লালবাগের কেল্লা ও তার ইতিহাস ।
লিখেছেন লিখেছেন সিকদারর ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০১:০৮:১০ দুপুর
মোগল আমলে বাংলায় নির্মিত ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত লালবাগের কেল্লা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি ।
এটি বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি প্রাচীন দুর্গ। মোঘল আমলে স্থাপিত এই দুর্গটি একটি মোঘল ঐতিহাসিক নিদর্শন। এটি পুরনো ঢাকার লালবাগে অবস্থিত, আর সে কারণেই এর নাম হয়েছে লালবাগের কেল্লা।
কেল্লার ভিতরে তিনটি পুরাকীর্তি রয়েছে। পরীবিবির মাজার, দরবার ঘর ও হাম্মামখানা এবং তিন গম্বুজওয়ালা মসজিদ।
চারদিকে উঁচু প্রাচীনঘেরা এ কেল্লা দেখলে হঠাৎ মনে হয় লাল মাটির তৈরি। প্রাচীরের উচ্চতা কোথাও কোথাও বিশ ফুট পর্যন্ত আছে । কেল্লায় ঢোকার জন্য চারটি ফটক ছিল। দক্ষিণ দিকের ফটকটি মূল ফটক হিসাবে ব্যবহার করা হতো। এখন এটি বন্ধ।
ফটকের সামান্য উত্তরে একটি গুপ্তপথ আছে ।
কেউ কেউ মনে করেন, এ পথ দিয়ে নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা দুর্গে যাওয়া যেতো। গুপ্তপথটি নোংরা আবর্জনা জমে দর্শনার্থীদের যাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। তাই এখন গুপ্তপথটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
দক্ষিণের ফটক থেকে উত্তরের ফটকে যাওয়ার মাঝ পথে রয়েছে চারকোণা একটি পুকুর। পুকুরের চারপাশের দেয়াল বাঁধানো। জনশ্রুতি আছে, সিপাহী বিপ্লবে নিহত এ অঞ্চলের সৈন্যদের লাশ এ পুকুরে ফেলা হতো। পুকুরের প্রায় দেড়’শ ফুট পশ্চিমে দরবার ঘর।
এখানে সুবেদাররা দর্শনার্থীদের সঙ্গে দেখা করতেন। দরবার ঘরের নিচতলায় হাম্মামখানা। অনেকে মনে করে, এ ভবনে সুবেদার শায়েস্তা খান বাস করতেন। দরবার ঘর ও হাম্মামখানায় মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে। এখন এটিকে জাদুঘর হিসাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
প্রথমে এই কেল্লার নাম ছিল কেল্লা আওরঙ্গবাদ। আর এই কেল্লার নকশা করেন মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ৩য় পুত্র আজম শাহ । তিনি ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার সুবেদার হয়ে এদেশে এসেছিলেন । ত নিজের বাসস্থান হিসেবে কেল্লা আওরঙ্গবাদ নামে এ দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করার মাত্র এক বছর শেষ হবার আগেই মারাঠা বিদ্রোহ দমনের জন্য তার পিতা সম্রাট আওরঙ্গজেব তাকে দিল্লি ডেকে পাঠান। এসময় শুধু একটি মসজিদ ও দরবার হল তিনি নির্মাণ করেছিলেন ।
তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদটি যে কারো দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম। মসজিদটিতে জামায়াতে নামায আদায় করা হয়। ঢাকায় এতো পুরনো মসজিদ খুব কমই আছে।
পরীবিবির মাজারের প্রায় পঁয়তাল্লিশ গজ পশ্চিমে কেল্লার মসজিদ। মসজিদের চারকোণে চারটি মিনার এবং ছাদে তিনটি গম্বুজ রয়েছে।
শাহ আজম চলে যাওয়ার পর দুর্গ নির্মাণের কাজ থেমে যায়।
১৬৮০ সালে নবাব শায়েস্তা খাঁ ঢাকার সুবেদার হয়ে আসেন । কেল্লার কাজ সমাপ্ত করার জন্য শাহজাদা আজম শাহ তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন। তাই তিনি এদেশে সুবেদার হয়ে আসার পর পুনরায় দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন । কাজ শুরু করার চার বছরের মাথায় তার আদরের কন্যা পরী বিবির মৃত্যু হয় । এতে তিনি মানসিক ভাবে ভীষন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খান এর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন।
বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁর আদরের কন্যার পরী বিবি ছাড়াও আরেকটি নাম ছিল । রহমত বানু। তবে খুব কম মানুষই তাঁকে এ নামে চিনতো । অনেকের ধারণা, পরী বিবি দেখতে পরীর মতোই সুন্দরী ছিলেন। তাই তাকে পরী বিবি ডাকা হত। তখন পরী বিবির সাথে শাহজাদা আজম শাহের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। এই কেল্লায় অবস্থান করার সময় অপরূপা সুন্দরী পরী বিবির হঠাৎ অকাল মৃত্যু হয় । পরী বিবিকে দরবার হল এবং মসজিদের ঠিক মাঝখানে সমাহিত করা হয়। লালবাগের কেল্লার মাঝখানে একই সরলরেখা বরাবর তিনটি স্থাপনা চোখে পড়ে। তার মধ্যে মাঝখানেরটি পরী বিবির সমাধি । সমাধির দিকে মোট বারোটি দরজা রয়েছে।
তার অন্তিম শয্যার ওপর যে সৌধ নির্মাণ করা হয়েছিল,২০.২ মিটার বর্গাকৃতির । এই সমাধিটি ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দের পুর্বে নির্মিত। সেটি ঢাকার অন্যতম সেরা সৌন্দর্যময় একটি মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন। এটি নির্মাণের মাধ্যমে পিতা শায়েস্তা খাঁর স্থাপত্য জ্ঞানের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। জানা যায়, শায়েস্তা খাঁ এ সমাধি সৌধটি নির্মাণ করেন তাজমহল ও সম্রাট হুমায়ুনের সমাধির স্থাপত্য রীতির সঙ্গে মুসলিম স্থাপত্যর আদলে। শায়েস্তা খাঁ সমাধি নির্মাণের জন্য সুদূর রাজমহল থেকে এনেছিলেন কালো ব্যাসল্ট পাথর। সাদা মার্বেল পাথরের বড় বড় ফলক এনেছিলেন জয়পুর থেকে। শ্বেত চন্দন কাঠ এনেছিলেন দরজা ও খিলান নির্মাণের জন্য। তৎকালীন আমলে এসব আনা ছিল খুবই কষ্টের। কেননা, তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না। সমাধির সাদা মার্বেল পাথরের ফলকগুলো যে আয়তনে আনা হয়েছল ততটুকুই আছে । কোন ছোট বড় করা হয়নি। তার ওপর কাটা হয় ফুলের নকশা। সমাধি সৌধের বিভিন্ন অংশ নির্মাণ করা হয় ফুলের নকশা খচিত জালি ও ফলক দিয়ে।
মূল সমাধি সৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের উপরের যে কালো গম্বুজটি চোখে পড়ে, তা মোড়ানো হয়েছে তামা বা পিতলের পাত দিয়ে। এটি এক সময় স্বর্নের পাত দিয়ে মুড়ানো ছিল । সেই স্বর্ণের পাত এখন আর নেই। একসময় এই স্বর্নের পাতের ওপর রোদের আলো পড়লে তা ঝলমল করতো।
বাংলাদেশে এই একটি মাত্র ইমারতে মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রং এর ফুল-পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলংকৃত করা। কক্ষগুলির ছাদ কষ্টি পাথরের তৈরি।
এসব জিনিস কয়েক শত বছর ধরে কন্যাহারা এক কোমল হৃদয়ের পিতার গভীর বেদনা নীরবে প্রকাশ করে আসছে ।
তবে এখানে পরীবিবির মরদেহ বর্তমানে নেই বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত।
১৬৮৮ সালে শায়েস্তা খাঁ অবসর নিয়ে আগ্রা চলে যান। শায়েস্তা খাঁ ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর নানা কারণে লালবাগ দুর্গের গুরুত্ব কমতে যায়।
এই সমাধি সৌধ স্থপতি শাঁয়েস্তা খার একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য নিদর্শন । তবে দুঃখের বিষয় হলো, পরী বিবির সমাধি সৌধের যত্ন নেই আগের মতো।
১৮৪৪ সালে ঢাকা কমিটি নামে একটি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান দুর্গের কিছু উন্নয়ন কাজ করে ছিল । এই সময় দুর্গটি লালবাগের কেল্লা নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯১০ সালে লালবাগের কেল্লা ঐতিহাসিক সংরক্ষিত স্থাপত্য হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে আনা হয়। অবশেষে নির্মাণের ৩০০ বছর পর গত শতকের আশির দশকে লালবাগ কেল্লার যথাসম্ভব সংস্কার করে এর আগের রূপ ফিরিয়ে আনা হয় এবং দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। প্রশস্ত এলাকা নিযে লালবাগ কেল্লা অবস্থিত।
লালবাগ কেল্লায় সর্বসাধারণের দেখার জন্যে একটি জাদুঘর রয়েছে, যা পূর্বে নবাব শায়েস্তা খাঁ এর বাসভবন ছিল আর এখান থেকেই তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। জাদুঘরটিতে দেখার মতো অনেক কিছুই রয়েছে। মুঘল আমলের বিভিন্ন হাতে আঁকা ছবির দেখা মিলবে সেখানে, যেগুলো দেখলে যে কেউ মুগ্ধ না হয়ে পারবে না।
শায়েস্তা খাঁ এর ব্যবহার্য নানান জিনিসপত্র সেখানে সযত্নে রয়েছে। তাছাড়া তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, পোশাক, সেসময়কার প্রচলিত মুদ্রা ইত্যাদিও রয়েছে।
এই মোঘল ঐতিহাসিক নিদর্শন লালবাগ কেল্লা তার নিজস্ব সিমানার ভেতরে প্রাচীর ঘেরা থাকায় দখলের হাত থেকে বেঁচে গেছে। তাই মোগল ঐতিহ্য নিয়ে এটি এখনো টিকে আছে কোলাহল মূখর রাজধানী ঢাকার বুকে । তবে নেই সেই আদি কারুকাজ ও সৌন্দর্য। এই ঐতিহাসিক স্থাপনার আরো যত্ন বা সংরক্ষণ প্রয়োজন। এজন্য গোটা লালবাগ কেল্লার ওপর সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের নজরদারি আরো বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন অনেকেই।
টিকেট প্রাপ্তিস্থানঃ
লালবাগ কেল্লার দরজার ঠিক ডান পাশেই রয়েছে টিকেট কাউন্টার, জনপ্রতি টিকেট এর দাম দশ টাকা করে, তবে পাঁচ বছরের কম কোন বাচ্চার জন্যে টিকেট এর দরকার পড়ে না। যে কোনো বিদেশি দর্শনার্থীর জন্যে টিকেট মূল্য একশত টাকা করে।
বন্ধ-খোলার সময়সূচীঃ
গ্রীষ্মকালে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কেল্লা খোলা থাকে। মাঝখানে দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত আধ ঘণ্টার জন্যে বন্ধ থাকে। আর শীতকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। শীতকালেও দুপুর ১টা থেকে ১.৩০ পর্যন্ত বন্ধ থাকে। আর সবসময়ের জন্যেই শুক্রবারে জুম্মার নামাযের জন্যে সাড়ে বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। রবিবার সহ সকল সরকারি ছুটির দিন লালবাগ কেল্লা বন্ধ থাকে।
তথ্য সুত্র
---------
উইকি পিডিয়া ( বাংলা )
ঢাকা জেলা ওয়েব।
কালের কন্ঠ পত্রিকা ।
বাংলাদেশ প্রতিদিন।
ট্রাভেল বিডি ডট কম।
বাংলাদেশ ৩৬০ডট নেট।
ছবি- গুগোল মামা ।
বিষয়: বিবিধ
৬০৫৪ বার পঠিত, ১২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমি আশাবাদী কর্তৃপক্ষ আপনার এই লেখাটি নির্বাচিত লেখা হিসেবে তালিকাভুক্ত করবে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এতো সুন্দরভাবে লালবাগের কেল্লার বর্ণনাটি আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য।
বর্তশান সংস্কার এর আগে এবং পরে এখানে যাওয়ার সেীভাগ্য হয়েছিল। লালবাগের কিল্লা আমাদের হারান অতিত ঐতিহ্য এর কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রসঙ্গত লালবাগের কেল্লা নির্মিত হয়েছিল মুলত দুর্গপ্রাসাদ হিসেবে। মুঘল আমলে ঢাকার সামরিক কিল্লা ছিল মুলত দুটি। একটি বর্তমান কেন্দ্রিয় কারাগার অন্যটি ধানমন্ডি ঈদগাহ মাঠ। বর্তমান পোস্তগোলা ক্যান্টনমেন্ট ও নাকি দুর্গ ছিল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন