শৈশবের সেই গান ........।

লিখেছেন লিখেছেন সিকদারর ২২ জুলাই, ২০১৩, ০৮:১২:৩৬ রাত

শৈশবে যখন গ্রামে ছিলাম তখন আমার চারপাশে জ্যাঠাত ভাই-বোনেরা ছিল । আমার ছোট ফুপু ও তার বান্ধবীরা তখন সতের আঠার বছর বয়স হবে । ওদের মুখেই শুনতাম গান। আমার ছোট ফুপু প্রায় একটা গান গাইতঃ গুন গুনাগুন গান গাহিয়া নীল ভ্রমরা যায়,

গানের তালে মন আমার উছলায় উছলায়।

আরেকটা গান এখনও মনে পড়ে ..... আগুন জ্বলেরে আগুন নিভানোর মানুষ নাই .....।

এগুলোই ছিল তখন বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় গান।

আমার বড় জ্যাঠাত ভাইয়ের মুখে তখন একটা গান শুনতাম ..

মাগো মা ওগো মা আমরে বানাইলি তুই দিওয়ানা ,

আমি যেতে পারি দুনিয়া ছাড়ি ,

তোকে আমি ছাড়বনা মাগো ,

তোকে আমি ছাড়বনা

মাগো মা ওগো মা আমরে বানাইলি তুই দিওয়ানা ।

গ্রামে গ্রীষ্মের কাঠ ফাটা রোদে যখন পুকুর খাল বিল শুকিয়ে যেত তখন চারদিকে পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়ে যেত। বড়রা মাঠে কড়া রোদের মধ্য খোলা মাঠে উপর বৃষ্টির জন্য নামায পড়ত । তখন নামায শেষে গায়ের পড়নের জামা উল্টিয়ে পড়ত তারপর দুই হাত যতটুকু উপরে উঠানো সম্ভব ততটুকু উপরে উঠিয়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করত । এতে দেখেছি প্রায় সময় আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামত।

এদিকে গ্রামের তরুন তরুনীরা গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে যেয়ে চাল, মিঠাই, মসলা চেয়ে নিত। তরুনরা সেগুলি রান্না করে সিন্নি পাকাত । তরুনীরা নতুন শাড়ি পেচিয়ে পড়ত । আচলটা কোমড়ে গুজে কোমরে পানি ভরা কলসি নিয়ে নাচত আর গান গাইত

আল্লাহ মেঘ দে পানি দে

ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে,

আসমান হইল টুটা টুটা জমিন হইল ফাটা

মেঘ রাজা ঘুমাইয়া রইছে মেঘ দিব তোর কেডা

আল্লাহ মেঘ দে আল্লাহ মেঘ দে

আল্লাহ মেঘ দে পানি দে পানি

ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে।।

ফাইটা ফাইটা রইছৈ যত খালা বিলা নদী

পানির লাইগা কাইন্দা ফিরে পঙ্খী জলদি

আল্লাহ মেঘ দে পানি দে পানি

ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে।।

কপোত কপোতি কাদে কূপেতে বসিয়া

শুকনা ফুরের কলি পড়ে ঝড়িয়া ঝড়িয়া

আল্লাহ মেঘ দে পানি দে পানি

ছায়া দেরে তুই আল্লাহ মেঘ দে।।

নাচের তালে তালে কলসি থেকে পানি পড়ত আর সেই পানি যেখানে মাটিতে পড়ত, সেখানে কয়েকজন তরুনী দুই হাতে মাটি লেপত আর গান গাইত। তারপর নাচ গান শেষ হলে চলত সিন্নি খাওয়ার ধাক্কাধাক্কি । আমরা যার যার কলা পাতা ছিড়ে নিয়ে আসতাম। সেই কলা পাতা সামনে রেখে মাটিতে বসতাম । তরুনরা পাকানো সিন্নি সেই কলা পাতায় ঢেলে দিত আমরা মজা করে খেতাম।

আমার ছোট এক জ্যাঠাত ভাই ছিল ছোটকালে তার স্বভাব ছিল পস্রাব খাওয়া । জানি না এই পস্রাব খাওয়ার কারনে নাকি এমনিই ও কথা বলত "ড" উচ্চারনে । তার ড উচ্চরনে কথা গুলি শুনতে আমরা খুব আনন্দ পেতাম । তাই আমি প্রায় ওকে বলতাম উজ্জল একটা গান গাত। ও তখন গাইত ...

কামেলেডা কাম কডিয়া কোডায় জানি লুকাইডে ,

ডো পাহাডের মাডে মাওলা মডডিড বানাইডে।

ওর এই গান শুনে আমরা হাসতে হাসতে পড়ে যেতাম ।

আমরা যখন চট্টগ্রাম শহরের মোগলটুলিতে থাকতাম তখন সেখানে একজন বৃদ্ধ ফকির আসতেন । ছোটখাট গড়নের হ্যাংলা পাতলা মানুষ ছিলেন । তার হাতে একটা লাঠি থাকত । তিনি যখনই আমাদের বাসায় সামনে আসতেন তখনই আমরা দুই ভাই তার সামনে এক মুঠো চাল নিয়ে হাজির হয়ে বলতাম ঐ গানটা গান না।

তিনি হাতের লাঠিটা মাটিতে ঠুকতে ঠুকতে গাইতেন ..।

চেপে চেপে দেব মাটি ,

চেপে চেপে দেব মাটি নিদয়ও হইয়া ।

মরন কালে ভুলিয়া যাবি এই দুনিয়ার মায়া।

চেপে চেপে দেব মাটি ,

চেপে চেপে দেব মাটি নিদয়ও হইয়া ।


সেই অনেক দিন আগের কথা । আজ কালের প্রহরে পেরিয়ে গেছে আঠাশ-ত্রিশ বৎসর । আজ কবরের কথা মনে করিয়ে দেওয়া সেই ফকির এতদিনে আর দুনিয়াতে নাই । কবেই কোন অজানা সময়ে তাকে দাফন করা হয়ে গেছে । দাফনকারীরা তার কবরে দিয়েছে মাটি চেপে চেপে নিদয়ও হয়ে । আমাদেরও একদিন চলে যেতে হবে । কত জনাইত ছিল , মা ছিল বাবা ছিল দাদা-দাদী ছিল । কোথায় আজ তারা ? কবরের বাসিন্দা হয়ে কেয়ামতের প্রহর গুনছে। আল্লাহ সেই ফকিরকে বেহেশত নসীব করুক।

বিষয়: বিবিধ

১৭৭০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File