দেশবাসী কাদছ কেন ? আমরাত মরিনি,আমরা বেচে গেছি । ( সাভারে নিহত গার্মেন্টস কর্মীদের স্মরনে । )

লিখেছেন লিখেছেন সিকদারর ২৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০৭:৩২:১৬ সন্ধ্যা

স্পেকট্রাম , তাজরীন ,এরপর রানা প্লাজা যার প্রতিটি ধুলিকনা আর বাতাসে মিশে আছে আমাদের মত বন্চিত আর অসহায় গার্মেন্টসের কর্মীদের আর্তনাদ । বিদায়ের অশ্রু জল শুকিয়ে মিশে গেছে পোড়া বাতাস আর কনক্রিটের ভাজে ভাজে । আমরা গার্মেন্টসের কর্মী । আমাদের রক্ত শোধিত ঘামের শ্রম দিয়ে মালিকেরা নতুন নতুন মডেলের নিশান পেট্রোল , পাজেরো গাড়িতে চড়ে। উনাদের নতুন ফ্লাট বাড়ি , নতুন গাড়ি , প্রতিরাতের নতুন পার্টি , আর স্টাটাস বাড়ানোর জন্য আমাদের প্রতিদিন সেই ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয় , তখন সারা দেশ থাকে ঘুমে বিভোর । শীতের কুয়াশা ভেজা কনকনে ঠান্ডায় বা গরমের চটচটে ঘামে দৌড়াতে হয় দুই মুঠো ভাতের জন্য । ঘুম থেকে উঠে আধোয়া কাপড়গুলো ধুয়ে, স্বামী সন্তানদের জন্য নাস্তা আর দুপুরের খাবার রান্না করি। নিজের জন্য ছোট ছোট দুই বাটিতে অল্প কিছু ভাত আর তরকারি নিই । তারপর তাড়াতাড়ি কাপড় পড়ে প্রায় দৌড়ে বের হওয়ার সময় চমকে উঠতে হয় ঘরের দুয়ারের একটু সামনেই দাড়ানো বাড়িওয়ালা । কোন প্রকারে বলি বেতনটা হলেই দিয়ে দেব । গলি ছেড়ে পেরিয়ে বড় রাস্তার মুখে বের হওয়ার সময় বাকি দোকানদারের ডাকের ভয়ে কান খাড়া করে ভীত সন্তস্ত্র হয়ে দোকান পার হওয়ার সময় দোকানদারের ডাকঃ কিরে বাকিত অনেক হল টাকা কবে দিবি ? কোন প্রকারে হাতের ইশারায় মুখের অসহায় অংগি ভংগি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি ওভার টাইমের টাকাটা পেলেই দিয়ে দেব।

দ্রুত পদক্ষেপে সহকর্মীদের সাথে চৌরাস্তার মোড়ে এসে দাড়াই । কখন আসবে লক্কর ঝক্কর মার্কা গাড়ি । গাড়ি মিস করলে আবার নিজের টাকা খরচ করে কর্মস্থলে যেতে হয়। গাড়িতে উঠার পর বাস হেলপার আর ড্রাইভারের চটুল রসিকতা হজম করত করতে অফিসে পৌছতেই তাড়াতাড়ি কাজে লেগে যেতে হয়। কর্মক্ষেত্রেও হয়রানি কখনও সহকর্মী কতৃক কখনও কর্মকর্তা কতৃক । সব মান-অপমান হজম করেই কাজ করতে হয় সারা মাস সারা বছর । তার উপর পান থেকে চুন খসলেই চাকরি হারানোর ভয় বেতন কর্তনের ভয় । সারাদিন উদায়স্ত খেটে কয় টাকাই বা বেতন দেয় গার্মেন্টস মালিকরা । তারপরও আসতে একটু দেরী হলেই কেটে রাখে একদিনের বেতন বা তিন দিনের বেতন। আমরাতো মানুষ আমাদের সুবিধা অসুবিধা অসুখ বিসুখত থাকতে পারে । না সে সব শোনার বা দেখার মত সময় মালিকদের নাই । চাকরিতে মাসে একদিনও গরহাজির না থাকলে মাসিক বেতনে একটা বোনাস দেয় । তিরিশ দিনের মধ্যে কোন কারনে একদিন আসতে না পারলে সেই বোনাস আর দেওয়া হয় না। সকাল ৮টা হত ৫টা পর্যন্ত ডিউটি । গার্মেন্টসের আইন অনুযায়ি ওভার টাইম সাতটার বেশি করানো যাবে না । সেখানে আমরা ছোট ছোট বাচ্চার মা আমদেরও বাসায় স্বামী আছে , নিজেদের অপুষ্টিতে ভরা দেহটার বিশ্রামের প্রয়োজন আছে । কিন্তু মালিকদের সে সব শোনার বা দেখার সময় কই আমাদের ওভার টাইম করতে হয় রাতের বারটা পর্যন্ত ।

তারপরও বেতন পাইনা সময় মত । বেতনের সময় হলেই তাদের ব্যাংকে টাকা থাকে না । শীপমেন্টের আগে বেতন হবে না আরও কত কি । এক মালিকতো ঈদের সময় আমাদের বেতন না দিয়ে তার স্ত্রীর জন্য দুটি বিদেশি কুকুর প্লেনে করে এনেছিল । এতে তার তার খরচ পড়েছিল কয়েক লক্ষ টাকা ,। তার এই কুকুর আনা দেখে তার এক বন্ধু তাকে বলেছিল তুমি তোমার কর্মীদের বেতন দিছ্ছ না ওরা ঈদ করবে কিভাবে ? মালিক বলেছিল আমি কি করব মাল শীপমেন্ট করতে পারি নাই টাকা দেব কোথ্থেকে ? বন্ধু ঃ কেন কুকুর না কিনে ঐ টাকাটা দিয়ে বেতন টা দেওয়া যেতনা । মালিক বন্ধুর সাথে রেগে গিয়ে বললঃ আমি কি ওদের বেতনের টাকা দিয়ে কুকুর এনেছি নাকি ? এটাতো আমার ব্যাংকে জমানো টাকা দিয়ে এনেছি ।

এই আমাদের গার্মেন্টস কর্মীদের জীবন ।

যে বেতন পাই বাজার করতে গেলে পচা মাছ, বাসী তরকারী ছাড়া আর কিছু কিনতে পারি না। প্রতিদিন বাজারে জিনিসের দাম হু হু করে বাড়ছে । বাড়ছে না আমাদের বেতন । বাড়িওয়ালা প্রতি বছর ঘর ভাড়া বাড়াছ্ছে । বাড়ছে বাচ্চার স্কুলের বেতন । বাড়ছে বই খাতার দাম। অসুখ হলে পয়সার অভাবে ঔষধ কিনতে পারি না । রোগ চেপে পড়ে থাকি বিছানায় যখন আর সহ্য হয় না তখন যাই ঔষধের দোকানে । হাতুরে ডাক্তার থেকে ঔষধ কিনি । বাচব কিনা মরব সেটা ভাবিনা কোন প্রকারে সুস্থ হতে পারলেই হল। এম বিবিএস ডাক্তারের ফিস এখন ২০০হতে ৩০০টাকা । ফিসেই যদি এত টাকা দেই ঔষধ কিনব কি দিয়ে ? বাচ্চার অসুখ হলে প্রথমে যাই হুজুরের কাছে । তারপর ভাল না হলে যাই দাতব্য চিকিৎসালয়ে। এইত আমাদের জীবন । কোন প্রকারে শ্বাস টুকু জিইয়ে রাখা ।

জীবনে আমাদের কিই বা ছিল। একটু হাসি আনন্দ করতে গেলেই মাসের শেষে বেতনের টাকায় টান পড়ে । সরকার আর বিরোধী দল আছে গদি নিয়ে টানা হেচড়ায়। আমাদের কথা ভাবার সময় কোথায় । তাদের যখন তখন ডাকা হরতালে আমাদের কর্ম ক্ষেত্রে যেতে হয় মাইলের পর মাইল পায়ে হেটে ।

আমরা মরলে কয়েক দিন হা হুতাশ তারপর সব শেষ । দোষিদেরও কোন বিচার হয় না । বরং আমরা মারা গেলে প্রশাসনের লাভ, উপরি কিছু ইনকাম হয় । যা দিয়ে প্রশাসনের কর্তারা তাদের বউয়ের জন্য উপহার বাচ্চার জন্য উপহার কিনে । আমরা ওত কারো স্ত্রী , আমাদেরওত বাচ্চা আছে । ওদের বাচ্চারা পায় উপহার আমাদের বাচ্চারা হয় এতিম ।

আমরা তখন কবরে আর শশ্মানে শুয়ে দখিনা আর উত্তরে হাওয়ার সাথে ফেলি ফেলে আসা দূর্বিসহ জীবনের দীর্ঘশ্বাস।

দেশবাসী তোমরাই বল আমরা মরে গেছি না, ঐ দূর্বিসহ জীবন থেকে বেচে গেছি।

বিষয়: বিবিধ

১৪২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File