গত ১১ সেপ্টেম্বর মক্কায় ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা ও আমাদের ( মুসলমানদের ) ভাবনা ও বিভ্রান্তি ।
লিখেছেন লিখেছেন সিকদারর ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৯:৫৯:০১ রাত
গত ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫ মুসলমানদের সর্বোচ্চ পবিত্র মসজিদ বায়তুল্লাহ শরীফে আছরের নামাযের পর ঘটে গেল ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মর্মান্তিক দুর্ঘটনা । যে দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১৩২ জন নিহত ও ১৮৪ জন আহত হয়েছে ।
এই দুর্ঘটনার পর পরই শোকে মূহ্যমান সারা বিশ্বের মুসলমানদের চোখের পানি ও হদয়ের ব্যাথা প্রশমিত হতে না হতেই ইসলাম বিরোধী চক্র শুরু করে দিয়েছে মহাসত্য বাণী আল-কোরানের অপব্যাখ্যা ।
প্রাচীন ইতিহাসে পাওয়া যায় মহানবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওায়াসাল্লামের জন্মের কিছুদিন আগে বাদশাহ আবরাহা প্রথম মক্কা আক্রমন করার অভিপ্রায়ে আসলে তাকে আল্লাহতালা আবাবীল পাখির মাধ্যমে ধ্বংস করে দেন ।
আবরাহার বাহিনীর আক্রমনের পর ৭২ হিজরীতে অত্যাচারী শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের শাসনামলে মক্কায় ঘটেছিল আর এক হতাহতের ঘটনা। তখন হাজ্জাজ বাহিনীর আক্রমনে একজন সাহাবীসহ বহু লোক নিহত হন। তখন ছিল হ্বজের মৌসুম । সেই সময় হাজ্জাজ বিন ইউসুফ সাকাফির নেতৃত্বে মোট ৭ হাজার সিরীয় সৈন্যসহ সাহাবা ইবনে জুবায়েরকে রাদীয়াল্লাহুতালা আনহুকে কাবাঘরে অবরুদ্ধ করে রাখে। ইবনে জুবায়ের রাদীয়াল্লাহুতালা আনহু কাবাঘরে অবরুদ্ধ অবস্থায় হ্বজ পালন করেন। হ্বজ শেষে আবু কুবাইশ ও কুয়াইকিয়ান পাহাড়দ্বয়ে অবস্থান নিলে। সেখানে হাজ্জাজের বাহিনী কামানের গোলা নিক্ষেপ করে । নিক্ষিপ্ত গোলা এসে পড়তে লাগল কাবার চত্বরে। এভাবে চলল বিরামহীন ধ্বংসযজ্ঞ। ইবনে জুবায়ের রাদীয়াল্লাহুতালা আনহু ও তার সংগীরা কাবার চত্বরে অবরুদ্ধ অবস্থায় কিছু দিনের মধ্যেই খাদ্যভাব দেখা দিল । ক্ষুদা-পিপাসায় সবার অস্ত্র ধারণ কঠিন হয়ে পড়ল।
শেষ পর্যন্ত ক্ষুদা-পিপাসায় দুর্বল ইবনে জুবায়ের রাদীয়াল্লাহুতালা আনহু ও তার সংগীরা মঙ্গলবার ১৮ জমাদিউল আউয়াল ৭৩ হিজরতে দুই হাতে দুই তরবারি নিয়ে হাজ্জাজ ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। একসময় কামানের গোলার আঘাতে উপুড় হয়ে পড়ে গেলেন ৭২ বছর বয়সী বৃদ্ধবীর সাহাবা ইবনে জুবায়ের রাদীয়াল্লাহুতালা আনহু ।এরপর তিনি কোন রকমে বাম হাতে ভর করে উঠে বসলেন। তখন একজন সিরীয় সৈন্য তার বাম হাত কেটে ফেলল। এবার এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। পরক্ষণে শত্রুরা সংঘবদ্ধ হয়ে একযোগে তার ওপর হামলে পড়ল। তার দুই পা দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। এমনকি শিরচ্ছেদ করে মস্তক নিয়ে চলে গেল বাদশাহর দরবারে। দেহ পড়ে থাকল কাবার চত্বরের মাটিতে। সেদিন তার সঙ্গে আরও ২৪০ জন শহীদ হয়েছিলেন।
এরপরে হতাহতের ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৭৯ সালে- শিয়াদের বিদ্রোহের সময়। তখনও বহু মানুষ নিহত হয়েছে।জুহাইমান বাহিনীর প্রায় ২৬০ জন বিপথগামী সৈন্য স্বল্পস্থায়ী এ যুদ্ধে নিহত হয় এবং আর ৫৬০ জন আহত হয় যদিও ইতিহাসবিদদের মতে এ সংখ্যা ছিল আরো বেশি। অন্যদিকে হারাম শরীফ উদ্ধারে নিয়োজিত সেনাবাহিনী এবং পুলিশ সদস্যের মধ্যে ১২৭ জন নিহত হন এবং আহত হন ৪৫১ জন।সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী জুহাইমানের ৭০ জন সহযোগী যাদেরকে পরবর্তীতে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়।
এরপর ১৯৮৯ সালে দুইটি ভয়াবহ বিস্ফোরণের ফলে মক্কায় ঘটেছিল আরেকটি বড় দুর্ঘটনা। এতে একজন নিহত ও ১৬জন আহত হন।
এরপর বর্তমানে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটে গেলো ১১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ২০১৫ সালে । যেখানে এখনো পর্যন্ত ১৩২জন নিহত ও ১৮৪জন আহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। এই ঘটনায় মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি সদস্যের হৃদয়ে রক্ষক্ষরণ শুরু হয়েছে, নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
আল্লাহতালা কুরআনের একাধিক জায়গায় মক্কাকে ‘নিরাপদ’ নগরী ঘোষণা দিয়েছেন। তবে কেন মক্কায় এমন একটি দুর্ঘটনা ঘটলো এবং কেন এমন হতাহতের সংবাদ এলো? সম্প্রতি ক্রেন ভেঙ্গে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার পর এই প্রশ্নটি বহু মানুষের মনেই জাগ্রত হয়েছে।
সুরা আলে ইমরানের ৯৭ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন –‘যে ব্যক্তি সেখানে (মক্কার হারাম) প্রবেশ করেছে, সে নিরাপত্তা লাভ করেছে’।
সুরা আনকাবুতের (আয়াত নং ৬৭) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-‘তারা কি দেখে না যে, আমি (মক্কা নগরীকে) একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল করেছি। অথচ এর চতুপার্শ্বে যারা আছে, তাদের উপর আক্রমণ করা হয়’।
সুরা তীনে আল্লাহ তাআলা মক্কাকে নিরাপদ শহর হিসেবে অভিহিত করেছেন। সুরা বাকারায় (আয়াত ১২৫) আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-‘আর স্মরণ করো তখনকার কথা যখন আমি এই গৃহকে (কাবা) লোকদের জন্য কেন্দ্র ও নিরাপত্তাস্থল গণ্য করেছিলাম’।
সম্প্রতি সৌদি আরবের মক্কায় ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনাটি নিয়ে অনেকেই এমন প্রশ্ন করছেন তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, কুরআনে বর্ণিত উপরোল্লেখিত মক্কা ও মক্কার মসজিদকে ‘নিরাপদ’ বলে আখ্যায়িত করার বিখ্যাত কয়েকটি ব্যাখ্যা রয়েছে। ব্যাখ্যাগুলো নিন্মরূপ-
আয়াতে উল্লেখিত নিরাপত্তা বলতে জাহেলী যুগের নিরাপত্তার কথা বুঝানো হয়েছে। তখন হারাম শরিফে কেউ প্রবেশ করলে তাকে আর কোন ধরণের আক্রমন করা হত না। অনেকে সাধারণ অর্থে হারাম শরিফে প্রবেশকারীর নিরাপদ থাকার অর্থ করেছেন। অর্থাৎ হারামকে আল্লাহ তা’আলা এতোটা মর্যাদা ও গাম্ভীর্য দান করেছেন যে সেখান আশ্রয়,নেয়া কোন খুনিকে কেউ সেখানে হত্যা করত না।
কোন কোন তাফসীরবিদ বলেছেন মক্কা শরীফের নিরাপত্তার মানে হলো, মানুষের গুনাহের ফলে আল্লাহ প্রদত্ত যে আযাব-গজব নাজিল হয়ে থাকে, তা থেকে মক্কার এই মসজিদ নিরাপদ থাকবে। (এই দু’টি ব্যখ্যা ইমাম তাবারীর তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে।) যেমনটি (সুরাতুল বাকারা ১২৬ নং আয়াতে) ইবরাহিম [আ.] দু’আ করেছিলেন।
কেয়ামতের পূর্বলগ্নে পৃথিবীর কোন শহর ও জনপদ দাজ্জালের ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকবে না। প্রতিটি স্থানে সে হানা দিবে। কিন্তু মক্কা (এবং মদীনা) নগরীতে সে প্রবেশ করতে পারবে না। এমর্মে সহীহ বোখারী ও মুসলিমে একাধিক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এর আলোকে অনেক মুফাসসির বলেন-মক্কা ও তাতে প্রবেশ কারীর নিরাপত্তা বলতে মানব ইতিহাসের সবচে বড় ফিতনা "দাজ্জালের" ফিতনা থেকে নিরাপদ থাকার কথা ইঙ্গিত করা হয়েছে।
অনেকের মতে, এখানে ‘সংবাদ সূচক শব্দ’ ব্যবহার করা হলেও উদ্দেশ্য নির্দেশ জারি করা। যা আল কুরআনের বহুল প্রচলিত ও প্রসিদ্ধ একটি পদ্ধতি। উদ্দেশ্য হলো, শাসকগণ যেন হারামে প্রবেশকারীদের কোন প্রকার অনিষ্ট সাধন না করেন, বরং তাদের নিরাপত্তা বিধান করেন। ইমাম জাসসাস সহ অনেকেই এমনটি ইঙ্গিত করেছেন।
অনেকে বলেছেন, মক্কার হারামে প্রবেশকারীকে নিরাপদ বলার অর্থ হলো, সেখানে কোনরূপ দণ্ড বাস্তবায়ন চলবে না। সুতরাং সেখানে কোন খুনী বা কাফেরকে হত্যা করা যাবে না, চোরের হাত কাটা যাবে না ইত্যাদি।
বিগত ৫ হাজার বছরে মক্কা কখনো বহির্শক্তি দ্বারা বারবার আক্রান্ত হলেও কেউ দখল করতে পারেনি। ইবরাহিম আলাইহি অয়াসাল্লাল্লাম এর দোয়ার ভিত্তিতে সেই দিক থেকে (বহির্শক্তির দখল হতে) নিরাপদ রাখার অর্থও হতে পারে। সুরাতুল আনকাবুতের ৬৭ নং আয়াতে এদিকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়।
তাই উপরোক্ত বাক্যগুলোতে লক্ষ্যনীয় যে, নিরাপত্তা’র ব্যাখ্যায় আজো পর্যন্ত কোন তাফসীরবিদ এ কথা বলেননি যে, মক্কা ও হারামের নিরাপদ হওয়ার অর্থ-‘মক্কায় মনুষ্যসৃষ্ট কিংবা প্রাকৃতিক কোন দুর্ঘটনা ঘটবে না’। বরং অন্য দশটি শহরের মতো মক্কাতেও এসব ঘটনা ঘটতে পারে। যেমনটি ইতিপূর্বে একাধিকবার ঘটেছেও । সুতরাং সেসবের সাথে কুরআনে বর্ণিত নিরাপত্তার ঘোষণার কোন সাংঘর্ষিকতা নাই।
এখানে একটি ব্যাপার না বললেই নয় নবুয়ত পাওয়ার প্রথম দিকে আমাদের প্রিয় মহানবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওায়াসাল্লামের রাত্রীকালিন নিরাপত্তা দায়িত্ব সাহাবাগন পালন করতেন পরবর্তিতে আল্লাহ মহানবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওায়াসাল্লামের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেন । তারপরও অহুদের যুদ্ধে তিনি তিনি আহত হয়েছিলেন ।তায়েফে ধর্ম প্রচারের সময় নির্যাতীত হয়েছিলেন । আল্লাহ কি চাইলে পারতেন না মহানবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওায়াসাল্লামকে নিরাপদ রাখতে । তিনিত ছিলেন আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা ও হাবিব ।
( আমার এই লেখা তথাকথিত ইসলাম বিরোধীদের দ্বারা আল-কোরানের আয়াতের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে নয় । কারন তারা অন্ধ । অন্ধরা নিজেরা যা ভাবে তাই বুঝে । যদি আল্লাহতালা তাদের হেদায়েত না করেন তাহলে জাহান্নামই তাদের উপযুক্ত আবাস। আমার এই লেখা সেই সব মুসলমান ভাই-বোনদের জন্য যারা এই ব্যাপারে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন । )
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুক ।
বিষয়: বিবিধ
১৯৭৮ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জুহাইমান আল-ওতাইবিরা শিয়া ছিলনা। সম্ভবত ১৯৮৭-৮৮ সালে ইরানিদের সাথে একটা দাঙ্গা হয়েছিল।
ভাল লিখেছেন। জোহাইমান ইস্যুটি আর একটু পরিষ্কার করে লিখলে ভাল হত।
মুসলিম এর কাছে আপনার সেন্স হতে উদ্ভুত লজিক গুলোকে 'মাগুর মাছের মাথার' ইক্যুইভ্যালান্ট লজিক বলে মনে হবে।
নিচের হাদীসটি পড়ে আবার ভাবুনঃ
The Prophet s.a.w. said “This world is a prison for the believer and a Jannah for the disbeliever”.
ইতিহাসের বিচারে - আপনি ভিলেন, ডাকাত, প্রতারক, ছিনতাইকারী, নির্যাতক ও নিপীড়কের পক্ষে - আর মুসলিমরা অত্যাচারিত, নির্যাতিত, প্রতারিত, সর্বসান্ত এর দলে।
বিচারক বিচার করতে গিয়ে কোন পক্ষকে পুরুষ্কৃত করবে?
জোহাইমান অবশ্যই বিরাট বড় ভুল করেছিল, উম্মাহ একটা বড় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা রেমিডি করার নিমিত্তে আর একটি বড় অন্যায়ের জন্ম দিয়েছিল।
কিন্তু আমরা যে বিষয়টি জানিনা - তা হল সংগঠিত ঐ বাহিনীর সদস্যরা - যারা বেশীরভাগই ব্রিলিয়ান্টলী নলেজেবল - মুসলিম প্রেমি - তারা কেন তা করলো, সৌদী সরকার আসলেই কখন হতে কিভাবে মুসলিম উম্মাহর কি কি ক্ষয় ও ক্ষতি বৃদ্ধি করতে লাগলো?
আপনি অপি বাইদানীর কমেন্ট মুছে দিয়েছেন কিন্তু তার প্রতিউত্তরে আমার কমেন্ট টি রেখে দিয়েছেন। ওটা মুছে দিলে আপনার লিখার পাঠকের কাছে কমেন্ট টিকে খাপছাড়া মনে হবে না।
ধন্যবাদ।
সুন্দর সময়োপযোগী পোস্টের জন্যে অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহ!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন