ফেলে আসা স্রোত ( স্মৃতিচারন )
লিখেছেন লিখেছেন সিকদারর ২২ জুলাই, ২০১৫, ০৫:৫২:৫৬ বিকাল
আমার দাদী যাকে আমার প্রায় আট নয় বছর বয়সে হারিয়েছি । সেই আমার দাদীর কাছেই বড় হয়েছি ছয় বছর বয়স পর্যন্ত । কারন আমার বয়স যখন দশ মাস তখন আমার মায়ের গর্ভে আসে আমার ছোট ভাই । আমার মায়ের পক্ষে দুই সন্তানকে এক সাথে পালন করা সম্ভব নয় তাই দাদী আমাকে তার সাথে করে বাড়িতে নিয়ে যায়।
এই কারনে আমার শৈশবটা কেটেছিল দাদার বাড়িতে । পদ্মার নদীর থেকে অনেকটা দুরে আমার দাদার বাড়ি পূর্ব নাম বিক্রমপুর বর্তমানে মুন্সিগন্জ । শ্রীনগর থানার পাঠাভোগ গ্রামের সিকদার বাড়ি আমার দাদার বাড়ি ।
গ্রামের বাড়িতে সবাই খুব ভোরে উঠত। ভোরে ঘুম ভাংগলেই দেখতাম দাদি পাটখড়ি দিয়ে ঘেরা ছন দিয়ে ছাওয়া পাকের ঘরের মাটির চুলায় ফু দিয়ে লাকড়িতে আগুন ধরাছ্ছে । আহ ! সেই ভোরে আগুন দেওয়া চুলার ধোয়ার ঘ্রান এখনও যেন পাই । সকালে ঘুম থেকে উঠলেই ছোট ফুপু নয়ত দাদী আমাকে বেতের পেয়ালা ( বেত দিয়ে বানানো পেয়ালা যা তখন পাওয়া যেত । এখন আর নাই ।)
করে মুড়ি আর মিঠাই দিত । গরম কাল হলে আখের মিঠাই শীতকাল হলে খেজুরের মিঠাই দিত। জানিনা এতে হয়ত আমার পেটে কৃমির প্রকোপটা বেশি ছিল। তাই প্রায় মধ্যরাতে ঘুমের মাঝে প্রচন্ড পেটের ব্যাথা হত । সেই ব্যাথায় চিৎকার করে কান্না করতাম । তখন দাদী আর ফুপু কতকিছুই না খাওয়াত । পিয়াজের রস খাওয়াত এতে না কমলে সেই গভীর রাতে বাড়ির পিছনের জংগলে অনাদরে বেড়ে উঠা আনারস গাছের কচি পাতার গোড়ার সাদা অংশটা পাটায় বেটে রস বের করত। সেই রস খাওয়ানোর পর আমার পেটের ব্যাথা কমত।
আমার সবচেয়ে বেশি ভয় করত সকালে পায়খানায় যাওয়া । কি এক বিভিষিকাময় এক অবস্থা । ঐ এলাকায় বছরে চার মাস পানি থাকে । পানি থাকা বলতে পাহাড় সমান উচু ভিটাটা ছাড়া ক্ষেত-বিল, ডোবা-পুকুর , নদী রাস্তা-ঘাট সব পানিতে ডুবে থাকে । তখন কোসা নৌকায় করে গ্রামের লোকদের চলাফেরা করতে হয়। সবার বাড়িতেই একটা দুইটা কোসা নৌকা থাকে। পাহাড় সমান উচু ভিটার পায়খানাটা থাকত ভিটা সমান উচুতে বেশ কিছুটা দুরে কোন ডোবার উপর । পায়খানাটা বানানো হত বিরাট লম্বা লম্বা চারটা বাশের খুটি দিয়ে । ভিটা থেকে পায়খানায় যেতে চিকন একটা সাকো বা পুল থাকত। ওটার উপর দিতে খুব সাবধানে যেতে হত । একটু বেশি নড়াচড়া করলেই সাকোটি হেলতে দুলতে থাকত । এই হেলাদুলা যদি থামানো না যেত তাহলে পাপৎ ধরনী তল। আর পড়বি পড়বিত পর সোজা মলমূত্রের ভাগারে । আর কিছু বলতে চাইনা । তখন সেখানে বড় বড় গুই সাপ দেখা যেত । এখন নাই ।
শীতের কাল ছিল আরেক মজার দিন । দাদীর হাতের নানা রকম পিঠার এক মেলা। ভাপা পিঠা , পাটিসাপটা পিঠা , চিতই পিঠা আরো কত রকমের পিঠা ছিল। রাতের ভাত খাওয়ার দাদী ও আশেপাশের আত্মিয় মহিলারা মিলে শুরু করতেন পিঠা বানানো ।
এরপর পিঠা বানিয়ে পিঠার সিক্কায় তুলে রাখতেন সেই খোলামেলা পাকের ঘরে । শীতের হিমেল ঠাণ্ডায় সেই হাঁড়ির ভিতর পিঠাগুলি ঠাণ্ডা হয়ে যেত।
আবার সুবহে সাদেকের সময় কুয়াশা ভেজা আঁধারে দাদী একা ঘুম থেকে উঠতেন । এরপর শুনা যেত মাটির হাঁড়ি পাতিলের ঠুকাঠুকি । সেই ঠুকাঠুকিতে গভীর ঘুমের মধুর স্বপ্ন ভেংগে যেত । আবার পাশ ফিরে লেপটাকে আরও জোরে আকড়ে ধরে আবার গভীর ঘুমে হারিয়ে যেতাম । পরে ঘুম থেকে উঠে খেতাম দাদীর হাতের খেজুর রসের পিঠা ।সেই খেজুর রস এখন আর পাইনা , পাইনা সেই স্বাদ।
আমাদের বাড়ির দক্ষিন দিকে ছিল একটা ছাড়া ভিটা ( সেই ভিটায় বহু বছর কেউ বাস করে না ।) আমি প্রায় সেই ভিটায় প্রায় একা চলে যেতাম । ভিটাটিতে নানা ধরনের গাছ ছিল । আম, জাম, হিজল, কড়ই, বড়ই, বাশ গাছ , গাব আরও কত গাছ । গাব খাওয়ার লোভে ওখানে আমার বেশি যাওয়া হত। পাকা পাকা গাব মাটি থেকে কুড়িয়ে খেতাম। কি সেই স্বাদ । পৃথিবীর এমন কোনও ভাষা নাই যা দিয়ে সেই স্বাদ বোঝাব। আমি কখনও একা বা আমার চাচাত ভাই বোনেরা সহ সেই সব গাছের ছায়ায় বসে পুতুল খেলা , দাড়িয়া বান্ধা , ডাংগুলি , কুতকুত খেলা , দড়ি খেলা আরো কত খেলা যে খেলতাম । সারা দিন আমরা ছোটরা ওখানে থাকতাম।
আমার বয়স যখন পাচ পার হয়ে ছয়ে পড়লাম তখন আমাকে স্কুলে ভর্তি করা হল । এখনও মনে আছে প্রথম দিন যখন স্কুলে যাই আমার ছোট ফুপু আমার মাথায় বেশি করে নারকেল তেল দিয়ে সুন্দর করে মাথা আচড়ে দিল । তারপর একটা আদর্শ লিপি বই, বাল্য শিক্ষা ধারাপাত ও একটা স্লেট আর তার পেন্সীল দিয়ে দিল। আমি এরপর আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় দুই বোন ও সমবয়সী ভাইয়ের ( এরা আমার বড় চাচার ছেলে মেয়ে । ) সাথে স্কুলে গেলাম । স্কুলটা ছিল এক কামরার একটা ঘর । সেখানে ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত সবাই একই সাথে বসতাম । সেই স্কুলে আমাদের সবেধন নীলমণি মাত্র একজন শিক্ষক ছিলেন । উনার নাম ছিল বিমল স্যার । আজও বেচে আছেন আমার সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক । তবে এখন আর পড়ান না ।
প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে আমাদের গ্রামে মেলা হত । এখনও হয় । তবে ছোটাকালের মত আর যাওয়া হয় না। শৈশবে তখন মেলায় যেতাম দাদার কাধে করে । আমার দাদা আমকে বেশির ভাগ সময় কাধে নিয়েই চলাফেরা করতেন । কেননা আমি দাদার কাধের দুই পাশে দুই পা দিয়ে চড়তে বেশি পছণ্দ করতাম। দাদা আমাকে কাধে করে মেলায় নিয়ে যেতেন । মেলায় যেয়ে প্রথমেই আমি একটা মাটির নৌকা নিতাম তারপর অন্য কিছু । সেই মাটির নৌকা বাড়িতে এনে তার সামনের দিকে একটা সুতা বেধে সারাদিন মাটির উপরে হেচড়ে হেচড়ে চালাতাম । নৌকাটি না ভাংগা পর্যন্ত চলত আমার নৌকা নিয়ে খেলা।
আমার দাদা ছিল মাছের রাঈশের মানুষ। আমাদের সারা গ্রামে উনার মত মাছ কেউ ধরতে পারত না। যেখান শত বার জাল ফেলেও কেউ মাছ পেত না সেখানে আমার দাদা একবারেই জাল ভরে মাছ তুলত। যা আজও আমাদের গ্রামের কিংবদন্তির হয়ে আছে। আমি প্রায় সময় দাদার সাথে মাছ ধরতে যেতাম । আহঃ কি সেই দিন !! আর কখনও পাব না ফিরে । আকাশে মেঘের ঘনঘটা । কালো শ্লেটের মত আকাশে ক্ষনে ক্ষনে বিদ্যুৎ চমকাছ্ছে । দাদা সামনে কাধে জাল নিয়ে একটু গুজো হয়ে খালি পায়ে হাটছে । আমি পিছনে ভয়ংকর আকাশের দিকে তাকিয়ে দুরুদুরু বুকে ভিরু ভিরু পায়ে ধান ক্ষেতের আইলের উপর দিয়ে হাটছি । কতবার যে আইলের থেকে ক্ষেতের ভিতর পা পিছলে পড়ে যাছ্ছে তার কোন হিসেব নাই। দাদা হাটতে হাটতে একসময় কোন খাল বা নদীর পাড়ে এসে দাড়াতেন । তারপর নদীর বুকে চোখ বুলিয়ে তার সবল হাতে ছুড়ে মারতেন জাল। জালটাও বিশাল হা করা মুখ নিয়ে নদীর বুকে ঝাপিয়ে পড়ত।
এরপর জালটা নদীর তলে বসে গেলে দাদা এবার আস্তে আস্তে টানতে থাকতেন । জাল গুটিয়ে মাটিতে তোলার সাথে সাথে আমি বসে যেতাম জাল থাকে মাছ ছাড়ানোর কাজে । এভাবে একবার মাছ ছাড়াতে যেতে বাইন ( বাইন মাছ নয়। ) মাছের মত এক মাছ আমার কচি একটা আংগুলে দিল কামড়। মাছের কামড়ে আমার আংগুল কেটে রক্ত বের হয়ে গেল । তখন আমার সেকি কান্না । বৃষ্টির পানি আর আমার চোখের পানি এক হয়ে সেদিন নদীর জলে মিশে গিয়েছিল। জানিনা এতে নদীর পানি একটু বেড়ে ছিল কিনা ? তবে আমার দাদার ফোকলা দাতের হাসিতে আমি লজ্জা পেয়েছিলাম।শৈশব প্রেম সে এক মধুর অভিগ্গতা । যদিও জানি না সেটা প্রেম ছিল না অন্য কিছু ছিল। কেন না আমরা দুজন প্রায় বাড়ির পিছনে জংগলে খেলতাম । বাড়ির কেউ যখন আমাদের কোথাও খুজে পেত না তখন বুঝত আমরা দুই দুষ্টু মনি ঐ জংগলে আছি। ওখান থেকে আমাদের ডেকে নিত দুপুরের ভাত বা অন্য কোন নাস্তা খাওয়ার জন্য। ঝড়ের দিনে যখন আম গাছ থেকে আম ঝরে পড়ত তখন আমার সেই বাল্য সাথী আমাকে ডাকত আম কুড়ানোর জন্য । বড় বড় ফোটার বৃষ্টি নয়ত শীল (ছোট ছোট বরফের টুকরা ) পড়ছে আমরা আম গাছের তলে আম কুড়াছ্ছি । পাকা আম কাচা পাকা আম কুড়ইয়ে কোচড়ে ভরছি । কে কত বেশি নিতে পারে তাই নিয়ে কত কাড়াকাড়ি কত মারামারি । একটা আম দেখলে সবাই দৌড়ে নিতে যেয়ে গায়ে গায়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতাম। গাছ পাড়া আমের চেয়ে কুড়িয়ে পাওয়া আমের স্বাদ যেন অ ——নে—–ক বেশি।
বিষয়: বিবিধ
২০৩৭ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পোষ্টটি ষ্টিকির উপযুক্ত ।
০ গর্ভকালীন সময় হল ৯ মাস ১০ দিন । সন্তান জন্মদানের পর ৬ সপ্তাহ সময়েও আবার সন্তান ধারনের পর্যায়ে আসা হয় না ।
তাই ১০ মাস ব্যাপারটা মনে হয় ঠিক না ।
চিতই পিঠার যে ছবি দিয়েছেন সেটা তো মোটা এবং ছোট। আমাদের দেশে আমরা খেতাম পাতলা , মাঝখানে আপনার দেওয়া ছবিটার মতই ঝাঁঝরা , রুটির সাইজের এবং প্রান্ত গুলো কিছুটা পোড়া পোড়া এবং মচমচে । খেজুরের জাল দেওয়া রস ও নারকেল দিয়ে বা গরুর মাংশের ঝোল ও সাথে আলু দিয়ে খেতে খুব মজা লাগে ।
বারবার মনে পড়ে সেই দিন গুলির কথা....।
আহ!আবার কি পিরে পাব..........।
ধন্যবাদ আপনাকে.....
আখেরাতের সামান করেছ কি জমা,
প্রভুর কাছে চেয়েছ কি ক্ষমা।
দিন ফুরাল সন্ধ্যা ঘনায়ে এল,
মাটির ঘরের ডাক যে না পেল।
সেত হতভাগা হতভাগা,
দিতে হবে হিসাব কতটুকু আদেশ করেছ নাগা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন