গুনাহ হতে নিজের দৃষ্টিকে হেফাজতের উপায়।
লিখেছেন লিখেছেন সিকদারর ০২ নভেম্বর, ২০১৩, ১০:৪৩:২৯ রাত
আমরা জীবনে যত পাপই করি তার উৎস অন্তরে হলেও তা শুরু হয় আমাদের প্রথমে দেখা এই দুই চোখে দিয়ে । আমরা যদি আমাদের এই দুই চোখের দৃষ্টিকে হেফাজত করতে পারি তাহলে অনেক গুনাহ থেকেই নিজেকে বাচাতে পারব। তাই আমরা কোরান ও হাদিসের আলোকে জানার চেষ্টা করি কিভাবে আমরা আমাদের দৃষ্টিকে পাপ কাজ থেকে রক্ষা করতে পারব ?
১/ সবসময় মনে রাখা যে আল্লাহ আমাদেরকে দেখছেন, আমি যেখানেই যান আল্লাহ আমার সঙ্গেই আছেন (তাঁর সর্বময় জ্ঞানের মাধ্যমে) হতে পারে আমি লুকিয়ে কোন সুন্দরী নারী বা মেয়েদের ক্ষেত্রে কোন সুন্দর পুরুষেকে দেখছি । মনে রাখতে হবে সাবধান !! আল্লাহ আমাকে দেখছেন । আমার দুই কাঁধে দুই ফেরেশতা আছে । তারা দেখছেন । তারা শুধু দেখছেন না আমার এই পাপ লিপিবদ্ধ করে রাখছেন।
يَعْلَمُ خَائِنَةَ الْأَعْيُنِ وَمَا تُخْفِي الصُّدُورُ
চোখের চুরি এবং অন্তরের গোপন বিষয় তিনি জানেন। (সূরা গাফিরঃ১৯)
২/ এই পাপ থেকে হেফাজত থাকার জন্য আল্লাহর কাছে মিনতি সহকারে সাহায্য চাওয়া।
যেমন কোরানে আছে-
وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ
তোমাদের পালনকর্তা বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি সাড়া দেব। (সূরা গাফিরঃ৬০)
৩) দৃষ্টি শক্তি আল্লাহর পক্ষ হতে বান্দার জন্য রহমত। চিন্তা করি, এই দৃষ্টি যদি না থাকত তাহলে এই সুন্দর পৃথিবী , আমার স্নেহশীল মাতা-পিতার স্নেহশীল চেহারা , আমার প্রেমময় স্ত্রীর চেহারা , আমার নিস্পাপ শিশু সন্তানের মিষ্টি মধুর হাসি কিভাবে দেখতাম ? পথ চলার সময় গর্ত ও ক্ষতিকর প্রাণীর আক্রমন হতে কিভাবে বাঁচতাম ? আমি যা যা নেয়ামত উপভোগ করছি তার সবই আল্লাহর তরফ থেকে পেয়েছি, আর এ জন্য আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। আল্লাহর দেওয়া দৃষ্টির নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা জানাতে হলে আমাকে আমার চোখ দুটিকে যা যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন সে সব জিনিস দেখা থেকে বিরত রাখতে হবে । ভাল কাজের প্রতিফল কি ভাল ছাড়া কিছু হতে পারে?
وَمَا بِكُم مِّن نِّعْمَةٍ فَمِنَ اللَّهِ
তোমাদের কাছে যে সমস্ত নেয়ামত আছে, তা আল্লাহরই পক্ষ থেকে। (সূরা নামলঃ৫৩)
৪/ নিজের দেহের মাঝে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নতকে ধারন করা । কারন যার ভিতর যত বেশি সুন্নত থাকবে সে তত বেশি পাপের বিরুদ্ধে দৃঢ় থাকতে পারবে । যেমন আমার মুখে সুন্নত অনুযায়ী দাড়ি আছে ( সর্ব নিম্ন এক মুঠি। ) তাহলে আমি চাইলেও কোন বেগানা নারীর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারব না। সুন্নত অনুযায়ী দাড়ি রেখে চেষ্টা করে দেখি । দাড়ি অর্থাৎ সুন্নতই আমাকে উক্ত পাপ কাজে বাধা দেবে।
৫/ সব সময় নিজের জবানকে আল্লাহর জিকিরে মশগুল রাখা । কারন আল্লাহ জিকিরকারীর কলবে বা অন্তরে শয়তান আসতে পারেনা । শয়তান আসতে না পারলে আমার অন্তরে পাপ কাজের অসওয়াসা বা ভাবনা আসবে না ।
৬/ ভয়াবহ কেয়ামতের কথা চিন্তা করা । কারন ঐ দিন আমাদের নিজেদের প্রত্যেকটি অংগ প্রত্যংগ আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষি দিবে । সেই চোখও বলবে এই ব্যাক্তি আমাকে ব্যবহার করে অমুক অমুক পাপ কাজ করেছে ।
৭/সৎসঙ্গে থাকা। বিশেষ করে হক্কানি আলেম ওলামাদের সাথে সম্পর্ক রাখা । কারন মানুষ যাদের সাথে চলাফেরা করে তাদের বৈশিষ্ট্য দিয়েই প্রভাবিত হয়। আর তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচরের অনুসরণ করে; এবং সবচেয়ে কাছের বন্ধুই মানুষকে তার নিজের পথে টেনে নেয়। আমি যদি এমন বন্ধুদের সঙ্গে থাকি, যাদের দৈনন্দিন অভ্যাসই হল অন্য নারীদের নিয়ে আলোচনা করা, হারাম দৃষ্টি নিক্ষেপ করা, তাহলে নিশ্চিত ভাবেই আমার জন্য দৃষ্টি সংযত রাখা দুরূহ হবে । অন্যদিকে আমি যদি এমন মানুষের সঙ্গে থাকি যিনি এই বিষয়ে সদা সতর্ক, স্বাভাবিকভাবেই তখন আমার ইচ্ছা থাকেলও এই হারাম কাজ প্রকাশ্যে করতে সংকোচ বোধ করবো। অতএব সঙ্গি নির্বাচনে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ ।
৮/ যেসব কুচিন্তা ও শয়তানের ওয়াসওয়াসা মনে জাগে তা আসার সাথে সাথে আল্লাহর কাছে আশ্রর প্রার্থনা করা । আউযুবিল্লাহ ও এস্তেগফার পড়া ।
৯/ বেশি বেশি করে মৃত্যুর কথা স্মরণ করা । মৃত্যুর পর কবরের কথা জীবন থাকতেই চিন্তা করা ও এই করুন পরিনতির কথা চিন্তা করে ভীত হওয়া।
১০/ বেহেশতের হুরদের কথা মনে করা; আল্লাহ আমাকে যা নিষেধ করেছেন, তা দেখা হতে নিজেকে বিরত রাখতে উৎসাহিত করবে, যাতে আল্লাহর এই নেয়ামতের পাওয়ার আশা করতে পারি। রাসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
‘জান্নাতের কোন নারী যদি দুনিয়ার প্রতি দৃষ্টিপাত করে তবে সমস্ত দুনিয়া আলোকিত ও খুশবুতে মোহিত হয়ে যাবে। জান্নাতি নারীর নাসীফ (ওড়না) দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে উত্তম।’ (সহীহ বুখারী ৬১২১; ইফা)
১১/ যার প্রতি আকৃষ্ট বোধ করছি তার ত্রুটি সম্পর্কে চিন্তা করা । যেমন এই নারী বা পুরুষ বৃদ্ধ হলেত কুশ্রি হয়ে যাবে ।
১২/ অপ্রয়োজনীয় এদিক সেদিকে দৃষ্টিপাত করা থেকে বিরত থাকা, শুধুমাত্র যা দেখা প্রয়োজন সেদিকে তাকানো; বিশেষ করে এমন জায়গায় অযথা দৃষ্টি না ফেরানো যেখানে এমন প্রলোভনের আশঙ্কা থাকে যা থেকে সহজে মুক্ত হওয়া কঠিন। হতে পারে সেটা আমার আশেপাশের দৃশ্যে, বা কোন ম্যাগাজিনে, টিভিতে, অথবা ইন্টারনেটে। যে সব কোরানের আয়াতে বা হাদিসে, দৃষ্টিকে এদিক সেদিক অযথা নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি নিক্ষেপ করতে নিষেধ করা হয়েছে তা মনে করা। যেমনঃ
“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে (নিষিদ্ধ জিনিস দেখা হতে) এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।” ( সূরা নুর- ৩০ )
১৩/ এটা মনে রাখা যে আমরা যে জমীনের উপর গুনাহ করি, সেই জমীন আমাদের বিরুদ্ধে আমাদের গুনাহের সাক্ষী দেবে। আল্লাহ বলেনঃ
يَوْمَئِذٍ تُحَدِّثُ أَخْبَارَهَا
সেদিন সে (পৃথিবী) তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। (সূরা জিলজালঃ ৪)
১৪/ বেশী বেশী করে নফল ইবাদত করা, কারণ নিয়মিত ফরজ , ওয়াজীব ও সুন্নত এবাদতের সাথে সাথে নফল এবাদত করে নিজের শারীরিক ও মানসিক কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়।
হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেছেন,
“...আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে। এমন কি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয়পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই যা দিয়ে সে শোনে (অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী শোনে)আমিই তার চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে সবকিছু দেখে (অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী দেখে) আমিই তার হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে (অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী হাত দিয়ে কাজ করে) আমিই তার পা হয়ে যাই যা দিয়ে সে চলে (অর্থাৎ আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী চলে) সে যদি আমার কাছে কোন কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায়, তবে অবশ্যই আমি তাঁকে আশ্রয় দেই।...” [সহীহ বুখারী ৬০৫৮]
১৫/ সবসময় এটা মনে রাখা যে, পরিস্থিতি যেমনই হোক, নিষিদ্ধের প্রতি আকর্ষণ বা প্রলোভন যতই বড় হোক, আমার মনের ভেতরে যতই আবেগের তাড়না আসুক, এই ব্যপারে আমার জন্য কোন পথ খোলা নেই। আমাকে সব জায়গায়, সব সময় নিষিদ্ধ জিনিস থেকে দৃষ্টি সংযত করতেই হবে। আশেপাশের কলুষিত পরিবেশের অজুহাত দিয়ে বা আমি প্রলোভনের শিকার হয়েছি, এসব কথা বলে নিজের দোষের সপক্ষে যুক্তি দেখানোর কোন অবকাশ নেই। কারন মনে রাখতে হবে এই পৃথিবী একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র । এখানে কোন নারী উলংগ হয়ে চলছে বলে আমি তা দেখতে পারবেন না । আমি যদি বলি রাস্তায় চলার সময় কোথায় তাকাব চারদিকেই উলংগতায় সয়লাব। কেন কোরানে যেখানে তাকাতে বলেছে সেখানে তাকাব ।
“মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি নত রাখে (নিষিদ্ধ জিনিস দেখা হতে) এবং তাদের যৌনাঙ্গর হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা আছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন।” [সূরা নুরঃ৩০]
নিচের দিকে তাকিয়ে হাটলে শয়তান প্ররোচিত করতে পারে না । কারন শয়তান আল্লাহকে বলেছিলঃ
অতপরঃ আমি ( পথভ্রষ্ট করার উদ্দেশে ) তাদের সম্মুখ দিয়ে, পশ্চাৎ দিয়ে, ডান দিক দিয়ে এবং বাম দিয়ে তাদের কাছে আসব , আপনি তাদের অধিকাংশকেই কৃতজ্ঞ রুপে পাবেন না । - সুরা আরাফ ১৭
সে উপর-নিচের কথা বলেনি । তাই নিচের দিকে তাকিয়ে হাটলে পাপ দৃষ্টি হতে বাচা যায়।
১৬/ এমন সব স্থান এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা যেখানে নিষিদ্ধ দৃষ্টির প্রলোভনে পড়ার আশঙ্কা আছে বলে মনে হয়। যেমন, মার্কেট, বিপনী বিতান, পর্দাহীন দাওয়াতের আসর, রাস্তা ঘাটে অলস আড্ডা, ইন্টারনেটে অহেতুক ঘাঁটাঘাঁটি ইত্যাদি। রসুল করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বলেছেনঃ তোমরা রাস্তার উপর বসা ছেড়ে দাও। লোকজন বলল, এ ছাড়া আমাদের কোন উপায় নেই। কেননা, এটাই আমাদের উঠাবসার জায়গা আর এখানেই আমরা কথাবার্তা বলে থাকি। তিনি বললেন, “যদি তোমাদের সেখানে বসতেই হয়, তবা রাস্তার হক আদায় করবে।” তারা বলল, রাস্তার হক কি?
তিনি রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ ‘দৃষ্টি অবনমিত রাখা, কষ্ট দেওয়া হতে বিরত থাকা, সালামের জবাব দেওয়া, সৎকাজের আদেশ দেওয়া এবং অসৎকাজে নিষেধ করা।’ (বুখারী ২৩০৩; ইফা)
ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এই হাদিসটি প্রযোজ্য। এখানেও নিজের দৃষ্টিকে (নিষিদ্ধ সাইট, অন্যের প্রোফাইল অকারণে দেখার মাধ্যমে) যত্রতত্র নিক্ষেপ করা, কাউকে কটাক্ষ করে মন্তব্য করা, অর্থহীন আলোচনায় লিপ্ত হওয়া অনুমোদনযোগ্য নয়।
১৭/ নিজের সাথে সংগ্রাম করা । দৃষ্টি নত রাখার জন্য নিজে নিজে অভ্যাস করার চেষ্টা করা এবং এ কাজে ধৈর্যশীল হওয়া ও হাল ছেড়ে না দেওয়া।
আল্লাহ বলেছেনঃ যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথে পরিচালিত করব। নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন। (সূরা আনকাবুতঃ ৬৯)
১৮/ যত্রতত্র দৃষ্টি নিক্ষেপের কুফল, এর শাস্তি ও তার যন্ত্রণার কথা চিন্তা করা। দৃষ্টি অবনত রাখার সুফল সম্পর্কে চিন্তা করা।
১৯/ যেসব পোষাকে, চালচলনে, কথাবার্তায় সৌন্দর্য প্রদর্শিত হয় ও অন্যকে আকৃষ্ট করে এমন সব কিছু নিজে পরিহার করা ও নিজের পরিবার ও আত্মীয়দেরকে পরিহার করার জন্য উপদেশ দেওয়া ।
২০/ বিয়ে হল একটি কার্যকরী প্রতিকার। নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ হে যুব সম্প্রদায়! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ে করার সামর্থ্য রাখে তারা যেন বিয়ে করে। কেননা, বিবাহ তার দৃষ্টিকে সংযত রাখে এবং যৌনতাকে সংযমী করে; এবং যাদের বিয়ে করার সামর্থ্য নেই, সে যেন রোজা পালন করে। কেননা, রোজা তার যৌনতাকে দমন করবে।” (সহীহ বুখারী ৪৬৯৬, ইফা)
তাই আসুন আমরা সবাই দৃষ্টির পাপসহ অন্যান্য পাপ থেকে নিজেকে হেফাজত করি ও হেফাজত থাকার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রাথনা করি।
তথ্য উপাত্তঃ কোরান, হাদিস, ইসলামিক বই ও নেট হতে সংগ্রহ।
বিষয়: বিবিধ
৩৬৭৫ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন