শৈশবের সাথী (শেষ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন সিকদারর ০৭ মে, ২০১৪, ০২:৪৩:২৮ দুপুর
শৈশবের সাথী । (এক )
শৈশবের সাথী ।( দুই )
আমি দৌড়ে আমার বাড়ির সামনের রাস্তায় আসতেই দেখি, আমার কয়েকজন বান্ধবী আমার বাড়ির দিকে আসছে।
আমকে দেখে বলল “তোর কাছেই আইতাছি। আমরা পূবের বিলে যাইতাছি। নৌকায় কইরা বেড়ামু। তুই যাবি ?
মানিক ভাইয়ের সাথে দেখা না হওয়ার কারনে আমার কিছুই ভাল লাগছিল না তাই বললাম।
“নারে ভাল লাগতাছে না। আমি যামু না।”
“তুই যাবি মনে কইরা, আমরা এতদূর হাইট্টা আইলাম।
” শরিরডা ভাল না তাই যাইতে ইছ্ছা করতাছে না।
ওরা আর কিছু না বলে চলে গেল।
বিকেলের আকাশ রোদের কিরনটা মোলায়েম। অগ্রহায়ণের বাতাসে হিমেল হিমেল ভাব আর নতুন ধানের ঘ্রাণ। ধান কাটা মাঠে কবুতর চড়ুই টিয়া ও আরও অন্যান্য পাখিদের বিচরনে মুখরিত। চাষিরা ক্ষেতের মাঝেই নতুন ধান মাড়াই করছে।ফসল ভাল হওয়ার খুশিতে কৃষকের খুনসুটিতে কিষানীর মুখে মধুর হাসি।
আমি এইসব দেখে হাটতে হটতে কখন যে মানিক ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার পথে চলে এসেছি নিজেই জানি না। দুর থেকে হঠাৎ মানিক ভাইয়ের বাড়ি দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্রই থমকে গেলাম ! লজ্জায় দাড়িয়ে গেলাম। ভাবলাম একি করছি ? আমার কি হয়েছে ? তাড়াতাড়ি আমি ফিরতি পথে আমার বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। মাথা নিচু করে হাঁটছি আর ভাবছি আমার কি হয়েছে ? মানিক ভাইকে দেখার জন্য এমন পাগলামী কেন করছি ? তাহলে কি আমার …….। আর কিছু ভাবতে পারছি না। ছিঃ আমার এই রকম অবস্থা বুঝতে পারলে মানিক ভাই কি মনে করবে ? ভাববে আমি একটা ফালতু মেয়ে। নাহ এখন থেকে নিজেকে সংযত করতে হবে। মানিক ভাইয়ের সামনে নিজকে ছোট করা যাবে না।
“চৈতি”
মানিক ভাইয়ের ডাক শুনে সন্ধ্যার বাল্যকালে চমকে উঠলাম। মাথা তুলে দেখি মানিক ভাই আমার সামনে দাঁড়ানো। কাদা পানিতে শুকিয়ে যাওয়া চুল চিরাচরিত নিয়মে প্রশস্ত কপালে লেপ্টে আছে। উদোম গা। পরনে ভিজা লুংগী। সারা দেহে শুকিয়ে যাওয়া কাদা মাটির প্রলেপ মাখানো। কাধে রাখা তিন কোনা মাছ ধরার জাল ডান হাতে ধরে আছে। বাঁ হাতে বেতের লম্বা একটা ঝুড়ি।
“কিরে মাথা নিচু কইরা, কি ভাবতে ভাবতে হাটতাছস ?”
এমন সময় মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক টিয়া পাখি ট্যাঁ ট্যাঁ ডাক দিয়ে উড়ে গেল। আমি মাথা উচিয়ে টিয়া পাখির ঝাঁকের দিয়ে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন বাক্যই খুজে পেলাম না। কারন সত্য কথা যায় না বলা তা শোভনীয় নয়। মিথ্যা কথা কি করে বলি, তাতেত গুনাহ হবে। তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলাম। আমার থেকে কোন সদুত্তর না পেয়ে এবার বলল ‘”সন্ধ্যা অইতাছে বাড়িতে যা গা।”
“তুমি কইথ্থিকা আইতাছ। সারা শরিলে ফুট মাখা।”
“মা কইছিল আমার সই আইছে ওগো লাইগা মাছ ধইরা লইয়া আয়। ওরা এখন ঢাকা শহরে থাকে ওখানে তাজা মাছ পায় না পায় কে জানে।”
“পুবের বিলে পানি কইম্মা গেছে তয় ওখান থিকা তগো লিগা মাছ ধরছি।”
“কি কি মাছ পাইছ ?”
বড় বড় ষোল মাছ, বাইলা মাছ, শিং মাছ, বাইন মাছ, আর কয়ডা বড় বড় কই মাছ পাইছি, মাছ আনার পর খালায় কইলো তুই নাকি কই মাছ বেশি পছন্দ করছ ? আগে জানলে আরও বেশি কইরা কই মাছ ধরতাম।”
“কেন আমার লাইগ্যা বেশি ধরন লাগব ক্যা ?”
মানিক ভাই আমার দুই চোখে গভীর দৃষ্টিতে তার দুই চোখ রেখে বলল “হেইডা তুই এখন বুঝবি না। আরও ডাংগর অইলে বুঝবি। যা বাড়িতে যা গা সন্ধ্যা অইয়া গেছে।”
এই বলে মানিক ভাই হন হন করে হেটে চলে গেল। আমি উনার শেষ কথা শুনে পাথরের মত স্থির হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে এই গাছ, পাখি ঐ সুনীল আকাশ, দেহ ছুয়ে যাওয়া বাতাস আহ ! কত সুন্দর ! আগেত কখনও এমন লাগে নি। আমার সারা দেহে যেন ভাল লাগার এক ভয়ানক সর্বনাশা ঝড় বয়ে যেতে লাগল।
এর কয়েকদিন পর আমরা শহরে চলে এলাম। মানিক ভাইয়ের সাথে আমার আর দেখা হয়নি।
এর মাসখানেক পর আমার বাবার প্রমোশন হয়ে খুলনায় বদলী গেলেন। এতে বছরের শেষ দিকে বাড়িতে যাওয়া টা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে গেল। আমরাও আর বাড়িতে তেমন একটা যেতাম না। প্রথম দিকে মানিক ভাইয়ের কথা স্মরণ করে প্রায় উদাস হয়ে যেতাম। মানিক ভাইয়ের মত কাউকেই দেখলেই লুকিয়ে লুকিয়ে বার বার তাকাতাম। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম। আমার কিশোরী কাল পেরিয়ে তারুণ্যের জগতে প্রবেশ করলাম। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। সেখানে নানা রকম বন্ধু ও বান্ধবীদের সাহচর্যে আমি বদলে যেতে লাগলাম। বদলে যেতে লাগল আমার কচি মনের পৃথিবী। মানিক ভাইয়ের স্মৃতি আস্তে আস্তে হৃদয়ের প্রাচীন ঘরে হারিয়ে যেতে লাগল। আমার নতুন বন্ধুদের তুলনায় মানিক ভাইকে গেঁয়ো মনে হতে লাগল। এত কিছুর পরও সেই বিকেলের পর সন্ধ্যার লগনের ভাল লাগাটা যেন আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি হয়ে রইল। সেই অচিন ভাল লাগার শিহরিত আবেশ জীবনে আর কখনও পাইনি । তখন উপলদ্ধি না করতে পারলেও এখন বুঝি ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম প্রেম। আর মানুষ প্রথম প্রেমের স্মৃতি কখনই ভুলতে পারেনা।
আজও বুভুক্ষ হৃদয় সেই ক্ষণটি বার বার ফিরে পেতে চায়।
( কাল্পনিক )
সমাপ্ত
বিষয়: বিবিধ
১৬০৬ বার পঠিত, ৩৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সব চাওয়া যে পূরণ হবার নয়।
আসলেই পড়ার মত একটি গল্প।
আপনার গল্পটিতে কিশোর বয়সের ভালো লাগা মূল উপজীব্য হলেও গ্রামীন পরিবেশের যে চিত্রটি তুলে এনেছেন সেটা হৃদয়কে স্পর্শ করেছে গভীরে।
আপনার পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় রইলাম।
আমার প্রিয় কচুরীপানার শুভেচ্ছা রইলঃ
আসলে কিশোর- কিশোরীর প্রেম মুল বিষয় নয় । আমার লেখার উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের পরিবেশে কিছু লিখা । সম্পূর্ন লেখাতে প্রেম না যতটুকু আছে তার চেয়ে বেশি আছে গ্রামের দৃশ্য । প্রেমটা এনেছি গ্রামের পরিবেশটাকে বাস্তবতার পোষাক পড়ানোর জন্য।
আসলেই ঠিক সময়ের সিড়িতে মানুষ যতই পদ চারনা করে, পরিবেশের পোষাক ততই বদলায় আর এতে কোমল হৃদয়ের মানুষেরা নিজের বর্তমানটাকে অতীতে হারিয়ে ফেলে গ্রহন করে ভবিষ্যতের সত্যটাকে।
দোয়া করবেন । আপানার কচুরী ফুলের শুভেছ্ছার জন্য জাজাকাল্লাহু খায়রান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন