শিক্ষনীয় ঘটনা । ( দুই )
লিখেছেন লিখেছেন সিকদারর ১৮ অক্টোবর, ২০১৩, ০৯:৫৭:৩৪ রাত
শিক্ষনীয় ঘটনা । ( এক )
শান্ত সুনিবির এক গ্রাম । সেই গ্রামে ছিল এক বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা । তাদের একমাত্র ছেলে, সে থাকে শহরে। সেখানে এক বড় কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা । কোম্পানিতে তার যথেষ্ট সুনাম আছে । কোম্পানীর মালিক তার কর্ম দক্ষতা ও আদব-কায়দায় তার উপর খুবই সন্তষ্ট । সে মালিককে এতটাই সম্মান করে যে, মালিক মাঝে মাঝে ভাবে, ছেলেটি হয়ত কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান । তার পিতা-মাতা নিশ্চয় খুবই ভদ্র এবং শিক্ষিত তাই এমন সন্তান হয়েছে।
সেই সন্তান মালিকের প্রতি যতটা শ্রদ্ধাশীল নিজের পিতা-মাতার প্রতি ততটাই উদাসীন । মাস শেষে বাড়িতে বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য মাসিক খরচ পাঠিয়ে তার দ্বায়িত্ব শেষ করে দেয় । এরপর আর কোন দ্বায়িত্ব পালন করার প্রয়োজন অনুভব করে না । এদিকে তার পিতা-মাতার সে একমাত্র সন্তান হওয়ায়, তার প্রতি তারা অত্যধিক স্নেহশীল । তাই তাকে দেখার জন্য সব সময় উদগ্রীব হয়ে থাকে । কিন্তু ছেলেটি তার পিতা-মাতাকে দেখার জন্য গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার এতটুকু সময় হয় না ।
এমতবস্থায় একদিন তার বাবা তার কাছে চিঠি লিখলেন।
স্নেহের পুত্র
জানিনা কেমন আছ ? তুমিত বড়ই ব্যাস্ত । এই বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে প্রতি মাসে একবার এসে দেখারও সময় তোমার হয়না । তুমি আমাদের এক মাত্র সন্তান। তোমাকে দেখলে আমাদের হৃদয়টা প্রশান্তি লাভ করে । আমাদের আর কোন সন্তান নাই । তোমার সন্তানদেরও কাছে পাই না । তাদের কচি কোমল কন্ঠে দাদা-দাদি ডাক শোনার জন্য, আমাদের বুভুক্ষ এই খালি বুকটা সারাদিন হাহাকার করে । নিজেদের সকল পুঁজি আর ভালবাসা স্নেহের পরশ দিয়ে তোমায় চিরকাল আগলে রেখে বড় করেছি । আজ আমাদের এই অসহায় আর একাকিত্বের সময় তুমি তোমার ব্যাস্ততার অজুহাত দেখিয়ে আমাদেরকে মাসেত দুরে থাক বছরে একবারও দেখতে আস না। মাস শেষে শুধু টাকা কটা পাঠিয়ে মনে কর নিজের দায়িত্ব শেষ করেছ ।
বাবা তুমি যদি আসতে না পার, তাহলে আর টাকা পাঠিও না । আমরা তোমার টাকার জন্য আল্লাহ কাছে খুজে তোমাকে দুনিয়াতে আনিনি । তোমাকে দুনিয়াতে এনেছি তোমার সান্নিধ্য ও ভালবাসা , তোমার সন্তানদের পরশ ও তাদের মুখে দাদা-দাদি ডাক শুনব বলে। তোমাকে আদর স্নেহ করে বড় করেছি বৃদ্ধ বয়সে তোমার সেবা পাব বলে । পৃথিবীর বুকে কারও কাছে যেন ছোট না হও, তাই নিজেদের শ্রম আর আর পরিশ্রম দিয়ে তোমাকে শিক্ষিত করেছি । আজ সব কিছু পেয়ে নিজে স্বয়ংসম্পূর্ন হয়ে আমাদের প্রতি তোমার দ্বায়িত্ব ভুলে গেছ। এই জন্যই কি তোমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি ?
ইতি
তোমার হতভাগ্য পিতা।
পিতার চিঠি পড়ে ছেলেটি খুবই বিরক্ত হয়ে গেল। ভাবতে লাগল হায় আমার পিত-মাতা বুঝে না এখানে আমাকে টিকে থাকতে কতই না পরিশ্রম করতে হয়। সকালে ঘুম থেকে কি যে দৌড় শুরু হয়, তা গ্রামে থাকা পিতা-মাতা কি করে বুঝবে।
ছেলে তারপরও সিদ্ধান্ত নিল আগামি কালই সে গ্রামে যাবে । তারপর বুড়া আর বুড়িকে বুঝিয়ে দিবে কেন সে আসতে পারেনা ।
পরের দিন ছেলেটি তার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছল । বিশাল বাড়ি সুনসান নীরবতা । মনে হয় এই বাড়িতে কেউ থাকে না । সে ভিতরে প্রবেশ করল । কাউকে দেখতে পেল না । তখন সে পাকের ঘরের দিকে গেল । দেখল তার স্নেহময়ী মা মাথা নিচু করে তরকারি কুটছে। ছেলের পায়ের আওয়াজ শুনে, তিনি মাথা তুলে তাকালেন ।
ছেলেটি দেখতে পেল, বহুদিন পর আসা একমাত্র ছেলেকে দেখতে পেয়ে তার মায়ের ধুসর বিষণ্ন চোখ দুটি এক অপার্থিব উজ্জলতায় ভরে গেল । দুর্বল শরীরে তাড়াতাড়ি উঠতে যেয়ে মায়ের শরীরটা যেন একটু দুলে উঠল । ছেলে তাড়াতাড়ি এগিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের পতন ঠেকাল। মা ও তার প্রিয় সন্তানের বুকে আশ্রয় পেয়ে পরম নির্ভরতায় আকড়ে থাকল । ছেলের মনে হল মায়ের শরীর যেন একটু কাঁপছে। বুঝতে পারল তাকে কাছে পাওয়ার উত্তেজনায় কাঁপছে। অনেক দিন তাকে পেয়ে মা এমন ভাবে ধরে রেখেছে যেন আর কোথাও যেতে না পারে।
ছেলে অস্ফুষ্ট কন্ঠে মাকে বললঃ মা বাবা কোথায় ?
বহুদিন পর ছেলের মুখে মা ডাক শুনে মায়ের দুই চোখ ভিজে উঠল। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মা বললঃ বাড়ির পিছনের উঠানে বসে আছে ।
ছেলে আস্তে করে মাকে ছেড়ে পিছনের উঠানে গেল । ছেলের পিছে পিছে মা ও এগিয়ে গিয়ে দরজার চৌকাঠে দাড়িয়ে থাকল।
ছেলে উঠানে এসে দেখতে পেল বাবা একটা লম্বা টুলের উপর বসে রোদ পোহাছ্ছে। ছেলে সালাম দিয়ে আস্তে করে বাবার পাশে বসল । বাবা সালামের উত্তর দিল, তবে পাশে বসা ছেলের দিকে ফিরে তাকালেন না । ছেলে জিগ্গাসা করলঃ কেমন আছেন?
ঃ ভাল ।
তারপর আর কোন কথা না বলে চুপচাপ কিছুক্ষন বসে থাকল । কিছুক্ষন পর বাবা ছেলেকে একটা কাক দেখিয়ে জিগ্গাসা করলঃ বাবা ওটা কি ?
ঃ কাক।
তারপর কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে আবার বললঃ ওটা কি ?
ছেলে আবার বললঃ কাক ।
কিছুক্ষণ পরে বাবা আবার বললঃ ওটা কি ?
ছেলে এবার কিছুটা রেগে গেল, তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে বললঃ কাক ।
আবার কিছুক্ষন চুপ থেকে বাবা বললঃ ওটা কি ?
এবার ছেলে নিজের রাগ আর সামলে রাখতে পারল না বললঃ আপনাকে বার বার বলছি ওটা কাক ওটা কাক তারপরও আপনি বারবার জিগ্গাসা করছেন ব্যাপারটা কি ?
বাবা এবার ঘুরে ছেলের রাগান্বিত চেহারার দিকে তাকালেন তারপর স্ত্রীকে বললেনঃ আমার টেবিলের উপর থেকে ডায়রীটা নিয়ে আসত।
মা টেবিলের উপর থেকে ডায়রীটা এনে স্বামির হাতে দিলেন । বাবা ডায়রিটা হাতে নিয়ে বেশ ভিতরের পাতা উল্টিয়ে ছেলেটির হাতে দিলেন ।
ঃ পড়ে দেখ ।
ছেলেটি অবাক হয়ে ডায়রীটি হাতে নিয়ে পড়তে লাগল।
আজ আমাদের একমাত্র ছেলের তিন বছর বয়স পার হয়েছে। সে একটু একটু আধো আধো বোলে কথা বলতে পারে । আমি স্কুল থেকে এসে ওকে কোলে নিয়ে বাড়ির পিছনে উঠানে বসেছি। এমন সময় ও একটি কাক দেখতে পেল। সে কাকটাকে দেখিয়ে বললঃ ওতা কি ?
আমি বললামঃ কাক।
আবার বললঃ ওতা কি ?
আমি বললামঃ কাক।
আবার বললঃ ওতা কি ?
আমি বললামঃ কাক।
এভাবে পনের হতে বিশ বার সে আমাকে একই প্রশ্ন করেছে । আমি প্রতি বারই একই উত্তর দিয়েছি।
ছেলেটি ডায়রীটি হাতে নিয়ে পাথরের মত স্তব্দ হয়ে গেল। তার দুই চোখ দিয়ে অনুতাপের নোনা জল ঝরঝর করে পড়তে লাগল। মাথা নিচু করে সেই চোখের জল লুকাতে গিয়ে বাবার বুকে আশ্রয় নিল ।
ওদিকে দরজার চৌকাঠে দাড়ানো তার স্নেহময়ী মা আচলের বাধ দিয়েও চোখের জল আটকাতে পারছে না।
পাঠক- পাঠিকারা আসুন আমাদের যাদের মা বাবা আছে তারা উনাদের সঠিক মূল্যায়ন করি । উনাদের শ্রদ্ধা করি ও সেবা করি । আর যাদের নাই তারা আল্লাহর কাছে উনাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করি। রাব্বীর হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানী ছগ্বীরা ।
বিষয়: বিবিধ
২১১০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন