে । থামাথামির কোন লক্ষন নাই। আমি আমার পদক্ষেপ আরও দ্রুত করলাম তাড়াতাড়ি ওকে পিছনে ফেলে অনেকটা সামনে এগিয়ে গেলাম। যত দ্রুত বাড়ি পৌঁছতে পারি , তত তাড়াতাড়ি এই যন্ত্রনাকে ঝেড়ে ফেলা যাবে।

যাই হোক শেষ পর্যন্ত বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছলাম । গেটের সামনে এসে গেটে হাত দিয়ে বাড়ি দিতে দিতে পিছন ফিরে দেখি আপদটা নাই । স্বস্থির নিশ্বাস ফেললাম যাক আপদটা বিদায় হয়েছে ।

বাসায় ঢুকে তাড়াতাড়ি ভেজা কাপড় বদলে নিলাম । তারপর সুস্থির হয়ে ভাবতে লাগলাম লোকটা কে ? ভাবতে ভাবতে কপালে হাত দিতে গাড়ির দরজার ভিতরের ফ্রেমে বাড়ি খেয়ে ছিড়ে যাওয়া আঘাতে ব্যাথা করে উঠল । উঠে আয়নার সামনে গেলাম কতটুকু কেটেছে দেখার জন্য । আয়নায় নিজের দেখতেই চমকে উঠলাম ! একই আয়নায় কাকে দেখছি ? আমাকে না কিছুক্ষন আগে রাস্তায় বকবক করা সেই লোকটিকে ?

সেই মধ্যবয়স্ক , গায়ের রং ফর্সা , মাথায় কাচাপাকা চুল । মুখের দাড়িও কাচাপাকা । কপালে কিছুক্ষন আগে আঘাত পাওয়া ছোট্ট একটা কাটা দাগ। একই রকম ! তাহলে আমি কি নিজেকেই নিজে দেখেছি ?

পরদিন সকালে ভাতিজাকে ডাকলাম । ভাতিজা এখন যথেস্ট বড় হয়েছে ।এইবার এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছে।ফলাফল খুব ভাল করেছে ।

বললাম “ ওই জায়গাতে কি কি গাছ লাগাবি? চারা অমুক নার্সারি থেকে যা লাগে নিয়ে রোপণ কর । নার্সারির মালিককে বলিস আমি টাকা দেব । আর এখনকার কাজ শেষ করে শহরে আমার বাসায় যাবি। যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া চাই । এখন থেকে শহরে আমার ওখানে থেকে পড়ালেখা করবি।

আমার কথা শুনে ভাতিজা তার মার মুখটা পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জল হয়ে উঠল ।

২৮/০৮/২০১৭

বিষয়: সাহিত্য

১০৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File